আমেরিকার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন সেবার আন্টাল্যান্টিক সিটিতে। প্রকাশক লেখক ছাড়াও মিডিয়া আর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডার লোভে সেখানে যাওয়া। সুনীলদা এসেছেন আগেই শুনেছি। শুনেছি শীর্ষেন্দুদাও আছেন, সমরেশ মজুমদার, পুরানো বন্ধু পঙ্কজ সাহা এবং নবকুমার বসু (ওর দাদা আমার বন্ধু)। প্রকাশকদের (প্রবীর মজুমদার, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, অপু দে প্রমুখ) সঙ্গে আড্ডা সেরে বেরুতেই, এক সার দোকানের গলির সামনে এক মহিলা পথ আগলে ধরলেন, এখনো সুন্দরী, বেঁটে খাটো, স্নেহশীলা চোখে প্রশ্রয়। ‘তুমি অরুণ না? চিনতে পারছ?’ পাশে দীপ্তি, আমার স্ত্রী। তার সতর্ক চিমটি খাবার আগেই, আমার চোখে থতমত ভাব দেখে বললেন, ‘আমি সুনীলের স্ত্রী।’ তখন মাটিতে মিশে যাই আর কী! দুহাতে জড়িয়ে ধরি স্বাতী বৌদিকে, ক্ষমা চাইতেই হল। বেশ কয়েকবার।
এই অনুষঙ্গটা উল্লেখ করার কারণ, সুনীলদার সঙ্গে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে পরিচয় সত্ত্বেও, সুনীলদার বাড়িতে বারকয়েক গেলেও, আমি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘণিষ্ঠ বৃত্তের মানুষ নই, সেটা বোঝাতে। নইলে, স্বাতী বৌদির মুখটা কেউ ভুলতে পারে, বিশেষ করে যার ঔদার্য-প্রশ্রয় আমার মতো এক কণিষ্ঠকে নানা উৎকট মুহূর্তে তরী পার করেছে?
সুনীলদার সঙ্গে দেখা বা পরিচয় ঠিক কবে মনে নেই। আনন্দবাজারে আমার চাকরি, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় থেকে, তখন আমার বয়স ২৬। শক্তিদা (চট্টোপাধ্যায়) আনন্দমেলা পাতার দায়িত্বে ছিলেন, তাই একটা যোগাযোগ ছিল। সুনীলদার সঙ্গে তেমনটা ছিল না।
সুনীলদার সঙ্গে আত্মিক পরিচয় অবশ্য অনেক আগে থেকে। আমি তখন কলেজের ছাত্র। ‘নীললোহিত’-এর পাঠক। বিস্ময়, আমার এক নিবিঢ় অস্তিত্ব থেকে নীললোহিত আমাকে আজও ছেড়ে যায়নি। আমার ভাবনা চিন্তা চলন বলনে নীললোহিত তার পূর্ণ অবয়বে আজও বিরাজ করছে।
কী ছিল নীললোহিত তথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই সব লেখায়? সেসব তো বাস্তবের ধরতাইয়ে এক একটি গল্প মাত্র। তবু তার রেশ এই প্রায়-বৃদ্ধ বয়সেও আমার মধ্যে সমান কাজ করে চলেছে। কী করে? বলতে পারব না, যদিও হাতের কাছে নেই নীললোহিত সমগ্র, আমিও দাঁড়িয়ে আছি নীললোহিতের সোনালী দিনগুলি থেকে ৫০ বছর দূরে।
আমি ১৭ বছর বয়সে বাড়ি পালানো ছেলে। এই বয়সের বাড়ি পালানোয় অবশ্যই নিছক রোম্যান্টিকতা ছাড়া আর কিছু ছিল না। উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল শহরের কলকাতা না-দেখা কিশোরের কাছে সেই ১৯৬২ খুব সুখকর ছিল না। মাত্র ১৫ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়া কলকাতায় তখন জীবন সংগ্রাম নিরন্তর। একদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তুহারা বাঙালিরা বাংশাল কোর্টে, শিয়ালদা কোর্টে কলম পিষছেন, বড়বাজারে মালিকের রক্তচক্ষুর সামনে নতজানু, সিনেমা হলের গেটকীপার, নয়ত দেশবন্ধু পার্ক, দেশপ্রিয় পার্কের ২৪ ঘন্টার বেড়ানি কিংবা চুরি করে ভিক্ষে করে সেই সময়ের হিন্দুস্তানের নিরাপদতম ফুটপাথে শায়িত। অন্যদিকে স্বাধীন কলকাতার বৃহত্তর বৃত্তের হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর থেকে নতুন স্বাচ্ছন্দ জীবনের ভিত স্থাপনে মরিয়া ঈষৎ অর্থবান সমাজের ভিন্ন মাত্রার সংগ্রাম। কৈশোর সংগ্রাম চেনে না, স্বপ্ন চেনে। তাই কলকাতার পথে পথে আমার চোখ দুটো সংগ্রাম দেখতে পেত না, খুঁজে পেত স্বপ্ন, কোন একদিন জিতে যাবার স্বপ্ন।
নীললোহিতের আবির্ভাব এই সময়ে, কয়েক বছর পরে। , জীবন সংগ্রামের স্রোতের ওই বয়সে সাহিত্যের হদিশথাকার কথা নয়, ছিলও না। কে যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন ‘টাইমস’ পত্রিকার। নতুন ইস্যু কেনার পয়সা ছিল না। পুরানোই পড়তাম, নইলে এসপ্ল্যানেডের ইউসিস (USIS) লাইব্রেরিতে। আর এভাবেই বাড়ি পালানো কৈশোরের পৃথিবী ভ্রমণ সম্পূর্ণ হত। বিশ্ব জুড়ে মানুষের বাস্তব গল্প পড়া হয়ে যেত, যৌবনের উদ্ভট জীবনযাত্রার হদিশ পাওয়া যেত।আএই সময়টায় মনের গভীরে চারপাশের এমন পৃথিবীই চোখের সামনে ফুটে উঠত। নীললোহিতের আবির্ভাব এমনই নিস্তরঙ্গ ভিতর আর টালমাটাল বাহিরের পরিমন্ডলে। আ পারফেক্ট টাইমিং।
সে-সময় বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের বড় মাঠ তোলপাড় করে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক একজন দিকপাল। তাঁদের সৃষ্টিতে ছেয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার রক্তাক্ত গর্ভযন্ত্রণা ও ছিন্নমূলের জীবন সংগ্রাম, সেইসব ক্লাসিকগুলোকে সম্যক উপলব্ধি করার জন্য আমরা কিশোর তরুণ যুবাদল সেই সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সুনীল হইচই ফেলে দিলেন পাড়ার ছোট্ট মাঠটিতে। কবিদলের এক গল্পকার! আমেরিকার বোহেমিয়নতা আর বাংলার রক্ষণশীলতার এক নতুন রসায়নের টানে দর্শকরা বড় মাঠ ফেলে ছুটে গেলেন ছোট এই মাঠটির দিকে। কোন যাদুবলে এই কান্ড সম্ভব হল, সেটা আপাত বিস্ময়ের মনে হলেও, আমার কাছে কোন অঘটন ছিল না।
নীললোহিত তথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁর জীবন ও লেখালেখিকে নানা অর্থে ব্যখ্যা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের পাঁচমাথার মোড়ের এই লেখক এখন, ৫০ বছরের ব্যবধানে, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর লেখার চুলচেড়া বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শুধু আজ নয়, আগামী বহু বছর ধরে সুনীল চর্চিত হবেন, আমার ক্ষুদ্র অনুভবে এমনটা মনেও হয়।
আনন্দবাজারে নীললোহিতের সাড়া জাগানো কলামের পর আমার পড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বই, ‘যুবক যুবতীরা’। বইটি কেন কিনেছিলাম,সম্ভবত তার ইঙ্গিত আছে ওই শিরোনামেই। তবে কলেজ জীবনের শুরুতে পড়া এই বইয়ে আমার একটা খোঁজও ছিল বলে মনে হয়। সেই খোঁজ ছিল নিজেকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোয় গড়ে তোলার কোন উপায়ের খোঁজ। এই উপন্যাসে তা মোটেই পাওয়া গেল না। উল্টে যা পেলাম, তা সংগ্রামবিমুখ এক ফুরফুরে জীবন-যাপনের দিশা। যেখানে উদাসীন মনে স্ফূর্তিই জীবন-যাপনের সোনার কাঠি। বাঙালির হিপি সংস্কৃতি বলে যদি থাকে, তাই ফুটে উঠতে থাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই সময়ের লেখাগুলোতে, যার পূর্ণ প্রকাশ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’-র পাতায়। বাড়ি পালানো বল্গাহীন একটি যুবকের প্রথম জীবনে এর চেয়ে পরম আকর্ষণীয় আর কী থাকতে পারে?
আমি তাই বারবার ফিরে যেতে থাকি একটি ললোহিতের যাদুর দুনিয়ায়। সেটা আনন্দবাজারের পাতার মধ্যে এমন না। নীললোহিতকে পড়তে পড়তে মনের অতল অবচেতনায় যে গভীর জীবনবোধের নির্যাস চুইয়ে চুইয়ে জমা হতে থাকে, তা পান করতে করতে।
আমি যৎকিঞ্চিৎ যতটুকু সততা নিজের মধ্যে প্রোথিত করতে পেরেছি, তা আমার প্রাক-যৌবনের আত্মসচেতন সেন্সিসিটিভ মানুষ নীললোহিতের কাছ থেকে। আমার দিগভ্রষ্ট সময়ে জীবন-চেতনা এই নিরাবয়ব যুবকের জীবন-চেতনার অনুসরণেই নিজেকে সাজিয়েছে। আজ ‘আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও’ উচ্চারিত হলেই যদিও সম্মানের ঢলে ঢেকে যাচ্ছে যুবাদলের মুখ, মনে রাখতে হবে, ৫০ বছর আগে নিজেই নিজের মতো করে আপন শরীরে নীল রক্ত ছড়িয়ে নীললোহিত রাজা হয়ে বসেছিলেন নতুন এক সমাজের কিশোর তরুণদের সাম্রাজ্যে।
পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার কাছে সুনীলদা হয়ে উঠেছেন বটে। কোন সূত্রে, ঠিক কীভাবে, মনে পড়ছে না। তবে নানা করণে দিল্লি আসার পর সুনীলদার সঙ্গে যোগাযোগটা বেড়েছিল। তিনটি কারণে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের কর্মসূত্রে, আমাদের দিল্লির পত্রিকা, প্রাংশুর সূত্রে এবং সবচেয়ে বেশি, মিহিরদার কারণে। দিল্লির প্রাচীনতম দিল্লি কলেজের বাংলার অধ্যাপক মিহিরদার সঙ্গে সুনীলদার সঃম্পর্ক ছিল ভক্ত আর ভগবানের। ষাটের দশকের ফুটপাথ বদলের সময় থেকেই। মিহিরদা তখন কলেজ স্ট্রিটের যুবক।
তাই মনে পড়ে সুনীলদার সঙ্গে ৪০-৪৫ বছরে অনেক অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ আড্ডার কথা (একান্তে নয় একবারও)। মিহিরদার বাড়িতে, দিল্লির আইআইসি-তে। সবসময়েই সবখানেই, সব পরিবেশে লক্ষ করেছি, সুনীলদা নীললোহিতের মতই স্পষ্টবাদী, সৎ, এবং আপনতায় ভরপুর। কলকাতার এক নম্বর সেক্সপীয়ার সরনীর বহুতলে, ম্যান্ডাভিল গার্ডেন্সের নয় তলায়, বই মেলায়, দিল্লির সাহিত্য একাডেমীতে, প্রাংশুর দফতরে, বিদেশের বুল্গারিয়ায় বা আমেরিকায়... সবখানেই সুনীলদা থেকেছেন নীললোহিত হয়ে। নিজের বিশ্বাসে অটুট, নিজের ভাবনা চিন্তায় ফুরফুরে। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে খুশি করতে বা প্রভাবিত করতে তার একটি কথাও না, একটি শব্দও নয় ।
এজন্যই সুনীলদাকে কোনদিন আত্মার আত্মীয় ভাবতে পারিনি আমি। আমার বাইরে, তিনি যেন আমারই আর একটি অস্তিত্ব, কিন্তু আমি না। এজন্যই আমার কোন কাজেই সুনীলদাকে আমি জড়াই নি, জড়াইও নি। একবার নিয়মভঙ্গ করতে সুনীলদাকে এনবিটির বাংলা ভাষার উপদেষ্টা করেছিলাম। তিনি আমাকে উপদেষ্টার উপদেষ্টা করে ছেড়েছিলেন। অফিসের বাইরেও কোন কিছুতেই তিনি আলাদা করে আমাকে উৎসাহ দেন নি, পরামর্শ দেন নি, সেসবের প্রস্তুতিতে অংশও নেন নি। এখনো কানে বাজে -- ‘তোমরা যা করছ, বেশ করছ। আমাকে ডেকো না। আমি পারব না।‘
এভাবে কোন সাকসেসফুল মানুষকে আমি সমাজে চলতে দেখিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলেন, চলে এসেছেন এবং চলছেন। আর এজন্যেই আমার সময়ে এবং আমার জীবনে সুনীলদা একজন স্বচ্ছতম মানুষ। যার ফলে অজান্তেই আমার কাছে তিনি এক অনুকরণীয় এক চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
-----------------------
No comments:
Post a Comment