My Readers

Sunday, August 3, 2014

যে-জীবন আমার ছিল না ঃ প্রথম দৌড়

(Please read from the bottom to follow the sequence)


 [ 'যে-জীবন আমার ছিল না  ঃ প্রথম দৌড়' begins separately with Chapter 31 ]


30. //গুরুদাস কলেজ //

চন্ডী বারবার বলছিল, কলেজ যদি পাল্টাস আমাদের গুরুদাস কলেজে চলে আয়। আমাদের ইংরেজির প্রফেসররা খুব ভালো। আমি ইংরেজি সাহিত্য অত বুঝি না, কিন্তু পিএস-এর ক্লাশ মিস করি না। সাহিত্যের বাইরেও যে জীবন তা যোগ করে সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করেন, তোর ভালো লাগবে। অর্জুন বলল, 'চন্ডী ঠিক বলেছে। আমাদের পাড়ার কলেজ, জানি ভালো কলেজ। আমার অনেক পরিচিত ওখানে পড়ে। তারওপর কো-এড কলেজ। টর তো পোয়া বারো।'' অর্জুনদের বাড়ি আমরা প্রায়ই যাই। গুরুদাস কলেজের আশপাশ দিয়ে গেছি বার দুয়েক। কলেজ বিল্ডিংটা ভালো। আমি বললাম, 'আমারও মনে হয় যদি চানস পাই এটাই ভালো হবে। শিয়ালদা থেকে হাঁটা পথ।' অর্জুন বলে, 'তা না অবশ্য, তবে তোর লম্বা লম্বা ঠাংয়ে ব্যাপার্টা কাছেই।' অর্জুন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেঁটে। অর্জুনের কথায় যুক্তি আছে। কো-এড বড় কথা না। স্কুল পেরিয়ে আমার প্রথম কলেজই ছিল কো-এড। চন্ডী বলল, 'ব্যমকেশ ঘোষ ইংরেজির হেড। আমাদের কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় উনি একটা প্রকাশনার মালিক। আমি চিনি স্যারকে। চল একদিন ধরি ওঁকে।' আমজাদীয়ার টেবিলে বসে ঠিক হল, গুরুদাস বেটার হবে। পার্ট ওয়ান না দিয়ে ভর্তি, কোন ভালো কলেজ পাত্তাই দেবে না।

সিএনআর-এর কাছে গিয়ে বললাম সব। গুরুদাস কলেজ আমার আস্তানা থেকে তিন মাইলের মধ্যে, বন্ধুরা পড়ে, কলেজের ইংলিশ ফ্যাকাল্টি ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি। সিএনআর আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, 'আরে! ব্যোমকেশ তো গুরুদাসেই পড়ায়। ব্যোমকেশ ঘোষ। ঠিক আছে। চিঠি লিখে দিচ্ছি। নিয়ে যাও। হয়ে যাবে। পরে চন্ডীর সঙ্গে গেলাম। ভর্তিও হয়ে গেলাম।

চন্ডী আমজাদীয়ায় এলো। সেখান থেকে ৩৬ নম্বর বাসে ফুলবাগান। বাস থেকে নেমেই কলেজ দেখা যায়, কয়েকটা নতুন গজিয়ে ওঠা বিল্ডিঙ্গের ফাঁক দিয়ে। আমরা পায়ে হেঁটে বিল্ডিঙ্গগুলোকে টেঁরে বেঁকে কলেজের মূল গেটে পৌঁছুই। গুরুদাস কলেজ বেলেঘাটার নতুন অঞ্চল ফুলবাগান এলাকায়। দুই ডানা মেলা কলেজ বিল্ডিঙ্গ। আমাদের মহারাজা স্কুলের কথা মনে পড়ে যায়। কলেজের সামনে কেয়ারি রাস্তা মূল গেটে মিশেছে। সামনে বিশাল পার্ক। হলুদ রঙের কলেজ। দেখলেই পঠন পাঠনের গন্ধ নাকে লাগে। সোজা টিচার্স রুমে। ব্যোমকেশবাবু চিঠিটা পড়লেন। বললেন, 'অফিস থেকে ফর্ম নিয়ে এসো।' কলেজে চণ্ডী বেশ পপুলার। সব বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছেই সে চন্ডীদা। অফিসেও। আমি ফর্ম ফিল আপ করলাম। বিজি লিখে দিলেন, 'এডমিট প্রভিসন্যালি। সাব্জেক্ট টু ট্রানস্ফার সার্টিফিকেট টু বি সাবমিটেড অন আ ল্যাটার ডেট।' ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। মনেই পড়ল না, জীবনের দৌড়ে আমি আজ তিন বছর পিছিয়ে পড়লাম বা হারিয়ে ফেললাম জীবনের তিন তিনটি বছর। চন্ডী আমাকে নানাজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল। যে রুমে ক্লাশ বসে নিয়ে গেল সেখানেও ।

পরিচয় হল ডগলাসের সঙ্গে। দেবু, রাধা, জহর, মিলন, ঝুমা, প্রভার সঙ্গেও। দূর থেকে পামেলা। সবার সঙ্গে মেশেনা, বড় লোকের মেয়ে। হাই হিল। টক টক আওয়াজ তুলে বারান্দায় হাঁটে। মনে হল, ওর ধারণা, সব ছেলেগুলো তাকেই গিলে খাচ্ছে, দেখছে। কথাটা মিথ্যে নয়। এমন বুক টান অহঙ্কারী পা ফেলা মেয়ে আমি এর আগে দেখিনি। আমিও তাকিয়ে থাকি ফ্যাল ফ্যাল করে। তেতলা থেকে দোতলায় নামছি। চন্ডী পরিচয় করিয়ে দিল তিনজনের সঙ্গে। সিঁড়ির মাঝপথে টার্নিং-এ দাঁড়িয়ে গল্প করছিল ওরা। বেলা মুখোটি হাসে, 'আমি ইতিহাসের।' আমার মনে হল, বেশ মানান সই ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে। তেল মাখা চুল, বেণি বাঁধা। কপাল থেকে টান টান দুরত্বে চুলের সীমানা। বেঁটে, মাথাটা তুলনায় ভারি আর বড়। 'অমল মুখোপাধ্যায়। লেখক, গুরুদাসে পড়েন না। কোন্নগরে থাকেন,' অমল মুখোপাধ্যায় নমস্কার করলেন। চন্ডীর ইন্ট্রোডাকশনে একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, 'ওই একটু আধটু লিখি, এটা আমার নতুন উপন্যাস।' উপন্যাসটার নাম, 'চেনা আকাশ অচেনা রঙ।' হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। অমলের ভাঁজ করা কনুইয়ের ত্রিভুজে একটা মেয়ের গোলপনা মুখ, ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে বলে, 'আপনাকে ইংরেজি অনর্সে বেশ মানিয়েছে,' বলেই চোখে ঝিলিক তুলে ফিচকে হাসি হাসে। চন্ডী বলে, 'দীপ্তি ভট্টাচার্য। আমি বেলা আর দীপ্তি একই ক্লাশে। মানে আমাদের ক্লাশে। দীপ্তি খুব সপ্রিতভ । ছোটখাটো, ফর্সা, উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে গোলাকার শরীর। কেন জানি না, আমার মনে হল, মেয়েটার সারা শরীরে মায়া। আন্তরিকতায় সে টই টম্বুর। আমিও চিমটি কাটি, 'কেন, ইংরেজি অনর্স পড়তে কি ঢ্যাঙা হতে হয় নাকি?' আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসে দীপ্তি, শুনতে পাই না। বলে, 'ইংরেজি পড়তে স্মার্টনেস দরকার। আপনার তা আছে।' আমার পিঠে দুটো বেলুন ফুলে ওঠে।
  
কিছুদিনের মধ্যেই কলেজে অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল। ক্লাশে, ক্লাশের বাইরেও। অধ্যাপকদের মধ্যেও আমার নামটা আর অপরিচিত থাকল না। ক্লাশের মারকুটে ডগলাস, দেবু, মঞ্জু, প্রভা; অন্যদিকে শান্ত মানস, জহর, রাধা, ঝুমা,; সিরিয়াস মৃণাল, প্রবীর, বেলা, দীপ্তি; রাজনীতির হরপ্রসাদ; সিনিয়ার ক্লাশের রাজনীতির চিত্তদা, অতুলদা। ইংরেজীর অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যোমকেশবাবু ছাড়াও প্রিন্‌সিপ্যাল হিমাংশু গাঙ্গুলি, বিভুতি ভুষণ সেন (বিবিএস), পরিমল সেন (পিএস),মঞ্জু আচার্‌য, বাংলার সুমিত্রা হালদার। আমি যাঁদের ছাত্র নই তাঁদের মধ্যে ইতিহাসের কৃষঞপদ দে (কেডি), সংস্কৃতের সুখময় গোস্বামী... আরো অনেকে। সবার নাম মনে পড়ছে না এখন।

কিছুদিনের মধ্যেই কিছু কান্ড ঘটালাম কলেজে। শোরগোল পড়ে যায়। ফ্রেশার্স ওয়েলকাম অনুষ্‌ঠান হবে। কলেজের অডিটোরিয়ামে। চন্ডীর শয়তানি। সিনিয়ার এসে বলল, 'তোমাকে গাইতে হবে।' আমি অপ্রস্তুত এটা অবশ্য না। দীপ্তিকে ফ্যাসাদে ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করার এরচেয়ে ভালো সুযোগ কবে পাই না পাই। ক্লাশের এই মেয়েটাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই আমার চারপাশের রুক্ষ্ পৃথিবীটার ধানখেত হাওয়ায় কাঁপছিল, সাগরের ঢেউ শান্ত হয়ে গিয়েছিল, পাহাড় চূড়ার বরফ গলে গলে পড়ছিল, নীল আকাশে ভাসতে শুরু করেছিল সাদা মেঘের টুকরো টুকরো ভালোলাগা। তাই কলেজের অফ পিরিয়ডের বেশির ভাগ সময়টাই কাটছিল ওকে কথার চিমটি কেটে কেটে। দীপ্তিও তেমনি উইটি। আমাদের মধ্যে হারজিতের খেলা চলছিলই। এবার ফ্রেশার্স ওয়েলকামে ওকে চরম চিমটি কাটার সুযোগ পেয়ে গেলেম। তাই না না করেও রাজি হয়ে গেলাম।

সবাই ভেবেছিল আমি হেমন্ত নয়ত শ্যামল নিদেন পিন্টুর গান গাইব। কিন্তু আমি প্রথমে একটু নাটকীয় ভঙ্গীতে ফিস ফিসিয়ে ন্যাট কিং কোলের 'ইউ আর মাই পারসোন্যাল পজেশন'-এর প্রথম কলিটি গেয়ে উঠি, যেন মাইকটাই আমার সেই পার্সন্যাল পজেশন, তাতেই দিলাম আবেগের সব নির্যাস ঝরিয়ে, গেয়ে উঠি, 'ইউ আর মাই পারসোন্যাল পজেশন...' শ্রোতাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা চন্ডী চিৎকার করে উঠতেই সারা অডিটোরিয়ায়াম হৈ হৈ করে ওঠে। দীপ্তি বসেছিল দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারিতে। একপাশে বেলা মুখোটি। আমি সরাসরি তর্জনী তাগ করি দীপ্তির দিকে, এবার শরীরের আবেগটা তীক্ষ্করি ওর দিকে, 'ইউ আর মাই পার্সোন্যাল পজেশন ইউ আর মাই অ্যালোন/ নো বডি মাস্ট কিস ইউ বাট মী/ নো বডি মাস্ট লাভ ইউ বাট মী...' চারদিকে আবার হৈ হৈ। আমার তর্জনীকে অনুসরণ করে সবার দৃষ্টি থেমে যায় দীপ্তির মাথায় কোলে পিঠে কাঁধে। কিন্তু আশ্চর্য, দীপ্তির কোন হেলদোল নেই। সে আমার চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসতে থাকে। ভাবটা এই, তোমার ব্যাবস্থা হবে এবার... মনে মনে ঘাবড়ে যাই।


29. // ফেল পাশ //

পার্ট ওয়ান পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল। এমনিতেই আমার কাছে বইপত্র কম, কেনার পয়সা নেই, ভরসা একমাত্র অ্যালবার্টস হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচার আর গোল্ডেন ট্রেসারি, একটু ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম বইকি। আমি অবশ্য বরাবর সব মাস্টার মশাইদের স্নেহধন্য ছাত্র। স্কুল জীবন থেকেই। কলেজেও। সিএনআর তো তাঁর বাড়ির দরজা হাট খুলে রেখেছেন আমার জন্য। প্রায়ই যাই। এটা ওটা জেনে আসি, শিখে আসি, মৃদু তর্কেও জড়িয়ে যাই। এভাবেই খুব বেশি বই না-ঘেঁটেও আমার পড়াশুনো চলে, সেই স্কুল থেকে। কিন্তু বিএ ক্লাশের সেকেন্ড ইয়ারে এসে, পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাবড়ে গেলাম। ছুটকো ছাটকা পড়াশোনায় যে এই ইউনি ভার্সটি লেবেলের পরীক্ষায় পার পাওয়া সহজ না, বুঝতে পারছিলাম। আমি সিএন রায় ছাড়াও অন্যান্যদের বাড়িতে যাতায়াত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু মুশকিল হল কবিতা নিয়ে। গোল্ডেন ট্রেসারির অনেক কবিতা ছিল আমাদের পাঠ্য়। ইংরেজী কবিতা আমার ভালো লাগত বলে আমার কাছে পুরো বইটা ছিল। কোথা থেকে ঐ বইটা সংগ্রহ করেছিলাম, মনে পড়ছে না। কিন্তু এই অগাধ সাগরে আমার মত ছিঁচকে ছাত্রের পক্ষে তা সামলানো সহজ ছিল না। সবচেয়ে বড় বিপদ, এটা ক্লাশে পড়াতেন টিএনসি-- তারকনাথ চক্রবর্তী, কলেজে ইংরেজীর হেড।

একদিন টিএনসি কলেজ আসছিলেন। আমি বাইরে রাস্তার ওপরে। দৌড়ে যাই। 'স্যার, আমি অমুক কবিতাটি ধরতে পারছি না। আপনার বাড়িতে একদিন আসি, স্যার?' টিএনসি একটু দাঁড়ালেন। আমাকে আপাদমস্তক দেখলেন। 'চলে এসো। মাসে ৭৫টাকা দিলেই হবে।' 'না না স্যার ট্যুশান নিতে নয়। একদিন সকালে মাত্র এই একটি কবিতা নিয়েই আলচনা করতে আসব।' 'কিন্তু টাকা তো লাগবে। ৭৫ টাকার নিচে আমি পড়াই না।' আমি মরীয়া, "স্যার আমি বোধয় বোঝাতে পারছি না। আমি নিজেই খেতে পরতে পারি না। অত টাকা কোথায় আমার?' 'তাহলে, বাবা অরুণ, তোমার জন্য ৭০ টাকা। তার নিচে নামতে পারব না।', বলেই কলেজের গেটের দিকে পা বাড়ান। আমি লাফিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়াই, 'আপনি ভুল বুঝেছেন সিরা। আমি তো মাত্র একটা কবিতার কঠিন জায়গাগুলো বুঝে নিতে চাই...' স্যার আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলেন, 'সে আমি বুঝেছি বৈকি। তুমি অন্য কারো কাছে যাও', বলে মেইন গেটের সিঁড়ি বেয়ে গেট পেরিয়ে চলে যান। আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। একি ব্যবহার একজন শিক্ষকের? টাকা ছাড়া একটা কবিতার কয়েকটা লাইনও না? আমার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে যায়, পায়ের পেশি শক্ত লোহা, গেটের দেয়ালে লাথি মারি। পায়ে ব্যথা লাগে খুব।

টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। পার্ট ওয়ান ইউনি ভার্সি টির পরীক্ষা, তাই টেস্ট দিয়ে পাস করলেই কলেজ ফাইন্যালে বসার অনুমতি দেবে। ইংরেজী পরীক্ষার একই দিনে দুটি পার্ট পেপার হয়ে গেলে। পরের দিন বাকি দুটি পার্ট। সেদিনের ফার্সট পার্টটা দিয়ে যখন সেকেন্ডটায় বসেছি, মাথা গরম হয়ে গেল, এই পেপার সেট করেছেন টিএনসি, মানে তারকনাথ চক্রবর্তী। সেদিনের অপমানের রক্ত যেন সারা শরীর থেকে ছুটে গিয়ে মাথায় জমে গেল। আমি মনে মনে চিৎকার করে উঠি, 'নো নো নেভার। নেভার আই উইল আনসার দোজ কোশ্চেনস সেট বাই সাচ আ বারবারিক ব্লাড থার্সটি টিচার!' আমি ঠিক এ কথাগুলোই একটু বড় বড় অক্ষরে আনসার শিটে লিখে দিলাম। শেষটায় যোগ করলাম, 'আই লীভ দ্য একজামিনেশন হল ইন প্রোটেস্ট।'

স্বভাবতই আটক গেলাম। বাকি পেপারগুলোর মারক্স আমাকে পাশ করালেও, আমি সেন্ট আপ হলাম না। কলেজ অফিসে গিয়ে দেখলাম, লিস্টের কোথাও আমার নাম নেই। মানে, আমার ছাত্র জীবন থেকে আরো একবছর বাদ হয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সামিল হওয়ায় আইএসসি পরীক্ষা দিতে না পারায় দু বছর, এবার যুক্ত হল তার সঙ্গে আরো এক। সত্য, অভীক, অর্জুন সব শুনে আমাকে শান্ত করার জন্য বসন্ত কেবিনে নিয়ে যায়। অনেক বোঝায়। 'জিদ করিস না। টিএনসি'র কাছে একবার যা, ওনার রাগ কমে যাবে।' অর্জুন বলে, 'তুই একজন শিক্ষককে বারবারিক, ব্লাড থার্সটি বলে অন্যায় করেছিস।' অভীক বলে, 'সমাজে গুরু শিষ্য পরম্পরা মানতে হয়। গুরুরা সব সময় নির্ভুল।' আমি মানি না। চুপ করে থাকি। ওদের পারিবারিক সামাজিক মানসিকতায় ওরা সারেন্ডার করে বসে আছে, তাইতে আমি কেন আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাব? ঘটনাটা কয়েকদিনের মধ্যে কলেজে চাউড় হয়ে গেল। সব শুনে কেউ গালাগাল দিতে লাগল তারকবাবুকে, কেউ আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করল, কেউ বলল, পড়াশুনার ব্যাপার। ঝঞ্ঝাট মিটিয়ে ফেলাই ভালো। আমি শুনে যাই। কিন্তু এ সবে মাথার রক্ত শরীরে ছড়ায় না। মাথাতেই জমাট বেঁধে থাকে।

আমার প্রিয় মাস্টারমশাই, তিনি আমাকে এই কলেজে ইংরেজী অনর্সে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন, একদিন টীচার্স রুমে ডেকে পাঠালেন, 'আমি তারকবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি, উনি বলেছেন, তুমি ক্ষমা চাইলেই উনি তোমাকে মাফ করে দেবেন। তুমি ফাইন্যালে বসতে পারবে।' সিএনআরের সামনে থতমত খেয়ে যাই। ওঁর চোখমুখ দেখে বুঝতে পারি, উনি আমার ব্যবহারে আহত হয়েছেন। আমি মাথা নিচু করে খানিক চুপ করে থাকি। তারপর ভয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলি তারকবাবুর ব্যবহারের কথা, আমার চোখে শিক্ষক ছাত্রদের সম্পর্কের কথা, আমার বিশ্বাসের কথা, আমার প্রত্যয়ের কথা। বুঝলাম, তিনি কনভিনসড হলেন না। বললেন, 'এভাবে নিজের ভবিষ্যত খারাপ কোর না, অরুণ। বলেছিলে তোমার অলরেডি দু' দু'টো বছর নষ্ট হয়েছে, আরো একটা বছর নষ্ট কোর না।' আমি কথাটা ঘুরিয়ে নিই, স্যারকে বলি, 'আপনি আমাকে অন্য কলেজে ভর্তি করে দিন, স্যার। যে কোন কলেজে। আমার ভালো দামী কলেজের দরকার নেই। আমার নিজের ওপর ভরসা আছে, স্যার। আমি সামলে নেব। যদি সফল হই এই সব এক দু' বছরের হিসাব আমারও মনে থাকবে না।' আরো খানিক এই ভাবে আমাদের একে অপরকে বোঝাবার পালা চলল। তিনি আরো কয়েকজন স্যারকে ডাকলেন, সবাই সিএনআরের সঙ্গে একমত, 'ক্ষমা চেয়ে নাও, অরুণ।'

সবাই পরীক্ষায় বসল। আমি না। অভীক, অর্জুন, সত্য তিনজনই। চন্ডী পড়ত আমাদের এক ক্লাশ নিচে, গুরুদাস কলেজে। এদের কারো সঙ্গে আমার সাব্জেক্টের মিল নেই। অভীকের বাংলা অনর্স, অর্জুনের পলিটিক্যাল সায়েনস আর সত্যর ইকনমিক্স। তাই ওরা পরীক্ষা দিতে গেলে আমি শেষের সময় ক'টি বসে থাকতাম বসন্ত কেবিনে। ওরা এলে আড্ডা হত। তারপর যে যার ঘরমুখো। আমি অবশ্য যেতাম আমজাদীয়ায়, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আর এক প্রস্থ আড্ডা, তারপর ঘরে ফেরা।

পরীক্ষা শেষে আমরা যেন মুক্ত পাখি। পার্ট টু'র কথা তো ভাবব পার্ট ওয়ানের রেজাল্টের পরে! মাস দুই তিন অপেক্ষা তো করতেই হবে। তবে কলেজে পড়াশুনো থেমে থাকে না। ওরা তিনজন ধীরে ধীরে সিরিয়াস হতে থাকে। পার্ট টু মানে জীবন মরণ যুদ্ধ। নিজেদের কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছেও। কলেজে নিয়মিত যেতে থাকে। ক্লাশ ফাঁকি দেয় না। আমি অবশ্য না। আমার হাতে অঢেল সময়। সিএনআর বলেছেন, পার্ট ওয়ান শেষ হলে তিনি অন্য কোন কলেজে আমাকে ভর্তির ব্যবস্থা করবেন। সেই আশায় বসে আছি। আমি সিটি কলেজে আর যাই না।

পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বের হল। আমি হতভম্ব। বাকি তিনজনের মুখ কালো। ওরা তিনজনেই ফেল করেছে। কী করে হল? অত্যন্ত বুদ্ধিমান এক একজন। তবু? বাড়ির সংস্কৃতিও ওদের অনুকুল। কলেজ, ভাইবোন, বাবা মা সবই অনুকুল। তবু ফেল? কী করে হতে পারে? আমরা কি বেশি আড্ডা দিয়েছি, একেবারেই পড়াশুনো করিনি? কারো কাছে উত্তর নেই। সবাই সেদিন গিয়ে বসলাম অর্জুনদের বাড়ির কাছে বেলেঘাটা লেকের সবুজ ঘাসে। লেকের জলে মাছেদের ঘাই নেই। আমাদের মধ্যেও কোন কথা নেই। নিস্তরঙ্গ জলস্তরকে ছাপিয়ে তোলপাড় হচ্ছিল এক একজনের বুকের ভেতরটা। এক সময় আমি রেগে যাই। 'অভী, তুই কী করে মাসিমার সামনে দাঁড়াবি, ভেবেছিস?... অর্জুন, পারবি তো বাড়ির বড় দাদা হয়ে মানা আর তানার সামনে মুখ উ'চু করে তাকাতে?... সত্য, তুই? শিবানী কিছু জানতে না চাইলেও, বোবা ইন্দ্রাণীর চোখ কি প্রশ্ন করবে না তোকে? আমি নির্মম হয়ে ওদের বুকে মাথায় হাতুড়ি পিটতেই থাকি। থামি না। 'তোরা যাই বল, আমি পরীক্ষা দিলে কম মারক্স হয়ত পেতাম, কিন্তু ফেল করতাম না কখনই।' সত্যি কী হত জানি না। আমি নিজেও যেন ওদের এই অবস্থায় দিশাহারা। ভয় হচ্ছিল, এই পার্ট ওয়ান আমাদের বন্ধু বিচ্ছেদ ঘটাবে না তো?

ওদের ফেল করাটা আমার ভেতরটা অনুশোচনায় তোলপাড় করে দিল। ওরা প্রত্যেকে নিজেদের পরিবারের শিক্ষা সংস্কৃতি আর ভালোবাসার পরিমন্ডলে বাস করে। একমাত্র আমি না। আমার পারিবারিক মন্ডল নেই, না পারিবারিক শিক্ষা বা সংস্কৃতিতে। আমার ছোঁয়ায় ওরা, মনে হল, নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আমার সময় কাটাবার তাগিদে ওদের ঘর থেকে বাইরে এনে আড্ডার গাড্ডায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। ওরা ধীরে ধীরে কূয়োর জলে ডুবে ডুবে গেছে। আমি জলে নামি নি। কেননা, আমি ছিলাম ঐ অন্ধকূপের মালিক। নইলে ওরা কেউ আমার চেয়ে কম মেধাবী বা বুদ্ধিমান তো নয়, আমি জানি, তবু এমনটা হয় কী করে? আমার ভাবনা সমর্থন পায় অর্জুনের বাবার কথায়। আমি কোন বন্ধুর বাড়িতেই যাচ্ছিলাম না ক'দিন। আমজাদীয়ার বাইরে যেতাম না। ওরা আসত আড্ডা দিতে। একদিন অর্জুন বলল, 'তুই আমাদের বাড়ি অনেকদিন যাচ্ছিস না বাবা খেয়াল করেছে। বাবা কি বলল জানিস? 'অরুণ আসবে কি? সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তাদের পড়ার সময় বরবাদ করে পরে রাত জেগে পড়াশুনো করে নিজের ঘর গুছিয়েছে। এখন কোন মুখে আসবে?' সবাই মেশমশয়ের কথাটা হাসাহাসি করে উড়িয়ে দিল বটে, আমি পারলাম না। মেশমশয় দূর্দ্রষ্টা। তিনি একশ ভাগ ঠিক মনে হতে থাকে সেদিন থেকে। আমি নিজেকে সতর্ক করতে থাকি, সতর্ক থাকতে শুরু করি...

-------------------------------------



28. //কৈশোর ছুটছে //



আমরা পাঁচবন্ধুর মধ্যে, আগেই বলেছি, পড়াশুনোটা ছিল গৌণ, আড্ডাটা ছিল মূখ্য। আমরা সাধারণ মেধার, পাশ করব না, এমনটা মনে হত না। আমরা যতটুকু পড়তাম, তা পাশ করার জন্য, জানার জন্য না। আমার অবশ্য সেই বিলাসীতার সুযোগ ছিল না। আমার বুকের ভিতরে নিজেকে প্রমাণ করার একটা দরকারি ব্যাপার ছিল। বাড়িতেও নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ ছিল। আর সমাজে সবার কাছেও। কেননা, আমি ছিলাম মূলত কলকাতার ফুটপাতের একটি ছেলে। অর্জুন রাজনীতি করত, তবে তার রাজনীতি ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার, দেশজুড়ে কম্যুনিজমের প্রতিষ্ঠা ট্রতিষ্ঠা নিয়ে ওর কোন মাথা ব্যাথা ছিল বলে মনে হয় না। অভীকের মধ্যে অনেক গুণ থাকায় ও ছিল জীবন সম্পর্কে দিশাহারা। কখনো তার মন গীতিকার হতে চাইত, কখনো কবি, ক্যামেরাম্যান, চিত্রপরিচালক, কখনো বা সিনেমাটোগ্রাফার। অভীক অধ্যাপক হতে চায়নি কোনদিন, তাই তার অধ্যয়ণে আগ্রহ ছিল না। সত্যর এসব ব্যাপার ছিল না। আমাদের মধ্যে ওর মধ্যেই ছিল সমকালীন কলকাতার প্রবাহ। রকবাজী ওর যেন চেতনায়। চন্ডীর ব্যাপারটা আলাদা। ও জানত, ওর রক্তে পড়াশুনার স্রোত নেই। সেটা ওর পারিবারিক পরিমন্ডলের দান। তো যা হয়, আমরা ছিলাম খুব সাধারণ মনের সংস্কৃতি মনা পরিবারের ছেলে। যার কেন্দ্রবিন্দুতে অচিরেই মেয়েদের মুখ সেঁটে যেতে থাকে।

সালটা মনে নেই। টালা পার্কে শিল্প মেলা। চন্ডী বাদে আমরা চারবন্ধু গেছি। সন্ধ্যে বেলায়। খুব ঘোরা ঘুরি মজাটজা করে বসেছি বিজলি গ্রিলের দোতলায়। সেই প্রথম বিজলি গ্রিলের নাম শোনা। খুব ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাজারে এসেছে তারা। এই মেলাতে তাদের কাঠের দোতলা রেস্ট্যুরেন্ট। আমরা একটা টেবিল ঘিরে যথারীতি হুল্লোড় করছি, হঠাৎ সত্য আমাদের ইশারায় সতর্ক হতে বলে। সামনে একটি চাঁপা ফুলের রঙের মেয়ে। পরনে চাঁপা রঙের ফ্রক। গায়ের রঙ ফ্রকটাকে আলো দিচ্ছে নাকি ফ্রকটা গায়ের রঙকে, বোঝার উপায় নেই। আমরা চারজনেই মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকি তাকে। সঙ্গে বাবা মা। অভী মেয়েটাকে দেখে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ। কবিতার মত মেয়েটা, বলল। সত্যি, মেয়েটা খুব সুন্দর, চেয়ে থাকার মত। অবশ্য আমাদের ঐ কৈশোরের শেষপর্বের জীবনে, যা কিছুই সুন্দর লাগার কথা। বাবা মাকে অনুসরণ করে মেয়েটা উঠে যায়। আমরাও তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে ওদের পিছু নিই। ওরা আইস্ক্রিম কেনে, পিছু পিছু আমরাও। ওরা যে দোকানে যায়, আমরাও সেই দোকানে নাড়াচাড়া করি বিক্রির জিনিস, আড় চোখে উপভোগ করি নাকে না-আসা চাঁপার সুগন্ধ। দারুণ ভীড় মেলা জুড়ে। বোধয় সেদিন ছুটির দিন ছিল। চারপাশের রাস্তা দিয়ে মানুষের ঢল, টালা পার্ক মুখো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের চার জোড়া চোখ থেকে হারিয়ে গেল মেয়েটা। আমরা হতাশ। ক্ষণিকের আনন্দটুকু যেন হঠাৎ যাদু কাঠির ছোঁয়ায় উবে গেল।

মনে নেই প্রস্তাবটা কার। আমাদের সবার এই মন খারাপে যে কেউ বলতেই পারে, 'ধুস, চল ফিরে যাই!' আমরা তাই কাছেই ট্রাম ডিপো, সেখানে পৌঁছে যাই। অনেক ট্রাম অনেক দিকে যায় সেখান থেকে। আমরা যাব কলেজ স্ট্রিট, অভীকদের বাড়িতে আড্ডা মেরে তারপর যা যার ডেরায়। কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম খুঁজছি, হঠাৎ দেখি চাঁপা ফুল। ঘরঘর করে যে ট্রামটা যাচ্ছে, তার জানালায়। সত্য চিৎকার করে ওঠে, 'ওই তো!' বলেই চলন্ত ট্রামের পিছিনে ছুটতে থাকে, আমরাও। টালা ব্রিজের ওপরে ওঠার সময় ট্রামের গতি একেবারে কমে এলো, কিন্তু আমরা সেকেন্ড ক্লাশের দরজাটা ধরতে না ধরতেই ব্রিজের ওপাশের ঢালে হুড় হুড় করে ট্রামটা নেমে যায়, আমাদের থেকে বেশ দূরেও চলে যায়। আমরা ছুটতেই থাকি। হই হই করতে করতে। লোকেরা হয়ত ভাবছিল, ট্রামে আমাদের কিছু রয়ে গেছে, আমরা ভুলে নেমে পড়েছি। ট্রাম একটা রেড লাইটে দাঁড়াতেই আমরা প্রাণপণ ছুট। কিন্তু কাছে যেতেই ফস্কে যায়। আবার ছুট। এখন মনে করতে পারি না, জীবনে আর কখনো অত বেগে অতটা রাস্তা ছুটেছে কিনা, ছুটতে পারতাম কিনা। আমাদের চারজনের একজনেরও মনে হয়নি, ধ্যুৎ ছেড়ে দে। মেয়েটা যেন আমাদের গালে চড় মেরে পালিয়ে যাচ্ছিল, আর আমরা তাকে ছাড়ব না। পাঁচ মাথার মোড়ে ট্রাফিক লাইটে ট্রামটা ধরে ফেলতে পারব নিশ্চিত। কিন্তু না, গ্রীন পেয়ে গেল ট্রামটা। আমরা ঝাঁকার ওপর দিয়ে, ঠেলা গাড়ি টপকে, একে ওকে ধাক্কে ঢুকে পড়ি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। এই রাস্তা দিয়ে অনেকগুলো ট্রাম চলছে এক অপরের পিছু পিছু। এবার তো স্পীড নিতে পারবে না। দৌড়ুতে দৌড়ুতে শ্রী সিনেমার কিছু আগে ধরে ফেললাম আমাদের লক্ষের ট্রামটাকে। অভী উঠল আগে, 'এখানে নেই তো!' মানে চাঁপা ফুল এই ট্রামে না। সত্য দৌড়ুতে দৌড়ুতে বলে 'তবে সামনেরটায়!', বলেই ছুট এবং ধরেও ফেলে। নেমে আসে 'নাঃ এতেও নেই!' তার আগেরটা ধরে সে, হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে দৌড়ুতে থাকা আমাদের তোলে। ট্রামটা তখন হাতিবাগান ছাড়িয়ে হেঁদুয়া মুখো। সামনে কোন ট্রাম আর নেই। অর্জুন এবার মুখ খোলে, 'কী হল বলত? মেয়েটা তো আর ট্রাম থেকে নেমে যায়নি, আমাদের চোখে পড়ত তাহলে। হাওয়া হয়ে গেছে তাও না। তাহলে? সত্যই একটা সম্ভাবাবনার হদিশ দেয়, 'বোধয় মেয়েটা তিন নম্বর ট্রামে উঠেছিল, তাই হাতিবাগান থেকে ডান দিকে শোভাবাজারের দিকে বেঁকে গেছে, আমরা ভুল ট্রামের পিছনে ছুটছিলাম এতক্ষণ। মানে আমরা এক নম্বর ট্রাম ভেবে ছুটেছি। ধ্যাৎ শালা! তোদের কারো মাথায় এলো না এটা? মেয়েটা কোন ট্রামে উঠেছে এটা দেখা উচিত ছিল'. অভী মিনমিনিয়ে বলে, 'তা কী করে হবে?. আমরা তো মেয়েটা যে ট্রামে ছিল, তার পিছনেই ছুটেছিলাম সারাক্ষণ। অন্য ট্রামের পিছনে তো দৌড়াইনি?' সেটাও ঠিক। কিন্তু মেয়েটা কী করে উধাও হল? আজো তার হিসাব মেলাতে পারি না।

-----------------------




27. // মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল //
  
আমাদের বাড়ির খুব একটা দূরে ছিল না মহারাজা স্কুল। ওই পথেই আসতেন দূ র্গা ঠাকুর। ওই পথেই ছিল কুমোর পাড়াযেখানে হাড়িকুড়ির ভাটায় শয়তান দুয়ো রানী লুকিয়ে রেখেছিল সুয়োরানীর চাঁদ কপালে হাতে তারা রাজকুমারকেযাতে পুড়ে মারা যায় রাজার পুত্র। বাবা-মা সকালে মহারাজা স্কুলের পিছনের ওই পথেই অনেক সময় বেড়াতে যেতেনঅনেক দিন আমি তাঁদের সঙ্গে দৌড়ে দৌড়েমহারাজা স্কুল আর কুমোর পাড়ার পাশ দিয়ে যেতামকল্পনা করতামকোথায় রাজপুত্রের রূপের আগুনে পুড়ে তৈরি হয়ে গিয়েছিল কাঁচা মাটির বাসন। কুমোরের ঘরে কী ভাবে ঠাঁই নিয়েছিল রাজপুত্র তাদের সন্তান হয়ে।  

ছোট স্কুল বড় স্কুলের তফাৎ বোঝার বয়স তখন আমার না। আমার পড়াশুনার শুরু নিমনগরে সাঁওতাল পল্লির পাশেযোগমায়া পাঠশালায়। আমার তিন বছরের বড় ভাইবাচ্চু পড়ত বাংলা স্কুলে। কান্নাকাটি করে এক বছর পরেই আমি বাংলা স্কুলে যাইপ্রধান কারণবাচ্চুর কাছেই শুনেছিবাংলা স্কুলের গা ঘেষে রেললাইনরেললাইন পেরুলেই কাছারিরেল স্টেশনটাও দূরে নাবড় মাঠও কাছে। এছাড়া পাশেই মস্ত টলটলে পুকুরজেলা স্কুলের। এখানে এসে একবছর বাদে আবার উড়ানমহারাজা স্কুলে। এর বড় কারণ ছিলচন্দ্রবাবু স্যার। পাড়ার বাদল এই স্কুলে পড়তওই বলত চন্দ্রবাবুর কথা, 'সব পিরিয়ডেই গল্প আর শুধুই গল্প। মজার মজার গল্প। রাজপুত্ররাজকন্যাদৈত্যি দানবরাজা রানী... আমাদের দিনাজপুরের রাজবাড়ির সব গল্প। ক্লাশে পড়াশুনা নেই। শুরুতে টুকটাকব্যাসবাকিটা গল্প আর গল্প।তো এরপর কেউ বাংলা স্কুলে থাকতে পারেএর সঙ্গে যোগ হলআমার বিরুদ্ধে বাচ্চুর নালিশ। আমি স্কুল ফাঁকি দিয়ে রেললাইনে গাড়ি দেখতে চলে যাইকাছারির আশেপাশে যাইরেল স্টেশনে যাই এই সব। তো মেজদার ঘোষনা, 'বাব্লুর পাড়ার স্কুলেই পড়া ভালো।তো আমি ভর্তি হলাম মহারাজা স্কুলে। সেই ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ আমি ছিলাম মহারাজা স্কুলের ছাত্র। ক্লাশের সেকেন্ড বয়।

আমাদের স্কুলটা ছিল বিশাল দুটি ডানা মেলা খয়েরি রঙের এক বুক টান ঈগল পাখির মত। শহরের যে কোন স্কুলের থেকে আলাদা। মহারাজা গিরিজানাথ দিনাজপুর শহরে কয়েকটি স্কুল করেছিলেনএটি তার মধ্যে বড়নামমহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল। একটানা ডানা ছড়ানো স্কুলটার আগে পিছে মাঠ। সামনের মাঠটা খুব বড়। পুব পাশে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর কয়েকটি কৃষঞচূড়ার গাছ। শীতে ঘণ সবুজগ্রীষ্ম ব র্ষা য় লালে হলুদে ছয়লাপ। গাছের নিচে অসাবধানে হুটোপুটি করলে পায়ে জামায় রঙ লেগে যেত। কৃষঞচূড়ার ছায়া ছাড়িয়ে একটু এগুলেই উঁচু দা র্জি  লিং রোড। শুনেছিলামবৃটিশরা কলকাতা থেকে দা র্জি লিং অবধি হাই রোড তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলশেষটায় হয়নিতার অংশ। পরে এঁটেল মাটির পথলম্বালম্বিপরিত্যক্ত। গরুর গাড়ি চলে মাঝে মধ্যে। গরুরা পা হড়কে হড়কে টানে ভারী গাড়ি। ব র্ষা য় এঁটেল মাটির কাদায় বসে যায় চাকাতখন গাড়োয়ান কাঁধ মেলায় গরু জোড়ার সঙ্গে। কখনো সখনো আমরা ছোটরা চাকা ধরে প্রাণপণ তা ঘোরাবার চেষ্টা করতামহেই সামালো হেইওওই ছোট্ট বয়সেই আমি যেন দা র্জি লিং রোডের ওপার থেকে অভিযানের আহবান শুনতে পেতাম। টিফিন টাইমে নেমে যেতাম অন্য পারের ঢাল বেয়ে। তারপর সবুজ ধান ক্ষেতকোন সময় ধান-কাটা-হলুদশুকনো। কোথাও টম্যাটোর ফলনকথাও কুলের ঝোপম ট র শুঁটি... সারা বছর ধরে কখনো সবুজ কখনো হলুদলাল নীল.. সব রঙই আমাকে হাতছানি দিত। আটকেও যেতাম। ক্লাশের ফা র্সট বয়মলয় সাহা (ওর জন্য কোনদিন ক্লাশে ফা র্সট হতে পারিনি), আমার সঙ্গে থাকলেও ক্লাশে ফিরে যেত দৌড়েআমার দেরি হয়ে যেত। তালুতে এক দুঘা বেতনয়ত, 'স্ট্যান্ড আপ অন দ্য বেঞ্চ,' খুব বেশি, 'স্ট্যান্ড আউট অফ দ্য ক্লাশ রুম' (এটা ছিল খুব লজ্জারকেননাক্লাশের বাইরে দাঁড়ালেগোটা স্কুলের  মাথা থেকে  মাথার সবাই দেখতে পেত।এসবে অভিযানের মাত্রা কমত বটেতবে তা বাদ পড়ত না।

স্কুল মাঠের প্রান্তেপশ্চিমেছিল একটা মশজিদ। মুয়াযযিন ছিল তার মালিক। মাথায় আধ কোঁকড়ানো কালো কুচকুচে ঠাসা চুলগায়ের রঙ্গটাও কালো। দাড়িটাও। পরতেন কালো জোব্বা। লুঙ্গিটাও যতদূর মনে পড়ছে কালো। গলায় মোটা দানার পুঁ তির মালা। ছোট মশজিদ। ডানদিকে কয়েক ধাপ উঠলে আযান দেবার পাটাতন। আমি জীবনে এত মধুর  আর উদাত্ত আহবানের আযান শুনি নি। টিভিতে মক্কা শহরের আযান শোনার পরেও বলছি। আমি  আযান এতবার শুনেছিস্কুল মাঠ থেকে বিকেলে খেলা শেষে বাড়ি ফেরার সময়সুরটা এখনো মনে পড়েএমনকি আযানের আহবানের আরবী শব্দগুলোও। সেসবের অ র্থ অবশ্য জানি না। আমি নির্দ্বিধায়  আযান এখনো নি র্ভুল সুরে দিতে পারি। আজো কাউকে আযান মানে কি এটা বোঝাতে আমি দুকানে হাত রেখে এই আযান দিয়ে তা বোঝাই। আমার মুয়াযযিনকে ভালো লাগত। ছোট বেলাতে তো বটেইবড় হয়েও। ওর বেশের মধ্যেই ভুর ভুর করত একটা বিবাগী মানুষের ধুপ সুবাস। একটা খাটিয়াএককোণে একটা উনুনপাশে কিছু ঝকঝকে বাসন কোসন। আর সারা মশজিদ জুড়ে অনেকগুলো মাদুর। এই ছিল তার সংসার আর ঐ শ্ব র্য। বাজারের পথে মুয়াযযিনকে আমাদের গলিপথ দিয়ে যেতে হত। বারান্দা থেকে ডাকতাম। গলিতে দাঁড়িয়েই দাড়ি গোঁফের জঙ্গল ফুড়ে ঝকঝকে দাঁত মেলে বলতেন কিছু। মনে নেই কি বলতেনতবে ওর সঙ্গে কথা বলে খুশি হতাম। মনের ভেতরে অদ্ভূত ইচ্ছা পাখা নাড়ত। আমিও যদি একদিন মুয়াযযিন হয়ে যাইশুধু একটা মশজিদেই নাসারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে যদি আযান দিয়ে দিয়ে ফিরিমুয়াযযিনকে মনে হত ফকিরআমার ফকির হতে ইচ্ছে করত খুব। এমন জীবনে তো বাঁধা বন্দ্ধনের বালাই নেইউত্তেজিত হতাম। ক্লাশ সেভেন এইট পর্যন্ত এই ইচ্ছাটা বুকে পুষতাম। আসলে যে কোন প্রবাহমান জীবনই আমার বুকের পাখির ডানা দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে দিত। ১৯৭১ সালে আমি এপার বাংলায়। খবর পেলামখান সেনাদের হাতে অসংখ্য বাঙালির নিধনের প্রত্যুত্তরে উত্তেজিত বাঙালিরা হত্যা করেছে মুয়াযযিনকে। মুয়াযযিন বিহারী ছিল।

আমার সাবজেক্ট সংস্কৃত ছিল না। আমি পড়তাম উ র্দু। তাই উর্দু স্যারের খুব প্রিয় ছিলাম। আমাদের সময়ে বইয়ে উ র্দু হরফ ছিল অন্যরকম, লেটার প্রেসে ছাপা। পড়তে সুবিধা হত, তবে উ র্দুর ছাত্র হিসেবে মজা পেতাম না। উ র্দু ক্যালিগ্রাফি আমার উ র্দু নেবার পিছনে কাজ করেছিল কিনা মনে নেই, তবে আমি এই ক্যালিগ্রাফিকে খুব পছন্দ করতাম, আজো করি। বোধগম্যতা বজায় রেখে  এই হরফটাকে এত অলঙ্কারে সাজানো যায়, খুব মজা লাগত। আমি উ র্দু তে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। সত্তরের নিচে মারক্স পেয়েছি বলে মনেই পড়ে না। মেজদা বলতেন, 'উ র্দু স্যার তোকে ভালোবাসেন, তাই...' কথাটা মিথ্যে বলব না। সত্যিই উনি মাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের গলি দিয়ে যাবার সময়, বেশির ভাগ সন্ধ্যের দিকে, আমার দুলে দুলে পড়ার সময় এসে দাঁড়িয়ে পড়তেন। উ র্দু বই বের করে পড়াতে বসে যেতেন। আমরা একবার সিনেমা সিনেমা খেলছিলাম আমাদের বাড়িতে, বারান্দায় শিশুদের হুল্লোড়। দেখি উর্দু স্যার। গোলগাল বেঁটেখাটো মানুষটা ছোটদের সঙ্গে আমাদের 'সিনেমা হলে' ঢুকে গেলেন। একটা চেয়ারে বসে আমার কারিগরির সিনেমা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। ‘দারুণ’। তিনি যে আমাকে ভালোবেসে বেশি মারক্স দিতেন না, তার পরিচয় মিলল ম্যাট্রিক পরীক্ষায়। আমার বয়স তখন চোদ্দ। উ র্দু তে আমি ৭৭ পেয়েছিলাম ম্যাট্রিকে। মেজদা চুপ।

রবীন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন আমাদের ড্রিল স্যার। খুব কড়া স্বভাবের মানুষ। যেমন ক্ষুরধার তেমনি ওজনদার। ক্লাশ থ্রিতে ভর্তি হয়েই ওনার ক্লাশ পেয়েছিলাম। কেউ একটু নড়লে চড়লেই চিৎকার করে বলতেন, 'এই ছেলে! তোর তো সাহস কম না? আমাকে চিনিস? তুই তো এত্তটুকুন! দু আঙুলের চিমটিতে ধরব আর টক করে মুখে ফেলে দেব, তারপর এক গ্লাশ জল। কোথায় থাকবি কেউ টেরও পাবে না। তোর বাবা মা যদি কান্নাকাটি করেন একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁতটা খুঁ চিয়ে থুক, ফেলে দেব তোকে বাইরে। খুব সাবধান। আমার ক্লাশে কোন অমনোযোগ চলবে না।’ আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। তবে ইনি আমার কাব্যগুরু। এর কাছেই পেয়েছি প্রথম কাব্য ধারণা। কবিতা কি, তা ওঁর কাছ থেকেই প্রথম শিখেছিলাম। আমি তখন ক্লাশ থ্রিতে (আমার ক্লাশগুলোর উল্লেখ করতে পারছি, কেননা, স্কুল বিল্ডিনঙ্গের কোন রুমে কোন ক্লাশে কী ঘটেছিল স্পষ্ট মনে আছে), তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন কাজী নজরুলের 'ভোর হল দোর খোল' কবিতাটি। পড়াতে পড়াতে একবার বললেন, আমার নাম কি? রবিবাবু স্যার। মানে? আমি রবি। মানে? আমি সূ র্য । মানে আমি সূযযি মামা।' বলেই তিনি টুক করে চেয়ার সরিয়ে টেবিলের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করলেন, বললেন, 'এবার রবিবাবু স্যার উঠছেন। মানে?   সূ র্য উঠছে। মানে? সূযযিমামা উঠছে। মানে? রবিমামা উঠছে।' এবার তিনি টেবিলের ওপর হামাগুড়ির ভঙ্গি করে বলতে লাগলেন, 'রবিমামা দেয় হামা। মানে? ভোরবেলায় সূ র্য আমাদের আকাশে হামাগুড়ি দিতে দিতে উঠছে। একটা শিশুর মত। সূ র্যের গায়ে লাল জামা। আমার এই জামাটা অবশ্য শাদা।' বলেই বোকা বোকা হাসলেন। আমরাও হেসে উঠি। কিন্তু আমি বুঝে ফেলি কবিতা লেখার অপার রহস্যটাকে। আজো খুব ভোরে লাল সুর্য উঁকি দিলেই রবিবাবু স্যারকে টেবিলের ওপর হামাগুড়ি দিতে দেখি। একইভাবে গদ্যের আড়ালে যে সাহিত্য, সেটাও রবিবাবু স্যারের কাছেই প্রথম শেখা। মুখস্ত হয়ে আছে লাইনটা, "কেঁচো সাপের মত ফুঁ সিয়া উঠিয়া কহিল, 'আমার মেজদিদি আছে।'. শরৎচন্দ্রের 'মেজদিদি' গল্পে আছে লাইনটা। ক্লাশ ফাইভে আমাদের পাঠ্‌য় ছিল। অনেকবার পড়েও আমি 'কেঁচো সাপ' বলে কিছুকে কল্পনায় আনতে পারছিলাম না। স্যার একদিন বুঝিয়ে বললেন কী ভাবে পড়তে হবে, 'কেঁচো # সাপের মত ফুঁ সিয়া...' কেষ্টর চরিত্র কী ভাবে অন্য একটি ছবিতে আরো বেশি স্পষ্ট হল, বুঝিয়েছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালে যখন খান সেনারা ১৩ দিন মুক্ত থাকা দিনাজপুর শহরের দিকে এগিয়ে আসছিল, শহরের হিন্দু মুসলমান নি র্বি শেষে আশ্রয় নিয়েছিল সীমান্তের ওপারে, মুখ্যত রায়গঞ্জে আর বালুরঘাট এবং আশেপাশের ছোটবড় শহরে। রবিবাবু স্যার গিয়েছিলেন রায়গঞ্জে। আমি মুক্তিযুদ্ধের শুরুর ২১ দিন ছিলাম বাংলাদেশের ভেতরে, আনন্দবাজার পত্রিকার যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে। কলকাতায় ফিরে এসে শুনি, দিনাজপুরের সবাই উত্তরবঙ্গে। রায়গঞ্জে গিয়ে আমার চেনা পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা করি, রবিবাবুর সঙ্গেও। তখনো তিনি সেই টগবগে মাস্টার মশয়। শেষ দেখা ১৯৭৯ সালে। রায়গঞ্জে কী এক কাজে গিয়েছিলাম। তখন রাত। লন্ঠনের আলোর আধো অন্ধকারে স্যার শুয়ে আছেন মশারির ভেতরে, তাঁকে দেখার উপায় নেই। ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো, 'কতদিন দেখি না তোমাদের, অরুণ! বেশি দিন আর বাঁচব না।' তিনি আর বেশি দিন বাঁচেন নি। দিল্লিতে বসে খবরটা পেয়েছিলাম। স্কুলের ফুটবল টিমে জোর করে আমাকে নামানো, স্কুলের ফাংশানে আমাকে দিয়ে নাচ করানো, গান গাওয়ানো... সেই থেকে সব স্মৃতি হয়ে ঝুলে রইল আমার জীবনে।

আমাদের স্কুলে বাহাদুরের ছিল এক মস্ত ভূমিকা। বাহাদুর হেডমাস্টারের ঘরের বাইরে, হল ঘরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে একটা টুলে বসে থাকত। কোমরে খাপে বন্দী একটা ভোজালি। বাহাদুরের কাজ ছিল, বারান্দায় ঝোলানো ঘন্টা পিটিয়ে ক্লাশ শুরু আর শেষ, স্কুল শুরুর আর শেষের ঘন্টা বাজানো। বাহাদুর ছিল বেঁটে। বৃদ্ধ। কিন্তু গড়ণে শক্ত পোক্ত। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটা টিপের উল্কি। বাহাদুর হাসলে ওই উল্কি কপালের নানা ভাঁজের ঢেউয়ে ডুবে যেত আবার ভেসেও উঠত। আমার খুব মজা লাগত উল্কির ওই লুকোচুরি খেলা। কোমরে ভোজালি থাকলেও বাহাদুর ছিল সারা স্কুলের ছেলেদের কাছের মানুষ। আমাদের ছোটবেলায় একমাত্র পরীক্ষা দেয়ার সময় ছাড়া দোয়াত কলম চলত না। ডট পেনের তো দিনই শুরু হয় নি তখন। আমরা পেনসিলে লিখতাম। তখন পেনসিল  শা র্পে না রের চল হয় নি। তো বাবা কাকার দাঁড়ি কাটার ব্লেড ছিল আমাদের পেনসিল শা র্প করার একমাত্র মাধ্যম। আর স্কুলে বাহাদুর। পেনসিল ভেঙে গেলেই আমরা ছুটে বাহাদুরের কাছে যেতাম। ক্লাশ চলতে চলতে স্যাররাও  বাহাদুরের কাছে ছুটে যাবার অনুমতি দিতেন। বাহাদুর কোমর থেকে বিশাল ভোজালিটা বের করে আমাদের পেনসিল শা র্প করত। পেনসিলগুলো ওর হাতে যেন মাখনের এক একটা স্টিক। এখনো পেনসিল শা  র্প করতে গেলে বাহাদুরের ভোজালিটাকে মনে পড়ে। কিন্তু অত সুন্দরভাবে শা র্প করতে পারি না। একবার দু'বার শিস ভাঙবেই ভাঙবে। এই বাহাদুর আমার জীবন থেকে কীভাবে অন্ত র্ধা ন হয়ে গেল, মনে করতে পারি না। বাহাদুর আমাদের ক্লাশে ডাকত, আমাদের ছুটি দিত, আমাদের পেনসিল শা র্প করত। তাকে মনে রাখার মত আর কোন ঘটনা ছিল না বলেই তার অ ন্ত র্ধা  ন আমাকে নাড়া দেয়নি নিশ্চয়।

আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন মীর মুশাররফ হোসেন। ঋজুদেহী। কায়েদ--আযমের মত লম্বাটে রুক্ষ্‌ম মুখশ্রী। সেটা বোধয় উনি নিজেও জানতেন। তাই কায়েদ--আযমি টুপি পরতেন। খুব কড়া মানুষ। সারা স্কুল তাঁকে ভয় পেত। শিক্ষকরাও। আমরা তো বটেই। আমাকে স্কুলের সব মাস্টারমশয় স্নেহ করতেনপ্রশ্রয় দিতেনএকমাত্র আমাদের হেড মাস্টার ছাড়া। উনি ভারতের মালদা থেকে আগত রিফ্যুজি। মুস্লিম লীগ করতেন,শহরে লীগের নেতাদের সঙ্গে তার উঠবস ছিল। আমার বাবা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষহিন্দু। সেটা কোন কারণ কিনা তা বোঝার বয়স আমার যখন 'আমি স্কুল ছেড়ে দিলাম। সেটা একটা ঘটনা।

আমি গাইতাম ভালো। সেই সময়  'পাক সাদ জমিনপাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। আমাকে পাঠানো হল সেই গান শিখে এসে স্কুলের সবাইকে শেখাতে। জেলা স্কুলে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে শিখে এলাম গানটা। এসেমব্লিতে আমরা কয়েকজন জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে গেয়ে লীড দিতাম। সবার শেখা হয়ে গেলে আমিও দাঁড়াতে লাগলাম সবার সঙ্গেলাইনে। একদিনখুব রোদ্দুরএসেমব্লিতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শেষহেডমাস্টার বলছেন। এই সময় ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে চোখ দুটোকে সুবিধা দিতে আমার মুখটা একটু বিকৃত হয়ে গেছে। হঠাৎ তাঁর কথা বন্ধ করে স্যার গ র্জে ওঠেন, 'এই অরুণআমি হেডমাস্টার বলছিআর তোমার হাসি পাচ্ছেতুমি জাতীয় সঙ্গীতকে অপমান করছ, জানো?' ক্লাশ নাইনে পড়িএই 'অপমানশব্দটার ইঙ্গিত বুঝতে বাকি থাকে না। তিনি আমাকে লাইন ছেড়ে বাইরে দাঁড়াতে বলেন। আমি লাইনের বাইরে দাঁড়াই। কয়েক দিন পরে জেলা স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে যাই। আমাদের এসিস্ট্যান্ট হেড স্যারমৈনুদ্দীন সাহেব (মেথর পাড়ায় যাবার রাস্তায় থাকতেননামটা ঠিক হল  কী?) নতুন স্কুলে আমার ভ র্তি র ব্যাপারে সাহয্য করলেন। স্কুলের সঙ্গে আমার আট বছরের সঙ্গ ত্যাগ আমাকে একটুও দুঃখ দিল না।

কষ্ট পেলাম জেলা স্কুলে ঢুকে। এটা আমার স্কুল না। এটা ওদের স্কুল। যাঁরা আমাদের শাসন করেযাঁরা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিভিলেজডতাদের স্কুল। আমার সহপাঠী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদুরে ছেলেএক রায় সাহেব বাহদুরের নাতিজেলার প্রধান কাস্টমস অফিসারের ছেলে এমনি আরো অনেকে। এদের জন্য ক্লাশের ছাদ থেকে ভারী কাঠের বীমে ঝোলানো মাদুরের শক্ত পাখা দেয়াল থেকে  দেয়ালদোলে। পাখা নাড়ায় দেয়াল ভেদ করে বাইরে চলে যাওয়া দড়িটাএক জ রা জী র্ণ বৃদ্ধ চাচা সেটা টানেন দুলে দুলেসারাদিন। আর ভেতরে হাওয়ায় চুল ওড়ে ,বইয়ের পাতা ওড়ে আমাদের সকলের। নিষ্ঠুরতার এমন শিক্ষা দিয়েই তৈরি হয় এখানে ভবিষ্যতের আমলা। আমি আমলা হতে চাই না। এদের সকলের পায়ে চামড়ার জুতো। এখানে বাঙালিরাও পড়ে বিহারীরাও। এই স্কুলে টিফিনের সময় মুসলমানদের জন্য পেটভরা লুচি আলুর দমহালুয়া বা মিষ্টিহিন্দুদের জন্য পেটভরা রাধা বল্লভী সন্দেশ রসগোল্লা... না না এটা আমার স্কুল হতে পারে নামনে হল। দম বন্ধ হয়ে আসে। মহারাজা স্কুলের জন্য মন খারাপ হতে থাকে। টিফিন দিত না আমাদের স্কুলআমরা মনের আনন্দে স্কুলের টিফিন টাইমটাকে ছুটির টাইম করে দা র্জি লিং রোডের ওপারে টম্যাটো আর ম ট র শুঁ টি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতাম। আমাদের সবার পায়ে জুতো থাকত বা থাকত না। আমাদের গরম লাগত না। খাতা নাড়িয়েও কোনদিন হাওয়া খেয়েছি মনে করতে পারি না। আমাদের স্কুলে বিহারী বন্ধু ছিল না। পাড়ার বিহারী বন্ধুরা যেত ইকবাল স্কুলে উর্দু মাধ্যমে পড়তে। আমাদের স্কুলে গরীব আর মেধাবীদের পড়তে সাহায্য করার জন্য স্কলারশিপ চালু ছিল। আমি হাফ ফ্রিতে পড়তাম।

জেলা স্কুলে এসে অনুতাপ হচ্ছিলতবে হেডমাস্টারের কারণে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ বোধ করতাম না। সময় সব কিছুকে সামলে নেয়। জেলা স্কুলে ছিলেন সেই সময়ের নামী কবিকাদের নওয়াজ। আমি অমরের (আমার মেজদাছোট ভাইশুধু এই পরিচয়েই আমাকে ভর্তি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমার প্রতি ওঁর নজরদারির সঙ্গে সৃষ্টিশীল হকিস্টিক স্যার আর ইংরেজির দুর্মুজ স্যার আমাকে গ্রাস করে নিলেন। এমন নামে তাঁরা কেন পরিচিত ছিলেন জানা হয় নি। হকিস্টিক স্যার আমাকে উৎসাহিত করলেন আমার সাংস্কৃতিক দিকটায়, দুর্মুজ স্যার গড়ে তুললেন আমার এক রোখা চরিত্র। আমাকে এভাবে একসময় স ম্পূ র্ণ গিলে ফেলল জেলা স্কুল।

তবে মহারাজা স্কুল ছেড়ে আসার দুঃখ আমার চিরকাল ছিল। বিশেষ করে হেডমাস্টার মীর মোশাররফ হোসেনের বুকের ভেতরটা ঝুঁ কে দেখার যেদিন সুযোগ পেলাম, সেদিন থেকে দুঃখের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুতাপ। আমি তখন ভারতে। ১৯৬৪ সাল। দিনাজপুরে গেলাম পুজোর ছুটিতে। সেদিন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। লন্ঠনের আলো জ্বলছে সব বাড়িতে। স্যারের বাড়িতেও। ওঁর কারণে স্কুল ছাড়তে পারি, কিন্তু এই দী র্ঘ বিচ্ছেদে কেবলই মনে হয়েছে কোথাও আমার  ভুল ছিল। আমি ওঁকে ভুল ব্যাখ্যা করেছিলাম। আমাকে ওই সময় দেখলে যে কারো মনে হতেই পারত, আমি হাসছি, বিশেষ করে দূর থেকে দেখলে। ছাত্রদের মধ্যে শ্রদ্ধা এমনি জাগে না, জাগাতে হয়। তিনি হয়ত সেই চেষ্টা করেছিলেন। আমি এক তরফা ব্যাখ্যা করে এক তরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুল ছেড়েছিলাম। বাড়িতে ঢুকেই স্যারের ছেলে, আমাদের বছর তিনেকের সিনিয়র, পান্নাদা, তার নাম ধরে ডাকি। উত্তরে স্যারের গলা, 'কে?' আমি বলি, 'আমি অরুণ। অরুণ চক্রবর্তী।' স্যার প্রায় ছুটে এলেন, হাতে লন্ঠন, 'অরুণ? তুমি?' লন্ঠন উঁচিয়ে আমাকে নীরিক্ষণ করলেন, নীরবে। 'কোথা থেকে এলে, বাবা?' আমি তাঁর দু' পা ছুঁ য়ে প্রণাম করি। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, সাঁপটে।  আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই বলতে থাকেন, 'এ তোমরাই পার। তোমাদের পরিবারই পারে শিক্ষকের প্রতি এমন শ্রদ্ধা জানাতে...' অনুতাপে আমার চোখে জল এসে যায়।

তারপর ৩০ বছর কেটে গেছে। ১৯৯৫ সাল। একটা খামে ভরা চিঠি। বয়ানটা ঠিক মনে নেই। তবে এই রকম, 'বাবাঅরুণ। আমি  আমার স্ত্রী মালদা থেকে সকালে রওনা হয়ে দিল্লি পৌঁছুবো রাতেএকটা থাকার জায়গা করে রাখলে ভালো হয়...' আমি আত্মহারা। আমার এতদিনের অপরাধের প্রায়শ্চিত্তের এই মহা সুযোগ। ছেলে মেয়ে আর বউকে বললাম আমার জীবনের মস্ত বোকামীর কথা। স্যারের মুখটা ভোলবার নয়। কায়েদ--আযম। অনেক লেটে গাড়ি এলোপ্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে। আমার বন্ধুর গেস্ট হাউসে স্যার উঠলেন। এসেছেনমূল উদ্দেশ্যআজমীঢ়ে ফকির হয়ে যাওয়া ছোটছেলের খোঁজে। আমি স্যারকে নিয়ে দিল্লিতে নানা জায়গায় ঘুরলামসবার সঙ্গে পরিচয় করালাম। আমার মাস্টার মশয় আর দিদিমণিকে। স্যারের চারপাশে অনেক মানুষের আনাগোণা শুরু হয়ে গেল। ডাক্তারলেখকসাধারণ মানুষ। এমনকি গেস্ট হাউসে মেয়ের বিয়ে দিতে আসা নাগপুরের কণ্যাপক্ষমাস্টারমশয়কে ছাড়লেন না। দিদিমণিকে বসিয়ে দিলেন মেয়েদের নানা কাজের মাঝে। দিদিমণি লজ্জায় সিঁটিয়ে থাকেন। যাবার দিন ঘণিয়ে এলো। স্যার বললেনতোমার বৌ ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছবি তুলব। আমার ছয় কপি চাই। আমার ছেলে মেয়েদের দেব। তোলা হল। স্যার ফিরে গেলেন। যাবার সময়তিনি আমাকে ধমকে (মনে পড়ে গেল পুরানো দিনবগি থেকে নামিয়ে দিলেন। 'তুমি নামো, নামো নইলে আমি কেঁদে ফেলব।আমি হতভম্ব।  প্লয়া টফ র্মে দাঁড়িয়ে থাকি। বিমূঢ়যতক্ষণ না ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে গড়াতে থাকে।

১৯৯৭ সাল। স্যার তখন বালুবাড়িতে এক দোতলায় থাকেন। সঙ্গে দিদিমণি। দেখা করতে গেলাম। দেয়ালে আমাদের ছয়জনের সেই ছবি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, 'আমার বাড়িতে মাত্র এই একটি ছবি। তোমাদের এই ছবি। আর কারুর কোন ছবি আমি রাখিনিরাখব না।স্কুলের সেই এসেমব্লি থেকে এই মুহূ র্ত টা অবধি সব স্মৃতি প্লাবণের মত ধেয়ে এলো আমার চোখে। আমি কেঁদে ফেললাম।


----------------------------------------------



26.  //কল্যাণগঢ় কলোনি //

মনুদার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। স্টিম ইঞ্জিন, লাল বগি, ভীড়। উঠে পড়ি ভেন্ডারদের জন্য নির্দিষ্ট কামরায়। বসার চেয়ে দাঁড়াবার জায়গা বেশি। বাড়ি ফিরছে সবাই। ক্লান্ত। ঘর্মাক্ত। খালি ঝুড়ি, ভিজে বস্তা, মাছের খালি বালতি টিন, দড়ির গোল্লা আগলে বেঞ্চে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমি দরজার কাছে দাঁড়াই। হাবড়া? তা এক ঘন্টা, বা তারও বেশি, জানাল একজন। উল্টোডাঙ্গা দমদম আসতেই হুড়োহুড়ি, স্রোতের তোড়ে ভেতরে সেঁধিয়ে যাই। ঐ ঝুড়ি, বস্তা। মাছের খালি বালতি টিন নেই এই যা। কামরা ভরে গেল। ঠাসাঠাসি। গরু ছাগলের মত একে অন্যের গায়ে হেলান দিয়ে ব্যালানস করে করে দুলতে থাকে। বারাসত আসতে কামরা বদল করি। বসার জায়গা পেয়ে যাই। হাবড়ায় আমার রাঙ্গামাসী থাকেন, মা'র রাঙ্গাদি। মণি মা বলেছিলেন, 'একবার যাস রাঙ্গাদির কাছে। খুশি হবে।' অনেক দিন কেটে গেছে। একদিন মনুদা আসতেই, ঠিকানাটা চেয়ে নিই। আজ যাচ্ছি।

হাবড়ায় নেমে রিকশা করতে হল। কল্যাণগঢ় বাজার দূরে। রিকশাওয়ালা বলল, অশোকনগরে নামলে কাছে হত। জানলাম। কল্যাণগঢ় বাজার মানে ছোটখাট একটা বাজার, খুব সাধারণ কিছু জিনিসপত্রের  দোকান। কাপড়ের, তরি-তরকারির, মশলাপাতি, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, চাল ডাল, খাতা পেনসিল, শাড়ি ব্লাউজ এই সব। তো এই বাজারে আছেন হারুদা, রাঙ্গামার বড় ছেলে, আমাদের বড়দার চেয়ে বয়সে বড়। কোন দর্জির দোকানে কাজ করেন। মনুদা বলেছিলেন, 'কল্যাণগঢ়  বাজারে হারু চক্রবর্তীর নাম বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে দাদার দোকান।' হলও তাই। রিকশা থেকে নেমে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করতেই পেয়ে গেলাম। দরজির দোকান তখন খোলেনি। আমার পরিচয় পেয়ে দোকানী বললেন, 'আজ দেরি হতে পারে। বেশি দূরে না। হাঁটা পথ। তুমি ওর সঙ্গে যাও। হারুদার বাড়ি ওইই তোমাকে পৌঁছে দেবে।'

সঙ্গী আমার থেকে বয়সে কিছু বড়। হাঁটা পথ বলতে যতটা ছোট পথ বোঝায়, হারুদার বাড়ি তা থেকে অনেক লম্বা। সঙ্গী পথটাকে ছোট করার চেষ্টায় কল্যাণগঢ়ের নানা কথা বলতে বলতে চলতে থাকেন। বুঝলাম, তিনি রাজনীতির লোক, এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থক। হারুদা এলাকার একজন নেতা। আশোকনগর-হাবড়ার এই রিফ্যুজি কলোনীর নাম বিধান রায় একজন জ্যান্ত কংগ্রেসীর নামে, আইনমন্ত্রী অশোক  সেনের নামে  কেন গড়লেন, তার ব্যাখ্যা তার কাছে হ'ল, কম্যুনিস্টদের এই ঘাঁটীটার ঘাড়ে কংগ্রেসের ছাপ মেরে দেয়া। এটা বিধান রায়ের একটা চাল। এলাকাটা ছিল, বৃটিশ এয়ার ফোর্সের রানওয়ে। বিধান রায় তার ওপরেই গড়ে তুললেন অশোকনগর-হাবড়ার বিশাল রিফ্যুজি কলোনী। অশোকবাবু পরে নেহরুর আইনমন্ত্রী হয়ে আছেন দীর্ঘকাল, কিন্তু এই এলাকা কংগ্রেসীদের হাতে নয়, রয়েছে বঞ্চিত মানুষের হাতে। কংগ্রেস দাঁত ফোটাতে পারেনি। আমার অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই, তাই সঙ্গীর কথাগুলোকেই মেনে নিচ্ছিলাম। এই কলোনীর লোকেদের চাকরি নেই। জমি নেই। দলমা ঘেরা বাড়ির বেড়ার বাগানে যা তরিতরকারি ফলে তা দিয়েই হয় দিন গুজরান, বাড়তি কিছু থাকলে যেমন, আম, জাম, কপি, মূলা, বেগুন সেসব নিয়ে সবাই যায় কল্যাণগঢ় বাজারে। সেখানে ছোট ছোট মহাজনরা তা কিনে চলে যায় কলকাতায়। তারা বেশি লাভে বিক্রি করে ফেরে। সঙ্গী কলকাতায় একবার গিয়েছিলেন। বাড়ির সজনে গাছে সেবার অনেক ফলন। এক বস্তা সজনে ডাঁটা নিয়ে ট্রেনে চেপে বৈঠকখানা বাজেরে বিক্রি করতে। কিন্তু স্টেশনে কামরা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একজন হামলে তা কিনে নেয়। পরে বাড়ি ফিরে শোনে, বাজার অবধি পৌঁছুতে পারলে বা ফুটপাথে বসে পড়তে পারলে অনেক বেশি টাকা পেত সে। তারপর, যা ফলন হয় কল্যাণগঢ় বাজারেই বিক্রি করে দেয়। ট্রেনের ভাড়া পুলিশের গুঁতো এসব থেকে তো রেহাই পাওয়া যায়! এখন কল্যাণগঢ়ের বড় ব্যাবসা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের চালের পাচার। কল্যাণ্গঢ় বাজারের ছোট মাঝারি বড় সব মহাজনই এই চালের ব্যবসা করছে। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে অনেক মহিলাকে কাজে লাগায় তারা। ট্রেনের ভাড়া দেয়, আর পাঁচ ছয় কেজির এক একটি পোঁটলা নিয়ে মেয়েরা আলাদা আলাদা ট্রেন বা কামরায় বসে কলকাতায় পৌঁছে যায়। সেখানে মহাজনদের এজেন্টদের হাতে তুলে দেয় ওই সব পোঁটলা। কম্যুনিস্টরা এ কাজে বাধা দেয় না কাউকেই। কলোনীর হত দরিদ্র মানুষের আয়ের আর কোন উপায় তো নেই চারপাশে!

ঠিক তাই। ডানপাশে আকন্দের ঘণ বেড়া। বেড়ার ঘেরে নানা গাছ গাছালি। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুটো টিনের ছাউনি দরমা বেড়ার দুটি কুটির। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ সঙ্গী চেঁচিয়ে ডাকে, 'ও হারুদা! দ্যাইখে যাও কারে আনছি। তোমার কুটুম গো!' রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, ডান দিক থেকে এসেছে একটা মেঠো পথ, সে পথে বাঁক নিতেই, ডান দিকে। একটা ময়লা সাদা থান পরনে, কাঁচাপাকা চুলের বুড়ি। মুখে শরীরে অসংখ্য বলি রেখা। আমার মায়ের মুখের আদল। বুঝে ফেলি, রাঙ্গা মা। 'তুই ব্যাইবলা না?' কাঁপা কাঁপা হাত পা শরীরে বুকে জড়িয়ে ধরেন।'মনুরে বললাম, নিয়ে আয় নিয়ে আয়, তার তো আর দেখা নাই। একা আসতে পারলি?' মায়েদের অহেতুক উৎকন্ঠা। আমি তো এসেই গেছি! বলি না। রাঙ্গামা আমাকে একইভাবে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আসেন উঠোনের মাঝখানে। চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকেন। 'ওরা তোরা দ্যাখ, কেডা আইছে।' গলা আরো চড়িয়ে পাশের বাড়ির দিকে হাঁকলেন, 'অ প্রভাত! প্রভাত! আয় দ্যাখে যা, ব্যাইবলা আইছে রে!'

বাড়িতে আর ছিলেন বৌদি। একটা ময়লা লালপেড়ে শাড়ি জড়ানো রোগা লিকলিকে শরীর। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বিস্ফারিত আন্তরিক দৃষ্টি। ছবিদি, নীল রঙ্গের শাড়ি। টান টান করে বাঁধা কালো কুচকুচে চুল, বেণিতে লালা ফিতে। 'মা, আমি বাবলুকে কখনো দেখেছি?' আমি ইয়ার্কি করি, 'আমি তো দেখেছি। তখন তুমি এত্তটুকুন।' দাওয়া থেকে ছুটে নিচে নামেন, 'কী বিচ্ছুরে বাবা!' ছবিদি আমার মেজদার বয়সী, রাঙ্গামা বললেন। মীনুদি, আমার ওপরের দাদা বাচ্চুর চেয়ে বড়, তখন ট্যুশানিতে, দেরি হবে ফিরতে। হারুদা এখন পার্টি অফিসে। ফেরার সময় হয়েছে। প্রভাতদা এলেন, মামাবাড়ির দূর আত্মীয়, রাঙ্গামাদের এক-ই গ্রামের মানুষ। একসঙ্গে দেশত্যাগী। পাশাপাশি জমি পেয়েছেন। প্রভাতদার দাদা একসময় ছিলেন দিনাজপুরে, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। তবলা বাজাতেন, গানও গাইতেন। আমি ফাংশনে জল তরঙ্গ বাজালে, তিনি সঙ্গত করতেন। নামটা মনে করতে পারছি না এখন।

হারুদা ছোটমামার মত। কৃষঞকায়, টানটান শরীর ঋজু ভঙ্গি। কম কথার মানুষ। পাশের ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে আমাকে ডেকে নিলেন। সবার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। মা, ছোটমামা, বড়মামা, বাবা, পাকিস্তানের রাজনীতি, সেখানে বিহারী উদবাস্তুদের অবস্থা। একসময় বললেন, 'আমাদের এখানে অবস্থা ভালো না। সবচেয়ে বড় অন্তরায় রোজগার। দত্তপুকুর থেকে বনগাঁ বিশাল এলাকার নানা জায়গায় রিফ্যুজিরা মরিয়া হয়ে বাস করছে। কিন্তু রোজগার নেই। শিক্ষা নেই তো চাকরি নেই। চাকরি নেই তো অর্থ নেই। অর্থ নেই তো রোজগারের সব পথ বন্ধ। প্রত্যেকটা পরিবারে জীবন ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। সংগ্রামের সঙ্গে মিশছে স্মৃতি-কাতরতা...' একসময় মনে হল, হারুদা নিজের কথাই বলছেন। আর আমার যেন চোখ ফুটছে। আমার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের জীবন যাপন কি অন্য রকম? শিক্ষাটার জোরে আমি কিছু রোজগার করতে পারছি বটে, সত্যি, ওই মূলধনটা আমার না থাকলে, আমিও  কি হারুদাকে এই গল্পই শোনাতাম না? সারা পরিবেশটার সঙ্গে অজান্তে একাত্ম বোধ করতে থাকি। তাই দুপুরে মৌরালা মাছের সলসলে ঝোল দিয়ে হাপুস ভাত যখন খাচ্ছিলাম (আজও ভুলতে পারি না সেই স্বাদ), আর রাঙ্গামা ধমকের সুর তুলে বললেন, 'তুই আজ থাইকে যাবি। কাল যাবি গা কলকাতায়', বৌদিকে বলি, 'এমন মৌরালা যদি কালকেও খাওয়াও, থেকে যাব।' সবাই খুশি। আমি থেকে গেলাম। বৌদি তাঁর একটা ধোয়া শাড়ি দিলেন। আমার লুঙ্গি।

-------------------------------------



//পাঁচবন্দ্ধু //


কলেজে ফার্সট ইয়ার শেষ হবার আগেই  কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে আমি গেঁথে গেলাম। অভীকদের পরিবার, সেখানে মাসিমা, মেশমশয় আর দিদি। অর্জুনদের পরিবার, সেখানে মাসিমা মেশমশয় আর দুই ছোটবোন, আর এক ভাই, সে আংশিক পঙ্গু ও খাটো বুদ্ধির। সত্যদের পরিবার, মাসিমা, মেশমশয়, সত্যের দুই দাদা আর এক ভাই, দুই বোন, সবচেয়ে ছোট, সে বোন, বধির। সত্যের বাবা ছাড়া, বাকি দুই মেশমশয় আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না, সেটা ওদের হাবভাব থেকেই বুঝতাম। মাসিমারা আমার হাত শক্ত করে ধরে না রাখলে, ওই দুই পরিবারে আমার অবাধ বিচরণ সম্ভব ছিল না। এভাবেই আমার জীবনটা নিঃসঙ্গতা থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে থাকে। আমিও কলকাতা জুড়ে আমার হাত পা মেলতে থাকি।


অভীকরা আমাদের মধ্যে সবার থেকে ধনী এবং আধুনিক ও সংস্কৃতিবান। অভীকের বাবার দিকের কাউকে আমরা দেখিনি, চিনিওনি। মা'র দিকের সবার সঙ্গে পরিচয় ছিল, ভালোবাসা ছিল। কোনদিন সকালে গেলে, দিদা হাতে একটা কলা ধরিয়ে দিতেন, 'সকালে কলা খাওয়া মানে সোনা খাওয়া, খাও।' দাদু আমাকে ডাকতেন 'ব্লাডি বেঙ্গলি' বলে। একদিন আলোচনার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওটা উচ্চারণ করেছিলাম, সেই থেকে। অভীকের বড় মামা, মেজমামা, সেজমামা এবং দুই মাসি সবাই খুব রসিক আর আন্তরিক ছিলেন। খুব মজা করতাম এদের কেউ বেড়াতে এলে। ছোটমামা, মানসিক জড়বুদ্ধি, আমাকে ডাকতেন, 'অনম।' আমাকে ভালোবাসতেন। অর্জুন বা সত্য ওঁকে উস্কে দিলেও আমার ওপর ক্ষেপে উঠতেন না, জড়ানো জিভে বলতেন 'অনম ভালো।' মাসিমাদের পরিবার ছিল প্রবাসী বাঙালির পরিবার। কানপুরের বাসিন্দা ছিলেন ওরা। দাদুদের ছিল বড় পরিবার। প্রবাসীদের সব গুণাবলী ওদের মধ্যে ছিল। পরমত সহিঞষুতা, রুচিশীল, শিষ্ঠাচারী, সংস্কৃতিবান, আর সব ভাষার মানুষকে যথাযথ সম্মান করার শিক্ষা। মাসিমাদের পরিবার আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করত, বিশেষ করে মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে।


এই সময়ে আমাদের চার বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল পাঁচ। সেটা চন্ডীদাসের কারণে। অভীকদের পাড়াতেই চন্ডীদের বাড়ি। কলেজস্ট্রিটেই পাড়ার নাম করা মিষ্টির দোকান ওদের। পারিবারিক ব্যাবসা। বাবার মৃত্যুর পর, বড়দা নেই, পাঁচ ভাইয়ের সংসার। একটা লম্বাটে তিনতলা বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবার। মেজদা বাড়ির কর্তা। হাওড়ার শহরতলীর মানুষ ওরা। ব্যবসার বাইরে ওদের জগত নেই। লেখাপড়াও না। চন্ডী ব্যতিক্রম। বিএ পড়ে, আমাদের কলেজে না। পূব কলকাতার গুরুদাস কলেজে। চন্ডী আমাদের মধ্যে সবচাইতে সরল ও সৎ. সাধারণত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলেমেয়েরা সর্বাঙ্গে ধূর্ত হয়, চন্ডীর মধ্যে সে গুণাবলীর ছিটেফোঁটাও নেই।


আমি বেশি ঘণিষ্ঠ ছিলাম অর্জুনদের পরিবারের সঙ্গে। খুলনার ছিন্নমূল পরিবার। দুই ভাই আর দুই বোন ওরা। ছোটভাই, সবার ছোট, আংশিক পঙ্গু ও খাটো বুদ্ধির, বোনেরা অর্জুনের চেয়ে ছোট। মেশমশয় সাধারণ সরকারি করমচারি। মাসিমার কাছে ছিল আমার যত আব্দার, কখনো সখনো ওদের আর্থিক অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে যাচ্ছেতাই আব্দার করে বসতাম। অর্জুন ছিল রাজনীতির ছাত্র ও কর্মী। সেটা টের পেতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিল। আমাদের সঙ্গে মেলামেশার সময় ওর রাজনৈতিক বক্তব্য বা রাজনৈতিক নীতি বা দলের কথা আলোচনা করত না। অর্জুন নিটোল ভাবে তার রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক চরিত্রকে আলাদা করতে পারত। তাই আমাদের সঙ্গে মেলামেশায় তার কোন খামতি ছিল না। অর্জুন ছিল কম্যুনিস্ট।


বেলেঘাটার এক গলিতে ছিল অর্জুনদের এক ঘরের বাড়ি। ইঁটের দালান। পিছনে বেড়া দিয়ে রান্না ঘর। তারপাশে টিউব কল। খাটা পায়খানা, অদূরে। ঐ একটি ঘরেই থাকত ছয়টি মানুষ। ঘরটা মণিমাদের ঘরের থেকে বড়। খাটটা ইঁট দিয়ে উঁচু করা। আমরা বন্ধুরা এলে, খাটের নিচে মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে গুলতানি মারতাম। মাসিমা, মেশমশয় আর বোনেরা ওপরে। একতলা দোতলায় চিৎকার করে চলত আমাদের কথপকথন। এরই মাঝে মাসিমা চা দিতেন, ভাইয়ের চিনিমাখানো ছানা থেকে এক খাবলা আমাকেও দিতেন, বন্ধুদের আর কারো এই সৌভাগ্য হত না। আমি ওই ছোট্ট আননদ্ঘণ সংসারটিতে ছিলাম সপত্ম সদস্য। এজন্য অর্জুনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের চেয়েও কয়েক পরত গভীর ছিল। সকাল হোক, বিকেল হোক বা রাত্রি, শিয়ালদা থেকে পায়ে হেঁটে মাসিমার কাছে পৌঁছে যাওয়া আর ভাইবোনগুলোকে নিয়ে হুল্লোড় করার অবাধ ছাড়পত্র ছিল আমার কাছে।


সত্যদের বাড়িতে আমরা কম যেতাম। সেটা মুখ্যত, ওদের বাড়িটা ছিল একটেরে জায়গায়। কেশব সেন স্ট্রিটের এক কানা গলিতে। দোতলায়। দুটি মাত্র ঘর নিয়ে। মাসিমা মেশমশয়, চার ভাই দুই বোন। রাতে  কখনো ওদের বাড়ি যাইনি, তাই জানি না, ওই দুই ঘরে, একটা ঘর তো একটা ডবল বেড খাটেই ভরা, কী করে ওরা ম্যানেজ করত। আমার অবশ্য কোন অসুবিধা হত না। আমি যখন খুশি চলে যেতাম, কলেজের কাছেই ছিল ওদের বাড়ি। বোনেদের নিয় হুল্লোড় করতাম। সত্যের ছোট বোনটা, শিউলি ছিল বধির। আমার ওকে নিয়েই কাটত বেশি সময়। আমাকে দেখলে শিউলিও লাফিয়ে ঝাপিয়ে একশা করত। মেশমশয় বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু তাঁর চোখে মুখে প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত খুঁজে পেতাম। মাসিমা ছিলেন রসিক। আমাদের সঙ্গে খুব রসিকতা করতেন। তাই এই বাড়িটাতে ছিল রাশি রাশি হাসির পরিবেশ।


আমরা দিনের পর দিন কী নিয়ে আড্ডা দিতাম এখন আর মনে নেই, অথচ প্রতিদন আমরা পাঁচজন মিলিত হতাম। কোনদিন আমজাদীয়ায়, কখনো অভীকদের বাড়িতে, বা অভীকদের বাড়ির কাছেই কলেজ স্কোয়ারের বিখ্যাত প্যারামাউন্ট সরবতের দোকানে, কোনদিন সত্যদের বাড়ির কাছে কেশব সেন স্ট্রিটের রকে। আমাদের মধ্যে একমাত্র অভীক ছিল ট্যালেন্টেড। গান লিখত, হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর দিত, কবিতা লিখত, নাটক লিখত, সুন্দর বাংলায় কথা বলতে পারত। মুখে একটি হাল্কা খিস্তিও ছিল না ওর। খিস্তিবাজ ছিল সত্য। নানা আড্ডা থেকে সংগ্রহ করা খিস্তি দিয়ে কথা বলত। একটা সুরসুরি অনুভব করতাম সে সব শুনে। চন্ডী গালাগাল দিতে জানত না। অভীকের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে নাড়াঘাটার চেষ্টা করত বটে, পারত না। অর্জুনের রাজনীতির জগতটা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল, আমাদের আগ্রহও ছিল কম। ওদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে ছিল একটি তেতলা বাড়ি। উচ্চমধ্যশ্রেণী। সে বাড়ির সবাই অর্জুনকে ভালোবাসত। কিন্তু অর্জুন এক প্লেটনিক প্রেমে জড়িয়ে গিয়েছিল ওই বাড়ির ছোটবোনের সঙ্গে। আমাদের পাঁচজনের জীবনে প্রথম প্রেমের ছোঁয়া। অধরা যদিও। আমি কোনদিন অরুন্‌দ্ধতীর সঙ্গে কথা বলিনি, কিন্তু সে আমাদের প্রত্যেককে চিনত, অর্জুনের কথায়। তাই অরুন্‌দ্ধতীকে আমরা সাড়ে পাঁচজনও ভাবতাম অনেক সময়।


আমরা পাঁচবন্ধু একটি বৃত্তে থাকলেও, আমাদের প্রত্যেকের এক একটি আলাদা বৃত্ত ছিল। আমার সেই বৃত্তে ছিল কাইজার স্ট্রিট, ইংরেজি সিনেমা, এস্প্লয়ানেডের নানা সুসজ্জিত দোকান রেস্তোরাঁ, যদিও সেসবে আমার প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত, আমার পকেট নির্ভর। অর্জুনের বৃত্তটা ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির লোক্যাল অফিস জোনাল অফিস আর রাজপ্নৈতিক দাদা বয়ান্ধুদের নিয়ে। চন্ডীর বৃত্ত ছিল সবচেয়ে ছোট। ওদের মিষ্টির দোকান, আর অভীকদের বাড়ি। অভীকের বৃত্তটা ছিল বড় আর রঙীন। সিনেমার ফোটগ্রাফি, বিজ্ঞাপনের কপি লিখয়ে, রেডিওর গান লিখিয়ে, পত্রিকা, গল্প-কবিতা লিখিয়ে এরা ছিল অভীকের সেই বৃত্তে। যদিও  ওদের কেউই ওই সবে সরাসরি যুক্ত ছিল না। 


সত্যের বৃত্যটা ছিল সবচেয়ে বৈচিত্র্যের। ওদের বাড়িটা ছিল কেশব সেন স্ট্রিটের দুই নামকরা মস্তানের দুই পাড়ার মাঝখানে। ওই এলাকায় সবারই বাড়ি ছোট, শোবার জায়গার বাইরে জায়গা থাকে না। তাই সত্যদের পাড়ায় রকবাজির কদর খুব বেশি। আর রকবাজির মজা হল, নানা ধরণের মানুষের উপস্থিতি ।  ওই সব রকের আড্ডডাবাজ আমিও ছিলাম। সত্যর এক বন্ধু, নাম মনে নেই, স্কুল পাশ করে নি, কলেজে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। আমি যখন একদিন ওকে একা পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলাম, 'তুই কি করবি? মোট বইবি নাকি?' বুকটান জবাব দিয়েছিল সে-- ' আমি মস্তান হবো। এটা মস্তানদের যুগ। দেখছিসনা আমাদের পাড়ায়? দু' দুটো কালীপূজা? গোটা কলকাতার সেরা পূজা। কালীপূজার সময় গোটা কলকাতা এখানে ভেঙে পড়ে। কেন? কি করে? লীডাররা আসে, বিশ্বজিৎ আসে, উত্তমকুমার আসে, বিকাশ রায়, স্প্রিয়া কে নয়? কিসের জোর? এর জোর'-- সে তার রোগা হাতের মাসল ফোলায়। আমি সেই প্রথম জানলাম, কলকাতায় মস্তান হওয়াটাও এক একজনের অ্যাম্বিশন হয়। সত্যের মধ্যে এসব দেখিনি। সে পড়াশুনো করত, ভাই বোনদের শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। আমাদের সঙ্গে মিশত, কোন মস্তানির রেখা মাত্র দেখিনি। তবে আমাদের মধ্যে সত্য ছিল সবচেয়ে চতুর। অর্জুন বুদ্ধিমান, অভীক সরল, চন্ডী মানুষকে খুশি রাখতে পারলেই ধন্য। আমি ওদের প্রত্যেকের জীবনেই নিজেকে যুক্ত করে মুক্তির স্বাদ পেতাম। আমার মধ্যে সিনেমার ডাইরেক্টর হবার সাধ যেমন হত, তেমনি ভাবতাম, রাজনৈতিক নেতা হলে লাভ বৈ ক্ষতি তো নেই। আবার এও মনে হত, মস্তান হওয়া খারাপ কী? রবিন হুডও ত মস্তানই ছিল? আবার মনে হত, কলেজ স্ট্রিটের পাব্লিশার হয়ে যাই, ব্যাবসা করি। কলকাতায় সবাই তো সবই পারে। তাহলে আমি পারব না কেন?  ছোট থেকেই তো সবাই বড় হচ্ছে! শুধু শুরু করতেই মানুষ যা দেরি করে ফেলে।


-----------------


24. //ভগবান না আল্লা ? //

  
আমি কোনদিন ভালো ছাত্র ছিলাম না। তবে ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলাম। এতে অবশ্য আমার কৃতিত্ব শূণ্য। শহরে আমাদের পরিবারের সুনাম ছিল। সেটা বাবা-মা' কারণে। ওঁরা দেশভাগের আগে থেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। দু'জনেই জেল খেটেছেন। আমার জন্ম ১৯৪৫ সালে। মানে আমার ছোটবেলাটা কেটেছে দেশভাগের গাঢ় ছায়ায়। দেশভাগের পরেও, পাকিস্তানী আমলে, বাবাকে যখন তখন যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখেই পুলিশ অ্যারেস্ট করত। একটু বড় হয়ে বুঝেছি, সেটা রাজনৈতিক কারণে যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি বাবা হিন্দু বলে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া একটি ঐশ্লামিক দেশে, যে কোন হিন্দুকে ভারতের চর আর রাষ্ট্র বিরোধী প্রমাণ করা খুব কঠিন ছিল না। বাবা এটা জানতেন, তবু দেশত্যাগ করবেন না, পণ। বলতেন, লড়াই তো এইখানেই। কায়েমী স্বার্থরা তো এভাবেই শাসনকাল বহাল রাখে। দেশভাগের পরে স্বাধীনতা-পূর্ব দিনাজপুরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ একেবারে ধ্বসে যায়। সেটা সম্ভব হল, দেশে মালদা, বর্ধমান, বিহার অন্যান্য জায়গা থেকে আগত উদবাস্তুদের কারণে। শিকড়ছিন্ন মুসলমানদের পক্ষে হিন্দুদের বিশ্বাস করার বিশেষ কোন কারণ থাকার কথা নয়। দিনাজপুর শহরটা ছিল হিন্দু প্রধান আর গ্রামাঞ্চল ছিল মুসলিম প্রধান। তাই যখন দলে দলে হিন্দুরা শহর খালি করে প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে, একে একে কমে যাচ্ছে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা, তখন উদবাস্তুরা এসে যে শহরের দখলদারি নেবে, অবাকের না। আমাদের পরিবার আদি মুসলিম বাসিন্দাদের কাছে সম্মানিত হলেও, উদবাস্তুদের কাছে সম্মানিত ছিল না। বাবা দেশভাগের এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতাকে মানতে নারাজ। তিনি গোটা বিষয়টাকে দেখলেন আদর্শের দিক থেকে। কম্যুনিজমের কেতাবী দৃষ্টিকোণ থেকে। এজন্য কম কষ্ট ভোগ করলেন না। শুধু জেল নয়, শীত গ্রীষ্মে একাকী সেলেও জীবন কাটিয়েছেন অনেকবার। বাবা কিন্তু পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক আন্দোলনেই তেমনভাবে সামিল হতে পারেন নি, যেভাবে তাঁর মুসলিম সহকর্মীরাঅংশ নিয়েছেন। একমাত্র ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া, পাকিস্তানের ২৪ বছর কালে বাবা সব আন্দোলনের শুরুতেই বন্দী হয়ে জেলে পঁচেছেন। মুক্তি পেয়েছেন একমাত্র তখন, যখন বাইরের আন্দোলন সম্পূর্ণ স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা দমেন নি। কোনদিন না। এক মুহূর্তের জন্যও না। আর বাবার এই অদম্য চরিত্রই, আমাদের, তাঁর সন্তানদের, ভালো না হলেও ভালোর তকমা জুটিয়ে দিয়েছে।। অন্যান্য ভাই বোনের কথা সঠিক বলতে পারব না, তবে আমার ক্ষেত্রে ছপ্পর ফোঁড় ভালোর তকমা যে জুটেছিল, সেটা ঠিক।

আমার ছাত্রজীবনের শুরু যোগমায়া পাঠশালায়। দিনাজপুরের নিমনগরে বিজয় মিত্র বলে এক ধনীর বাড়ির মাঠের দুপাশে কয়েকটা একতলা ঘরের সারি, সেইখানে। মাঠের বাঁ দিকের সারিতে ছিল আমাদের ক্লাশ, হাট খোলা জানালা। বাইরে ঘণ সবুজ জঙ্গল। ডানদিকের সারির পাশেই সাঁওতাল পল্লী। সেখানে এক মস্ত কালী মন্দির। পাঠশালা থেকে অনেক দূরে রেললাইন। ট্রেনের হুইসেল শুনলেই আমি কোন না কোন ছুতায় বাইরে চলে আসতাম, কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ির যাওয়া দেখতাম। এই স্কুলে আমার ছিল ক্লাশ ওয়ান। বাড়ি অনেক দূরে, তবু হেঁটে আসতাম। আমার বড় বাচ্চু। পড়ত আরো দূরের বাংলা স্কুলে। স্কুলে যাওয়ার সময় আমরা অনেকখানি পথ একসঙ্গে যেতাম। তারপর যেত সোজা, আমি বাম দিকের রাস্তাটা ধরতাম। স্কুল যাওয়ার পথে, বাড়িতে, বাচ্চু আমাকে প্রায়ই শোনাত ওর স্কুলের গল্প। ওদের ক্লাশের এক্কেবারে পাশেই রেল লাইন। রেল লাইন পার হলেই বিশাল কোর্ট চত্বর। সেখানে কত কিছু। বাঁদর খেলা, যাদুকরের যাদু, ছোটছোট ছেলেমেয়েদের সার্কাস, ঢোলের বাজনা, রিকশা, মোটর গাড়ি, মানুষের হই চই কী নেই সেখানে। স্কুলের একপাশে মস্ত পুকুর। ছোট বড় নানা সাইজের সোনালি রূপালী মাছ ঘাই মারে। পুকুরের জলও টলটলে ঝকঝকে।

যোগমায়া আমার ভালো লাগত না। সারাক্ষণ ভয় ভয় করত ওখানে পড়তে। কারণ ছিল। স্যার বলতেন, অমনযোগী ছাত্রদের জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে তাড়া করে। অনেক সময়ে লাফিয়ে জানালা দিয়ে ক্লাশেও ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে, যারা স্কুল পালাবার চেষ্টা করে, পথে সাঁওতালরা তাদের খপ করে ধরে নিয়ে সোজা বিশাল মা কালীর পায়ের কাছে খ্যাচাং। পাঠাবলির মত। এই ভয়- ধীরে ধীরে আমাকে স্কুল ফাঁকি দেয়ার হাতে খড়ি দিল। বুদ্ধি- জোগাল, ওই ক্লাশ ওয়ান থেকেই। আজ পেট ব্যাথা, কাল পায়ে ব্যাথা, পরশু পায়ে ফোস্কা... এক সময় বললাম, আমি বাচ্চুর স্কুলে ভর্তি হব। আমার পাঠশালা থেকে বাচ্চুর স্কুল যে অনেক অনেক ভালো সেটা বোঝার বয়স তখন আমার হয়েছে। যোগমায়ায় আমার বয়স ছয়। আমার রোজকার কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে কে যেন আমাকে বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা স্কুল আমার দুপাশে দুটো ডানা জুড়ে দিল।

একটা ডানা কোর্ট চত্বেরে নিয়ে যায় আমাকে, আর একটা ডানা স্টেশন রোডে। স্কুলে ঢোকা মাত্র আমি উড়তে শুরু করেছিলাম, তা নয়। স্টেশন রোডটা আবিষ্কার করলাম মিছিলে হেঁটে। সেই সময়টায় ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধছে। মিটিং মিছিল লেগেই আছে শহরে। মা মেজদা জড়িয়ে পড়ছেন। আমি মা' পাশে পাশে, আঙুল ধরা। মেজদা আমাকে দিয়ে লেখাচ্ছেন পোস্টার, খবরের কাগজে, কাপড়ের টুকরো কাপড় জড়ানো কাঠি আলতার বাটিতে চুবিয়ে চুবিয়ে। কিন্তু কোর্ট চত্বরে যেতাম পা পিছলে। টিফিনের সময় আমাদের এক দল ছুট্টে চলে যেতাম রেল লাইনে। পাথরে পাথর ঠুকে চকমকি তোলা, লাইনের ঢাল বেয়ে পাহাড়ে ওঠা নামা, টেলিগ্রাফ পোস্টে কান পেতে বাতাসের শব্দ শোনা, কোনো গাড়ি চলে গেলে লাইনে কান পেতে তার গুড়গুড় করে মিলিয়ে যাওয়া অনুভব করা, এই সব চলত। তারই ফাঁকে সবার অলক্ষে লাইনের ওপারের ঢাল পিছলে কোর্টে চলে যাওয়া আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় অভিযান মনে হত। আমাদের বয়সীদের কাছে কোর্ট একটি ঘোষিত নিষিদ্ধ এলাকা, সে কথা জানতাম। কিন্তু আমার কাছে কোর্ট যেন একটা গোটা পৃথিবী। রোখে কে?

শহরের কেন্দ্রে আমাদের এই প্রাইমারি স্কুল, মানে বাংলা স্কুল। কোর্ট, স্টেশন রোড আর রেলগাড়ি আমাকে বাহিরমুখো করার জন্য ছিল পর্যাপ্ত। বোধয় সে কারণেই পড়াশুনোয় আমার মেধা কাজ করত না বা করে নি। সম্ভবত এসবই স্টেজে মেরে দেবার প্রবণতার বীজ আমার মধ্যে বুনতে থাকে ওই ছয় সাত বছর বয়স থেকেই।  কোরটে কী নেই? যাদুকর, শেকড় বাকড়ের ডাক্তার, কান পরিষ্কারের মাস্টার, লম্বা চোঙ্গায় চোখ বিঁধিয়ে চশমা দেবার ডাক্তার, কোমড়ে দড়ি বাঁধা চোর, বাঁদর খেলা, যাদুকরের যাদু, ছোটছোট ছেলেমেয়েদের সার্কাস, ঢোলের বাজনা, আমওয়ালা, লিচুওয়ালা, ডালের বড়া, ডিমভাজা, বিস্কুট, লজেনস, লাল নীল বেগুনি হলুদ নানা রঙের সরবতের চলন্ত দোকান... আর মানুষ। সবাই যেন ছুটছে। মেঝেতে পিঁপড়েরা যেমন সব দিকেই সবাই ছোটে, তেমনি। ভাগ্যিস এই সময়ে  বাবা জেলে, নইলে ওই কোর্ট চত্বরে আমার কোনদিন যাওয়াই হত না। বার এসোশিয়েশনে বাবার বসার জায়গা ছিল, পরে জেনেছি, কোর্ট চত্বরের মধ্যিখানে।

কোর্ট চয়ত্বর যদি পৃথিবী, স্টেশন রোড ছিল দিনাজপুর। দু'পাশে সুদৃশ্য দোকান, মনিহারি, শাড়ি, জামা-কাপড়, লেপ তোষক, জুতো, ম্যাগাজিন, রেডিও, দর্জি, মুচি, ভিখারি, রিকশা, সাইকেল, একটা দুটো মোটর গাড়ি, চিনাবাদাম, ডালের বড়া, ডিম ভাজা, রেস্টুর্যান্ট, সেখানে উঁচু আওয়াজের হিন্দী গান, সিনেমা হল, নাটকের মঞ্চ... সারা শহরটা যেন দুপাশের দুই সারিতে বাঁধা। আমার কেবলই মনে হত, এইখানে না এসে সবাই পাড়ায় দৌড়াদৌড়ি করে মরে কেন? আমি স্কুল শেষে অনেক সময় সরাসরি বাড়ি না গিয়ে রেল লাইন ধরে স্টেশন, সেখান থেকে স্টেশন রোড বেয়ে জেলখানার সামনে থেকে ডান দিকে বেঁকে মুনসীপাড়া হয়ে, ঘাগড়ার পঁচা খাল পেরিয়ে, মেথর পট্টির ভেতর দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সবাই জানত, ছোট পায়ে দূরের পথ পেরুতে সময় তো লাগবেই।

বাংলা স্কুলে আমার সময়কাল ১৯৫১-১৯৫২. এই সময়টা ভাষা আন্দোলনের। রাজনীতি বোঝার বয়স তখন আমার না। অনেক কিছুই বুঝতাম না। তবু হাতে ছোট ছোট চাটাইয়ে সাঁটা পোস্টার নিয়ে মিছিলে জুটে যেতাম। আমাদের শহরের একমাত্র কলেজ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, আমাদের স্কুল মাঠের অন্য প্রান্তে, তাই আন্দোলনের ঢেউ প্রায় প্রতিদিন ধ্বনি তুলত আমাদের স্কুলের দালানে, আমাদের মনে, রক্তে। এমনিতেই বাড়ির পরিবেশে আমার মনে অনুকূল ভুমি তৈরি ছিল, আমি তবু মিছিলের নামে শহ্র প্রদক্ষিণের সুযোগ হাতছাড়া করতাম না। সেই সময়ের দু'টি স্লোগান এখনো কানে বাজে-- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, কালাকানুন বাতিল করো। আমি অবশ্য কালা কানুনের অর্থ বুঝতাম না। নূন-লবনের সঙ্গে এই মিছিলের মিলটা কোথায় অনুমান করতে পারতাম না। কিন্তু মিছিলে জোর স্লোগান তুলতাম কালা কানুনরে বিরুদ্ধে। এই ভাষা আন্দোলন আমাকে আরো বাহিরমুখো করে তুলল। প্রায়শই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যেত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আর আমরা ছোটরা তাইতে জড়িয়ে পড়তাম। আমার বিশ্বাস, এই সময়কালটাই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ঊষা কাল। ১৬ ডিসেম্বর বা মার্চ নয়। কেননা, ভাষার দাবি যেভাবে আবালবৃদ্ধবনিতাকে ছেয়ে ফেলেছিল, মুক্তি যুদ্ধ সেভাবে সেই সময়ের আমার বয়সীদের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ একটি পরিণতি, ভাষা আন্দোলন ছিল একটি যাত্রা।

আগেই বলেছি, দিনাজপুর শহর ছিল হিন্দু প্রধান, হিন্দুরা চলে যাওয়াতে সেই শূণ্যস্থান দ্রুত ভরে ফেলে বিহারের উদবাস্তুরা। তুলনামূলকভাবে গ্রামাঞ্চলের বরদ্ধিঞষু মুসলিম পরিবারের মানুষ সহজে শহরমুখী হতে চান নি, ফলে শহরে বিশেষ করে ব্যবসা চাকরির ক্ষেত্রে বিহারিদের প্রাধান্য হঠাৎ বেড়ে যায়। এর কারণেই হিন্দু বন্ধু ছাড়া আমার বিহারি বন্ধুদের সংখ্যা বেশি ছিল। পাড়ায় ক্যাবলা, বাদল, দিলু ছাড়া বাঙালি মুসলিম বন্ধু শুধুই মোতালেব। বিহারিরা বড়লোক আর আমরা হিন্দু-মুসলমানরা গরীব, এইটে বুঝতাম। আমাদের বিহারি বন্ধুদের কাছেও আমরা একটু অবহেলিত বোধ করতাম। ওদের তুষ্ট রাখার একটা প্রবণতা যে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, সেটা এই বয়সে এসেও মনে পড়ে। দিলুর বাবা ছিলেম্ন মোক্তার। দিলুর দুই বড় দাদা ভারতে চলে গেছে। দিদি আর এক বোন এখন বাড়িতে। দিলুর বাবা আমার বাবার থেকে বড়, কিন্তু স্বভাবে উল্টো। সেই সময়কার এসডিও ম্যাজিস্ট্রেট এই মাপের আমলাদের সঙ্গে তার দহরম মহরম। মা সাবধান করে দিয়েছিলেন আমাকে, বাড়ির সব কথা জ্যাঠামশয় বা দিলু বা বেবিদিকে বলবি না। আমি তাই সাবধানে কথা বলতাম, জানতাম, দিলুরা আমাদের লোক না। ওই বয়সে কখনো সখনো বাঙালি মুসলমানদেরও আমাদের নিজেদের লোক মনে হত না। বিহারিদের বেশি ভালো লাগত। বড় কারণ বোধ হয়, আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুতেই থাকত না ওরা। ওদের বাড়িতে পয়সা অনেক, তাই ফুটবল কিনত ওরাই, খেলতাম আমরা।

মনে পড়ছে, একবার, একটা পাকিস্তানী সিনেমা দেখেছিলাম। রূপকথার গল্প ছিল কি? মনে নেই। হয় তো। ছোটদের অনেকেই আমরা সিনেমাটা দেখেছিলাম। সেখানে একটা বেজির সঙ্গে একটা সাপের লড়াই ছিল। লড়াইয়ে বেজি সাপটাকে মেরে ফেলে। একদিন মোতালেবদের বাড়িতে গেছি। মোতালেবের মা ভালো ছিলেন না। মোতালেবরা গ্রামের জোতদার, তাই পাড়ার ভোম্বলরা ভারতে চলে গেলে ওদের বিরাট বাড়িতে ঢুকে পড়ে। মোতালেবকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাতেন ওর মা। গোয়াল ঘর সাফ সুতরো রাখা, গরুদের খাবার দেওয়া, খড় কাটা, সবার জন্য চানের জল রেডি রাখা, বাগান নিঙরোনো, বস্তা বোঝাই বাজার করা, বাড়ির সব 'টা ঘর ঝাঁট দেয়া... আর মোতালেবের ছোটভাই, মঈন আরাম করত, দুধ ফল খেত। মোতালেবের জুটত মুড়ি আর লঙ্কা। আমি আর ক্যাবলা তাই মোতালেবের মা'কে দু'চোখে দেখতে পারতাম না। ওঁকে ভুলেও মাসিমা বললে রেগে যেতেন, খালা আম্মা ডাকতে হত। কথায় কথায় খালা আম্মা বলতেন, ‘তোদের ভগবানের চেয়ে আমাদের আল্লার শক্তি বেশি। আল্লা ভালো বেশি।'  আমার কাছে এর উত্তর ছিল না। আমাদের বাড়িতে পূজা পাঠ নেই। আমাদের ভাইবোনের জন্মের আগেই বাবা কুলদেবী মা কালীর ছবি বাড়ির কোন দেয়ালেই আর রাখেন নি। তাই ভাবতাম, হবেই বা। খালা আম্মা সেদিন জিজ্ঞেস করলেন, 'তুই সিনেমাটা দেখেছিস?' ঘাড় নাড়ি। 'তো কী দেখলি? পারল তোদের মনসা ঠাকুর জিততে? বেজিটা কেমন করে মেরে ফেলল মনসাকে? তাহলে, কার শক্তি বেশি, তোদের ভগবানের না আমাদের আল্লার? যদি ভগবানের শক্তি বেশি হত, তাহলে হেরে গেল কেন? জিতলেই পারত?' আমি সত্যি কনফ্যুজড হয়ে গেছিলাম এই যুক্তির সামনে। অনেকদিন ধরেই আমি মনের কোণে বিশ্বাস করতাম, ভগবান না। আল্লার শক্তিই বেশি।


--------------------------



23. // ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস //

দিনের কলেজ আর রাতের কলেজের তফাৎটা প্রথম দিনেই চোখে পড়ে। একই বিল্ডিংয়ে রাতের কলেজটা যেন ব্রাত্যজনের। অন্যদিকে দিনের কলেজ যেন রাজা। চোখেও পড়ে তা। এখানে তারুণ্য ছোটাছুটি করে, রাতের কলেজে ঝুঁকে পড়া যুবাদলের ফাঁকিবাজি। রাতের কলেজে রাজনীতি ছিল বার দুয়ারে, দিনের কলেজে রাজনীতি কলেজের ক্লাশরুমে, অলিন্দে। ক্যান্টিনে। সামনের রাস্তার ফুটপাথে। কলেজের প্রথম দিনেই  দেখি আমি রাজনীতির মুখোমুখি। আসলে আমার কলেজ অভিজ্ঞতায় রাজনীতি কলেজের ভেতরে এতটা প্রত্যক্ষ ছিল না। পাকিস্তানে আমাদের কলেজে রাজনীতি ছিল রাষ্ট্রব্যাবস্থার বিরুদ্ধে। শাসক শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করার রাজনীতি। দলমত নির্বিশেষে আমরা এই লক্ষেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তাম। আমাদের পথ আলাদা ছিল, লক্ষ ছিল এক। কলকাতার কলেজ রাজনীতিটা দেখি অনেকখানি প্রত্যক্ষ। এই রাজনীতি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে না। এখানে রাজনীতি নিজের দলের জন্য আর অন্য দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। সিটি কলেজে অন্যান্য কলেজের মতই দুটো গোষ্ঠী-- এসএফআই আর ছাত্র পরিষদ। এদের কাজ নিজেদের মূখ্য দল-- কম্যুনিস্ট পার্টি আর কংগ্রেসের দলশক্তিকে সমর্থনের সংখ্যায় ও শক্তিতে মজবুত করা। এদের নিজস্ব কোন এজেন্ডা নেই। আমি মেলাতে পারি না। তাই প্রথম দিন থেকেই নিজেকে রাজনীতির পরিমন্ডল থেকে দুরে রাখার চেষ্টা করে গেছি।

সেটা  সম্পূর্ণ হল এক ঘটনায়। কী এক কারণে ছাত্র পরিষদ মিছিল করবে বলে নানা ক্লাশ থেকে ছেলেদের রাস্তায় এনে দাঁড় করাচ্ছিল। অধ্যাপকরাও ক্লাশে এসে হৈ হট্টগোল দেখে টিচার্স রুমে ফিরে যাচ্ছিলেন। সবাই রাস্তায় দাঁড়াচ্ছিল , তাও না। কেউ কেউ  গেটের পাশে কলেজ ক্যান্টিনে ঢোকে, কেউ কেউ তো এদিক সেদিক চলে যেতে থাকে। আমার কী হল, রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়েই কয়েকজনকে বলছিলাম, 'এটা কেন? কালকে করো, আমরাও রেডি হয়ে আসব। একজন দুজন নয়, সবাই মিলে আরো বড় মিছিল করব,' এই ধরনের কোন কথা। কি হল, দেখি, আমার চারপাশে বেশ ভীড় জমে গেল, তা দেখে আমি গলা চড়াই। যুক্তির পর যুক্তি টানতে থাকি। হাততালি পড়তে লাগল। আমিও বলতে থাকি, চলো, ক্লাশে ফিরে যাই, স্যারদের ডেকে এনে ক্লাশ চালু করে দিই। হল কিন্তু। অনেকেই হুড় হুড় করে আবার ওপরে দোতলায় উঠে গেল। আমি আমাদের ক্লাসের স্যারকে ডেকে আনি, বলি, 'মিস্আন্ডার্সটায়ান্ডিং স্যার, আমরা কাল যাব, আজ ক্লাশ হবে,' স্যার এলেন, আমাদের ক্লাস চালু হয়ে গেল। সেই দেখে অন্য আরো কয়েকটা ক্লাশেও। শেষটায় মিছিলের কী হয়েছিল এখন মনে পড়ছে না।

পরের দিন কলেজে যেতেই, একজন লম্বা চওড়া, হাতা গোটানো পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা, রোমশ বুক আর শক্তপোক্ত হাত, পলিটিক্যাল সায়েনস ক্লাশের বন্ধু, আমাকে দোতালার বারান্দার একপাশে ডেকে নিয়ে গেল। 'দারুণ করলি তো! তোর মধ্যে লিডার্শিপ কোয়ালিটি প্রচুর। শুনেছি, তুই এসএফআই সাপোর্টার? এবারের নির্বাচনে তোকে কলেজে আমরা চাই।' ছেলেটা লক্ষমীকান্ত দে। পরে, কম্যুনিস্ট পার্টি দুভাগ হলে, সিপিএমের এমএলএ হয়েছিল। বিধানসভায় একবার দলের চীফ হুইপও। আমি বলি, 'নারে লক্ষমী, আমি রাজনৈতিক পরিবারের বটে, কম্যুনিস্ট বাবা মা'র সন্তানও বটে। কিন্তু, আমি রাজনীতি করব না। আমি এ দেশের কিছুই জানি না। তা ছাড়া, আমার অন্য কাজ আছে। সেটা রাজনীতি না।' পরের দিনগুলোতে লক্ষমীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠল ঠিকই, কিন্তু সরাসরি ওদের কোন আন্দোলনেই আমি থাকি না। এই ঘটনারই পরপর, নাকি আরো কিছুদিন পরে মনে নেই, আমি ক্লাশে ক্লাশে আচমকা ক্লাশ বন্ধ করার বিরোধিতা করছিলাম। সব ক্লাশেই হাততালি মিলছিল। আমিও দ্বিগুণ উৎসাহী তখন। হঠাৎ দেখি, কয়েকজন তাগড়া ছেলে এগিয়ে এল, ক্লাশের ডায়াস থেকে আমাকে চ্যাং দোলা করে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামিয়ে সোজা একেবারে রাস্তায় শুইয়ে দিয়ে বলল, এ রকম লেকচারবাজী করতে দেখলে শালা...' সে কাজ ছাত্র পরিষদ করেছিল নাকি ধুরনদ্ধর লক্ষমীর ছেলেরা, তা এখন আর মনে পড়ে না। এটা মনে পড়ে, এই ঘটনার পরে কলকাতায় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে, একমাত্র ম্যাকনামারার কলকাতা সফরের আগে, আমি নিজেকে জড়াইনি কোনদিন। ম্যাকনামার ঘটনা অনেক পরে, আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে।

লেকচারবাজির ফলে একটা কাজ হল, কলেজে আমার বন্ধু সংখ্যা বেড়ে গেল। সব স্ট্রিমের ছেলেরাই কোন না কোন মাত্রায় আমার কাছের মানুষ হতে থাকল। ক্যান্টিনে ঢুকলে একাধিক টেবিলে বসে আড্ডা দেয়ায় আর অসুবিধা থাকে না। এই ভাবে একদিন দেখা গেল, আমরা চারজন ঘণিষ্ঠ হয়ে গেছি। এবং বিস্ময়ের, আমরা চারজন চারটি ভিন্ন বিষয়ে অনর্স পড়ি। অভীক বাংলায়, সত্য ইকনম্নিক্সে, অর্জুন পলিটিক্যাল সায়েনসে। আর আমার তো ইংরেজি। আমি খুব খুশি চার পথের এই মোড়টাতে পৌঁছে। ওই তিনজনের মানসিকতা আর পছন্দের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি সহজেই। আমি অবলীলায় অভীকের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে পারতাম, সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে বা সমাজ নিয়ে সত্যের সঙ্গে।  আমাদের আড্ডার চেহারাটা রকবাজী পর্যায়ের হয়ে দাঁড়াল। যদিও আমরা কলেজের কাছেই দুটো বেঞ্চের 'বসন্ত কেবিন' (কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের না) আর আমাদের রেল কলোনীর কাছে আমজাদীয়া ছাড়া আর কোথাও বসতাম না। অভীকের বাবা কলকাতার খুব নামী আইনী প্রকাশক, সত্যদের আছে একটি টেইলারিং শপ, শ্যামবাজারে। খুব নামী দোকান। অর্জুনের বাবা সাধারণ সরকারী কর্মচারি। বলতে পারব না, আমরা কি করে আড্ডার খরচা চালাতাম। আমি তো নইই। আমার কোন প্রশ্নই ছিল না। ওরা তিনজন ধনী সন্তান তাও না। ওরা মোটা অঙ্কের হাত খরচা পেত তাও না। তবু, চায়ের ওপরে সিঙ্গারা বা কাটলেট বা চাঁপ রোটি আমরা যে খেতাম না তাও না। তবে হ্যাঁ আমরা ভাগ করে খেতাম, তাই খরচাটা ভাগে কম পড়ত। আমাদের আরও একটা ব্যাপার অনুঘটকের কাজ করে থাকবে। সেটা, আমরা কেউই ব্রিলিয়ান্ট ছিলাম না। আমরা ছিলাম সাধারণ মেধার ছাত্র। তাই আমাদের কথাবার্তা কখনই কোন গূঢ় আলোচনায় বদলে যেত না।  

আমার অনর্স পড়ায় কতগুলো অসুবিধা ছিল। প্রথম অসুবিধা, ইংরেজি সাহিত্যের বই দামী, সেগুলো কেনার ক্ষমতা আমার নেই। দ্বিতীয়ত আমি পাকিস্তানের ছেলে, ভারতে ইংরেজি সাহিত্যের প্রেফারেনস জানি না। তৃতীয়, আমার সাধারণ মেধা। ক্লাশ ফলো করা তাই ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ল। সঙ্গে ছিল বাংলা আর পলিটিক্যাল সায়েন্স। আমার তাইতে মনযোগ বেশি। সেগুলো তো বই ছাড়াই ম্যানেজ করা যায়, সে কারণেও হতে পারে। ধীরে ধীরে এই অবস্থান থেকে মুক্তির উপায় বার করলাম, খুব যে এফেক্টিভ হল তা অবশ্য নয়। আমি দ্রুত লিখতে পারতাম ছোটবেলা থেকেই। ভাদুড়ি দিদিমা, ক্যাবলার ঠাকুমা, কিরণ কাকিমা এদের হয়ে আমিই তো পোস্টকার্ডে চিঠির ডিকটেশন নিতাম। আমি ক্লাশে স্যারদের লেকচার যতটা সম্ভব ভারবাটিম নোট করতে লাগলাম। ঘরে ফিরে সেগুলোয় চোখ বোলাতাম আর সে সব ছড়িয়ে ছড়িয়ে ভাবতাম। কিছুদিনের মধ্যে বিষয়গুলো অনেকটা ঝরঝরে হয়ে উঠতে লাগল। আমার এই মনযোগী নোট নেয়াটা অলক্ষে একটা সুফলও এনে দিল। স্যাররা ভাবলেন, তাঁদের লেকচার আমার ভালো লাগে, তাই নোট করি। ভাবলেন, আমি একজন সিরিয়াস স্টুডেন্ট। ভাবলেন, আমি মেধাবী। আর এভাবেই আমি ওঁদের চোখে মিছিমিছি ক্লাশের একজন ভালো ছাত্র হয়ে উঠলাম। আমি অবশ্য আমার আসল দুর্বলতা কারু কাছেই ফাঁস করি না। এমন কি ওই তিন বন্দ্ধুর কাছেও না। এই মিথ্যের পরিমন্ডলেই একটা সময় এলো, যখন আমি নিজেও নিজেকে ভালো ছাত্র ভাবতে শুরু করি।

সিএন রায় স্যার আমাকে ভালোবাসবেন, এতে অবাকের কিছু ছিল না। ওঁর সুপারিশেই আমার ইংলিশ অনর্সে ভর্তি হওয়া। স্যারের বাড়ি যেতাম। আমার কাছে বই নেই এ কথা বলতাম না কখনো। আমি ক্লাশের নোট থেকে যা বুঝতাম সেটাই ওঁর কাছে বলতাম। ভুল হলে শুধরে দিতেন বা নানান ক্লাশ নোট পড়তে দিতেন। কখনো বা একটা দুটো রেফারেন্স বইও দিতেন। ফেরত দেবার শর্তে। আমি ঘরে এসে সে সব নাড়াচাড়া করে খুব একটা কিছু বুঝে ফেলতাম তা নয়। তবে ইংরেজি সাহিত্যের একটা বাতাবরণের ছোঁয়া পেতাম অবশ্যই। আমার মস্ত অসুবিধা হচ্ছিল, ইংল্যান্ডের আকাশ বাতাস সমাজ মানুষ কোন কিছু সম্পর্কেই আমার কোন সম্যক ধারণা নেই। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও অভীকের সঙ্গে বাংলা নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা চালিয়ে যেতে পারতাম, সেটা বাংলা সাহিত্যে আমার দখল আছে, তা বলে তো নয়, বরং সেটা সম্ভব হত আমি বাংলাকে বেশি করে চিনি বলে। বাংলার মাটি মানুষ নদী নালা সমাজ জীবন যাপন অর্থনীতি সব কিছুতেই আমার একটা প্রত্যক্ষ ধারণা তো ছিল, এবং সেটাই আমাকে বাংলা সাহিত্যকে আমার কাছে অচেনা অজানা করে রাখত না। কিন্তু ইংরেজির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। আমার কাছে ইংল্যান্ডের পরিচয় একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে, তার বাইরে কিছু না। কিন্তু যত বেশি ক্লাশ করতে শুরু করলাম ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রাথমিক অজ্ঞানতার কুয়াশাটা ধীরে ধীরে হাল্কা হতে থাকে। কিন্তু স্পষ্ট হয় না। আমাদের একটা ক্লাশ হত ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস। এই ক্লাশটা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। একটাই কারণ, যিনি পড়াতেন, মনে হত, তিনি ইতিহাসের মাস্টারমশয় বেশি, সাহিত্যের মাস্টারমশয় কম। এই ক্লাশটা ধীরে ধীরে হলেও আমাকে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করাতে পারছিল। এক বন্ধুর কাছে আ হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচার নামে একটা বই দেখলাম। ঢাউস। দামও ঢাউস। ভয় পেয়ে যাই।

একদিন অভীকদের ডাইনিং টেবিলে, ওটাই ছিল আমাদের চার বন্ধুর কাছে  ড্রইং রুম, সাহিত্য আর সমাজ নিয়ে আমার গুব্লেট চিন্তার কথা আলোচনা করছিলাম। মাসিমা এই সময়ে আমাদের এটা ওটা খেতে দেন, আমাদের কথাবার্তা শুনে বললেন, 'তুই একবার শমীকের সঙ্গে দেখা কর। আমাদের কলেজে ইংরেজি পড়ায়।' মাসীমা সিটি মর্ণিং মানে, মেয়েদের কলেজ, রামমোহন কলেজে হিন্দী পড়ান। মাসীমা কানপুরের প্রবাসী বাঙালি। শমীক মানে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এখন বাংলা ও সাহিত্য সিনেমা বিষয়ে অথরিটি, তিনি। দু'তিন দিন পরে মাসীমা যখন বললেন, আমার কথা ওঁকে বলেছেন, পৌঁছে গেলাম। বললাম, আমি একটা ঠিকঠাক সহজ হিস্ট্রি অফ লিটারেচারের বই খুঁজছি। কিন্তু সব ক'টা বই এত বিশাল বিশাল, সাহস পাচ্ছি না, আর তা ছাড়া পার্ট ওয়ান পরীক্ষার পরেই তো ওটা আর কাজে লাগবে না। আমার পরের কথাগুলো নিশ্চয়ই হাস্যকর ঠেকেছে শমীকবাবুর, হাসলেন, 'কেন? সাহিত্য নিয়ে পড়বে না? ইতিহাস তো সব সময়ই কাজে লাগবে।' বুঝলাম, ধরা পড়ে গেছি। চুপ করে থাকি। উনি নিজেই বললেন, তুমি একদিন এসো, আমার কাছে একটা হিস্ট্রি বই আছে। তোমাকে দেব। ইতিহাস মানে, বলতে পার, ইতিহাসের অ্যাব্রিজ্ড ভার্সান। বুকের পুকুরে ঢিল পড়ে, আমি তো তেমনই একটা সিরিয়াস ফাঁকিবাজি পড়াশুনার পথই খুঁজছিলাম!

বইটা অ্যালবার্টস হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচার। বেশি মোটা না। বইটা মাস দুই তিনেকের মধ্যে আদ্যপান্ত পড়ে ফেলি। আর আমি আমার মত করে ইংলিশ অনর্সের 'ভালো' ছাত্র হয়ে যাই।

----------



22.  // মণিমা //

আমি যে-সময় কলকাতায় লড়াইয়ের ফাঁক ফোকর খুঁজছি, সে-সময়  দেশভাগের রক্তচিহ্ন তখনও কলকাতার পথ ঘাট ফুটপাথ থেকে মুছে যায় নি। পনের বছর আগের দেশভাগের ক্ষত থেকে চুইঁয়ে চুইঁয়ে নামছে শিকড়ছিন্ন মানুষের স্রোত, এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে সবাই, সংকুচিত হচ্ছে সুযোগের ক্ষেত্রগুলো। অবিশ্বাস, ঈর্ষা, কনুই প্রতিযোগিতা, ভন্ডামি এমনকি প্রত্যক্ষ শত্রুতাও  তখন কলকাতার বুকে সাপের মত সন্তর্পণে মাটি ঘেঁষে বুকে হাঁটছে। সর্বত্র সবার একটিই সন্ধান-- সুযোগ। যে কোন সুযোগ। যে কোন ক্ষেত্রে, যে কোন কাজে। আমিও সনদ্ধানের ভীড়ে ব্যতিক্রম নই। তফাৎ, আমার একটি নির্দিষ্ট লক্ষপথ আছে। সাংবাদিকতা। টের পেতে থাকি, বাড়ি থেকে কম্যুনের যে-শিক্ষা, তা ইতিমধ্যেই আমার হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে, আমিও ধীরে ধীরে আমাকে ঘিরেই নিজেকে গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। তবে নিঃসঙ্গতা নির্বান্ধবতা সময়ে কুরে কুরে খায়। আত্মীয়দের খোঁজে নামি। কী করে কার খোঁজ পাচ্ছিলাম জানি না। তবে দেখতে পেলাম, আমার কিছু আত্মীয় আছেন কাছাকাছি, কলকাতাতেই।

ক্রিক রো, সেখানে সতু কাকু, বাবার খুড়তুতো ভাই, সত্যব্রত চক্রবর্তী, হিলি মেইল ডাকাতিতে মা' সঙ্গী, ধরা পড়ে আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন নির্বাসিত হয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর মুক্তি পেয়ে কলকাতায়। বিয়ে করেন নি। বোন থাকেন বিহারের ডেহরি-অন-শোন। কলকাতায় ভাগ্নে থাকে সঙ্গে, পাশের ঘরে। মা' রাঙ্গাদি, আমাদের রাঙ্গামা, আগে দেখিনি, থাকেন অশোকনগরের কল্যাণগড় কলোনীতে, দেশভাগের নির্মম শিকার, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে বিধবা চলে আসেন এই উদবাস্তু কলোনীতে। মা' সবচেয়ে ছোটবোন, আমাদের মণিমা, এঁকেও আগে দেখিনি, একছেলে নিয়ে উদবাস্তু, কসবার বস্তীতে, মেশোমশয় ব্যাংশাল কোর্টে খাতা চিঠি মুসাবিদা লিখে নকল করে যা পান উপার্জন করেন।

সতুকাকুই বললেন, তাঁদের আর এক জ্ঞাতি আছেন কলকাতায়। বাবার থেকে একটু বড়, বৃটিশ আমলের আমলা। আলিপুরে মস্ত বাড়ি। ঠিকানা দিলেন। নামটা এখন মনে পড়ছে না। আমি একদিন শিয়ালদা থেকে বাসে করে আলিপুরে গিয়েছিলাম, শুধু আলিপুর অঞ্চলের মডার্ন বাড়ি ঘর দেখতে। সে সময় সবচেয়ে নামী দামী বড় লোকদের এলাকা হিসেবে আলিপুর ছিল বিখ্যাত। কলকাতা তখন গৃহহীন শিকড়হীন মানুষে ছড়াছড়ি, আলিপুর যে সেখানে দর্শনীয় হবে সে আর অবাকের কী? সেই আলিপুরে আমার আত্মীয়, তাও বাবার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো দাদা, আমার গর্বের সীমা নেই। এবার আর দেখতে যাওয়া নয়, বাগান পেরিয়ে কেয়ারি পথ বেয়ে ড্রয়িং রুম, ডাইনিং হল সবখানেই ঘুরব আমি। পৌঁছে গেলাম ঠিকানা মিলিয়ে। বাবার দাদা তখন বাড়ির সামনের এক চিলতে বাগানে, পাইপের গলা টিপে টিপে নানা গাছে জল দিচ্ছেন। পরনে ফতুয়া, পাজামা। দুটোই ধবধবে। আমি গেটে। পাইপের জলের মুখ বন্ধ না করেই কথা বলতে থাকেন। একবার গাছের দিকে, একবার আমার দিকে আড়চোখে আমাকে দেখে কথা চালাতে থাকেন। বাবা কেমন আছেন, মা। বাবা কি পাকিস্তানে এখনো রাজনীতি করেন? মা কি ওই মুসলমান সমাজেও ঝান্ডা উঁচিয়ে সভা সমিতি করেন? সতুকাকুর খবর জানেন বললেন। এও বললেন, সতু শান্ত হয়ে গেছে। আন্দামান থেকে ছাড়া পাবার পর রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছে, ঠিকই করেছে। এখন তো দেশ স্বাধীন। এখন দেশকে গড়তে হবে। এখনো রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া ঠিক না... কিন্তু তার গাছে জল দেয়া শেষ হয় না। চলতেই থাকে। আমি লোহার গেটটা দোলাতে দোলাতে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকি। একসময় আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে, বাবলু। একদিন এসো আমাদের বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া করে যেতে হবে সেদিন।' এবার বাগানের পাঁচিল ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন... আমি ফিরে আসি। অগস্ত্য ফেরা!

অনেকেই বলল, বালিগঞ্জ স্টেশনের পাশের রেল গেটের ওপারেই কসবা। টানা রাস্তাটা আর. কে. ঘোষাল রোড। সেখানে পৌঁছুলে কেউ কেউ বললেন, রাস্তার দুপাশে যত বাড়ি সবক'টাতেই আর. কে. ঘোষাল রোডের নম্বর। আমার হাতে যে নম্বর, তার হদিশ পাওয়া ভার হয়ে উঠল। কতক্ষণ ঘুরেছি খুঁজেছি মনে নেই। ঠিকানা মিলল, বাম দিকে। বেশ কিছু অলিগলি পাক খেয়ে, রেল লাইনের অদূরে, এক বস্তী, সেখানে। মণিমাদের এক ঘরের বাসা। দেয়াল ইঁটের গাঁথনি, মাথায় টালি। ঘরের মধ্যে একপাশে একটা বড়সড় খাট-- মণিমা, মেশোমশয় আর তাদের ছেলে, আমার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে, মণিমা হিসেব কষে টসে বললেন, এই তিনজনের শোবার জন্য। খাটটা কয়েকটা ইঁটের ওপর উঁচু করা, নিচে বাক্স পেটরা, বাসন কোসন। ঘরে দুটি জানালা। একপাশে একটা আলনা। ঘরের অরদ্ধেক জুড়ে মেঝে ঝকঝকে। এখানেই খাওয়া দাওয়া, দুপুরের ভাত ঘুম। মণিমা মেঝেতে শুয়েছিলেন, উঠে এগিয়ে এসে আমার পরিচয় পেয়ে শীর্ণা মহিলা কেঁদে ফেললেন। তার এক দিদি আর দুই দাদা পাকিস্তানে। তিনজনই দিনাজপুরে। ছোটমামা কোর্টে মুহুরির কাজ করেন, আমাদের বাবার এসিস্ট্যান্ট। বড় মামা নানা কাজ করেন, ভালো গান গান। দু ভাই নাটক যাত্রায় খুব নাম করেছেন। সব শুনে, মণিমা খুশি হলেন, কিন্তু স্বস্তি পেলেন না।

আমার পৌঁছুতে পঁছুতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই বিকেলটা নেমে এলো দ্রুত। মেশোমশয় এলেন, খানিক পরে মনুদাও। মেশোমশয়, বেঁটেখাটো, টকটকে ফর্সা। সারা শরীরের চামড়া কুকড়ে গেছে। শরীর সামনে ঝুঁকে গেছে। সেটা বয়সের ভারে নাকি দেশভাগের ভারে, আমার বোঝার বাইরে। চটি খুলে, বারান্দার বালতিতে রাখা জল মগে করে দু'পায়ে ঢাললেন, এক পা দিয়ে আর এক পা রগড়ে রগড়ে ধুয়ে ঘরে ঢুকলেন। মণিমা পরিচয় করিয়ে দিতেই, ধূসর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে, 'ভালো করেছিস। এই কলকাতায় এভাবেই কেড়ে খামচে জয় করতে হয়, তুই পারবি।' মনুদা তখন পা ধুচ্ছেন, ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'ও পারবে না।' নিজেই উত্তর দিলেন, 'পারবে কী করে? তোর মণিমা ছেলেকে কলকাতায় চলতে ফিরতে দিতেই ভয়ে মরে।' আবার মণিমাকেও সমর্থন করে বললেন, 'ওরই বা দোষ কী? ঘর পোড়া গরু তো!' মেশোমশয়কে এই সময় খুব অসহায় লাগছিল।

দেয়ালে গাঁথা পেরেকটায় লম্বা ঝুলের জামাটা ঝোলাতে যাবেন, মাসী বললেন, 'তোমাকে একবার বাজারে যেতে হবে। বাবলু রাতে খেয়ে যাবে।' আমি না না করে উঠি না, ভালই। শঙ্করদাকে এক রাতের জন্য মুক্তি তো দেয়া যাবে! মেশোমশয় জামার পকেট থেকে অল্প কিছু টাকা পয়সা বের করে গুণলেন। উবু হয়ে খাটের তলা থেকে একটা কাঠের বাক্স টে নে নিয়ে তা থেকে কিছু যোগ করে নিয়ে মনে মনে বললেন, 'এ বেলায় কি কিছু পাব?' বেরিয়ে গেলেন। আম্‌ও ঘরের বাইরে আসি। এক চিলতে লম্বাটে বারান্দা মত। তার এক পাশে দেয়াল ঘেষে কয়লার উনুন। মাসীর রান্না ঘর। এই বারান্দাটাই বৈঠকখানা। মাটি থেকে অপ্লপ উঁচু। তাতে বসে মাটিতে পা রেখে মনুদা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলেন। কাঁসার বাটিটা এগিয়ে ধরলেন, 'তুমিও খাও'. আমি খাবলা মেরে এক মুঠো তুলি। খিদে পেয়েছিল বৈকি। দুপুরে না-খেয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাসাটা খুঁজে পেতে পেতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল। মাসী তখন ভাত ঘুমে মেঝেতে।

রাতে মাংস ভাত। তার আগে ডাল আর ডাটা চচ্চড়ি। ঠেসে খাওয়া হল। মাসীর রান্না খেতে খেতে মা'র হাতের লালটুকটুকে পাতলা ঝোলের মাংসের গন্ধ  পাই। একই হাতের রান্না যেন। বলি, 'মণিমা, আপনি তো মা'র মত রাঁধেন!' মেশোমশয় বললেন, 'তোদের দিদিমাও এমনটাই রাঁধতেন।' মণিমার বুক ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল কি? শুধু বললেন,' আমরা ছিলাম ছয় বোন দুই ভাই। আমি সবার ছোট। বিয়ের আগে রান্নাবান্না জানতাম নাকি, নাকি করতে হত? কী করে যে এটা শিখে ফেললাম, বলতে পারব না।' সত্যি দারুণ খাওয়া হল। আবার আসব, এই কথা দিয়ে পৌঁছে যাই বালিগঞ্জ স্টেশনে।

ট্রেনে উঠে দরজার কাছেই দাঁড়াই। মাঝখানে একটা হল্ট স্টেশন, তারপরেই শিয়ালদা। চলন্ত ট্রেন থেকেই দেখা গেল, রেলের লাইনের ধারেই খাটাল। অনুমান করার চেষ্টা করলাম, খাটালের মাথার অন্ধকার আকাশের নিচেই কোথাও মণিমাদের বাড়ি। ভাবছিলাম, মণিমাদের এই জীবন কি নিরদ্ধারিত ছিল? এখানে ব্যাংশাল কোর্ট, ওপারে কী করতেন? কী দেখে এই সুপুরুষ যুবার হাতে মেয়ে, বোনকে তুলে দিয়েছিল সবাই? ব্যাংশাল কোর্টে চিঠি চাপাটি লিখে জীবন কাটাবেন এটা ভেবে নিশ্চই না, তাহলে? মেশমশয়ের লম্বা জামাটার পকেটের ছবিটা চোখে ভেসে উঠল। উনি কি কোন টাকা বের করেছিলেন, নাকি শুধুই কয়েন? গা শিউড়ে ওঠে, মনে পড়ে, একটাও টাকার নোট দেখিনি আমি। পয়সাগুলোকে মুঠোতে নিয়েছিলেন মাত্র। কাঠের বাক্সটা থেকে টাকা বের করেছিলেন মনে পড়ল। মানে? শঙ্করদাকে এক রাতের মুক্তি দিতে গিয়ে মানুষটাকে কয়েক রাত্রির ঋণে জড়িয়ে ফেললাম আমি? শিয়ালদায় নেমে প্লয়াটফর্ম ধরে হাঁটে গিয়ে মনে হল, আমার পা দুটো আর চলতে পারছিল না যেন। কেমন অবশ অবশ লাগছিল উরু দুটো...


_______________________



21.  // মাদার মেরী //


ফোটোগ্রাফি, নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং নাকি ইংলিশ অনর্স এই নিয়ে যখন আমি চক্রব্যুহে ফেঁসে আছি, ঘরে বসে, আমজাদীয়ায় বসে মাথার চুল ছিঁড়ছি, ঠিক সেই সময় এক দামাল ঝড় এসে আমাকে একটা গাছের ডালে লটকে দিল। সরদার্জী একটা ফ্রড। টাকা পয়সা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। মাঝখানে আমাকেও একটা ফ্রড বানিয়ে রাস্তায় ফেলে গেছে। ক'দিন থেকেই আমার কাছে জমা টাকাটা সরদার্জীকে দেয়া হয় নি। ভর্তি নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। একদিন অফিসেও গিয়েছিলাম, পাই নি। একদিন হাওড়ার অশোকা হোটেলেও। সেখানে ক্যাফেটারিয়ার ম্যানেজার বলল, সরদার্জী তো বোর্ডার নয়, এখানে খেতে আসত। বেশির ভাগ ব্রেকফাস্ট। এখন কিছুদিন ধরে আসছে না।  মনে পড়ল, আমি এলে ওই সময়েই আসতাম। ব্রেকফাস্টের সময়। একবারও মনে হয়নি সে বোর্ডার নয়। বেয়ারাদের সবাইকে তো চিনত! সন্দেহের একটা তুলো আমার চারপাশে ঘুরতে লাগল। সোজা জুনের অফিসে চলে যাই, সব শুনে মাটিতে বসে পড়ি যেন। 'ইউ আর স্টিল ওয়ার্কিং উইথ হিম? হি ইজ আ ফ্রড, শান্তিপুর। আই অ্যাম সরি। আই ব্রট ইউ টু হিম। আই অ্যাম রিয়েলি সরি, ডিয়ার।' ম্যাগাজিন অফিস থেকে লোক এসেছিল খোঁজ করতে। ঐ অফিসটার শুধু ঠিকানাই ব্যবহার করত সর্দার, ওর নিজের টেবিলও ছিল না....' আর শুনে কী করব? মনে পড়ছিল সরদার্জীর বেপরোয়া চলাফেরা। ট্যাক্সি চড়ত। ব্রড্ওয়ের ব্যালেন্টাইন বারে একসঙ্গে বীয়ার-ও খেয়েছি, সঙ্গে লোভনীয় সন্যাক্স। ওর চলাফেরায় আমি স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম। আমার গাড়ি, বারে বন্ধুদের নিয়ে হুল্লোড়... একজিকিউটিভ উত্তমকুমারের জীবন। 

ফরিদ আমার মনটাকে বুঝে ফেলতে পারে আমার দিকে তাকালেই, 'চায়েঁ লায়েঁ, হারুণজী?' চা? কার পয়সায়? পকেটে পড়ে আছে বউবাজার টু চাঁদনির কোন না কোন সাধারণ শ্রমিক কর্মচারির পয়সা। বিশেষ করে মনে পড়ছিল, চাঁদনির প্লামবিং শপের সেই ঘর্মক্লান্ত কর্মচারিটির মুখটা। আজো, এই পঞ্চাশ বছরের দুরত্বেও মনে পড়ে মুখটা আর এক অসহায়ত্বের রক্ত ছনছনিয়ে ওঠে সারা শরীরে। ছয়মাসের জন্য সে বুক করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সোভিয়েত নারী। তার টাকা আমার পকেটে। কার টাকায় খেয়েছি বিরিয়ানি, চাঁপ, ফিরনি? ফরিদ সম্ভবত আমার ফ্যালফ্যাল করে চাওয়া মুখের দিকে চেয়ে জেনে গিয়েছিল, আমার কাছে টাকা নেই। চা আর আনে নি সে। 

আমি ক্রমশ ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছি। আমি প্রতিদিন ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছি। অথচ আমি জানি, আমাকেই এ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমাকেই নির্দেশ দিতে হবে আমাকে, কী করতে হবে। আমাকেই বলতে হবে আমাকে, এটা করো, এটা কোর না। এ যে কী বিষম বিভ্রান্তি!

এক সকালে আঙ্কল প্যাটার্সন এলেন। এই সময়টা আমজাদীয়ায় আসেন ব্রেকফাস্ট করতে, কাজে যাবার আগে। বেঁটে খাটো মানুষ। সাড়ে চার ফুট? গোলগাল। পাট ভাঙা চেক শার্ট, গুঁজে পরেন। সারা শরীরটাই ফুটবলের মত। হাত দুটো ছোট ছোট, পা-ও। হাতের আঙুল মোটা মোটা। কিন্তু বামনবীর না। ল্যুকদের নিচে আমারটার মতই এক ঘরের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকেন। সাত কুলে কেউ আছেন কিনা আমরা কেউ জানি না। খিদিরপুর ডকে কাজ করেন, আয়রন ওর জাতীয় নানা মিন্যারালসের লোডিং আনলোডিং তদারকীর কাজ। সোজা আমার টেবিলে এসে বসলেন। 'অফিস যাচ্ছ, আঙ্কল?' না আজ দেরী করে যাবেন। লাঞ্চের পরে। নাও যেতে পারেন, একটা জাহাজ চরায় আটকে গেছে, তাই ঠিক নেই। 

'বাট হোয়াই ইউ লুক স্যাড, ডিয়ার?' খুব স্নেহশীল মানুষ। আমাকে অযথাই ভালোবাসেন। জানেন, আমিও তার মতই একা মানুষ। চাকরি খুঁজছি। পড়াশুনাও করতে চাই। 'কাম অন, ইউ আর অলওয়েজ আ চেয়ার্ফুল চ্যাপ!' যেন আমি আমার ভেতরের সব কিছু ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে উজার করে দিয়ে বসেছি। তবে কি আমার মুখে অসহয়তা ফুটে উঠেছে? হয়ত। আমি বললাম সব কথা, আমি কী ভাবে আমার জীবনের এক মহা সনদ্ধিক্ষণে এসে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসে আছি। আমার আগের সব হিসাব কী ভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এখন কোনোটাই এক নম্বর না, কোনটাই তিন নম্বর না। ফোটগ্রাফির প্রতি আমার আগ্রহ ইতিমধ্যে না-এর পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে পাড়ে আছাড় খেতে শুরু করেছে, কিন্তু অত টাকা পাব কোথায়? দাদা বলছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং, দাদা মিছিমিছি আমার ওপরে ভরসা করছেন তাও না। কিন্তু আমি তো সাংবাদিক হতে চাই। পাকিস্তানে বসে কি আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম না? আর ইংলিশ অনর্স। অনর্স পড়লেই যে ইংরেজি লেখায় হাত পেকে যাবে গ্যারান্টি কোথায়?

আঙ্কল মন দিয়ে চোখ পিট পিট করে সব শুনলেন। আমি উত্তরের অপেক্ষায়, হঠাৎ বললেন, 'লেটস গো টু মাদার মেরী। শী উইল শো আস দ্য ওয়ে।' মাদার মেরী? আমি অবাক। বললেন, 'ইয়েস মাদার মেরী। দ্য সেম সিচুয়েশন কেম টু মাই লাইফ টূ, শান্তিপুর! মাই পসিশন ওয়াস মাচ ওয়ার্সট দ্যান ইয়র্স, আই ওয়েন্ট টু মাদার। শী টোলড মী হোয়াট টু ডু, হুইচ ওয়ে টু ডু। আই ফলোড হার। লুক, হোয়াট আই আম টূডে।' সত্যি, আঙ্কল  সদাহাস্য সুখী মানুষ। আমরা বলাবলি করি। সকালে বিকালে চান করেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্যান্ট শার্ট। নিভাঁজ আঁচড়ানো চুল। মদ্যপান হয়ত করেন। আমরা কেউ টের পাই না। পাড়ার সবাই আঙ্কলের প্রশংসা করেন। নিন্দে শুনিনি একটাও, কারো কাছেই।

'তুমি অপেক্ষা করো, আমি জামা কাপড় পাল্টে আসি। রাতের বেশেই আমজাদীয়ায় এসে বসেছি তো?' খপ করে হাতটা ধরে টেনে বসিয়ে দেন আমাকে, 'হোয়াট? ইউ আর গোয়িং টু গড'স প্লেস, শান্তিপুর। গড উইল সী ইউ, নট ইয়োর ড্রেস, ডিয়ার! নো ওয়ান ইজ ডার্টি টু মাদার মেরী। এভরিওয়ান ইজ হার চাইল্ড...' বলতে বলতে চলতে শুরু করেন। আমি তাঁকে দম দেওয়া পুতুলের মতো অনুসরণ করতে থাকি। কাছেই বৈঠকখানা চার্চ। শুনেছি, জব চার্ণকের চার্চ। কোনদিন ভেতরে যাই নি। আমি কোনদিনই কোন মন্দির মশজিদ বা চার্চের ভেতরে যাই  নি। আজ গেলাম। শুধু গেলামই না, আঙ্কল প্যাটার্সনের নির্দেশ মেনে একটি মোমবাতি নিয়ে চার্চের ভেতরে একেবারে মেরীর পায়ের কাছে। আঙ্কল যেমনটা করেন। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে মাদারের পায়ের কাছে রেখে, ফিরে এসে দুমুঠো একত্র করে, হাঁটু গেড়ে, টেবিলে কনুই চেপে বসে যাই। আঙ্কল আমার পিছমের সারিতে। শুধু ফিসফিসিয়ে বললেন, 'প্রে'.

প্রে? আমি তো প্রার্থনা করতে আসিনি! আমি কেন এসেছি? আমিই জানি না। চোখ বুজি। কিন্তু কোথা থেকে ঢল দিয়ে আমার দু'চোখ ভিজে গেল। মাদার মেরীর দিকে তাকাতেই দু'চোখ বেয়ে.
আমার গাল বেয়ে অশ্রুর ঢল নামল। হাতের পিঠ দিয়ে তা মুছতে যাব, হঠাৎ মনে হলো, 'আরে, হচ্ছেটা কী?! হচ্ছেটা কী অরুণ চক্রবর্তী? নিজের ওপর নিজের সব আস্থা খতম? নিজের সব শক্তি লোপাট এই একটি বিভ্রান্তিতে? সেই ভগবান ভরসাই জীবন? উঠে দাঁড়াই। ঘুরে সোজা চলে যাই চার্চের বাইরে। আঙ্কলের জন্য অপেক্ষা করি না। আঙ্কল খানিক পরে বাইরে এলেন, 'হোয়াট হ্যাপ্পেন্ড, শান্তিপুর? শী ইজ নট গড অফ মাইন, আ ক্রিশ্চিয়ান। শী ইজ ফর অল। অল হিন্দুস, মুসলিমস...' আমি হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকি, 'দ্যাটস নট দ্য পয়েন্ট, আঙ্কল। আই ওয়ান্ট টু বি আ মী। আই অ্যাম অরুণ, অরুণ চক্রবর্তী। আই উইল হ্যাভ টু উইন অল অডস, এন্ড অল বাই মাইসেল্ফ, আঙ্কল....'

কয়েকদিন পরেই ফোটগ্রাফির ভর্তির ইন্টারভ্যু। টেবিলের ওপারে কলেজের প্রিনসিপ্যাল মনে হল। দু'পাশে দু'জন। 'তুমি তো টেস্টে ফার্সট হয়েছ। তোমাকে ভর্তি করলে কন্টিন্যু করবে তো, নাকি ছেড়ে অন্য লাইন পেলে চলে যাবে?' আমি আর চালাকি করব না। মনে মনে ঠিক করি। বলি, 'যদি, ইংরেজি অনর্স পেয়ে যাই, স্যার, তাহলে ফোটোগ্রাফি পড়ব না।' প্রিনসিপ্যাল প্রশংসা করলেন আমার স্বচ্ছ চিন্তার। বললেন, 'তোমার ফোটগ্রাফি হবে। তবু ভর্তির আগে ভেবে দেখো।' ফাইন্যাল সিলেকশন লিস্ট যখন টাঙানো হল। আমার নাম কোথাও নেই। মন খারাপ হল বটে, তবে হতাশ হইনি আর।

এরপর এলো বিই কলেজের ভর্তির টেস্ট পরীক্ষা। ইংরেজী অনর্সে ভর্তি মোটামুটি স্থির। সিএনআর আমার নতুন ফর্মটা ভরিয়ে রেখেছেন, বলেছেন, হয়ে যাবে। বেলাবেলি কলম টলম ঠিকঠাক করে শিবপুর রওনা হলাম। কিন্তু মন চাইছে না। দাদার মুখটা মনে পড়ছে। দাদা আমার ছোটবেলা থেকেই বলতেন, আমার নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কিল জন্মগত। আমি ভবিষ্যতে ভালো ইঞ্জিনিয়ার হব। ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে আমার ধারণা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। পরে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা শুনেছিলাম। আগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু... শিয়ালদা থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে বাসবদল করে শিবপুর। আমি ডান দিকের জানালায়। হাওড়ার ভীড় ঠেলে ঠেলে যাচ্ছিল বাসটা। আমার মনে ভীড়-- পরীক্ষা দেব কি দেব না। হঠাৎ দেখি 'অজন্তা' সিনেমা হল। বিশাল হোর্ডিং। 'নির্জন সৈকতে'. অনিল-শর্মিলা। নেমে পড়ি। আমি তো টেস্ট দিয়েও সিলেক্ট না হতে পারি! পরীক্ষা না-দিয়ে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরেছি, এই কথাটা দাদা না-জানলেই তো হল...

_____________________


20. // ক্যানভ্যাসার //


একদিন বাইরে যাবার মুখে জুনের সঙ্গে দেখা, জুন জিরার্ড। সেদিন সবার ছুটি। ফ্লয়াটের বাইরে দড়িতে কাপড় জামা মেলছিল। আমাকে ডাকে। আলতো ভেজা ভেজা শরীর। ওর শরীরকে জরিপ না করে ওর দিকে তাকানো অসম্ভব। সেটা জুন নিজেও জানে। কিছু মনে করে না। বলে, 'শান্তিপুর, ইউ আর লুকিং ফর আ জব, আই অ্যাম টোল্ড।' বললাম, ঠিক শুনেছ। 'আই নো সাম ওয়ান, হি ওয়ান্টস ইন্টেলিজেন্ট ইয়ংম্যান। ফর ক্যানভাসিং।' আমার তখন সাংবাদিকতার থেকেও বড় দরকার একটা কিছু করে পকেটে কিছু রাখার। কাগজ কিনতেও তো পয়সা লাগে! এস্প্লানেড যেতে অন্তত এক পিঠের বাস ভাড়া তো দিতে হয়। এক পিঠ না হয় হন্টন। মেজদার দোকানে কেক পিসের পয়সাও অনেক সময় বাকি পড়ে যাচ্ছিল। স্টের্টসম্যানের বিলও। জুন বলল, 'টুমরো, নাইন থার্টি। আই উইল টেক ইউ টু দেম। দেয়ার্স আরে নিয়ার মাই অফিস।'

জুনদের অফিসটা ছিল, তখন ব্রেবোর্ণ রোড-হাওড়া ব্রিজ কানেক্টর ফ্লাই ওভার তৈরি হয়েছে কিনা মনে নেই, তার ডান দিকে। তেতলায়। ঝুলে কালিতে যেমন হয় বিল্ডিং তেমনি। টানা বারান্দায় পরপর অফিস। জুনদের অফিসের পাশেই, দুটো অফিস বাদে একটা অফিসে নিয়ে গেল। চাকরিতে জুটে গেলাম। সদার্জি বস। ঝকঝকে চেহারা, বাংলা হিন্দি ইংরেজি তিন ভাষাতেই চোস্ত। মুহূর্তে আকর্ষণ করার পার্সোন্যালিটি। কাজঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা প্রকাশনের গ্রাহক সংগ্রহ করতে হবে, নানা কনসেশন্যাল স্কীমে। আমি খুশি অন্য কারণেও। ওই সোভিয়েত ইউনিয়ন পত্রিকাটি দেখে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে রাখা হত। আইসোটপ আবিষ্কারের কথা এই পত্রিকাতেই প্রথম পড়েছিলাম। এই পত্রিকা মানেই মানুষের কাজের খবর, খেত-খামার কল-কারখানা সবাই সবখানে কাজ করছে তার ছবি। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। মেশিন ধান কাটছে, কল নিজে নিজেই তৈরি করছে নানা জিনিস এই সব ছবিওয়ালা লেখা। বাবা বলতেন, মানুষকে  সমান মর্যাদা দিলে সবাই কাজে উৎসাহ পায়। কম্যুনিজম মানে, সমান মর্যাদা, সমান সম্মান। আমি পত্রিকাগুলো আর রসিদ বই একটা বড়  খামে ভরতে ভরতে ভাবলাম, আমাদের শ্রমিক কৃষকদের খুব উৎসাহিত করার পত্রিকা এসব। সবার কাছে পৌঁছে দেয়া একটা বড় কাজ হবে। সর্দার্জি বললেন, আজ এসব নিয়ে বাড়ি যাও। ভালো করে দেখ, হোয়াট আর দ্য গুড আবাউট দীজ। উই উইল ডিসকাস নেক্সট।' পরদিন হাওড়ার অশোকা হোটেলে যেতে বললেন। সর্দার্জী আমারই কাছে পিঠের বয়স, কিন্তু অভিজ্ঞতায় আর স্মার্টনেসে আমার চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে।

আমি নিজেই ঠিক করে নিলাম, বউবাজার টু চাঁদনি। সর্দাজীও বলল, 'ঠিক আছে, আমি অন্যদের অন্য জায়গায় রিক্রয়ুট  করছি।' তারা কারা জানি না, নইলে একটু শিখে টিখে নেয়া যেত ওদের ফিল্ড এক্সপেরিয়েনস থেকে। বেশ চলতে লাগল আমার ক্যানভাসিং। নানা দোকানের কর্মচারিরাই আমার লক্ষ, আমার যুক্তি আর জীবন-সম্ভাবনার কথায় অল্পেতেই বিশ্বাসী হয়ে উঠতেন তারা। টাকা দিয়ে মাসিক, ত্রৈমাসিক এমন কি ছয় মাসের জন্যও গ্রাহক হতে থাকে তারা। সর্দার্জী খুব খুশি, 'তুমি ব্রিলিয়ান্ট সেলসম্যান, অরুণ, ইউ উইল গো ফার ইন ইওর লাইফ।' আমার উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে যায়, গ্রাহকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমার কমিশনও। একদিন আমজাদীয়ায় 'বিরিয়ানি' অর্ডার করলাম। ফরিদ থ। মনি ব্যাগ খুলে অনেকগুলো নোট দেখালাম, 'কমায়া ভাই। ম্যায় বহত খুশ আজ।' ফরিদও খুশি। বেছে বেছে ভালো পীস, বেশ খানিকটা পরিমাণ বাড়িয়ে জাফরানে ম ম করা বিরিয়ানি নিয়ে এলো। সম্ভবত সেটাই আমার নিজের পয়সায় প্রথম এলাহী খাওয়া।

আমি জানতাম, এখানেই জীবনের শেষ না। এটা শুরু মাত্র। তাই ক্যানভাসিংয়ের  ফাঁকে ফাঁকে আমার অন্য চেষ্টাগুলো বস্তাবন্দী ছিল না। গ্রাজুয়েট কের্সে ভর্তির মর্শুম শুরু হতেই কোমর বাঁধি। সীটী ডে আমহার্শটে পড়ব, কেননা, বাড়ির কাছে। দুই, চেনা কলেজ। কিন্তু পড়ব আমি ইংরেজি অনর্স। যদিও ইংরেজিতে মারক্স কম। ৫৩ কি ৫৪, মনে নেই। কলেজ অফিস আমাকে হঠিয়ে দিল। অঙ্কে অনর্স নাও, নিদেন কেমষ্ট্রি বা বাংলায়, ইংরেজিতে অসম্ভব। আমি হতাশ হবার মানুষ কোনদিন্ই না। তবে ফেল টেল করি। এখানে যেমন ঘটতে চলেছে। মানে, আমার সাংবাদিকতা ফেলের মুখে। ইংরেজি না শিখলে সাংবাদিকতা হবে না, তা বাংলাতেই হোক বা ইংরেজিতে, সেটা বুঝে ফেলেছি। একটিও বাংলা নিউজ ঊইক নেই। শুধু যুগান্তর আনন্দবাজারের স্থানীয় সংবাদ পড়ে কি আর সাংবাদিক হওয়া যায়? ইংরেজিতেও নেই কোন নিউজ উইক্লি। ডাইজেস্ট পত্রিকা বলতে 'রিডার্স ডাইজেস্ট', কিন্তু সেটা তো খবরের না। নানা ধারার ইংরেজি লেখালেখির সঙ্গে অবশ্য পরিচয় হয়, খুব কাজের। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে রিডার্স ডাইজেস্ট কিনি, এই একমাত্র পত্রিকা, যা কয়েক বছর পরেও পড়ে একই আনন্দ পাওয়া যায়। 'টাইমস' পত্রিকার দাম তো আমাকে বিক্রি করার মত। তাও মাঝে সাঝে কভার স্টোরির প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীয়তা খুটে খুটে দেখে কিনে ফেলি। তখন মনে হত, এই সময় যদি বাড়িতে থাকতাম! দাদা 'টাইমস' পত্রিকার ভক্ত। নিয়মিত রাখতেন। নিজে নিজে ইংরেজি শেখা ছাড়া উপায় কি? তাই ইংরেজি অনর্সচাইই চাই। ইংরেজিতে ডায়রি লেখা বন্ধ করেছি দিন সাতেক চেষ্টা করার পরই। আর্টিক্ল জানি না, পার্টস আফ স্পীচ জানি না, টেনসের জ্ঞান নেই, সবচেয়ে বিপদ, আমার ইংরেজি শব্দ ভান্ডার খুব খুব সীমিত। এঙ্গলোদের সঙ্গে ঝরঝরিয়ে কথা বললেই কি আর ইংরেজি শেখা হয়? মনে হয়. ওদের  শব্দ ভান্ডারও কম। শ' খানেক? তাও সন্দেহ হয়। সুতরাং পড়া ছাড়া উপায় নেই। তাতে ইংরেজি লেখা শিখতে না পারি, ইংরেজিটা জানতে তো পারব? স্টেস্টসম্যান তো আছেই, আছে আমেরিক্যান লাইব্রেরি, সাতদিনে একদিন ইন্ডিয়ান একস্প্রেসে দিল্লি এডিশন, আর মাঝে সাঝে রীডার্স ডাইজেস্ট আর টাইমস। সারাক্ষণ সংবাদের দুনিয়ায় ভেসে বেড়াই।

কাগজে একটা বিঞ্জাপন দেখে আনন্দে ফেটে পড়ি। যাদবপুরের  রিজিওন্যাল ইনস্টিট্যুট অফ প্রিন্টিং টেকনোলজিতে ফোটোগ্রাফি ক্লাশে কয়েকটা সিট, ভর্তির পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হবে। ফোটো জার্নালিজম তো খারাপ ব্যাপার না! আমেরিক্যান লাইব্রেরিতে গিয়ে ফোটো জার্নালিজমের ওপর বেশ কিছু বই অ্যালবাম খাবলে খাবলে দেখে আমার উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে এলাম। লাইব্রেরিতে বসে নিজের কল্পনায় কিছু কোশ্চেন আনসারও ঠিকঠাক করে নিলাম। পরীক্ষা দিলাম, রেজাল্ট বেরুল। আমার নাম এক নম্বরে। মানে, আমি টপার! জীবনে কোন দিন ফার্সট হইনি। স্কুলে মলয়টা ঐ জায়গাটা এক বছরের জন্যও ছাড়েনি। আমি সেকেন্ডই থেকে গেছি চিরকাল। একি কান্ড! মাকে লিখলাম, ' মা, আমি ফার্সট। তোমার ছেলে কলকাতায় টপার। ফোটোগ্রাফি কলেজের পরীক্ষায়।' 

উত্তর এলো দাদার কাছ থেকে। চিঠিটার বয়ান এই রকম-- 'ছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই তোর মধ্যে এক মস্ত ইঞ্জিনিয়ারের সম্ভাবনা দেখেছি। ছবি তোলার নেশা ছেড়ে, বিই কলেজে এডমিশন নে। ভর্তির ফর্ম জমা দিয়ে এডমিশন টেস্টের অ্যাডমিট কার্ডের কপি আমাকে পাঠাবি। আমি দেখতে চাই, তুই চেষ্টা করেছিস, পরীক্ষা দিয়েছিস।' বিপদ। আমাদের পরিবারে দাদা এমন একটি ব্যক্তিত্ব, যাঁকে অমান্য করার কথা আমরা ভাই-বোনেরা ভাবতেই পারি না। দাদা কোনদিন আদেশ করেন না, মনে হয়, যেন দুটি হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করছেন। আমি ধস্ত হয়ে গেলাম এই চিঠি পেয়ে।

শিবপুরের বিই কলেজে ভর্তির ফর্ম জমা দিলাম। অ্যাডমিট কার্ড এলো। ঢাউস কাঁচের বুকে ভুষো কালির ছাপে ঘটাং ঘট, জেরক্স কপি হল। পাঠিয়ে দিলাম কপি, দাদাকে। ফোটোগ্রাফির কী হবে? আমার অবশ্য ফোটগ্রাফি ক্লাশের ঘোরটা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে তখন। আমার একটা আদ্দিকালের মরচে ধরা কোডাক বক্স ক্যামেরা ছিল। ছবি তোলা আমার চিরকালের নেশা। ফিল্ম রোল কেনা, তার নেগেটিভ করা প্রিন্ট করা-- মস্ত খরচ। এখনো আমার কাছে ঠাসা প্রায় এক কারটন নেগেটিভ রাখা আছে, প্রিন্ট করা হয় নি। কোডাক পাল্টে দামী ক্যামেরা জুম ওয়াইড। তার ওপর ট্রাভেলিং... ভয় হতে শুরু করল। অন্যদিকে ইংরেজি অনর্সে ভর্তি হবার কোন সম্ভাবনাও দেখছিলাম না। ৫৩ মারক্স নিয়ে ইংরেজিতে অনর্স দেয়া যায় না, জিদ ধরেছে কলেজ অফিস। আমি আবার চক্রব্যুহে ফেঁসে যাই। দাদা যাই-ই বলুন, আমার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিঙ্গের কোন ছটা নেই। ওটা দাদার  কল্পনা প্রসূত। ফোটোগ্রাফি ধীরে ধীরে না-এর দিকে চলে যাচ্ছে, ইংরেজি অনর্স সুদূরে। তাহলে? ক্যানভাসিং সম্বল? ফ্রম দুধ টু মেডিক্যাল ভায়া আইস্ক্রিম এন্ড ম্যাগাজিন? পার্ক সারকাস অঞ্চলে বেশ কিছুদিন দুধের ক্যানভাসিং করেছি, বোতলের দুধের গ্রাহক সংগ্রহ করতাম, কিছুদিন আইস্ক্রিমের ঠেলা ঠেলে হকারিও করেছি। এখন চলছে ম্যাগাজিন। এরপর না হয় মেডিক্যাল। সেই সময়ে আমার বয়সীদের মধ্যে দুটি ক্ষেত্রে ক্রেজ। মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ আর 'জেনারাল অর্ডার স্কপ্লায়ার্স', মানে, আলপিন টু কাগজের বড় বড় রিম সাপ্লাই, অর্থাৎ যাবতীয় স্টেশনারি সাপ্লাইয়ের কাজ। তো না খেতে পেয়ে কলকাতার ফুটপাথে আমার কঙ্কাল কোনদিন পড়ে থাকবে না, তাতে আমি স্থির।

দিনের সিটিতে একদিন মরীয়া হয়ে পৌঁছে যাই। একজন সিনিয়ার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করি, 'আপনাদের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে স্নেহশীল, ছাত্রবৎসল, ইনস্পায়ারিং টীচার  আছেন কেউ? কে তিনি?' ছাত্রটি ঝট করে বলে, 'সিএন্আর, সি এন রায়। ওঁর মত টীচার  হয় না। যেমন সৌমিকান্তি (ইংরেজিতে বলেছিল, শব্দটা মনে পড়ছে না এখন) তেমন কাইন্ড।' ছেলেটি আমাকে স্যারের বাড়ির নাম্বার দিতে পারল না, ডিরেকশন দিল। ক্রিষ্টোফার লেন। এন্টালি পেরিয়ে ডান দিকে বাঁক, সুন্দরী মোহন এভুন্যু, তার ডান দিকে। 

পরদিন সকালেই, কলেজে যাবার সময়ের আগে পৌঁছে যাই সি এন রায়ের বাড়িতে। ব্লাইন্ড লেনের মুখে দরজা। হাল্কা পর্দা হাওয়ায় দুলছে। ঠান্ডা পরিবেশ। কড়া নাড়বার আগেই পর্দা তুলে দেখেন, আমি প্রণাম করি। অমন সৌম্যকান্তি মানুষকে প্রণাম না করে থাকতে পারিনি। গোলপনা মুখে গোল ফ্রেমের চশমা, গায়ের রং ফর্সা, পাট করে চুল আঁচাড়ানো, 'এসো।' আমি ভেতরে যাই, ছোট ঘর কিন্তু অনেক বড় পৃথিবী। আলমারিতে টেবিলে গাদা বই, ছাদের পায়ের কাছে, দেয়ালের মাথায় তিন পাশ জুড়ে শেল্ফ, ঝকঝক করছে বই। আমি কাতর ভাবে সব নিবেদন করলাম। আমার সব কথা বললাম তাঁকে (আমার ইংরেজির অদক্ষতার কথা গোপন রেখে), ইংরেজি আর বাংলায়, 'আমাকে সাংবাদিক হতেই হবে, স্যার। বাংলা পড়ে সাংবাদিক হওয়া যায় না। বাংলা ভাষা সাংবাদিকতার ভাষা নয়, স্যার।' সব শুনে একসময় বললেন, 'কলেজের সময় হয়ে এলো। তুমি কাল কলেজে বেলা বারোটা নাগাদ আমার  সঙ্গে দেখা কোর। আমি টীচার্স রুমেই থাকব।' দূর দিগন্তের কোথায় যেন, ঝলসে উঠল এক চিলতে বিদ্যুৎ। 

পরের দিন দেখা করলে বললেন, ‘সামনের সপ্তাহে তারকবাবুর সঙ্গে কথা হবে। তুমি নতুন একটা ফর্ম সংগ্রহ করে রাখ।’ হবে হবে না,  হবে না হবে। দম বন্ধ অবস্থা আমার। এদিকে ফোটোগ্রাফি এডমিশনের ইন্টারভ্যু এগিয়ে এলো। শিবপুরের এডমিশন টেস্টও।
------------------------



19. // খোদ গুরু //

রাতের কলেজে ক্লাশ শুরু হতেই বিকেলের ট্যুশানি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সকালে একটা ট্যুশান, তারপর দিনের বেলায় এখানে ওখানে। বিকেল হতেই কলেজ মুখো। এবার রাতের কলেজ শেষ। আর দমবন্ধ করা রাতের কলেজে না। দিনের কলেজে ভর্তি হতেই হবে। প্রস্তুতি নিতে থাকি। একই সঙ্গে লেগে থাকি সাংবাদিকতার প্রস্তুতিতে। কি করে সাংবাদিক হতে হয়? সাংবাদিকরা কী করে? কী ভাবে সারা পৃথিবীর খবর পৌঁছে যায় তাঁদের হাতে? এ সব অনুমান করতে পারলেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না। বুঝি, এজন্যেই যুগান্তরের সেই নিউজ এডিটর বলেছিলেন, খবরের কাগজের অফিসের চারপাশে দেখে দেখেও নিজের ভেতরে একটা প্রস্তুতি তৈরি করা যায়। যুগান্তরে এরপর গেছি কয়েকবার, কিন্তু ওভাবে হয় নাকি? নিউজ এডিটর আমাকে খুব আদর করে বসতে টসতে দিতেন তা তো নয়। চোখের পাশে মণি টেনে এক দুবার দেখেছেন, এই যা। যুগান্তরে যাবার আগ্রহটা এভাবেই একসময় কমে যায়, তবে সাংবাদিক হবার আগ্রহটা এসব থেকে বেড়ে যায়, জিদ ধরে নেয় যেন। স্টেটসম্যান ছাড়া কোন কাগজ পড়ি না। ছোটবেলায় দাদা বলতেন, ইংরেজি শিখতে হলে স্টেটসম্যান পড়তেই হবে। জানি না কেন, আমাদের ছোটবেলায় এই কথাটা খুব চালু ছিল। অন্যদের মুখেও শুনতাম।  স্টেটসম্যানের প্রতি আমার দুর্বলতা সে কারণেও হতে পারে।

আমি এস্প্লানেডে ইউএসআইএস (আমেরিকার তথ্য সংস্কৃতির) লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলাম। এখন মেট্রপোপলিটান বিল্ডিঙ্গসের একতলায় যেখানে কটেজ ইন্ডাস্ট্রির এম্পরিয়াম সেইখানে ছিল লাইব্রেরিটা। সুরেন ব্যানার্জী ড়োডের দিকে পুরোটা কাঁচের দেয়াল। পাশ দিয়ে প্রবেশ। ঝকঝক করত ভেতরের সুসজ্জিত লাইব্রেরি, রিডিং কর্নার। বাইরে থেকে দেখলেই ইচ্ছে করত ঢুকে পড়ি। লাইব্রেরির  সুন্দর এয়ারকন্ডিশন্ড পরিবেশটাও আকর্ষণ করত আলাদাভাবে। ওখানে গেলে নিজেকে এক অন্য পরিবেশে পেতাম। সাংবাদিকতার ওপর প্রচুর বই। আমেরিকার নানা কাগজও থাকত সেখানে। আমেরিকায় তখন চলছে হিপ্পি সমস্যা। তা নিয়েও কত বই। কী করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যায় সেই সবের আলোচনা। আমার অবশ্য আগ্রহ ছিল জার্নালিজমের র্যাকগুলোর চারপাশে। কত ঘটনা পড়তাম। উৎসাহিত হতাম। নিজে থেকেই একটা খবর নিয়ে খবরের কাগজের অফিসে ঢুকে পড়েছিল একটি ছেলে, তাঁর 'নোজ অফ নিউজ' টের পেয়ে বিখ্যাত সেই কাগজ তাকে রিপোর্টারের চাকরিতে জুড়ে দেয়। চাকরি পেয়ে যায়। পরে বড় সাংবাদিকও হয় সে। আমিও ভাবতাম, একদিন আমিও এভাবেই হয়ে যাব এক মস্ত সাংবাদিক।

ইউএসআইএস লাইব্রেরি থেকে দুটি মন্ত্র শিখে ফেললাম, যা আজো আমার লেখালেখির জীবনমন্ত্র হয়ে আছে। এক, একজন সাংবাদিক পৃথিবীর সবকিছুর ৫% জানবে, আর জানবে বাকি ৯৫%তথ্য কী করে সংগ্রহ করতে হয়, এবং দুই, পৃথিবীর যেকোন ঘটনা, এমন কি কেনেডি হত্যাও, ৩০০ শব্দের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে রিপর্ট করা সম্ভব। আমি ক্লাশ টেনে পড়ার সময় থেকেই ডায়রি লিখতাম। এপারে এসেও আমার ডায়রি লেখা চলছিল। বছর ঘুরতেই একটা ডায়রি কেনা ছিল আমার প্রথম প্রেফারেনস। এই দুই মন্ত্র আমার দিনপঞ্জী লেখাকে আমূল পাল্টে দিল। আমার দিনপঞ্জী ধীরে ধীরে পাল্টে গেল দিনমনোপঞ্জীতে। অনেকটা আজকালকার ফেসবুকের পোস্টের মত। আমার ডায়েরিতে শুধু ঘটনা না, জায়গা পেতে থাকল, ঘটনার পটভূমি, কখনো সখনো পটভূমির পটভূমি। কিন্তু সব সীমিত শব্দের মধ্যে। ডায়রির একটি মাত্র পাতায়। তা দুটোই হোক বা চারটে বা একটি মাত্র ঘটনা। আমার পড়াশুনো, আমার মেলামেশা, আমার সন্ধান সব এভাবেই হয়ে উঠল ক্যাপশ্যুল। ফাটলেই তা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাইকোন নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের গভীরে ঢুকে নিজেকে খোশমেজাজে পাচ্ছিলাম না। এক নয় বহুতে প্রবেশ করে আমার তখন দিশাহারা অবস্থা। আমার তো গুরু নেই, নিজেকেই গুরু মেনে শাসন করতে থাকি নিজের ইচ্ছারই আতিশয্যকে। এভাবে মাসখানেক যেতে না যেতে নিজেকে রীতিমত একজন তৈরি মানুষ বলে মনে করতে লাগলাম।

বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় তখন টেবিলে ঝুঁকে একটা লেখা পড়ছিলেন। সেই কিংবদন্তী সম্পাদক, নিতাইদা ভারতে আসার প্রথম দিনেই যাঁর কথা বলেছিলেন, সেই বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। আমি এতদিনে তাঁকে জেনেছি, চিনেও ফেলেছি কিছুটা। জেনে গেছি, সাংবাদিকতার এক মহীরূহ তিনি। যুগান্তর ছেড়ে দিয়েছেন। এখন বসুমতীর সম্পাদক। বউবাজারের বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে, ভেতরে, ডানদিকে সম্পাদকের ঘর। বাধা দেবার মত কোন পিওন টিওন ছিল বলে এখন মনে পড়ছে না। মাথা তুলে আমাকে নীরিক্ষণ করলেন, 'বলো? কী জন্যে আসা?' 'আমাকে যদি বসুমতীতে কোন কাজ দেন।' আমাকে আবার নীরিক্ষণ করলেন, এবার আপাদমস্তক। ঘাবড়ে যাই। বেঁটেখাট মানুষ। শ্যামলা গায়ের রঙ। চোখে চশমা ছিল? মনে পড়ছে না। চোখ দুটো ছোট, কিন্তু তীক্ষণ, জ্বলজ্বলে। 'ওঁর সঙ্গে কথা বলো। মুৎসুদ্দি, দেখো তো। কথা বলো।' দরজার পর্দার ভেতর-পাশেই, একটা টেবিল চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন মুৎসুদ্দি। কি কথা হল, ডিটেইল মনে নেই। এর মধ্যে একজন সুপুরুষ মানুষ ঢুকলেন। আকর্ষণীয় মানুষ। টুকটুকে গায়ের রঙ, কাটা কাটা মুখাবয়ব, ঝাকড়া চুল, সদাহাস্য। মুৎসুদ্দি আমাকে বললেন, 'তুমি, জীবনের সঙ্গে কথা বলো।' বলে বিবেকানন্দবাবুর টেবিলের দিকে তাকালেন। সুপুরুষ আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। কাঠের সিঁড়ির মুখে। দুদ্দাড় শব্দে লোক ওঠানামা করছে, তারই মধ্যে সব শুনে বললেন, 'অরুণ, প্রি-ইউনিভার্সিটি ইজ নট এনাফ। কম করে গ্রাজুয়েট হতেই হবে। সেটা করে আমার সঙ্গে দেখা কোর। প্রমিস। তোমাকে নেয়া হবে।' আমি ততদিনে একই রকম বোকা নই আর। গ্রাজুয়েট মানে আরো তিন বছর। মনে মনে বলি, 'আপনি তখন থাকবেন তো এখানে, জীবনদা?' বুঝি, সবখানের  বাংলা সাংবাদিকতা  এক অলক্ষ সুতোয় গাঁথা। আমেরিক্যান লাইব্রেরি থেকে  শিখেছি, এই গ্রাজুয়েট ফ্রাজুয়েট সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কোনই প্রয়োজনের ব্যাপার না। 'চলি' বলে আমি দুদ্দাড় শব্দ তুলে বসুমতীর বাইরে এসে দাঁড়াই। তখন বউবাজার স্ট্রিটে জনস্রোত, উল্টো স্রোত। গলগল করে ছুটছে ডালহৌসি টু শিয়ালদা। আমিও শিয়ালদামুখো স্রোতটায় জড়িয়ে যাই। সোজা আমজাদীয়ায়।

আমজাদীয়া আমার ভাবনার ঘর। আমার ঐ ছোট্ট ইউরিন্যাল-কাম-বেড-কাম-টি রুমে পড়াশুনা চলে, ধ্যান-ভাবনা চলে না। কয়েকদিন ধরেই দিশাহারা লাগছিল। আমজাদীয়ায় টেবিল-সারির শেষ প্রান্তে, কেবিনের গা ঘেঁষে ছিল তিন চেয়ারের একটা টেবিল। আমি বসতাম সিঙ্গলে, লম্বা রেস্ট্যুরেন্টার এনট্রানসের দিকে মুখ করে। রেস্ট্যুরেন্টের সবাই জানত, ওটাই আমার বসার জায়গা। খালিও পেতাম প্রায়ই। এক কাপ বা বেয়ারা ফরিদের বরাদ্দের অর্ধেক কাপ চা নিয়ে কাটাতাম যতক্ষণ খুশি সময়। ওরা সবাই আমাকে কেন যেন ভালোবাসত। বিশেষ করে ফরিদ। ওর কথা নানা জায়গায় লিখেছি, এখানে আবার লিখব এক সময়। জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যের সঙ্গে কথা বলার পর কেন যেন মুখটা তেতো হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে একটা জিদের শিং-নাড়া টের পাচ্ছি। একদিন চায়ের কাপটা এগিয়ে কাঁধের গামছায় হাত মুছতে মুছতে ফরিদ বলে, 'কই দিন সে হারুণবাবুকো দুঃখী দেখনে মিল রহা হ্যাঁয়। খরিয়ত হ্যায় না সাহাব?' বলি, 'দুঃখী না ফরিদ মিঞা, বহত উলঝন মেঁ ফাঁস গয়া।' ফরিদ এরকম সময় কথা বাড়ায় না সাধারণত। অন্য টেবিলে অর্ডার নিতে চলে যায়।

সত্যি, মহা উলঝনে ফেঁসেছি আমি। একটা কাজ পেলে, চারপাশটা ঠিক হয়ে যায়। আমার স্বপ্নের জীবন কাছে আসে, শঙ্কর্দা মুক্তি পান, আমি নিজেকে আরো পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠাও দিতে পারব এই মহানগরীতে। মা'কে লিখতে পারব, 'মা আমি পারি। আমি পেরেছি।' সেই পারাটাই হচ্ছে না। চাকরি কি আর পেতে পারি না একটা? পেতেই পারি। রেলে, ব্যাঙ্কে, সরকারি দফতরে, কোন প্রাইভেট ফার্মে। পারি। আমাকে তো অফিসার করবে না কেউ। নিজেকে টেনে ছড়িয়ে তো নিয়ে যেতে পারব! কিন্ত্রু সে কথা ভাবতেই ভয়ের স্রোত তিরতির বইতে শুরু করে। তা করব কেন? আমার সাংবাদিকতার কী হবে তবে? আমি জীবন-লোভী মানুষ, ছোটবেলা থেকেই। অল্প বয়স থেকেই যতই মঞ্চে মঞ্চে গান গাই, নাচি, আবৃত্তি করি, নাটক করি, দলবেঁধে ফাংশন ভন্ডুল করি, মারামারি করি-- সবই একটি দারুণ জীবনের লোভে। এখুনই যে-কোন চাকরি নিলে আমার সব হবে একদিন, জানি। কিন্তু কোনদিন সাংবাদিক হওয়া হবে না, তাও জানি।

একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ইংরেজিতে ডায়রি লিখতে শুরু করি। গুলি মারো বাংলা সাংবাদিকতাকে! আমেরিক্যান লাইব্রেরিতে সকাল সকাল পৌঁছ যাই। টিফিন টাইমের পরে অন্য কাজ। এস্প্লয়ানেড থেকে ফেরার পথে প্রতি সোমবার কিনে আনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রবিবারের দিল্লি এডিশন। সাংবাদিক আমাকে হতেই হবে। বাংলা না হোক ইংরেজিতেই। এবং গ্রাজুয়েশনের আগেই। সাংবাদিক হওয়ার অপেক্ষায় তিনটি বছর বইয়ে দেবার মত সময় তো আমার হাতে নেই...

-----------------------





18. // সিটি নাইট আমহার্সট //

কলেজ শুরু হল। রাতের কলেজে যাওয়ার অন্য রকম গন্ধ নাকে লাগে, চারপাশটাও অন্য রকম লাগে। দুপাশের দোকান, হেঁটেচলা নারী পুরুষ-- যেন অন্য এক গ্রহের বাসিন্দা আমি। কলেজ যাওয়ার পথে মানুষ সার বেঁধে হুড়মুড়িয়ে বাড়ির পথ ধরে? কলেজ যাওয়ার পথে দুপাশের দোকানগুলোতে আলো জ্বলে? কলেজ যাওয়ার পথে ল্যাম্পপোস্ট মাথা নিচু করে আলো দেয়? আমি মির্জাপুর বেয়ে আমহার্সট স্ট্রিট, ডানে বেঁকে সোজা সিটি কলেজে পৌঁছে যাই। বিশাল দালান। একটা দুর্গের মত। দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের মত খোলা আকাশের নিচে না। সেখানে ছিল, পাশেই রেল লাইন, কলেজ বিল্ডিংয়ের বাইরে বিশাল শিমূল গাছ, সামনে খোলা মাঠ-বাগান, কেয়ারি পথ, তা পেরিয়ে খেলার মাঠ, ফুটবল ক্রিকেট খেলে সবাই। এখানে কলেজে ঢোকার মুখে একটা লোহার দু'পাল্লার গেট। তাও মোটা লোহার শেকলে আলগা করে তালাবন্ধ। কাৎ হয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। আশে পাশে কোথাও টিনের কারখানা, সারাক্ষণ বাজছে ঠং ঠননন, রাস্তার উল্টো ফুটে শন পাপড়ির হালুই, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে, ক্লাশ রুমেও পাক খায় সেই সুবাস। হালুইকরের দু' দোকান পাশে একটা চাইনীজ ডাইং ক্লিনার্সের দোকান। ক্লয়ায়ন্ট নেই, অথচ সার বেঁধে ঝুলছে শাড়ি, প্যান্ট, কোট...

কলেজের সর্বত্র ন্যাংটো বালব। করিডোর  ক্লাশরুম অফিস ঘর সব খানে। ক্লাশরুমে মাথার ওপরে পাখা, মানে, একটা হাড়ির চারপাশে চারটে কাঠের ব্লেড, ধুলো কালি আর ঝুলে কালো, অ্যান্টিক। ঘুরছে। হাওয়া ছড়াচ্ছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সিটি আমাহার্সট আমার কাছে তখন একটি ঐতিহাসিক স্পট। কলেজে জলের ব্যাবস্থা বলতে একটি কোমর উঁচু বড় চৌবাচ্চা, তার চারপাশে কল, নিচে জল বাইরে যাবার চওড়া নালি। এই কল খুলে বিভূতিভূষণের 'অপরাজিত' অপু জল খেয়েছিল। আমি সেই দৃশ্য সত্যজিতের ছবিতে দেখেছিলাম। ভর্তি হতে এসে এই চৌবাচ্চা দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। ঠিক করেছিলাম এই কলেজেই, যা করেই হোক, এডমিশন নিতেই হবে আমাকে। কাঠখড় পুড়িয়ে সত্যমিথ্যে চালাকি করে তা শেষটায় করতেও পেরেছি। এই আমার জয়। প্রথম দিন সেই জয়ের স্বাদ নিলাম আঁজলা ভরে। আমার কলকাতা আসা ধন্য হয়ে উঠল।

কলেজের প্রথম দিনেই বন্ধু পেয়ে গেলাম, সন্দীপ। ওর ঠাকুর্দা ছিলেন রামকৃষি পরমহংসের সময়ের মস্ত বাঙালিদের একজন। নামে চিনলাম। এক ঐতিহাসিক ভূমিকার মানুষ। চিকিৎসক ছিলেন। হেঁদোর পাড়ায় এক গলিতে মস্ত বাড়ি। শক্ত পেটানো শরীর। রঙ ফর্সা না। তাই প্রথমটায় বিশ্বাস হয় নি ওর কথা। কলকাতার পুরানো বাসিন্দা, আভিজাত্য থাকবে না? মনে হয়েছিল। সন্দীপের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার মস্ত কারণ ক্লাশে আর সবাই বয়সে বড়। নানা জায়গায় চাকরি করে টরে সন্ধ্যেয় কলেজে আসত তারা। 'তুমি কেন রাতের কলেজে?' সন্দীপ বলেছিল, দিনে বাড়িতে দোকানে নানা কাজ থাকে তাই। আর কারো কথা মনে পড়ে না। একমাত্র অলোকদার কথা মনে পড়ে। কী ভাবে পরিচয় হয়েছিল মনে নেই। খুব সুন্দর দেখতে অলোকদা। নাতিদীর্ঘ শরীর। সুস্বাস্থ্য। গায়ের রঙ আর বেশভূষায় আভিজাত্যের ছাপ। থাকতেন আমহার্সট স্ট্রিটের অপর প্রান্তে, ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের উল্টো দিকের এক গলিতে। আমি গান ভালোবাসি শুনে আমাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইপি রেকর্ডের মস্ত কালেকশন। আমি তো স্কুল থেকেই আধুনিক বাংলা গানের ভক্ত। অনুরোধের আসরের অবদান। আমাজাদীয়ার পাশে 'মেজদার' সিগ্রেট নস্যি বিড়ির দোকান। একটা রেডিও বাজত। কলকাতায় এসে আমার গান শোনা সেখানেই। বাস ট্রামের ঘর্ঘরের মধ্যেই। অলোকদা চিন্ময় চট্টোপাধ্যের ভক্ত। তবু আমি প্রায়ই কলেজ শেষে অলোকদার সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে যেতাম গান শুনতে। ওঁর আর আমার পছন্দের মিল ছিল এমন না। অলোকদার কালেকশনের প্রায় সবটাই রবীন্দ্র গান। আধুনিক বলতে শুধুই তরুণ বন্দ্যপাধ্যায়। আধুনিক। তবু গান শোনার নেশা পেয়ে বসেছিল কিছুদিন।

একদিন দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, সন্দীপ এসে বলল, 'তুই সপ্তপদী দখেছিস? সুচিত্রা-উত্তম?' আমি দেখিনি। পাকিস্তানে তখন এপারের সব ছবি দেখানো হত না। কী করে যেন দু'একটা চলে যেত। শেষ ছবি দেখেছি বোধহয়, 'পৃথিবী আমারে চায়। উত্তম-মালা সিনহা' এপারে এসে সিনেমা দেখার নেশা ক্রমশ বেড়ে গেছে। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দি সিনেমা, নয়ত ওয়েস্টার্ন। বাংলা দেখা হয় না। অত খোঁজও রাখি না। বললঃ ' দারুণ ছবি। দেখে আয়। আবার এসেছে। আবার কবে আসবে কি আসবে না!' উত্তরের কোন এক সিনেমা হলের নাম বলল। গাইল, 'এই পথ যদি না শেষ হয়।' বেশ নতুন সুর। কথাটাও মনে গেঁথে যাবার মত।

পরের দিনই ম্যাটিনি শোতে দেখে এলাম। খুব টান টান ছবি। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের কথা মনে পড়ল। মিনুর কথাও। ওকে কতই না উত্যক্ত করেছি! তবে সপ্তপদী আমাকে ইনস্পায়ার করল অন্য কারণে। উত্তমকুমার। এটুকু বুঝলাম, জীবনে কিছু একটা হয়ে ওঠাটা এমন কোন ইম্পরট্যান্ট ব্যাপার না। কিছু একটা করাটাই বড়। আমার ভালোলাগে নি, রীনা ব্রাউনের ফিরে আসাটা। কৃষঞেন্দুর কিছু না করে ওঠাটা আমাকে অস্বস্তি দিল বেশি। সন্দীপকে পরের দিন বললাম, 'দেখে এলাম রে। দারুণ লাগল। খুব ইনস্পায়ারিং!' সন্দীপ হা হাহা করে হেসে বলে। 'ইনস্পায়ারিং? রাতের কলেজ, গুরু! এখানে ঐ চানস নেই।' সন্দীপের পক্ষে এটাই ভাবা স্বাভাবিক, সেটা টের পেয়েছি আগে, ওদের বাড়িতে একদিন বেড়াতে গিয়ে। ওর দুই দিদি, ফর্সা, টোপা গাল, বোকা সুন্দরী। বাড়িতে আদ্যিকালের খাট পালঙ্ক চেয়ার মাদুর। বাড়ির সামনে লাল সিমেন্টের রক। উঁচু। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হয়। বাড়ির কর্তার খালি গা, পরনে ধুতি, বুকে কাঁচা পাকা বড় বড় লোম। এক দিদি আমাকে খেতে দিলেন, একটা ঠান্ডা সিঙ্গারা, আর ঝুরঝুর হয়ে যাওয়া ছানার সন্দেশ। আধুনিকতা বলতে জল খাওয়ার কাঁচের গ্লাস। তো সন্দীপ আমার কথার এভাবেই ব্যাখ্যা করবে, অবাকের না।

সিটি নাইটের স্মৃতি আমার বেশি নেই। এক বছরের কলেজ। অসমবয়সীরা ক্লাশমেট। রাতের কলকাতার নিঃসঙ্গতা। এই সব মিলিয়েই বোধয় কলেজ আমাকে মনযোগী করে তুলতে পারে নি। সন্দীপও যে খুব নিয়মিত কলেজে আসত বা পড়াশুনায় মনযোগী মনে হয় নি। তিন পুরুষের উত্তর কলকাতার বনেদী আর সুপরিচিত পরিবার, তাদের  কাছে নাইট কলেজটাই তো বিলাসীতার নামান্তর। সেটার প্রমাণ পেলাম আর একদিন।

আমি বারান্দায় রেলিংয়ে ঝুঁকে, সন্দীপ পেছন থেকে সটান জাপটে ধরে আমাকে, 'অরুণ, দারুণ অভিজ্ঞতা। দারুণ অভজ্ঞতা রে! উফফ!' আমি যত জানতে চাই, ব্যাপার্টা কী, ও ততই উচ্ছাসে হই হই করতে থাকে। শেষটায় বলে, 'সোনাগাছিতে গিয়েছিলাম!' আমি হাসি। বড়লোকের ছেলে, 'সোনার হার বানিয়ে এনেছে। এখন দেখাবে। তারপর বনেদী পরিবারের হীরে জহরতের গল্প। কিন্তু না। সেদিনই জানলাম, সোনাগাছি মানে কলকাতার একটি বেশ্যা পল্লী। আমার সারাটা শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। বলল, ' তোকে একদিন নিয়ে যাব।যাবি তো?' ঘাড় নাড়ি, যাব। আমার তখন গা ঘিন ঘিন করলেও ঔৎসুক্য কমে না, বরং বেড়েই যায়। 'তুই ওখানে কেন গেলি? তোর বয়স হয়েছে?' 'ধ্যুৎ, এজন্য বয়স দরকার হয় না। সাহস দরকার হয়।' 'বাড়ির সবাই যদি জানে?' 'গাধা। আমি কি বলতে যাব নাকি? আমি কারো সঙ্গেই যাই নি। একাই গেছলাম।' শুনলাম সব। সোনাগাছি কোথায়। আমাদের কলেজ থেকে কতদূরে, কী করে এগোতে হয়, কী বলতে হয়... দিনাজপুরে আমাদের পাড়ার রহমান কাকুর কথা মনে পড়ল। মাঝরাতে মদে চুর হয়ে ঢুলতে ঢুলতে চিৎকার করে নানা ধরণের গান গাইতে গাইতে রিকশা করে বাড়ি ফিরতেন। বাবা-মাকে বলতে শুনেছি রহমান কাকু বাসুনিয়া পট্টির গলি থেকে ফিরছেন। জানতাম শহরের বেশ্যা পল্লীটা ছিল ওরই কাছে পিঠে।

ঘরে ফিরে উদোম হয়ে সাবান ঘষে ঘষে নিজেকে সাফসুত্র  করলাম। জামা প্যান্ট গেঞ্জি জাঙ্গিয়া সব সাবানে ফেনা তুলে তুলে পরিষ্কার করলাম। জানি, বেশ্যাপল্লীতে নানা রোগের মারণ জীবাণু কিলবিল করে। সে রাতের পর থেকে সন্দীপকে দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে উঠতে লাগল। ওকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থাকি। আমার বন্ধুত্ব না থাকলে সন্দীপের যে কিছু যায় আসে না, জানতাম। ওর প্রতি আমার ঘৃণা দিন কে দিন বাড়তে থাকে। কলকাতার বাবু কালচারের কথা জানি। তাবড় তাবড় মহানায়কদের কথাও শুনেছি, পড়েছি, সন্দীপ আমার কাছে তাই কোন বিস্ময় ছিল না। আমি ওদের ছাঁচের মানুষ নই এটা জানতাম, তাই ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কোন রকম প্রয়োজনই ছিল না। প্রায় ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হল। হলও তাই। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে।

অথচ এই নিন্দিত ঘৃণিত সন্দীপই কিছুদিন পরে আমার এক ধ্বস্ত সময়ের কান্ডারী হয়ে উঠল। সে কথা বলি।

আমি রাতে পুড়াশুনা করতাম। সকালে ট্যুশানি, দিনে নানান কাজের ধান্দা, সন্ধ্যা রাতে কলেজ, রাতে হাইড্রয়ান্টের আড্ডা-- সব মেটাবার পর পড়াশুনা। অনেক রাত অবধি। কখনো সখনো ভোর হয়ে যেত। শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে এক ভাঁড় চায়ে চুমুক দিয়ে চান করে ঘুম। সেদিন ট্যুশান বাতিল। দিনের ঘোরাফেরাও। ঘুম ভেঙ্গে কলেজের পথে। এই অভ্যাসটা অনেকদিন কম বেশি ছিল। আমার শরীরের ঘড়ি এভাবেই কাঁটা মিলিয়ে নিয়েছিল। প্রি-ইউনিভারসিটির ফাইন্যালের আগে টেস্ট পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট মনমত হল না। কেমিস্ট্রি আমার চিরকালের চক্ষুশূল সাবজেক্ট। যখন আইএসসি পড়তাম তখনো। টেস্ট পরীক্ষায় পেলামঃ অঙ্কে ৮২, ফিজিক্স ৭৬ আর  ৩৪ কেমিস্ট্রিতে। সব্বোনাশ, একটুর জন্য আটকে যেতাম আর কি। মনে মনে ঠিক করলাম, এখন থেকে কেমিস্ট্রিতে জোর দেব। দিলামও। অঙ্ক আর ফিজিক্স নিয়ে তো ভয় নেই। বাংলা ইংরেজি নিয়েও না। বড় কিছু তো হব না, ফেল না করলেই হল। ফাইন্যাল শুরু হল। ফিজিক্স পরীক্ষা সবার শেষে। ফুরফুরে মন নিয়ে আগের পরীক্ষাগুলো ভালই  দিলাম। গান গাইতে গাইতে পরীক্ষা হলে যেতাম। সবাই বলত, 'তুই পাগল নাকি? এত ইম্পরট্যান্ট পরীক্ষা, টেনশন নেই?' ফিজিক্স পরীক্ষার আগের রাতে আড্ডা টাড্ডা সেরে পড়তে বসি। সব জানা। এক এক করে মোটা বইটার পাতা উল্টে যাই, মানে চোখ বুলাতে থাকি। গোটা বইটা জলবৎ লাগতে লাগল। ভারি মজা পেলাম। মনটা ফুরফুর উড়ে চলে নির্জন রাতের হাওয়ায় ভেসে ভেসে। একসময় দেখি, ওমা! ভোর হয়ে গেছে। মোরগ ডাকছে, ট্রাম বাসের আওয়াজ কানে আসছে, নিচে কেউ কয়লার উনুনের ধোঁয়াও ছড়াচ্ছে। শিয়ালদা, চা, চান। ঘুমোতে গেলাম না। ভয় হল, দশটায় পরীক্ষা, যদি ঘুম না ভাঙ্গে? একটু আলো ফুটতেই আমজাদীয়ায় যাই। 'হারুণবাবু আয়া! মালাই মার কে!' আমজাদীয়ার চা বিখ্যাত ঐ আশ্চর্য মালাই মারার জন্য। আঃ, ফ্রেশশ!

পরীক্ষার হলে বসে হাসি পেল। আনসার শিট এলো। কোশ্চেন পেপারও। গোটা কোশ্চেন পেপারটারই উত্তর দিতে পারি, উদাউট সিলেকশান। আমি এতটাই প্রিপ্যারড। চোখের ওপর দিয়ে ছুটে গেল ফিজিক্স বইয়ের পাতাগুলো।  আমার পিছনেই সন্দীপ, 'অরুণ, মাইরি, আমাকে একটু হেল্প করিস কিন্তু। জানিস তো ফিজিক্সে আমি খুব কাঁচা।' সন্দীপ কোন সাবজেক্টে কাঁচা নয়, ঐ একটি ছাড়া? হাসি পেল। হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি, মনে পড়ছে না কিছু। অবাক। ঘাবড়ে যাই। অথচ আমার সব উত্তর জানা। অনুভব করতে পারছি, কিন্তু লিখতে পারছি না এক লাইনও। এক, দুই তিন, চার... না না না, কোন কোশ্চেনেরই উত্তর লিখতে পারছি না। ঘাবড়ে যাই। পাগল হয়ে গেলাম নাকি? লিখতে বসি। না, আসছে না। আবার লিখতে বসি, না পারছি না। সন্দীপ ফিসফিসিয়ে বলে, 'বসে আছিস কেন? লিখবি না?' আমার মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে নৈতিকতা এসে ভর করে। মনে মনে বলি, 'আমার এই পরীক্ষা পাশ করার কোন অধিকার নেই। আমি আনফিট,' শুণ্য খাতা হাতে উঠে দাঁড়াই, সন্দীপকে বলি, 'আমি যাচ্ছি। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না।' সন্দীপ কেমন এক গার্জিয়ানি স্বরে ধমকে ওঠে, 'বোস। উঠবি না। বিশ্রাম কর। যেতে হলে সবার শেষে যাবি। কেউ তো তোকে যেতে বলছে না!'

বসে পড়ি। আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? আমি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেলাম? আমার সারাটা জীবন এভাবে শেষ হয়ে গেল? কান্না পেয়ে গেল। মনে মনে কেঁদেও ফেলেছি হয়ত। 'কোনটা পারছিস না?' সন্দীপ জিজ্ঞেস করে। 'ওটার মানে তো এই' বলতেই এক চিলতে বিদ্যুত খেলে যায়। কয়েক লাইন লিখে ফেলি। কিন্তু সবটা না। আবার জিজ্ঞেস করে। আবার বলি। আবার বলে দেয় সন্দীপ। একবার নিজের খাতা উঁচিয়ে দেখায় স্যারের চোখ এড়িয়ে। লিখে ফেলি। এভাবে কয়েকটা। ঘন্টা বেজে যায়। খাতা নিয়ে চলে যান স্যার। আমি ঠায় বসে। সন্দীপ আসে। দেখি মাত্র ৩০ মারক্স আনসার করেছি। মানে ফেল।  ৩০ পাশ মারক্স। হল থেকে বেড়িয়ে যাই নীরবে। মনে আছে। কলেজ থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে থাকি। আমহাসর্ট স্ট্রিটের শেষ মাথা থেকে ডাইনে বৌবাজার, বাঁয়ে বেঁকে সোজা পার্ক স্ট্রিট। বাঁয়ে ঘুরে মল্লিক বাজার। সেখান থেকে সোজা আমজাদীয়া। আমি ফিনিশড আমার স্বপ্ন ফিনিশড। আমার অভিযান ফিনিশড।

যখন রেজাল্ট বেরুলোঃ অঙ্কে ৮৫ , কেমিস্ট্রি ৬৭ আর ফিজিক্স ৩০, মানে পাশ। সন্দীপের অবদান। তাই ওকে ঘৃণা করলেও আমার জীবন থেকে মুছে দিতে পারিনি।

------------------



17. // মাইকেল //

আনন্দবাজার না কোন পত্রিকায় ছিল বিজ্ঞাপণটা। একমাত্র বিকেলের ট্যুশানিতে সামলানো যাচ্ছিল না সবটা। দুপুরে প্রায়ই খাচ্ছিলাম শঙ্করদার ওখানে, মাঝে মধ্যে রাতেও। সকাল বিকাল এটা সেটা মুখে দিয়ে চিবিয়ে ম্যানেজ করা যাচ্ছিল। তো চলে গেলাম। ফড়েপুকুর নাকি শ্যামপুকুর, এখন ঠিক মনে পড়ছে না। তবে 'কলকাতা-৪' মনে আছে। গলির পাশে মস্ত দরজা। ভেতরে লাল সিমেন্টের মেঝে, সিঁড়ি। উঠোনের চারপাশে সরু সরু পিলার। চাতালের মত। অনেকেই থাকেন এই বাড়িতে, অনুমান করলাম। সব শুনে একজন, চাতালের দড়িতে গামছা শুকোচ্ছিলেন, একটা সিঁড়ি দেখিয়ে ওপরে যেতে বললেন। কম বয়সী একটি মেয়ে, 'দাদু, দাদু তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন (নাকি এয়েচেন? মনে পড়ছে না).' বলতে বলতে একটা ঘরে নিয়ে গেল। বড় ঘর। এক দেয়ালে দুটো বিশাল জানলা। মেঝে থেকে প্রায় ঘুলঘুলি অবধি। তাতে লম্বালম্বি শিক, লাল। দু' কপাটের জানলা, সবুজ খড়খড়ির। জানলা দুটো হাট খোলা। দু'জানলার মাঝখানে যে-দেয়াল অংশ, সেখানে বেতের আরাম কেদারায় একজন খুব-বেশি-বৃদ্ধ-নন মানুষ অরদ্ধ শায়িত। চোখে গগলস। চোখ দেখার উপায় নেই। পরনের ফতুয়া আর ধুতি ধবধবে ফর্সা। সারা ঘর জুড়ে আভিজাত্যের সুবাস। ঘরের মাঝখানে মার্বেল টপের একটা টেবিল। তাতে নিপাট ভাঁজ করে রাখা আনন্দবাজার। পাশে দুটো হাতলওয়ালা চেয়ার, কাঠের। একপাশে একটা বিশাল কাঠের আলমারি, তার পাশে নানা কারুকাজের পালঙ্ক, তৃতীয় বিশাল জানালার পাশে। ঘর জুড়ে আলোয় আলোময়। কলকাতার গলিতে এমন আলোময় ঘর সচরাচর চোখে পড়ে না।

'কতদূর পড়েছ?', ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন। গভীর আওয়াজ। স্পষ্ট উচ্চারণ। গলায় অসহায়ত্বের মায়া। এই প্রশ্নের কারণ, আমার কাজ হবে এই দৃষ্টিহীন মানুষটাকে প্রতি সকালে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো। মাসে ৫০ টাকা। অনেক অনেক টাকা আমার কাছে। এক কথায় রাজি। সেদিন পড়লামও। এডিটরিয়াল আফটার এডিট খেলা রাশিচক্র, দিনপঞ্জী.. সব। খুব খুশি। মেয়েটা এক কাপ চা আর বিস্কিট দিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে মনটাও প্রফুল্ল হয়ে উঠল। আমি কাগজ রাখি না। হঠাৎ হঠাৎ শঙ্করদার বাড়িতে চোখ বোলাই। এমন পুঙ্খনাপুঙ্খ, কোনদিন না। কাইজার স্ট্রিটে ফিরতে ফিরতে মনে হল, আমি ওদের সবার থেকে আলাদা। আমি ওদের থেকে অনেক কিছু বেশি জানি। সেই দিন থেকে রবু রুমি শিলকাটাউ অসিত সবার সঙ্গে যেন একটা দুরত্ব গড়ে উঠতে লাগল আমার। রুণু কোনদিনই আমাদের দলের না। ওর মার্দাঙ্গা চরিত্রের সঙ্গে আমাদের মিল খেত না। রুণুও আমার মত শান্তিপুর শান্তিপুর ছেলেদের সঙ্গে মিশত না, বরং মনে মনে আমাদের বিরুদ্ধে একটা জন্মান্ধ ক্রোধ পুষে রাখত। যা হোক, আমার ভালো লাগতে লাগল আমার এই আলাদা সত্তাকে, সেই প্রথম দিন থেকেই।

প্রতি সকালের খবরের আনন্দবাজারের সঙ্গে একসময় যোগ হল, স্টেটসম্যান। মাইনেও বেড়ে গেল, ৮০ টাকা। আমি মহানন্দে। এই রকম চলতে চলতে একদিন বিকেলে চলে গেলাম যুগান্তর অফিসে, কাছেই। মনে হল, আমাকে কেউ যদি দু' একটা সমসাময়িক প্রশ্ন করেই বসে, বেশ ভালো উত্তর দিতে পারব। পৌঁছে গেলাম প্রধান সম্পাদক ও মালিক, তুষার্কান্তি ঘোষের কাছে। কালো কুচকুচে ভারি গোঁফ। কপালের কাছে বাবু কলকাতার কোঁকড়া বাবড়ি। অন্য কারো ঘরে ছিলেন। টেবিলের ওপর বসে কথা বলছিলেন, দু'হাতের আলগা মুঠোতে একটা লাঠি। 'আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়', বলে চলে গেলেন সেই লোকটা। তিনি শরীরটা ঘুরিয়ে বললেন, গলায় সবটুকু স্নেহ ঢেলে, 'কি চাই বাবা?' 'আমি কাজ করতে চাই। সাংবাদিক হতে চাই।' কাছে ডাকলেন, সস্নেহে কাঁধে হাত রাখলেন, 'কতদূর পড়েছ?' 'প্রি-ইউনিভারসিটী পড়ছি। সিটি কলেজে। আমাকে ট্রেইনিং দিন', কাতর প্রার্থনা জানাই। গোঁফের তলে মিষ্টি হাসলেন, 'সে তো হতেই পার। কিন্তু আর একটা পাশ দিলে ভালো হয় না? মানে গ্রাজুয়েট? নইলে বড় সাংবাদিক তো হতে পারবে না, বাবা!' আমি ওর নরম স্বভাবে সাহস খুঁজে পাই, নাছোড়বান্দা হয়ে পড়ি। 'বেশ, তুমি 'অমুকের (নাম মনে নেই এখন, চীফ রিপোর্টার) সঙ্গে দেখা কোর। কাল এসো।' আমি আত্মহারা। স্বয়ং মালিক বলেছেন আবার আসতে! সেই ভদ্রলোকের খোঁজ করলাম। আসেন নি। ঠিকানা জোগাড় করলাম, 'খেলাৎবাবু লেন', টালা ট্যাঙ্কের দিকে, রাস্তার ঢালে।

পরদিন কাগজ পড়া শেষ হলেই চলে যাই খেলাৎ বাবু লেনের সেই চীফ রিপোর্টারের বাড়িতে। শ্যামপুকুর থেকে দু' তিনটে স্টপ, হেঁটেই চলে যাই। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হল। খুব স্নেহশীল। বললেন একই কথা। গ্রাজুয়েট না হলে সাংবাদিক হওয়া যায় না, ক্লার্ক হওয়া যায়। 'তবু মাঝে মধ্যে অফিসে এসো। চারপাশে দেখে দেখেও নিজের ভেতরে একটা প্রস্তুতি তৈরি হয়। সেটা জরুরি।' এটাই বা কম কি? উড়তে উড়তে ফিরে আসি কাইজার স্ট্রিটে।

সেদিন বিকেলেই মাইকেল এলো আমার ঘরে। কাকতালীয়? জানি না। বলল, 'চলো, আজ কফি খেতে যাব?' আমি আগে কখনো কফি খাইনি, কফির কথা শুনেছি, পড়েছি বটে। জামা কাপড় পরে রেডি হয়ে নিই। তিন নম্বর বাসটা ধরি। সোজা দোতলায়। মাইকেল হঠাৎ যেন সিটি গাইড। এন্টালি থেকে ডান দিকে মোড় নেবার আগে, বলল। 'তুমি যদি সোজা যাও, আসবে মল্লিক বাজার। অন ইয়োর লেফট মুসলিমস, অন রাইট খ্রিশ্চানস, ভেরি ইন্টারেস্টিং!' মাইকেলের কাছেই শুনলাম, কী করে এঙ্গলো ইন্ডিয়ানরা দলে দলে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাইকেলের ঠাকুর্দার বাবার ছিল ঘোড়াগাড়ি তৈরির কারখানা। ঠাকুর্দা ব্যাবসা করতেন ঘোড়াশালের। বাবা ছিল মোটর গাড়ির মেকানিক, এলগিন রোডে ওদের বিশাল গ্যারেজ। এখন নেই, বাবা সব বিক্রি বাটা করে চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এক আঙ্কল রেলে চাকরি করতেন, তিনিও চলে গেছেন, তাঁর কোয়ার্টারেই দু'ভাই থাকে। এখন অস্ট্রেলিয়া যাবার অপেক্ষায়। 'উই ওয়র আ বিট রিচ ইন ক্যালকাটা ইউ নো?' মাইকেলের হাত পা'র দিকে তাকাই, হ্যাঁ সে আভিজাত্যের দাবী ও করতেই পারে, কিন্তু বেশবাস? গ্যাবার্ডিন। খটকা লাগে।

আমরা নিউ মার্কেটে ঢুকে পড়ি। আমি এখানে আগে এসেছি একবার। একা একা। তাই তেমন মজা পাই নি। ভিন দেশ ভিন দেশ মনে হয়েছিল। এবার খাঁটি এক সাহেবের সঙ্গে, নিজেকে রেডি করি।

ম্যাগনোলিয়া। কফি বার। ম ম করছে কেক পেস্ট্রির মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। চার-পাঁচটা চৌকো টেবিল। পাশে ছোট ছোট চেয়ার। একটা দুটো টেবিলে বসেছে কেউ কেউ। কম বয়সী, একটি লাল চুল মেয়েও আছে। মারকেটের ভেতরে এত ছিমছাম রেস্ট্যুরেন্ট থাকতে পারে ভাবনায় ছিল না। লম্বা কাঁচের শো কেস, তাতে কেক পেস্ট্রি, প্যাটিস আরো কী সব। আগলে আছে দোকানী। বুকের কাছে লালা সাদা স্ট্রাইপের অ্যাপ্রন। মাথায় বাবুর্চি টুপি। একেবারে ইংরেজি সিনেমায় যেমনটা দেখি ঠিক তেমনটি। একটুখানি বসতেই, 'ওয়ান্ট টু লিসেন টু মিউজিক? হুইচ সঙ্গ?' ভাবলাম ও উঠে গিয়ে দোকানিকে রিকোয়েস্ট করবে , কিন্তু না, বলতে বলতে একটা মেশিনের কাছে দাঁড়ায়। আমি এর আগে কখনো অটোমেটেড মেশিন দেখিনি। ওখান থেকেই জিজ্ঞেস করে আবার, 'টেল মী, হুইচ সঙ্গ?' আমি প্রথমত ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিয়ে বলি, 'ক্লিফ রিচার্ড। সামার হলিডে।' কিছুদিন আগে পমপম শুনিয়েয়েছিল ওর গুরুদেবের গান। মাইকেল যেন লাফিয়ে ওঠে, 'হোয়াট আ চয়েস, ডিয়ার!' একটা মেশিন-হাত রেকোর্ডের গাদা থেকে আমার পছন্দ করা রেকর্ডটা তুলে নিয়ে ডিস্কে শুইয়ে দেয়। অন্য পিন ওয়ালা হাতটা আলতো করে রেকর্ডের ওপর বসতেই গানটা শুরু হয়ে যায়, আমি হা। গানটা বাজতে শুরু হতেই, বসে থাকা অন্যরাও পায়ে তাল ঠুকতে থাকে, মাথা কাঁধ ঝাঁকাতে থাকে তালে তালে। 'দিজ ইজ জ্যুক বক্স। দেয়ার ইস নো সেকন্ড ওয়ান ইন এন্টায়ার ক্যালক্যাটা। উই কাম হেয়ার টু প্লে আওয়ার ওন মিউজিক!'

ব্লয়াক কফি। এত বাজে জিনিস আগে খাইনি কোনদিন। কিন্তু কী করা? ভালোলাগাতেই হল। অবশ্য মাইকেলের গল্পের তোড়ে খারাপটা বেশিক্ষণ জিভে লেগে ছিল না। ডক ইয়ার্ডে ওর গুরু থাকে। জাহাজে কাজ করে, ইয়া বাইসেপ। মাইকেল নিজের বাইসেপ দেখালো, মাঝারি, তাতে অ্যাঙ্গকারের উল্কি। বলল, সারা খিদিরপুরে তার গুরুই সেরা মস্তান। মুসলমান মাসলম্যান আছে সেখানে, কিন্তু 'অল আর র্যাটস টু হিম।' বলল, কী ভাবে একজনের হাত টেবিলে রেখে ছুরির এক ঝটকায় তার চারটে আঙুল উড়িয়ে দিয়েছিল মাইকেলের গুরু। আমার ডান হাতের পাতাটা উল্টে ডেমোনস্ট্রেশন দিল সে, আমি ভয় পেয়ে যাই। যদি ম্যাগনোলিয়াতেই ওর বিরুদ্ধ দল ওকে অ্যাটাক করে? তবে তো আমিও...! উশখুশ করতে থাকি। 'নো ওররি, শান্তিপুর। ইফ রুণু এভার ডিসটার্ব ইউ, টেল মী। আই উইল ফিক্স হিম। রুণু রুলস ওনলি রেল কোয়ার্টার্স! হা হা হা!' ওর ওই হাসি এখনো কানে বাজে। হুঙ্কারও না, খিকখিকও না।

মাইকেলের কথা শুনতে শুনতে একটা ব্যাপার মাথায় ঘুরতে থাকে। মাইকেলকে ভালোও লাগতে থাকে, ওর কাছ থেকে আরো গল্প শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি। ঠিক করি, পরের দিন যুগান্তরের চীফ রিপোর্টারের কাছে গিয়ে কলকাতা থেকে এঙ্গলোদের দলবেঁধে কলকাতা থেকে চলে যাওয়া নিয়ে একটা লেখার অনুমতি চাইব। যদি পাই, পাবই আমার ধারণা, তবে কেল্লা ফতে, আমার সাংবাদিক হওয়া আটকায় কে! জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার কোন গার্ল ফ্রেন্ড নেই?’ খানিক চুপ করে থাকে, বলে, 'ইয়া, আই হ্যাড ওয়ান। বাট শী ইজ আ বিচ!' অনেক কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বুঝলাম, ভুল প্রশ্নে সেই সম্ভাবনার নটে গাছটি মুড়িয়ে বসলাম। মাইকেল বলল, 'লেটস গো!' আমি আর কথা বাড়াই না। কফির পয়সা মাইকেলই দিল।

আমরা নিজামের দিক থেকে বেরুলাম। সোজা ধর্মতলা স্ট্রিট, সেখান থেকে বাস ধরে কাইজার স্ট্রিট যাব। হাঁটছিলাম। পাশেই প্যারিস বার। 'ডিড ইয়ু ভিসিট ইট এভার?' আমি মাথা নাড়ি, না। জানালো, দারুণ সব সুন্দরীরা এখানে ডানস করে। বিদেশ থেকে আসে তারা। পয়সা অবশ্য বেশি খরচ হয়। কিন্তু 'ফান ইজ ফ্যান্টাসটিক। উই উইল কাম ওয়ান ডে। ইটস নট টাইম ইয়েট, এলস উই ক্যুড সিট অ্যাট লিস্ট ফর আ মাগ অফ বীয়ার ইচ!'. আমি হাঁফ ছাড়ি। সন্দেহ হচ্ছিল।, কফির দামটা মাইকেল প্যারিস বারে মিটিয়ে নেবে না তো?

সামনে জ্বলজ্বল করছে এলিট সিনেমা। কি এক ইংরেজি ছবি চলছে। দূর থেকে এলিট সিনেমাটা সত্যি খুব আকর্ষণীয়। মাইকেল তার মানিব্যাগ খুলে কিছু টাকা পয়সা গুণল। বললাম, 'না ভাই সিনেমা যাব না।' টাকা গুণে মানি ব্যাগে রেখে বলল, ‘নো, নট ফর দ্যাট। ওক্কে। লেটস গো!' বলে সিনেমা হলের ফয়ারে গেট কীপারকে কিছু বলে ঢুকে গেল। ঝলমল করছে নানা রঙের আর সাইজের বোতল। ওপরে লেখা, এলিট বার। ভেতরে সিনেমা চলছে, ভীড় নেই। মাইকেল এগিয়ে যেতেই বলি, 'মাইক, আই ডোন্ট ড্রিঙ্ক ডিয়ার। আই নেভার হ্যাড!' হো হো করে হেসে ওঠে, উই উইল হ্যাভ জাস্ট বীয়ার। দ্যাট'স নো ড্রিঙ্ক, শান্তিপুর। টেস্ট ইট, টু নো ইট!' বাধা দিই না। আমার যে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না তা না। প্যারিস বারের কথা শুনেই ফিনফিনে হাওয়া বইছিল বুকের ভেতর। খরচের ভয়ে তা মুখে আনিনি। এখন রাজি হয়ে যাই। উঁচু দুটো স্টুলে দুজনে বসে বীয়ার খেতে থাকি, ইংরেজি সিনেমার মত। দারুণ লাগছিল। মাইকেল বলল, 'উই উইল কাম অন অ্যানাদার ডে। উই উইল হ্যাভ ফুল ফান দেন।' এটাই আমার প্রথম ড্রিঙ্ক করা। মাথা তখন ফুরফুর করছে, প্যারিস বারটা মাথায় ছবি হয়ে দোল খেয়ে উঠল, বললাম। 'সিওর। আই প্রমিস।' বীয়ার খাওয়া হলে, মাইকেল অন্য কোথাও গেল, আমি ফিরে এলাম শিয়ালদায়।

মাইকেলের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি সেদিনের পর। একবার খোঁজ করতে গিয়ে, ল্যুকের কাছে শুনলাম, মাইকেল দাদার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। আমার কান্না পেল। কেন? আজো মনে করতে পারি না ঠিক কোন কারণে আমার সেদিন কান্না পেয়েছিল…

-----------------------------------------



16. // কাইজার স্ট্রিট //


শঙ্করদার আপত্তি থাকলেও কাইজার স্ট্রিটের এই রেল কলোনীর ছেলেদের সঙ্গে না মিশে উপায় ছিল না। বাড়ির বাইরে একটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে উঠে এসেছি তখন। সাত বাই দশ ঘর। ঘরের মধ্যেই কলতলা, পাশে ইংলিশ ফায়ার প্লেস, মানে এখন রান্নার জায়গা। কলোনির বাইরে ছিল শববাহন-খাটের অনেকগুলো দোকান। সেখান থেকে জ্যান্ত মানুষের শোয়ার মত একটা চৌকি এনেছি, পাশে দেয়াল ঘেষে রাখা সেটা। কলপাড়ই আমার স্নানাগার, আমার প্রস্রাবখানা। এমন ঘরে একটানা কতক্ষণ থাকা যায়? বাইরে বেরুতেই হত। এক এক করে পরিচয় হল সবার সঙ্গে। তবে, ওরা আমাকে খুব সম্মান করত তা না। রুণু, শক্তপোক্ত, সবচেয়ে দাঙ্গাবাজ, আমার নাম দিল, 'শান্তিপুর।' মূর্খটার কাছে শান্তিনিকেতন আর শান্তিপুর এক। আমাকে শান্তিনিকেতনের ন্যাকা চৈতণ্য বালক হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে এই নাম। হাইড্রান্টের উঁচু কভারটার ওপরে আড্ডা ছিল ওদের। আমার যাতায়াতের পথে। ওদের খপ্পরে পড়তেই হত। দলের কেউ কেউ ব্যাঙ্গ করে ডাকত, 'এই শান্তিপুর লোকাল, এখানে এসো তো?' যেতাম। উপায়ই বা কী? রুণুর বন্ধুবান্ধবীদের বেশির ভাগ ছিল এঙ্গলো ইন্ডিয়ান। তখনো কলোনিতে প্রায় পাঁচ-দশ ঘর এঙ্গলো পরিবার। ওরাও আমাকে ডাকত 'শান্তিপুর।' ওরা ইংরেজী ভাষী, শান্তিপুর স্টেশনের নামে যে কারো নাম হয় না, সেটা ওদের ভাবনায় আসার কথা না।

দলের মধ্যে একমাত্র অসিতের সঙ্গে আমার বন্ধুতা মিশ খেলো ধীরে ধীরে। অসিতরা থাকে বাংলো কোয়ার্টারে, ওর বাবা চীফ কন্ট্রোলার। অসিতের এক দিদি ছিল। নামটা মনে নেই। ওর কথা কেন মনে এলো পরে বলব। রুণুর বাবা ছিলেন গার্ড। রবুর বাবা মা দুজনেই চাকরি করতেন রেলে। দুজনেই বড় অফিসার। রবু আর রুমি দুই ভাই। রুমি বছর খানেকের বড়। দুজনেই আড্ডার বন্ধু। শিলকাটুয়া, ওর আসল নাম কোনদিন জানি নি। সবাই ঐ নামেই ডাকত ওকে। শিল নোড়া কাটুয়াদের মত দেখতে, তাই এই নাম। বাবা টিকিট চেকার। 'অনেক পয়সা। তবু শালা আমাদের জন্য চুরি করবে না', রুণু গদাম করে একটা লাথ মেরে বলত। শিলকাটুয়া খ্যাক খ্যাক করে হাসত। ঢ্যাঙ্গা শ্যামলের বাবা ছিলেন শেয়ালদা স্টেশনের কর্মী... এদের কারো পড়াশুনা করার ছিল বলে মনে হত না, একমাত্র অসিত ছাড়া।

ইতিমধ্যে সার্পেনটাইন লেনে একটা ট্যুশান পেয়ে গেলাম। কে জোগাড় করে দিয়েছিল মনে নেই। দুই ভাইকে একসঙ্গে পড়াতে হয়, পয়সা কিছুটা বেশি। সন্ধ্যার সময় যেতে হয়। আমি রোজ যেতাম অন্য একটা কারণেও। ওদের মা, মাঝারি গড়ন, গোলগাল, সন্ধ্যারানী সন্ধ্যারানী মায়াবী। পড়াতে বসার আগে প্রথমেই একটা দুটো লুচি বা পরোটার সঙ্গে একটা গরম গরম ওমলেট খেতে দিতেন। কোনদিন শুধুই ওমলেট। আমাকে কি খুব বুভুক্ষু লাগত দেখতে? জানি না। তবে ওই অযাচিত স্নেহ আর গরম ওম্লেট আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। পারতপক্ষে অ্যাবসেন্ট হতাম না। ফিরতে রাত হত, পড়তাম আড্ডার খপ্পরে। একদিন রাধুদা আমার ঘরে এসে গালমন্দ করে গেলেন। ইঙ্গিতও দিলেন, উচ্ছেন্নে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আড্ডার অমোঘ টানে হাইড্রান্টের চারপাশে প্রায় আটকেই গেলাম। রাতের রুটিটা মুখে গুঁজেই আড্ডায় চলে যেতাম। অনেক রাত অবধি চলত হই হই হাসি চিৎকার করে গান। কিছুটা গালি গালাজও।

মানুষ কি আর খারাপ হয়? খারাপ হয়ে যায়। রাধুদার কথায় তাই মন খারাপ করি না। অসিত তো আছে ওদের মধ্যে। রুণুও যে একশ ভাগ খারাপ তা নয়। ও একগুঁয়ে উদ্ধত, অন্য কারো প্রাধাণ্য ওর পছন্দ নয়। হৃদয়হীন। সব ঠিক। কিন্তু মা যখন ওকে বকেন, মাথা নিচু করে থাকে। মা ভুল হলেও প্রতিবাদ করে না। বাড়ির বাইরে এসে যে ওর বিরুদ্ধে নালিশ করেছে, তাকে খুঁজে বের করে নাক দাঁত ফাটিয়ে দেয়। রবু আর রুমির বাবা মা দুজনেই আপাদমস্তক অসৎ মানুষ। রবু রুমির দোষ কি? দুঃখের, ওদের বাবার শরীরের আদল, গায়ের রঙ, হাইট, চুলের বিন্যাস আমার বাবার মত। ওঁকে দেখলেই বাবাকে মনে পড়ে যেত, অথচ স্বভাবের জন্য লোকটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইছছে করত। শিলকাটাউয়ের স্বভাব ওর বাবাকে অনুসরণ করে। টিকিট চেকার, এন্তার কামাই। কামাইয়ের নেশায় বাড়িতেই থাকতেন না। রাত দিন ডিউটি। শিলকাটাউ বলত, 'রাতের ডিউটিতে কামাই বেশি। বাবা যখন দিনে ঘুমে অজ্ঞান, আমি তখন পকেট থেকে...'. আমাকে একদিন বললঃ 'কী বোকা তুই, শান্তিপুর? সিনেমার জন্য পয়সা জোগাড় করতে এত ভাবতে হয় নাকি? তোর দাদাদের বাজার করতে যাস না? যাস জানি। তো সাড়ে তিন শো'র মাছকে হাফ কেজি, তিনপো আলুকে এক কেজি... এই ভাবে কটা আইটেম ম্যানেজ করতে হয় একটা টিকিটের জন্য, অ্যাঁ? আমি তো শালা, এই ভাবেই...' তাই মানতাম, মানুষ খারাপ হয় না, হয়ে যায়।

কলোনির মধ্য দিয়ে বাইরে যাবার যে-পথ, তারই ধারে, একটা প্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় থাকত ল্যুক মাথ্যুজ। কেরলের খ্রিশ্চান। আমার বয়সী। ডার্টি ডজনের জিম ব্রাউনের মত কৃষঞবর্ণ, পেটানো শরীর। ওর সঙ্গে কী ভাবে যেন পরিচয় হয়েছিল। বাড়িতে বাবা, বোধয় রিটায়ার্ড। মা, বব ছাঁট চুল, গোলগাল, চাকরি করতেন। ল্যুকের এক দিদি, সেও এস্প্লয়ানেডের দিকে কোথাও চাকরি করতেন। ল্যুকদের পরিবার আমাকে ভালোবাসত। কেন এখন মনে নেই। তবে, ল্যুকের অবদান ছিল বেশি মনে আছে। আমি স্পোকেন ইংলিশ জানতাম না। অনেক কষ্টে, বাংলাকে অনুবাদ করে, তাকে শুদ্ধ গ্রামারে ফেলে খাবি খেতে খেতে ইংরেজি বলতাম। একদিন, অফিস যাবার পথে, দিদি আমাদের দুজনের মাঝখানে এসে ল্যুককে বলল, 'ববি, হোয়াই ডোন্ট উ টিচ শান্তিপুর স্পোকেন ইংলিশ?' বলেই চলে গেলেন। ল্যুক হো হো করে হাসতে থাকে, আমাকে চিমটি কাটার মত করে বলে, 'শান্তি, ইয়োর ইংলিশ অ্যাট্রাকটিং গার্লস, ডিয়ার?' কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল স্পোকেন ইংলিশ শেখার উদ্যোগ। আমি ল্যুকদের বাড়িতে যেতাম, ল্যুক আমার ঘরে আসত। আমরা দুজনে যা কথাই বলতাম, তা একমাত্র ইংরেজিতে। ল্যুকের একটাই মন্ত্রঃ 'শান্তিপুর, উ জাস্ট টক টু মী ইন ইংলিশ। ডোন্ট থিঙ্ক। জাস্ট স্পিক। বি ইট 'আই ইজ' অর 'আই গোজ'. সত্যি খুব কাজে লাগল। দিদিও আমার সঙ্গে কথা বলতেন আর বলে যেতেন, 'কাম অন শান্তি, কাম অন! জাস্ট স্পিক। হোয়াট এভার কামস টু ইওর মাইন্ড। স্পীক স্পীক স্পীক!' কিচেন থেকে কোনকোন সময় আন্টিও বলে উঠতেন, 'নেভার ফিল শাই! ইটস নট ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ এনিওয়ে! আই কান্ট স্পিক প্রপার বেঙ্গালি। আম আই শাই? আমি দুঃখিত পাই?" ল্যুকদের পরিবারের অবদান আমার জীবনে ক্ষণকালের জন্য হলেও তার সুফল সারাটা জীবন জুড়েই। ওই স্পোকেন ইংলিশের সড়গড়তা আমাকে পাড়ার এঙ্গলো ইন্ডিয়ানদের কাছাকাছি নিয়ে গেল। কলকাতা অভিযানে যে-কোন এক নতুনের মুখোমুখী হওয়ার সাধ আমার মনের চোর কুঠুরিতে আরো অনেক ইচ্ছার সঙ্গে ছিল, সেটা বুঝতে সময় লাগে না। 

বুল ডগের মত বিপুল দেহী স্যামুয়েল সাহেব, লোকোমোটিভ ইঞ্জিনের ড্রাইভার, ফ্লয়াটের বাইরে চেয়ার পেতে বসে থাকতেন অফ ডিউটিতে। ওঁর মেয়ে জুন। শাল বৃক্ষের মত টানটান আদিবাসী যেন, পাথর খোদাই। মোটা ঠোঁট। পীণোন্নত, উঁচু বাটক। হাঁটুর ওপরে স্কার্ট। সুগঠিত মসৃণ পায়ের কাপ, হাই হিল। এমন মেয়ের পাশে কখনো দাঁড়াইনি, এখন রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বলি। স্যামুয়েল সাহেব মেয়েকে ডেকে বাড়িতে যেতে বলেন না। 

পমপম চুলে প্যান্টে শরীরে চলায় ক্লিফ রিচার্ড, যে কলকাতার এঙ্গলো ইন্ডিয়ানদের বিশ্বময় গর্ব। আমাকে বাড়িতে ডেকে ক্লিফ রিচার্ডের গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত। ওর বাবা, রেলের কোন পোস্টে জানা হয়নি। পম্পম বলত, বোনটার বিয়ে হলেই ওরা কানাডায় চলে যাবে। 

আঙ্কল প্যাটার্সন থাকতেন ল্যুকদের ফ্লয়াটের পাশেই, একটা গ্রাউন্ড ফ্লোরের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে, আমারটার মতই। চিরকুমার। কোথা থেকে এসেছেন জানা হয়নি। আমাকে ভালোবাসতেন। আমার জীবনের ওই দীর্ঘ এলোমেলো দিনগুলোতে বেঁটেখাট ফুটবল আকারের  মানুষ আংক্ল প্যাটার্সন আমার কাছে যেন ছিলেন আর এক কান্ডারী।

মাইকেল আমার বয়সী। টকটকে গায়ের রঙ। নীল চোখ। দেখলেই বোঝা যায়, বেশি দূরে ফেলে আসেনি বৃটিশ রক্ত। দাদার সঙ্গে থাকে। বাড়ির সবাই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। দুই ভাই রয়েছে চলে যাবার অপেক্ষায়। মাইকেল সারাক্ষণ কালো স্যুট পরত। আমাকে বলত, 'ভেরি ভেরি চীপ, শান্তিপুর। টাচ ইট। ইটস গায়াবার্ডিন। ইউ ওয়ান্ট ওয়ান? আই উইল টেক উ টু ফ্রি স্কুল স্ট্রিট।' মাইকেল স্বপ্ন দেখত। প্রায় সর্বক্ষণ। তাই ওর কথার সত্য মিথ্যা যাচাই করা ছিল খুব কঠিন। তবে সে-সব ঝাড়াই বাছাই করে যে নির্যাস পেতাম তা থেকেই মাইকেলকে মাণ্য করতাম আমার অন্য কলকাতার প্রথম ক্লনিক্লার হিসেবে।
-----------------------


15. // খাওয়া থাকার পরিবর্তে ছাত্র পড়াইব //

শঙ্করদা আমার ছোট পিসির বড় ছেলে। আগে মাত্র একবার তাঁকে দেখেছি। দিনাজপুরে। আমি তখন আরো ছোট। এখানে এসে কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি, মানুষটির দুটি আশ্চর্য অনমনীয় সত্তা আছে। এক, সবকিছুর সঙ্গে যে-কোন মূল্যে সমঝোতা করা আর দুই, অনমনীয় আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয়, যাকে বলে লৌহ চরিত্র। আমার বাবার মত। তবে বাবার মধ্যে শঙ্করদার প্রথম গুণটি ছিল না। এক্কেবারে জিরো। তাহলে নরানাং মাতুলঃক্রম কী করে?

পিসেমশয় মারা যাওয়ার পরপরই দেশভাগ হয়ে যায়। পিসেমশয়রা থাকতেন সিরাজগঞ্জে। পিসিমার পাশে তখন পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে শঙ্করদার বয়স ১৮. বাড়ির বাক্স পেঁটরা বেঁধেছেদে বললেন, 'চল, আমরা কলকাতায় চলে যাই।' উপায়ই বা কী। শঙ্করদাও ক'দিন থেকে মা'কে এটাই বোঝাতে চাইছিলেন। পিসিমার তিন ছোট ভাইয়ের এক, সেও সিরাজগঞ্জে, স্কুল টীচার, রাজী না। 'আমাকে তো সেখানেও টুশ্যানি করে সংসার চালাতে হবে, দিদি। সেখানে সবাই অচেনা। এখানে তবু অনেকে চেনে আমাকে....' পিসিমা ট্রেনে উঠলেন। বসার জায়গা পেলেন মেয়েকে নিয়ে। বাকিরা ভীড়ে দাঁড়িয়ে ঢুলে ঢলে রাত পার করে শিয়ালদায়। অসংখ্য ছিন্নমূলের সাগর সঙ্গমে দাঁড়িয়ে পিসিমা মত বদলালেন, বললেন, 'বেহালায় চল, তোদের কাকাদের বাড়ি। ওদের বাড়িটা নাকি বড়, তোদের বাবা বলতেন।'

বেশিদিন না। কাকাদের উশখুশ বাড়তেই শঙ্করদা টের পেয়ে যান। বুঝে ফেলেন, যা কিছু সঞ্চয়, তা ভেঙেই চলতে হবে। পিসিমাও তাতে সায় দিলেন। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই কাকার দুপা ছুঁয়ে প্রণাম করে, মা আর ভাইবোনদের নিয়ে কলকাতা থেকে পাঁচটা রেল স্টেশন দূরে, ২৪ পরগণার আড়িয়াদহে, খুব শস্তায় দুটো ঘর ভাড়া করে চলে গেলেন শঙ্করদা। বয়স তখন এই আমার মতই। পরদিন থেকেই চাকরির সন্ধান। মেলে না। বুঝলেন, এই হট্টমালার সময়ে একটা টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট হাতে থাকলে, চারপাশের প্রতিযোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। শিয়ালদার জর্জ টেলিগ্রাফ থেকে পাশ করলেন টেলিগ্রাফি। চাকরিও জুটে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। রেলের শিয়ালদা ডিভিশনের এক অফিসে। সেই সময় কলকাতায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি এক সামাজিক কালচার। আমার প্রবেশ এই লড়াইয়ের ১৫ বছর পরে। বুঝতে পারি, বদলায় নি কিছুই। সংগ্রামের পথটা দীর্ঘ হয়েছে শুধু। মানুষ বদলেছে। সমাজ থেকেছে স্থির। বাবা বলতেন, এপার বলো, ওপার বলো-- দেশ দুভাগ করলেই সমাজ বা মানুষ ভালোর পথে হাঁটে না। আমি মানি নি। তাই সীমান্তের এপারে। কিন্তু বাবা কি ভুল? বাড়ির আর সবাই? এখনো বুঝে ওঠার সময় হয় নি।

বাড়িতে আনন্দবাজার। যুগান্তরের ঠিকানা সঙ্গে ছিলই। একদিন বাগবাজারে যুগান্তর অফিসে পৌঁছে যাই। একটা গলির ভেতরে, বিশাল বাক্স বিল্ডিং। একপাশের সারা আকাশের দখল নিয়েছে। প্রবেশ পথ পিছনে। কাছে যেতেই বিকট ঘড়র ঘড়র আওয়াজ। আরও একটু ভেতরে গিয়ে দেখি, বিশাল বিশাল কয়েকটা মেশিন দৈত্যের মত হা করে গলগল করে খবেরের কাগজ উগলে দিচ্ছে, একটা লোক তড়িঘড়ি সেগুলো সাজিয়ে পাশে রাখছে আর একজন নিয়ে চলে যাচ্ছে। 'ওপরে যাওয়ার রাস্তা কোনটা?'-- জিজ্ঞেস করি একজনকে। কোমর ভেঙ্গে কাগজ গোছাতে গোছাতেই হাত তুলে বললেন, 'ওই দিকে লিফট'. কিন্তু কী কোথায়? অন্ধকার। দিনের বেলায় ইতি উতি কয়েকটা ন্যাংটো বালব। ঠাহর করতে পারি না। একসময় পেয়ে যাই। গ্রিলওয়ালা লিফট। ঘটাং খট। কিন্তু এখানে না। বিজ্ঞাপনের অফিস রাস্তা পেরিয়ে। এটা আনন্দ বসু লেন। বিজ্ঞাপনের অফিস, বাগবাজার স্ট্রিটে।

ফিরে আসি। খবরের কাগজের সাংবাদিক হব, কলকাতায় আসার সময় স্বপ্নের যে পুঁটুলি কাঁধে নিয়েছি, সাংবাদিকতা তাতেও আছে, অনেক স্বপনের একটি। খবরের কাগজের অফিসেও এলাম। নিতাইদার পরামর্শ মত, 'প্রথমেই যুগান্তরে যাবি', সেই যুগান্তরেই। কিন্তু সাংবাদিকতার কথা মাথায় নেই সেদিন। উত্তেজনাও না। আজকাল শঙ্করদার মুখটা মনে পড়ে প্রায়ই। সর্বদা হাসছেন। পরিবারে বিব্রত মানুষটা, আমার মতই একলা।  খাবারের থালা, সংসারের নানা আয়োজনের দিকে তাকালে বাস্তব আড়াল থাকে না। তাই আগে বিজ্ঞাপন। পরে সাংবাদিকতা। কাগজের অফিস তো চেনা হয়েই গেল। বিবেকানন্দবাবুর কাছে যাওয়ার লিফটটাও। 

'থাকা খাওয়ার পরিবর্তে ছাত্র পড়াইব'. বক্স নাম্বারে বিজ্ঞাপন। ৬ টাকা। সাতদিন পরে দেখে যেতে হবে, আমার নম্বরে কোন উত্তর এসেছে কিনা। কাউকে বললাম না। শঙ্করদাকে তো নয়ই। এখন দমবন্ধ অপেক্ষা। 

এদিকে জুন মাস শেষ হয়ে গেল, কলেজে কলেজে ভর্তির মরশুম অনেক আগেই শুরু হয়েছে। একদিন  আমহার্সট স্ট্রিটের রাতের সিটি কলেজে গেলাম ভর্তি হতে। আইএসসি পড়েছি দু'বছর। গোপন করলাম। ফাইন্যাল পরীক্ষার সাত-আট দিন আগে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার, আইবি'র কারসাজিতে, পরীক্ষা দেয়া হল না। স্কুলের ম্যাট্রিকুলেশনের মার্কশিট নিয়েই এপারে আসা। প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব। 'ট্রানস্ফার সার্টিফিকেট লাগবে।' বললেন হেড ক্লার্ক। আমার হাতে জ্বলজ্বল করছে দিনাজপুর জেলা স্কুলের সাদা মার্কশিট। প্রায় হাতে পায়ে ধরি মানুষটার। আমি জানতাম হবে, মানুষের হৃদয়ে জল নেই, আমি মানি নি কোনদিন। বললাম, ' আপনি প্রভিশন্যাল এডমিশন দিন, আমি ট্রানস্ফার আনিয়ে আপনার কাছেই জমা দেব।' আমার ফর্মে, লাল কালিতে লিখে দিলেন, 'এডমিট প্রভিশন্যালি'. আমি আর কোনদিন তাঁর সম্মুখীন হই নি, হলেও লুকিয়ে নিয়েছি নিজেকে। 

যুগান্তরের বিজ্ঞাপনের অফিসে গিয়ে দেখি, জবাব এসেছে। একটি। পরদিন সকালে সটান সেই বাড়িতে। মানিকতলা মেইন রোডের খাল পুলের ডান পাশে নেমে ইউ টার্ন, তারপর বস্তির পাশ দিয়ে হেলে, খালের ধারে একটা একতলা দালান। দেয়ালে নীল রঙের কাঠের দরজা। কড়া নাড়তেই এক মধ্য বয়স্কার জিজ্ঞাসু চোখ। সব শুনে-- 'আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।'  হল ঘরের প্যাটার্নের একটা ছোটখাট ঘর। এক পাশে একটি টেবিল, দুটো চেয়ার। বুঝলাম, এখানে বসেই চলবে পড়াশুনা। আমাকে বসিয়ে বললেন, 'উনি এখুনি আসবেন। চানে গেছেন।' সারা ঘরটা খালি। চার দেয়ালে চারটে মা কালীর ছবি। তিনটি মুখশ্রীর। একটি করাল জিহ্বা খড়্গহস্ত, পূর্ণাঙ্গ। সাদা পুরানো দেয়াল। একই হাইটে প্রতিটা দেয়াল জুড়ে কালো ছোপছোপ দাগ। ধরতে পারলাম না কেন। তবে হাতের ঘষায় হয় নি, তাহলে দরজা বা জানালার পাশে হত। ছোপছোপ দাগ চারটি শূণ্য দেয়াল জুড়েই।

খানিক পরে আমার থেকে হাইটে সামান্য খাটো, কর্তা, এলেন। আমার থেকে খুব বেশি বয়স, তা না। দুধে আলতা গায়ের রঙ। পরনে লাল রঙের ধুতি। সেটাই কোচা দিয়ে পাক খেয়ে বুক কাঁধ বেয়ে পিঠে ঝুলছে। মুখ ভর্তি কালো কুচকুচে দাঁড়ি। গোঁফের আলাদা অস্তিত্ব নেই। আমার কাছে এসে হাসলেন। কালো ঘুটঘুটে জঙ্গল ফুঁড়ে দারুণ ধবধবে শক্ত পোক্ত দাঁতের সারি, 'একটু বসুন ভাই, পুজোটা সেরে নি।' ঘরের মাঝখানে দাঁড়ালেন। চারদিকের চারটি ছবির উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন। বেশ জোরেই। স্পষ্ট গম্ভীর গমগম করে সেই মন্ত্র সারা ঘরটায় ছেয়ে গেল, ভরে গেল। ঘরের পরিবেশটা মুহূর্তে যেন পালটে গেল। আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল।  লোকটা একটা দেয়ালের কাছে গেলেন। মাথাটাকে ছাগলের মত উঁচু করে পেছেনে টেনে, 'জয় মা! জয় মা! জয় মা! বলে দরাম! দরাম! দরাম! তিনবার দেয়ালে সজোরে মারলেন। কপালটা থেৎলে ফেললেন। খানিক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার দিকে এগিয়ে এলেন। এবার এত ভয় পেলাম, চেয়ার ছেড়ে সটান উঠে দাঁড়াই। 'বসুন বসুন। কপাল বেয়ে এক ছোট্ট রক্ত রেখা তাঁর ভ্রূ ছুঁয়ে নাকের পাহাড়তলি ছুঁতেই লাল ধুতির খুঁট দিয়ে তা মুছে বললেন, 'আপনার এটাই ঘর। একটা খাট দেব। আমার ভাইপো, ক্লাশ সিক্স। ওকে পড়াতে হবে। সকাল আর রাতে। স্কুল থাকলে দুপুরে স্কুল ফেরার পরে আর রাতে। ভেতরে কল পাড় আছে। পায়খানা, খাটা অবশ্য, সকলের সঙ্গে, মানে, কমন। আমরা যা খাব আপনিও তাই খাবেন। আমরা মাছ খাই, মাংস, খিচুরি, লাবড়া সব...' বহুদিন আমি এর বাইরে আর কিছুই মনে রাখতে পারিনি। আমি উত্তরে কী বলেছিলেম, কী ভাবে ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, কিচ্ছুটি মেনে পড়ে না।

শুধু এটুকু মনে আছে, খালপুলে দাঁড়িয়ে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। নানা কথা ভেবে। যাবার সময় পিসিমা দিয়েছিলেন ৫ টাকা। তুফুদা ১০ টাকা, বৈজুদার ৫০ টাকার বাকিটা, আর সেদিন কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন শঙ্করদা দিয়েছেন ১০ টাকা... আমাকে রোজগার করতেই হবে। শঙ্কর্দাকে মুক্তি দিতেই হবে। কিন্তু কী ভাবে, কী করে? এই শহরে আর কি কি উপায় আছে, তার সন্ধানে নামতে হবে এখন থেকেই... হেঁটে হেঁটে শিয়ালদা ফেরার সারা পথটায় ভাবতে ভাবতে নানা সম্ভাবনার কথা মাথায় এক এক করে ঢুকতে লাগল...
--------------------

14, // তিনটি কলকাতা //

প্যান্ট অল্টার হয়নি। পেতে পেতে বিকেল চার-পাঁচটা। এখন কী করা? বাড়ি ফেরাই ভালো। শিয়ালদা তো বেশি দূরে না। দোকানটার উল্টো ফুটে দাঁড়ালাম। ফেরার ট্রাম ধরব।  সামনে দিয়ে একটা ট্রাম যাচ্ছিল। তার গায়ে কাঠের ছোট্ট প্লেটে লেখা, 'গড়িয়াহাট রোড।' প্রায় দৌড়ে উঠে পড়ি। মলয়দের বাড়ির ঠিকানা, গড়িয়াহাট রোড। ফাঁকা। জানালার ধার পেয়ে যাই, বাম পাশের জানালা। কলকাতা আবিষ্কার করতে হবে। আজ আমার জীবনের রেড লেটার ডে। রাস্তার ধার ঘেষে নানা দোকান। সাহেবী টুপির দোকানটা আমাকে আকর্ষণ করল। কোমরে রিভলভর গুঁজে পাছাটা 'দ' করে বাঁকিয়ে দাঁড়াবার সখ আমার বহুদিনের। আমি আর সামাদ মডার্ণ সিনেমায় সকালের শোতে যেতাম। প্রতি রবিবার। সামাদ বাড়ির আদুরে ছোট ভাই, ওদের ওষুধের দোকানের ড্রয়ার থেকে খাবলা মেরে পয়সা তুলে নিলে কেউ আপত্তি করত না। আমরা টেক্সাসের লড়াই দেখতে যেতাম।

কলকাতাকে কি খুব আলাদা পেয়েছিলাম সেদিন? ৫২ বছর পরে অতটা ডিটেলে মনে পড়ার কথা না। কিন্তু প্রথম বিস্ময় তো রক্ত বেয়ে ছোটে সারাটা জীবন। সেই বিস্ময়টাও ছুঁতে পারছে না আমার স্মৃতি। সেটা কি ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘুরেছি বলে? নাকি দিনাজপুরের মাড়োয়ারি পট্টির দু'পাশে এমনই দোকানের সারি দেখে দেখে ওই বয়সেই বুড়িয়ে গিয়েছিলাম? ট্রামের অবাক অস্তিত্বের ঘোর কেটে গেছে। গিজগিজ মানুষের ভীড় আর সার সার দোকান ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। পাড়া নেই সারাটা পথে। তাহলে কোথায় কলকাতার জীবন? কলকাতার হারজিৎ? কলকাতার রাস্তা তো শুধু খোয়া ওঠা, এবড়ো খেবড়ো না? কোথাও কনক্রিট। কোথাও পিচ ঢালা। মসৃণ অথবা হোঁচট খাওয়ার রাস্তা । কলকাতার জীবন মানে কি শুধু এই? তা তো হতে পারে না। লক্ষ লক্ষ মানুষ তো শুধু এজন্যেই কলকাতা কলকাতা করে মরে না। এখানেই তো শুনেছি গাড়ি ধোয়া মোছার ছেলেটা আশুতোষ মুখার্জীর মত গোঁফ-ভারি অন্যমনস্ক কমল মিত্রের পকেট ফস্কে পড়ে যাওয়া মনি ব্যাগ দেখতে পায়, তা ফিরিয়ে দেবার জন্য সেই কমল মিত্রের গাড়ির পিছু পিছু সারাটা পথ দুদ্দাড় ছুটে হাঁফাতে হাঁফাতে কমল মিত্রের  হাতে মনি ব্যাগটা বাড়িয়ে দেয়। কমল মিত্র ব্যাগ খুলে টাকাগুলো দেখে গুণে খুশি, বাড়িয়ে দেন পাঁচ টাকার নোট। 'আমি বকশিস চাই না। দান নিই না।' 'কী নাও তবে?' 'কিছু না', ঘুরে দাঁড়ায় ছোট ছেলের বিক্তিত্ব, দরজার দিকে। 'আরে! দাঁড়াও দাঁড়াও। চাকরি করবে?' চাকরি হল মালিক কমল মিত্রের কারখানায়, বাড়িতে সমবয়সী সুচিত্রা সেন। শেষটায় উত্তমকুমার কারখানার জেনেরাল ম্যানেজার। হয় না? এই কলকাতাতেই হয়। জানি তেমন মানুষও ঘুরপাক খাচ্ছে এই মস্ত শহরের রাজপথ গলিপথ বেয়ে। কারো পিঠে উত্তমকুমারের সততার পুঁটুলি।  কারো হাতে বিকাশ রায়ের তালাবন্ধ ব্রিফকেস। মজা পেয়ে যাই এই সব ভাবতে ভাবতে। রাস্তার ধারে ধারে উত্তম কুমার বিকাশ রায় কমল মিত্রদের খুঁজতে থাকি। দু'চারটে বিকাশ রায় ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পেলাম না। 

ট্রাম এক সময় বাঁ দিকে বাঁক নিতেই অন্য জগত। অন্য শহর। এখানে বাঙালি কম। সুসজ্জিত নানা ধরনের দোকান। ক্রেতারাও অন্য রকম, সাহেব মেমসাহেব। বুঝলাম, অনেক দিনের পুরানো বৃটিশ এরা। গায়ের রং মুখশ্রী পাল্টে গেছে। পাল্টায় নি শুধু স্বভাব, হাঁটাচলা বা বেশবাস। বয়স যা-ই হোক, মেয়েদের পরনে শর্ট আর স্কার্ট, পুরুষদের প্যান্ট শার্ট, কারো কারো মাথায় হ্যাট বা ক্যাপ। বাড়িগুলোও ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। ফুটপাথ ঝকঝকে। দু'পাশের দালানগুলোর কিছু কিছু জানালায় পাশে ঝুলছে নানা রঙের ফুলের ঝাড়। জানালায় ধব্ধবে টানটান পর্দা। এই তো কলকাতা! ক্যালকাটা। আমি নিজেকে খুঁজে পাই। আমার সারা শরীর জুড়ে অজানা অচেনা এক সাফল্যের মাছ সাঁতার কাটতে শুরু করে দেয়।

একসময় ট্রামটা শিয়ালদা স্টেশনের মত একটা শেডওয়ালা স্টেশনের সামনে থেমে গেল। সবাই নেমে গেল, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর যাত্রী সবাই। সবার শেষে আমিও। 'এটা গড়িয়াহাট?' 'হ্যাঁ গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো।' গড়িয়াহাট রোডটা কোনদিকে?' স্টেশন থাকলে সে স্টেশনের নামে একটা স্টেশন রোডও থাকবে, অনুমান করলাম। সে তো আরো ওদিকে। এটা আসলে বালিগঞ্জ। ট্রাম ডিপোর নাম গড়িয়াহাট।' 

যত বড় শহর, তত তার বৈচিত্র্য। হয়েই থাকে, হাঁটতে থাকি। দেখি, দু'পাশে আর এক কলকাতা। একদিনে তিন কলকাতা দেখা? আমার অভিযান সার্থক। চওড়া ডবল ক্যারেজ রাস্তা। দু'পাশে সুদৃশ্য ঝকঝকে দালানকোঠা। নানা ডিজাইনের। বোঝাই গেল, অভিজাত পাড়া। সিনেমার কলকাতা তো এটাই। চিনে ফেলি মুহূর্তে। শিয়ালদার কলকাতায় মানুষজন, দালানকোঠা, দোকানপাট, গাড়ি বাস ট্রাম সবাই যেন হুড়মুড়িয়ে একে ওকে গুঁতিয়ে কনুই মেরে ছুটছে, এখানে আসার সময়, ট্রাম থেকে দেখলাম, সাহেব কলকাতা, আর এই। উচ্চবিত্তের কলকাতা।  

পৌঁছে যাই গন্তব্যে। সাইনবোর্ডে লেখা-- গড়িয়াহাট জংশন। চার মাথার জংশন। চারটে গড়িয়াহাট রোড নাকি? তা তো হয় না। জিজ্ঞেস করলাম। দক্ষিণের রাস্তাটার নাম গড়িয়াহাট রোড। বাড়ির নাম্বার গুণে গুণে এগুতে থাকি। ৩২/১এ, আমার মুখস্ত। অনেকদিন থেকেই চিঠি লিখতে আমার মহা আনন্দ। দূর দূর আত্মীয়ের ঠিকানা জোগাড় করে করে পোস্টকার্ড পাঠাই। এক লাইন থেকে ২৫ লাইন। ওই পোস্টকার্ডেই। মলয় তো স্পেশ্যাল। আমার ক্লাশ থ্রির বন্ধু। 

কিন্তু না। এই নম্বর এখানে নেই। রাস্তার ডান পাশে দোকানের সার। বামপাশে বাড়ি। উঁচু উঁচু। ১৮, ২০, ২৬... কিন্তু ৩২/১এ নেই। 'আর একটু এগোও।' এবারে গোল পার্ক। একটা গোলাকার পার্ককে ঘিরে আছে পাঁচটা রাস্তা। গড়িয়াহাট রোড তাহলে এখানেই শেষ? পাশেই একটা মিষ্টির দোকান। গাঙ্গুরামের। জুনের গরম। এতটা পথ হেঁটে হতাশায় ক্লান্ত লাগছে। এদের জিজ্ঞেস করাই শ্রেয়। দোকানটা ঝকঝকে। মাছি ভনভন না। দোকানীরাও খালি গায়ে বা লুঙ্গি-পরা বা গামছা-পরা না। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে ইতস্তত করছি। 

এই সময় দোকানের মুখে একটা সাদা এম্বাসাডর গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ওপাশের দরজা খুলে আমার চেয়ে বছর তিন চার বড় একজন, টি শার্ট আর প্যান্ট পরনে, সুস্বাস্থ্য, একমাথা কালো চুল। নামল। ধীরে খুব ধীরে দরজা লক করল। আরো ধীরে এক এক পা সুখী পা ফেলে দোকানে উঠে গেল। পায়ে স্যান্ডেল। কে এই যুবক? কার সন্তান? কী করে এর বাবা? এর মা? ভাবতে থাকি, আমি এরকম নই কেন? ঈর্ষা না, শুধু প্রশ্নটাই ধেয়ে এল। আমরা পাকিস্তানে আছি বলে? আমার বাবা যখন তখন জেল বন্দী হন বলে? আমাদের মা তাঁর আট সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খান বলে? আমরা বালতি ভরে সাবানের ফ্যাক্টরি থেকে সাবান জল এনে মা'কে কাপড় কাঁচতে সাহায্য করি বলে? মনে আছে, এ সবের একটাও আমার না-হবার কারণ বলে মনে হয় নি। নিজেকে অসমর্থ মনে হয় নি একবারও। শুধু মনে হল, আমি সুযোগ পাই নি। এখোন এই শহর আমাকে সেই সুযোগ দেবে। আমিও গাড়ি চালিয়ে এসে দই কিনে নিয়ে যাব এই গাঙ্গুরাম থেকে।

গড়িয়াহাট রোড আরো খানিকটা এগিয়ে, একটা রেল লাইন, সেই পর্যন্ত। 'তোমাকে বাম পাশ ধরেই খুঁজতে হবে। রাস্তার সব জোড় নম্বর বাম দিকে।' এক সহৃদয় যুবক বুঝিয়ে বলল। তাই মানলাম। কিন্তু ৩২/১এ নেই। আছে তো বটেই। আমি তো রেগুলার চিঠি লিখি মলয়কে! মনে মনে ভরসাকে ছুঁয়ে থাকি। ইতিমধ্যেই মাইল দুয়েক হাঁটা হয়ে গেছে বোধয়। চলো, আরো খানিক না হয়। রেল গেটে পৌঁছ গেলাম। একজন বলল, 'আমার মনে হয় এটা গড়িয়াহাট রোড সাউথ।' আরের তাই তো? গড়িয়াহাট রোড সাউথই তো হবে! ভুলেগুলে বসেছিলাম।  উনি বললেন, লাইনের ওপার থেকে গড়িয়াহাট রোড সাউথ, এপারটা শুধুই গড়িয়াহাট রোড। হাঁফ ছাড়লাম। আরো আধঘন্টা হেঁটে ঘেঁটে পেয়ে গেলাম মলয়কে। বাড়িতেই ছিল। বাড়ি ভর্তি লোক। মলয়ের দাদা, বৌদি, ছোট ছোট দুই ভাইপো ভাইঝি, এক ভাগ্নে। দেখি, সবাই আমাকে চেনে। বৌদি বললেন, ' সুশীল, এই তোমার অরুণ? রোগা লিকলিকে। ঢ্যাঙ্গা।  আমি ভাবলাম না জানি কোন প্রেমেন মিত্তির!' কিন্তু সবাই আমাকে চিনল কী করে? মলয় বলল, 'তোর পোস্টকার্ড। সবাই পড়ে, তাতে তোর আঁকা দিনাজপুরের ছবি দেখে.. দাদা, দাদার বন্ধুরাও। চিনবে না?'

--------------------------


13. //  আশ্রয় //

ছোটপিসিমা অপেক্ষা করছিলেন দরজার কাছে। আমি দরজায় দাঁড়াতেই চৌকাঠের ভেতরে দাঁড়িয়েই আমার মাথায়, দু'হাতে, বুকে, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকেন, 'মা বরদেশ্বরী, এই পাগলা ঠাকুরর্কে সুমতি দিও!' পাগলা ঠাকুর? চমকে উঠি। বিন্যাফৈরের গ্রামে আমার ঠাকুর্দাকে সবাই পাগলা ঠাকুর বলে ডাকত! দাদুর মতিগতির ঠিক ছিল না। সেরেস্তার নিয়মকানুন মানতেন না বলে সন্তোষের মহারাজার সেরেস্তা থেক বিতাড়িত হয়েছিলেন। যজমানি করতেন। তাও ঠিকঠাক না। ঠাকুরের প্রতি আনুগত্যই নেই। লোকে তাঁকে ডাকাডাকি বন্ধ করে দিল। শুরু করলেন, গ্রামের কাছেপিঠের বাড়িগুলোতে দু'একটা পূজার। পোষায় না। এক ভোরে এক বিধবার কষ্ঠিপাথরের বরদেশ্বরী মূর্তিকে কাঁধে নিয়ে দে দৌড়। বাড়ির সবচেয়ে বড় টিনের চৌচালা ঘরে প্রতিষ্ঠা করলেন সেই কালী মূর্তি। 'পাগলা ঠাকুরের মন্দির।' থানা পুলিশ হলে বললেন, মা আমায় স্বপ্নাদেশ করেছেন, তাই। পিসিমা কিনা সেই পাগলা ঠাকুরকে দেখলেন আমার মধ্যে? বিস্ময়টাকে  ঢোক গিলে পেটে চালান করে দিয়ে পিসিমাকে জড়িয়ে ধরি (আমাদের পরিবারে প্রণাম-প্রথা বাবা বন্ধ করেছেন বহুদিন). পিসিমা কিছুটি জানতে চাইলেন না, কেন এসেছি। মা কেমন আছেন বা অন্যান্য ভাইবোন। যেন কাছের কোন স্টেশন থেকে এই বাড়িতে আসা।

জানলাম, পিসিমা পরশু মেজছেলে আর মেজবৌকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে যাবেন। বাড়িতে থাকব, আমি, রাধুদা, বাড়ির বড়দা (শঙ্করদা) তাঁরা স্ত্রী, তিনটি ছেলেমেয়ে। ফ্লয়াটে মাত্র দুটি ঘর। দেখলাম এখানেও কালিয়াগঞ্জ। সংগ্রাম। কুণ্ঠিত হই। কিছু বলি না। স্নান করে ট্রেনের জামা পাজামা পরতেই হাহা করে উঠলেন মেজবৌদি। 'একি? তোমার আর কোন কাপড় জামা নেই? আমি মাথা নাড়ি, নেই। বেঁধেছেদে ফেলা একটা স্যুটকেশ খুলে তড়িঘড়ি আমাকে একটা ডুরে কাটা শাড়ি দিলেন, 'এটা লুঙ্গি করে পর।' আমি ইতস্তত করতেই, 'কলকাতায় এটাই দস্তুর। কাল সকালে বাজারে বেরুলে দেখতে পাবে।'

পরদিন এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ সারকুলার রোডের ওপরে আমজাদীয়া রেস্টুরেন্টের উল্টো ফুটপাথে দাঁড়াতেই কলকাতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আমার দুচোখ ফুঁড়ে। ট্রাম, লম্বা লম্বা সরকারি বাস। মানুষের হুটোপুটি। এক ফার্লং দূরে শিয়ালদা স্টেশন, এই এলাকাটায় ব্যস্ততা সে কারণেও বেশি। বাস ট্রামের পেট ফুঁড়ে যেমন গলগল করে নারী-পুরুষ নেমেই ছুটছে, তেমনি হুড়মুড়িয়ে সেসবে একদলের ঢুকে পড়ার ঠেলাঠেলি তাগিদ। ঢাকার সদরঘাটে লঞ্চ স্টীমার নৌকো ধরতেও একই গাদাগাদির দৃশ্য। একটা ট্রাম সামনে আসতেই বৌদি বললেন, 'উঠে পড়। কেউ কোলে তুলে নেবে না।' উঠে পড়লাম তিনজনে। আমার প্রথম ট্রাম চড়া। সেই প্রথমের অভিঞ্জতা এখন ফিকে হয়ে গেছে, তবে মনে পড়ছে, বৌদি কাঁধে হাত দিয়ে চেপে আমাকে একটা সিটে বসিয়ে দিলেন। আমরা বাজারে যাচ্ছি। আমার জন্য জামা কাপড় কিনবেন তুফুদা।

আমরা যাচ্ছি ধর্মতলায়। খানিক বাদেই জানলার ধারে বসার সুযোগ পেলাম। খোলা জানালা। কলকাতা চলতে লাগল পাশে পাশে। বাম পাশের জানালা, চোখের সামনে কোন বাধা নেই। দিনাজপুরের কথা মনে পড়ল। হাঁটতাম। কখনো সাইকেলে। কখনই রিকশায় না। আমি যখন কৈশোরের শুরুতে, দেশ ভাগ হয়েছে তার দশ বছর আগে। আমাদের শহর থেকে খুব বেশি ষাট কিলোমিটার দূরে বিহার। দিনাজপুর শহর ভরে গেল মূলোৎপাটিত বিহারীতে। নারী পুরুষ, শিশু কিশোর যুবক। চারদিকে। সব পাড়ায়। কোথাও কোথাও তড়িঘড়ি গড়ে তোলা মস্ত মস্ত রিফ্যুজি কলোনীতে। ছিন্নমূল, সংগ্রাম, ভিনভাষী... এই শব্দগুলোর গূঢ় অর্থ যখন বুঝতে শিখলাম, তখন আমাদের শহরে বিহারীদের টিঁকে থাকার লড়াইয়ের তিন আনা চার আনা কমপ্লিট। শহরের এমাথা  ওমাথায় পাক খেতে খেতে যা দেখতে পাই, তা শহরের ঝাড়ুদার, সরকারী দফতর স্কুলে সাহেব এবং তাঁদের ছেলে মেয়েদের মাথার ওপরে যারা দড়ি টেনে টেনে দুলে দুলে মাদুর-পাখা দোলাচ্ছে, নর্দমা সাফাই করছে, পিঁপড়ে খাওয়া লজেঞ্চুস বিস্কিটের দোকানে মেলে ঝিমুচ্ছে, সকালে উঠে দোকানের সামনে ভেতরে ঝাড়াই মোছাই করছে, হাত নেই পা নেই কিংবা অকেজো অঙ্গে শুধু গলা ফাটিয়ে ভিক্ষা করছে, তাঁরা সবাই বিহারী। দিনাজপুরের ধার্মিক বিন্যাস, দেশভাগের আগে ছিল-- শহরে হিন্দু আর গ্রামে মুসলিম। তাই দাঙ্গা বাঁধেনি আমাদের শহরে। এক অমোঘ নিয়মে শুধু কমে গেছে হিন্দুর সংখ্যা আর বেড়ে গেছে গ্রাম থেকে উঠে আসা জোতদার শ্রেণীর পরিবার আর এই ছিন্নমূল বিহারী মুসলমান। জানালার ওপারে চলন্ত কলকাতায় আমি দিনাজপুরকেই দেখতে পাই। লড়াই লড়াই। জীবনটাকে ধরে রাখার লড়াই।

দোকানটার নাম ছিল বোধয় 'ওয়ালিউল্লাহ', ম্যাডান স্ট্রিটের ক্রসিং্এর পাশে, ধর্মতলায়। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। অনেকদিন দোকানটা দেখলে রোমাঞ্চিত হতাম। এখন দেখি না। ওরা দু'জনে মিলে আমাকে এক জোড়া প্যান্ট শার্ট কিনে দিলেন। সেই সময়ে আমরা পাজামা আর শার্টের সঙ্গে শু পরতাম। আমার পায়েই ছিল দিনাজপুর থেকে পরে আসা জুতো জোড়া। মেজবৌদি বললেন, একটু আঘাত করেই, 'এখানে তোমার ওই পাকিস্তানী ফ্যাশান অচল, বাবলু মিঞা। এখানে পাজামার সঙ্গে স্যান্ডেল পরে, প্যান্টের সঙ্গে জুতো।' একটা চামড়ার স্যান্ডেল কেনা হল। পরের দিন আবার আসতে হবে। প্যান্ট অল্টার করতে হবে। বৌদিরা আজই চলে যাবেন, 'কী বাঙাল, আসতে পারবি তো?' আমি এমনই একটা চ্যালেঞ্জের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি একা একা দেখব কলকাতাকে এটা অনেক আগেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম। ভয় তো বাড়ির বেল কাঠালের ছায়ায় রেখেই বেড়িয়েছি। পরের দিন ২৭ জুন, ১৯৬২. রেড লেটার ডে। আমার কলকাতা অভিযানের দিন।
-------------------


12. // কলকাতায় প্রথম দিন //

বিকেল গড়াতেই বর্ধমান। কখনো এপাশে কখনো ওপাশে কালো ধোঁয়ার মেঘ ছড়াতে ছড়াতে ঝিকঝিক গড়গড় শব্দ তুলে ছুটছে ট্রেন। এবার শেয়ালদা। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি আমার কাঁধের ঝোলাটার ফিতেটা মুঠিতে শক্ত করে ধরি। অচেনা দেশ, অচেনা শহর। যা চেনা তা সুচিত্রা-উত্তমের ছবিতে দেখা মিষ্টি সংগ্রাম আর অপার রোম্যান্টিকতা। আমার ভেতরের উত্তমকুমার চলেছে কলকাতায়। গান গাইবে নাকি রাস্তায় রাস্তায় হেঁকে চলা নিলামওয়ালা, ঠিক জানি না। এখন শুধু পৌঁছে যাওয়া। শিয়ালদা। কলকাতা। 

ডানকুনি আসতেই একটা শহরের আঁচ পেতে থাকি। ঢাকা থেকে ফেরার সময় দিনাজপুরের কাছাকাছি পৌঁছুলেই লাইনের দু'পাশের ঝোঁপ ঝাড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে দিনাজপুর শহরের গন্ধ নাকে লাগত। এখানেও নিশ্চই তেমনি। কলকাতার গন্ধ চিনি না বটে কিন্তু নাকে লাগতে লাগল। ট্রেনটা বাম দিকে অনেকটা হেলে হেলে উঠে গেল পাঁচতলায়। বালির স্টেশন, রেলগাড়ি, মানুষজন সবাই নিচে, আমরা অনেক ওপরে। একবার ব্রাক্ষমণবাড়িয়ার নদী পেরুতে রেললাইনটা এভাবেই দশ তলায় উঠে গিয়েছিল। বালিঘাটের পাঁচতলার স্টেশনটা পেরুতেই দেখি নিচে দূরে গঙ্গার পারে তিন চারটে মন্দিরের উদ্দেশ্যে সবাই প্রণাম করছে। অনেকে পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে গঙ্গায়। মাস্টারমশায় বললেন,' বাবলু, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। প্রণাম কর।' কেনো? মন্দিরকে প্রণাম করব কেন? মনে মনে ভাবলাম। কিচ্ছুটি করলাম না। আমি পরে দক্ষিনেশ্বার কালি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছি বটে, আজো একবারো প্রণাম করিনি। কেন? পরে হবে সে কথা।

একসময় রেল লাইন নিচের দিকে নামতে থাকে, দেখি, বাম দিকে একটা ভাঁজ ভাঁজ ছাদের পাশে, দেয়ালে, নীল নিয়নে লেখা 'ধীরেন কড়াই'. কথায় ও কড়াইয়ের রেখায়। ওটা দেখে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। একটা লোহার কোড়াইয়ের এত সম্মান? কলকাতা কি সত্যি সবাইকেই সম্মান করে? আরো রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছিল। একটা পাল্যাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছি, স্টেশনের নাম দমদম। আমি দমদম জায়গাটাকে চিনতাম। বাড়িতে চোঙা গ্রামোফোনের কাছে গায়কের গানে নিবিষ্ট কুকুর, 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস।' রেকর্ডের লেবেলে লেখা থাকত, গ্রামোফোন কোম্পানি, দমদম'. এই সেই দমদম? স্বপ্ন নয়ত? পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের কলকাতায়?

সত্যি একসময় পৌঁছেই গেলাম। মাস্টার মশায়ের হাত থেকে একটা হালকা বাক্স বা টোপলা নিয়ে প্রায় সবার আগেই প্লয়াটফর্মে নামলাম। শিয়ালদা। চারপাশে তাকিয়ে প্রথমেই অনুভব করলাম আমি এই মুহূর্ত থেকে এক বিশাল শহরের মানুষ। এখানেই কাটাবো আমার দিন রাত, হাসি কান্না, আনন্দ উচ্ছাস। মা'র মুখটা ভেসে উঠতেই ঝটকায় তা সরিয়ে দেই। না। পিছনে তাকানো নয় আর। চারিদিকে অসংখ্য লোকজন নারী পুরুষের ব্যাস্ততায় আমি আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। মাস্টার মশায়কে তাঁর জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছি কি দেই নি (ধন্যবাদ জানাবার শিক্ষা তখন আমার ছিল না)  খপ করে কে আমার বাম হাতের কব্জিটা মুঠো বন্দী করে ফেলে, যেন, মাস্টার মশায়ের জিনিস চুরি করেছি। ঘাবড়ে গেলাম। মুখ তুলে তাকাতেই দেখি, রাধুদা। আমার ছোটপিসির ছোট ছেলে। 'কী রে! খুব লায়েক হয়ে গেছিস? বাড়ি পালানো? কোত্থেকে এই ভুত চাপল মাথায়, অ্যাঁ?.' আমি হতবাক। ভেতরে ভেতরে কি খুশি হলাম? হয়ত। 'চল, মা কলকাতায় এসেছে, তোর জন্য অপেক্ষা করছে।' 'আপনারা জানলেন কী করে?' 'তাতে তোর কী দরকার?' মাস্টার মশয় কি জানতেন, আমাকে কেউ নিতে আসবেন? আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, 'আছা বাবলু, চলি'
শিয়ালদার স্টেশনের বাইরে এসে চক্ষু চড়ক গাছ। লক্ষ মানুষ হুটোপুটি করছে, একটা লাল রঙের দোতলা বাস (আগে দেখিনি), এগারো নম্বর, মানুষের সেই সমুদ্র ঠেলে আস্তে আস্তে স্টেশনের দিকটায় আসছে। হাতে হ্যাঁচকা টান। 'আগে বাড়ি চ, কলকাতা পালিয়ে যাচ্ছে না। দু পা দূরে আমাদের বাড়ি।' কিন্তু সত্যি কলকাতা তখন পালিয়ে যাচ্ছিল আমার মাথার উত্তেজনার হাঁড়ি ভেঙে। দিশাহারা লাগছিল। কলকাতা দেখা হল না। আমরা মিনিট কয়েক পরেই এক গলিমুখে ঢুকে পড়লাম।



11. // শান্তিনিকেতন //

ট্রেনে ভীড় ছিল কিনা মনে নেই। গরম ছিল খুব। মেল ট্রেন বলে হুড়মুড়িয়ে ছোটার ট্রেন, তা না। স্টেশনে স্টেশনে থেমে থেমে চলছিল। লোক ওঠা নামা করছে। ভীড় থাকলেও আমার গায়ে লাগার কথা না, কেননা, আমি সিঙ্গল সিটে, জানালার ধারে। ভারত কত বড় দেশ তখনো জানি না। কিন্তু এটুকু জানি তেঁতুলিয়া টু টেকনাফ নয়। নানা স্টেশনের নাম দেখে দেখে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। 'বোলপুর'এর পাশে শান্তিনিকেতন লেখা দেখতেই, আমাদের বগিতেই যেন উঠে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। দেখতে পেলাম, দাঁড়িয়েছিলেন জোব্বা পরে, প্লয়াটফর্মে, এখন উঠে এলেন। আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত। সাঁওতাল রমনী খুঁজতে থাকি। রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন, সাঁওতাল পল্লী আর সাঁওতাল রমনী... এ সব জানতাম। আনিসুর ভাইয়ের কাছে শুনেছি। দাদাকে যদি বলতে পারতাম, 'দাদা, আমি এখন শান্তিনিকেতনে!' হঠাৎ ক্যাশের কৌটোটা মুখ ব্যাজার করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মুখ ঘোরাই।

দাদার বেডরুমে একটা চার্ট পেপার টাঙিয়েছিলাম। প্রতিদিন দু'বেলা দাদা দিনের রোজগারের টাকা প্যান্টের পকেট থেকে উগলে আমার হাতে দিতেন। তাঁর হাত মুখ ধুয়ে আসার ফাঁকে আমি তা গুণে, চার্ট পেপারে বিন্দু বসিয়ে রেখা টেনে দিতাম। আগের দিন থেকে টাকার অঙ্ক কম হলেই, 'বাব্লু, কাল আরো রোগী দেখতে হবে। গ্রাফকে কিছুতেই নিচের দিকে যেতে দেওয়া চলবে না।' দাদার দেড় দু বছরের নতুন ডাক্তারি। এটা ছিল আমাদের দু'জনের একটা খেলা। মা রাগ করতেন। 'এসবের কোন মানে হয়? বাব্লু পড়ায় মন দিচ্ছে না। টাকা পয়সার হিসাব বাচ্চুকে দে।ও ধীর স্থির।' দাদা ক্যাশিয়ার পাল্টান নি। মনে পড়ল, পরশু সকালে, সেই আদরের ক্যাশিয়ার, ক্যাশের কৌটো খুলে হাওয়া। দাদার জন্য মনটা হু হু করে উঠল। দাদা কি দুঃখ পেয়েছেন? হয়ত না। আমি ছাড়া কেউ জানেই না যে ওখানে পঞ্চাশ টাকা শর্ট হয়ে গেছে। তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোরের কি নিজের কাছে নিজেকে সাধু ভাবা মানায়? আর মানায় না বলেই দেখি জানালার বাইরে সবাই ফিক ফিক করে হাসছে। দৌড়ে চলা গাছপালা, টেলিগ্রাফ পোস্ট, আল ঘেরা মাঠ, মাঠে খাটতে থাকা মানুষ, আকাশের স্থির জমাট মেঘের দল সব সবাই আমাকে দেখে মুচকি হেসে হেসে যাচ্ছে। কামরার ভেতরের সবাই এতক্ষণ আমকে দেখছিল, আমি তাদের দিকে তাকাতেই সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মাস্টার মশয়, তাঁর বাড়ির লোকজন, নানা সিটে বসে থাকা যাত্রী, মাটিতে বসা, দাঁড়িয়ে থাকা কামরার সবাই মুখ ঘুরিয়ে... লজ্জা লজ্জা আর লজ্জা। এমন দাগী শরীরে পালানো যায়, অভিযান হয় না।

দাদা কি এখন বাচ্চুকে ক্যাশিয়ার করেছেন? নাকি আর কোন ভাইকে দায়িত্বশীল ভাবতেই পারছেন না? মা'র হাতে তুলে দিচ্ছেন টাকা? দাদা কোনদিন মনি ব্যাগ ব্যবহার করেন নি। আয় করার সেই প্রথম দিনগুলোতেও না। শুরুতে হয় ভাইবোন, নয়ত মা, পরে বৌদি। দাদার ভরসার জায়গা। আমার বেলায় তার সব পঁচে গেল, পঁচে গেল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, দাদা নিজেই পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে টেবিলের ওপর রেখে গুণছেন। একসময় বিরক্ত হয়ে মা'কে ডাকছেন। আর কোন ভাইকে ডাকছেন কী? জান্তে ইচ্ছে করছিল, জানতে ইচ্ছে করছিল।

এই সময় মাস্টার মশয় ওপাশের জানালা থেকে আমাকে ডেকে বললেন, 'বাবলু, সাবধান। অনেক সময় জ্বলন্ত কয়লা গুঁড়ো চোখে পড়ে। তোমার চোখ তো কয়লায় জ্বালা করছে মনে হচ্ছে? চোখে মুখে জল দিয়ে এসো।' ভাঙা, পানের পিচে দাগী বেসিন। কলটা খুলতেই ফুটন্ত জল। আঁজলায় নিয়ে ঠান্ডা করে করে চোখে মুখে দেবার সময় বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে। সঙ্গে মা। জুটলেন বাবার আর এক বন্ধু। রোজ আসেন না। বাবা একসময় তাঁকে বলছিলেন, 'বিল্পবীদের মনে গ্লানি থাকে না, অনুশোচনাও না।' ট্রেনটা এই সময় ঝাঁকিয়ে দুলিয়ে দুরন্ত ছুটছিল কি? কারো কাঁধে হাত রেখে টাল সামলাচ্ছিলাম কি? মনে নেই।

বর্ধমান এলো। ট্রেন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। খানিক পরে সবাই উঠে এলো, হাতে মিস্টির প্যাকেট। বারহাবা স্টেশনে সবাই 'চা, এই চা' বলে কাড়াকাড়ি করছিল, কেননা, সেখানকার চা নাকি বিক্যাত। টেস্ট করা হয়নি। আমার কাছে সীমিত পয়সা। বর্ধমানে হামলে পড়ার মিস্টির ক্ষেত্রেও তাই। মাস্টার মশয়কে বলেছি, পেটটা ঠিক নেই, তাই লাঞ্চ নেব না। এবার বললাম, আমার মিস্টি ভাল্লাগে না। বর্ধমান থেকে ট্রেন ছাড়তেই সবার মধ্যে সাজো সাজো রব। জানলাম, এবার আসবে কলকাতা-- আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা! আমার রক্তে যেন তখন 'শুধু তোমার সুর বাজে'*!

---------
* বড় হয়ে সমর সেনের কবিতায় পড়া।



10. // মাটি ও মানুষ //

 ভোর। ট্রেন ছুটছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এখন আর ঠিকঠাক মনে পড়ে নারাতটা জেগে কেটেছে নাকঘুমিয়ে। মাঝরাতে বগিটাকে ঠেলেঠেলে যখন দার্জিলিং মেলের লেজে জোড়া হলজেগেছিলাম। দার্জিলিংমেল যে লাইনটায় দাঁড়িয়েসেই লাইনটা ধরে পিছন দিকে সোজা একটানা ছুটে নয়টা ছোট ছোট স্টেশনপেরুলেই সোজা মা' কোলে। নেমে পড়বমনটার ভেতরে ছোট্ট একটা মাছ তিরতির পাখনা নাড়লকিন্তু ঘাইতুলল না। মাস্টার মশয় বলেছিলেনবারসই থেকে ট্রেন বাঁক নেবে বাম দিকে। মানেমা আমার সরলরেখারবাইরে চলে যাবেন। আমি হব কক্ষচ্যুত। হলও তাই। ভোর হল বিহারের মাটিতে। ট্রেন ছুটছে সকড়িগলিরগঙ্গা পারের দিকে।

মাস্টার মশয় সঙ্গের ছেলেটাকেআমার থেকে একটু বড়বললেন, 'একটা চাদর নিয়ে ছুটবি। ওপারে ট্রেনেজায়গা রাখতে হবে। নইলে মুশকিল।আমি শুনেই আগ বাড়িয়ে বলি, 'আমাকে একটা চাদর দেবেনআমিওদৌড়ুব। বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের বাহাদুরাবাদ ঘাটেও ঢাকা টাঙাইল থেকে আসা-যাওয়ারসময় এটা ছিল মাস্ট। ট্রেন থামতেই আমরা দু'জন দে দৌড়সবার আগে স্টীমারে। উঠেই ছেলেটাকে বলি, 'আর এগিয়ো না। এখান দিয়েই নামতে হবে। সেটাই নিয়ম। অন্য সাইডটা ঘাটে ভেড়ে না। এখানে দাঁড়ালেআমরাই প্রথমে ট্রেনে পৌঁছুতে পারব। হলও তাই। আমরা একটা ফাঁকা কামরা পেয়ে গেলাম। ইচ্ছে মতোভালো জায়গা দখল করি। আমি নিলাম আলাদা। জানালার সাইডে সিঙ্গল সিট।
ট্রেনটা এখন ভারতের মাটি কামড়ে ছুটছে।  তো মাথার চুল নয়, সতের বছরের শৈশব আর কৈশোর ট্রেনেরগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কপালে সাপটা মারছে। জেল থেকে বেরিয়েদু'মাসের মধ্যেপরশুএমনই একঝলমলে সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছিআজ ২৫ জুন। বুকটা গুমগুম শব্দ করে। ১৯৫৮ সালে আয়ূবক্ষমতায় আসার সময় থেকেইপ্রত্যক্ষ আয়ূব বিরোধিতার দায়ে বাবা জেলবন্দী। আর আমিচার বছরেরমধ্যেই এই। পলাতক। দেশদ্রোহী। বাবার চোখে আমি বিধর্মী এখন। মাইকেল ত্যজ্যপুত্র হয়েছিলেনধর্মান্তরের কারণেরামমোহন ধর্মকে অস্বীকার করে। আর আমিবাবার দেশধর্মকে ত্যাগ করেছি। সারাপূর্ব পাকিস্তানে চলছে তুলকালামআয়ূবকে টেনে নামাতেই হবে। সেই দাবীতেলক্ষে আমিও তো ছিলামরাস্তায়। অথচ...

'বাবাতুমি- তো বলেছিলেদেশের ঋণ শোধ করা যায় দু'ভাবেই। সমাজের ভেতরে থেকে বা সমাজের বাইরেথেকে। বলেছিলে তো!' গা ঝাড়া দিয়ে বুক টান করে সিটে বসে যাই। ভারতের মাটি মানুষকে চেনার খেলায় মেতেযাই। বগির ভেতরে, মানুষগুলোর গায়ে মনে এক একটা উপন্যাসপম ইতিহাস ঝলসাতে থাকে। বাইরে ,মাঠের আলে আলে আর এক ইতিহাস। যা আমার জানা হয় নি কোনদিন।

ট্রেনটা নলহাটি ছাড়তেই একটা আওয়াজ কানে আসে। 'জল খাইবেন নাকিবাবুজলঠান্ডা জল। খাইবেন?'ভীড় ঠেলে ঠেলে আমার পাশে দাঁড়াতেই দেখিবেঁটেখাটো। গোলগাল। শক্তপোক্ত। কাঁধের দু'পাশ দিয়ে এসেপেটের কাছে ঝুলছে ক্যামবিসের একটা বড় ব্যাগতাতে দশ পনেরোটা কোকের ভরা বোতল। গলায় লকেটেরমত ঝুলছে ওপেনারতার সঙ্গে জপমালার টোপলাসেটা ক্যাশবক্স। শিউড়ে উঠিলোকটার দুটো হাতইকনুই থেকে বাদ। কেউ ঠান্ডা কোক লিমকা সোডা কিছু চাইলেইকোমর ভেঙ্গে সামনে ঝুঁকে পড়ছেন। খপ করেদুই কনুইয়ের সঁড়াশিতে একটা বোতল তুলে দু'হাঁটুর ফাঁকে বন্দী করে ফেলছেন। বুকের কাছে পেনডুলামওপেনারটাকেও দুই কনুইয়ে খপ করে ধরে চাড়ভভক শব্দে খুলে যাচ্ছে বোতল। বোতলটা দুই কনুই থেকেকাস্টমারের হাতে চালান হয়ে যাচ্ছে অবলীলায়এক লহমায়। আমি থ। আমাদের শহরে এমন হাতকাটা ভিখ্রীরসংখ্যা অনেক। কিন্তু এখানেআমি এক অন্য পৃথিবীর স্বাদ পেতে শুরু করি। খানিক পরে আরো বিস্ময়।লোকটা তার 'জল খাইবেন,বাবুজল?' আওয়াজ হাঁকিয়ে হাঁকিয়ে কামরার এমাথা ওমাথা বার দুয়েক ঘুরে দর্জারকাছে গেলেন। ট্রেন ছুটছে। ওই কনুই হাতেই দরজার হ্যান্ডেল ধরে ধরে পা দুটকে দু'ফালা করে করে পাশেরকামরায় চলে গেলেন। গলায় বোতল-ব্যাগের ঝুড়ি। ওই মানুষটার এই দৃশ্য আমি আজো চোখ বুঝলে দেখতেপাই। মানুষটাকে না দেখলে আমার লড়াই অনেক দীর্ঘায়িত হত বলে মানি।


9. // কালিয়াগঞ্জ // 

হাতে তখন সাড়ে সতের টাকা। পিসতুতো দাদাবড় পিসি আর নেইপশ্চিমবাংলার এক থানা-শহরের স্কুল মাস্টার। পড়ন্ত বেলায় আমাকে এক জামাএক পাজামাপায়ে চটিতে দেখে চমকে উঠলেন। বললাম সকালেই বাড়ি থেকে পালিয়েছি। কেউ জানে না। দাদার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। 'বাড়ি থাইকে পালালি ক্যানকচি বয়স তোর। আমার যা অবস্থাতিন ছেলেমেয়ে...' বুঝলামভয় পেয়েছেনওর ঘাড়ে না পড়ি। বলি, 'আমি আজ নয় তো কাল কলকাতা চলে যাব। টাকা আছে আমার কাছে।নিশ্চিন্ত হলেন। পরদিন সকাল হতেই বৈজু ডাগার কাছে। হাই রোডের পাশেই বাড়িওই কালিয়াগঞ্জেই। মাড়োয়ারি। কয়েকটা চালকলের মালিক। বড়দার ছোটবেলার বন্ধু। বললাম, 'কলকাতায় যাব। বাড়ির কেউ জানে না। আমি সাংবাদিক হতে চাই।ইনিও ভয় পেলেন। সমর জানে নাআমি তোমাকে টাকা দিলে রাগারাগি করবে... 'কিন্তু আমার কাছে মাত্র সাড়ে সতেরো টাকাএই দেখুন।আমি পাজামার পকেট থেকে খাবলা মেরে সব কটা টাকা পয়সা বের করি। বৈজুদা আমার ছেলেমানুষী দেখে মৃদু হাসলেন। বসতে বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম। উনি টাকা না দিলে হিচ হাইকিং করব। মন খারাপের কোন জায়গাই নেই। কালিয়াগঞ্জ থেকে বা কালিয়াগঞ্জের ওপর দিয়ে সারাদিন রাত ট্রাক যাচ্ছে কলকাতায়খোঁজ নিয়েছি আসার সময়। বৈজুদা এলেন। হাতে কিছু টাকাআমাকে দিলেন, 'পঞ্চাশ আছেএর বেশি হাতে নেই এখন।সত্যি কি মিথ্যে আমার কী যায় আসেআমি আত্মহারাকালিয়াগঞ্জ থেকে কলকাতার ট্রেন ভাড়া ষোল টাকা।

এখন আমার কাছে সাড়ে সাতষট্টি টাকা! পরম নিশ্চিন্তি। নিতাইদার বাড়িতে ফিরি। আমাকে দেখেই দাদা ছাত্রদের বসতে বলে বাইরের বারান্দার মাদুর ছেড়ে উঠে এলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন, 'তোর কপাল ভালো। আমাদের হেড মাস্টার মশায় আজ কলকাতা যাচ্ছেন। রাতের ট্রেন। সঙ্গে বাড়ির লোকজন।  ওদের সঙ্গে গেলে তোর আর ভয় থাকবে না।' আমি ট্রেনের টিকিট কাটতে স্টেশনে চলে যাই।

ফিরে এসে আমরা দুজন যখন ভেতরের টানা বারান্দায় আসন পেতে খেতে বসেছি, রোগা লিকলিকে সংসারের ভারে নুজ্ব মানুষটা হয়ে গেলেন এক প্রাণময় পুরুষ। 'একটা কথা কিন্তু বলব বাবলু, জীবনে বড় হতে গেলে, এভাবেই হয়। তুই পারবি। কলকাতায় নেমেই বিবেকানন্দ মুখার্জীর সঙ্গে দেখা করবি।' আমি জানতে চাই, 'কে এই বিবেকানন্দ মুখার্জি?' 'ওহ, তোর তো জানার কথা নয়। যুগান্তরের এডিটর। মস্ত সাংবাদিক। নেহ্রুও ভয় পায় তাঁকে।' সেই প্রথম ভারতের এক সাংবাদিকের নাম জানলাম। নেহরুর নাম জানতাম।' মনে মনে ঠিক করলাম, প্রথমেই যাব যুগান্তরে। নিতাইদা যুগান্তর রাখতেন, ঠিকানাটা নোট করে নিলাম।

বিকেলের ট্রেন। আমাদের শহরের মত মিটার গেজ লাইন। কাটিহার যাবে। আমাদের বগিটা যাবে কলকাতায়। দু তিনটি স্টেশন পরেই বারসই জংশন। এখানে আমাদের বগিটাকে কেটে একটা ইঞ্জিন যখন অন্ধকার কোন এক জায়গায় ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল, তখন রাত। বগিটাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাস্টার মশয় মোমবাতি জ্বাললেন। মাঝে মধ্যে কারো কারো হাতের টর্চের আলো এদিক ওদিক লাফালাফি করছিল। আমি ভেতরের আর বাইরের অন্ধকারে একাকার। খানিক পরেই ঝাঁপিয়ে এলো মন খারাপ। মা'র জন্য। গতরাতে এই সময় খোলা বারান্দায় মাদুরে মা'র পাশে শুয়ে ছিলাম। জুন মাসের আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা ঝিলমিল করছিল। আমি একবার তারার দিকে, একবার মা'র দিকে তাকাচ্ছিলাম। দু'একবার মা'কে জড়িয়েও ধরছিলাম। কিন্তু একবারও বলিনি, 'মাগো, কাল আমি থাকব না তোমার পাশে।' জানতাম ঐ তারাভরা আকাশ আর মা রয়ে যাবেন আমার ভাবনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, কয়েক মুহূর্ত পর থেকেই, তবু। এখন ভাবি, কিশোর মন কি সত্যিই সবচেয়ে নিষ্ঠুর হয়? নতুন জীবনের আহবানের জয়ঢাকের আওয়াজ কি ঢেকে ফেলে মায়ের ডাককেও? আমার কানে কেন বাজল না  বাতাসে ভেসে ভেসে আসা মা'র উৎকন্ঠায় ভেজা 'বাবলু' ডাকটা? অন্ধকারে নিজেকে বোধয় স্পষ্ট দেখা যায় বেশি। আমি টের পেলাম, আমি কাঁদছি। জামার হাতায় 'ঘুম পাচ্ছে' অছিলায় চোখের জল মুছতে থাকি। কত মুছব? প্লাবন যেন বড় বড় ঢেউ তুলে ছুটে এলো। ছানুর জন্য, বড়দার জন্য, ফিজু, শিখা, ডিকু, বাড়ির শিশু দোপাটি, লাল ঝুঁটি মোরগ ফুল, বটগাছ....  নদীর বিশাল বিশাল ঢেউ একের পর এক এসে পাড় ভাঙ্গতে থাকে… 

8. // শাকচুন্নি //

আমরা আট ভাইবোন। বড়দা আর সবচেয়ে ছোটভাই ডিকুকে বাদ দিলে আমাদের প্রত্যেকের ভালো আর খারাপ নামের বাইরে একটা 'খ্যাপানোর' নাম ছিল, এখনও আছে। যেমন, শুটকু (মেজদা), ভুটু (আমার ওপরের ভাই), দাতু (আমি। সব সময় দাঁত বের করে হাসি বলে), শাকচুন্নি (আমার পরের বোন), নাকু (বোনের পরের ছোট ভাই), শুটকি (ভাইয়ের পরে ছোটবোন). আজকে শাকচুন্নির কথা বলব।

শাকচুন্নির ডাক নাম সানি থেকে ছানি। ভালো নাম স্নিগ্ধা। চার পুত্র সন্তানের পরে প্রথম কন্যা সন্তান, তাই বাবা মা আর দাদার আদরে বাঁদর বোন। আমার ছোট। লড়াই মারামারি হিংসে তো ছিলই। আমরা সব ভাই, এমন কি ছোট ভাইও ওর ওপর নজর রাখত। মাথায় রাখে না উকুনের ভয়ে, মাটিতে নামায় না বাঘের ভয়ে, এমন ভাব। তাই বাবা মা দিনে অন্তত দু ডজন নালিশ পেতেন, আমরা সবাই সানির বিষয়ে রিপোর্ট করতাম। এর বড় কারণ, বাড়ির আদরে ওর মধ্যে একটা ক্যাবলা ভাবও ছিল। যে কারো সঙ্গে লাফাতে লাফাতে চলে যেত। নাচতে বললেই স্কার্ট ঘুরিয়ে নাচত, কেউ রিকশায় উঠতে বললেই রিকশায় গিয়ে বসত। তবে গুণ ছিল, একই ভুল ও দু'বার করত না। আমরা নালিশ রিপিট করার সুযোগ পেতাম না।

আমি ওর  নাম দিয়েছিলাম, 'শাকচুন্নি'. একদিন সন্ধ্যায় দু'জনের মধ্যে চলছিল বেদম মারপিট। বাবার নির্দেশ ছিল, যে যাইই করুক, মেয়েদের গায়ে হাত তোলা চলবে না। আমি তাই ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেদম মারপিট করছিলাম। ও রেগে আমাকে 'দাতু' বলে আমার চুলের গোছা ধরে অ্যাটাক করছিল, আর চিৎকার করে কাঁদছিল। মারের আগেই কান্না? আমি তখন বেপরোয়া লাথি চড় কিল ঘুষি চালাচ্ছিলাম, রাগে মুখে এসে গেলো, 'শাকচুন্নি কোথাকার!' সেই থেকে 'শাকচুন্নি'. বাড়ির নিয়ম শাকচুন্নিটা জানত, সে জন্যে সারা পাড়া কাঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল। বন্ধ দরজার বাইরে ভয় পেয়ে মা বাচ্চু, ফিজু এসে হাজির, 'দরজা খোল দরজা খোল...' এই মারপিটের শেষ ফলটা কী হয়েছিল, সেটা অন্যদিন বলা যাবে।

আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন। আমাদের সম্পর্কটা মধুর হতে কিন্তু বেশি সময় লাগে নি। আমার সমস্ত পাগলামী আর দুষ্টুমির রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল বোনটা। আসলে মা'র বাইরে আমাদের কাছে আর কোনো মায়ের ছোঁয়া তো ছিলো না। ধীরে ধীরে ও আমার দ্বিতীয় প্রশ্রয়দাতৃ হয়ে উঠল। আমার তিন বছরের ছোট ছানু। ও গানশিখত, আমি তবলা বাজাতাম। ও কোন বন্ধুর বাড়ি যাবে, পৌঁছে দিতাম। সময় হলে ফিরিয়েও আনতাম। ও-ও তেমনি, পড়তে বসে আমার ঘুম পেলে অন্যদের মত মেজদার কাছে রিপোর্ট করতে ছুটত না। বরং, নিজে দুলে দুলে পড়ার সময় আমার গায়ে হাত পাখা চালাত। পাড়ায় নববর্ষের প্রভাত ফেরি চালু করলাম ছোটদের নিয়ে, সাইড ড্রাম বাজাবে কে? আমি ছানুর কাঁধে ক্রশ করে ঝুলিয়ে দিলাম সাইড ড্রাম। আমার হাতে রাস্তা জোড়া ফেস্টুনের এক প্রান্ত। পিছনে আমার চেয়ে কম বয়সীদের মিছিল। এমনকি পুণ্যদা রিকশওয়ালা চুনোপুটিদের তাঁর রিকশায় বসিয়ে আমাদের পিছনে পিছনে। সম্ভবত পরবর্তীতে ছানুর জীবনে মিছিলের ভূমিকার সুত্রপাত এই সময়েই।

ঢাকায় মেডিক্যাল পড়ার সময়, বাংলাদেশ আন্দোলনের শুরুতে ছানু পৌঁছে গেল মিছিলের অগ্রভাগে। পাশে অগ্রজরা, যাঁদের অনেকে পরে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছেন। আমাদের বাকি সব ভাইবোনদের মতই ছানুও রাজনৈতিক আন্দোলনে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল, কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না।

শাকচুন্নি একটু বড় হতেই নানা সাংস্কৃতিক কাজে জড়িয়ে যায়, গান নাটক আবৃত্তি। আমি আমার বারো তের বয়সে আমাদের বাড়ির মাঠে আয়োজন করি 'রবীন্দ্র জয়ন্তী'. প্রভাত ফেরির এক্সটেনশন বলা যায়। নিয়ম করলাম, ১৫ বছরের ওপরে কেউ থাকবে না। মনে আছে,  বাবার কাছারি ঘরে পড়ে থাকা একটা পুরানো হাত-নোট বইয়ের মাঝ বরাবর ভাঙা ইঁট দিয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে আমি আর বন্ধু ক্যাবলা বানালাম পার্ফোরেটেড রসিদ বই। ওপরের অংশ আমাদের, নিচেরটা দাতার। মনে আছে, প্রথমেই পাড়ার হোমিও ডাক্তার শৈলেন সোমের কাছে গেলাম, 'জ্যাঠামশায়, রবীন্দ্র জয়ন্তী করব। ছোটরা। চাঁদা দিতেই হবে।' তিনি এটা ওটা জিজ্ঞেস করে শেষটায়, একটা সিকি (পঞ্চাশের দশক) দিলেন। আমরা এতটা আশাই করিনি। এক মুহূর্তে হাত পায়ে আনন্দের স্রোত বয়ে গেলো। খসখস করে ওঁর নাম লিখে ফরফর করে রসিদ কেটে দিলাম। ব্যাস, আমাদের যাত্রা হল শুরু, ছানু লেগে গেল ওর চেয়ে আরো ছোটদের একত্র করে প্রোগ্রাম সাজাতে। আমি আর ক্যাবলা হাটে বাজারে সবার কাছে হাত পাততে লাগলাম। এক আনার বেশি কেউ দেয় না। কেউ বা তাড়িয়ে দেয় মাছি তাড়াবার মত। কাপড়ের দোকানদার, পেঁয়াজের আড়ৎদার, লঙ্কার ডাঁইয়ে বসে থাকা বন্ধু ধলার বাবা... কেউ বাদ নেই। কিছুদিনের মধ্যেই ১২-১৩-১৪ বছরিদের ভীড় জমে গেল।

পাড়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে চার-ছয়টা চৌকি আনা হল, স্টেজ। পাড়ার মা-মাসীদের কাছে হাত পেতে পেতে আনা হল শাড়ি, উইংস। পাড়াতেই আমাদের স্কুল, মহারাজা গিরিজানাথ.. হেডমাস্টারের কাছে দাঁড়ালাম। শ্রোতাদের জন্য গোটা দশেক বেঞ্চ  হই হই করে বয়ে নিয়ে এলাম সবাই। পুলহাটের চালের মিলে গিয়ে মাড়োয়ারি মালিকের দাক্ষিণ্যে নিয়ে এলাম নানা মাপের ত্রিপল, মাটিতে দর্শক শ্রোতাদের জন্য ফরাস। বাঞ্ছারাম পুলের কাছে ডোল্লাদার টিন ঢালাইয়ের দোকান, চোঙা নিয়ে আমরা সারা শহর ছোটখাট মিছিল করে অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করলাম। ডোল্লাদার দাদা ছিলেন ইউসুফ ভাই, তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন এক মাইকের দোকানে, বিনে পয়সায় জোগাড় হল দুটি মাইক স্ট্যান্ড আর একটি চোঙা লাউডস্পীকার। অনুষ্ঠানে ভীড়। দু'তিন বছরে আমরা নামী আর দামী হয়ে গেলাম। শহরের অন্যান্য অনুষ্ঠানে কর্তারা আমাদের জন্য বরাদ্দ করতে লাগল কোথাও আধ ঘন্টা কোথাও এক বা দেড় ঘন্টার অনুষঠান। সবাই শিশু শিল্পী। ছানু গান গায়, আমি তবলা বাজাই। কখনো একক অনুষ্ঠানে চীনামাটির নানা আকারের বারো চোদ্দটা বৌলে নানা মাত্রায় জল ভরে জলতরঙ্গ বাজাই। ক্যাবলা করত কমেডি, আরো ছোটরা জুতা আবিষ্কার... এই সব।

ছানুর রাজনৈতিক বুদ্ধি ছিল প্রখর। ১৯৬২ সালে দেশ জুড়ে আয়ূব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, দিনাজপুরেও। আমার তখন ১৫/১৬ বয়স। কলেজে। আমিও জড়িয়ে গেলাম। দল বেঁধে সারা শহর জুড়ে রাস্তাঘাট রেস্টুরেন্ট দোকান অফিস সর্বত্র আয়ুবের ছবি ভেঙ্গে চুরে পায়ের তলে পিষছে সবাই পাগলের মত। আমিও। একদিন পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে বেদম চার্জ। আমি পালাই। দৌড়ে বাড়ি। ঢুকেই গেটের দরজা বন্ধ করে দি। ছুটে গিয়ে রান্না ঘরে মার হাড়ি থেকে ভাত নিয়ে রান্না ঘরের মেঝেতে খেতে বসে যাই। গেটে পুলিশ ধাক্কা দিচ্ছে। বাবা তখন জেলে। আমাকে চিহ্নিত করা কারো কাছেই মুশকিল না। হঠাৎ দেখি ছানু ছুটে কূয়োর পাড়ে চলে গেল। গিয়েই চোখের নিমেষে এক বালতি জল সারা গায়ে ঢেলে দিয়ে, চিৎকারঃ 'মা, ও মা, দেখতো কে গেটের দরজা ধাক্কাচ্ছে! আমি তো চান করছি!' কূয়োর পাশেই আমাদের গেট। পুলিশ ফিরে গেল। তবে পরদিন কাক ভোরে পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করে, বাবাকে যেমন নিয়ে যায়, আমাকেও অ্যারেস্ট করল। তিন মাস পরে ছাড়া পেলাম... ততদিনে আমার বুকের ভেতরে পৃথিবীর রঙটাই পাল্টে গেছে... শুরু হল নতুন জীবন....

ছানু এখন ডাক্তার। বিলেতে থাকে। আমরা ছাড়াছাড়ি ১৯৭২ সাল থেকে। মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া আছে। কিন্তু... আর কী হয়? এখন সব ভাই-বোনদের জন্য অহেতুক আতঙ্কে শরীর খারাপ করে। আমরা সবাই ওর কাছ থেকে শরীরের কথা লুকাই। নইলে ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা। অন্য কারো কথা শোনার অভ্যেসটাই আর নেই ওর।


মনে পড়ে। বাড়ি থেকে তখন বেরিয়ে যাচ্ছি। মাঠে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে শেষবারের মত দেখে নিয়ে মুখ ফেরাতেই, বাইরের কাঁঠাল গাছের ছায়ায় শাকচুন্নি দাঁড়িয়ে। পরনে একটা হলুদ ফ্রক। ১৪ বছরের তন্বী বোনটি আমার! কাছে যেতেই দুটি টলটলে স্থির পুকুর মেলে জিজ্ঞেস করে, 'তুই চলে যাচ্ছিস?' সবাইকে মিথ্যে বলতে সময় লাগে নি, মা'কেও না। ওর সামনে থতমত খেয়ে যাই। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, 'কই? তোকে কে বলল? মিথ্যে কথা। তুই থাক, আমি বাজার থেকে দৌড়ে আসছি।' দ্রুত পা চালাই। কতক্ষণে গলির প্রান্তে পৌছুবো! পৌঁছেও গেলাম। ফিরে দেখি, একই ভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের হলুদ ফুল। এক লহমায় পাক নিয়ে অদৃশ্য করে দিলাম শাকচুন্নিকে....



7. // আমরা দুই ভাই //

বাচ্চু আমার তিন বছরের বড়। কোনদিন দাদা বলে ডাকিনি, 'বাচ্চু' বলে এখনো ডাকি, শিলিগুড়ির নামী চোখের ডাক্তার হলেও। আমার ছোটবেলায় আমার যদি ঘোষিত শত্রু বলে কেউ থেকে থাকে সে এই বাচ্চু। বাজারে যাবে না, হাটেও না। 'মা আমি পড়ছি, বাবলুর পড়াশুনো সেই সকালেই শেষ। ও যাবে।' এক অর্থে ঠিক, খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করত, বেশির ভাগ সময়েই। বাবা আমাদের দুজনকে এক ঘরে থাকতে আদেশ করেছিলেন। কেন জানি না। ঘরে দুটি জানালার পাশে একটি করে টেবিল। পাশে একটি করে বই-খাতা রাখার নড়বড়ে র্যাক। ঘরের দুপাশে দুটি বিছানা। আমার বিছানা একটা লম্বা জানালার পাশে। বাইরে বেল কাঁঠালের দুটি মস্ত গাছ। শিরশিরে হাওয়া আসে সর্বক্ষণ। বাচ্চুর এসবে কোন বাছ বিচার ছিল না। তার পড়াটা নির্বিঘ্নে হলেই হল। তাই সহজেই বাজার হাটের দায় আমার ওপর পড়ত। অবশ্য এতে আমার আগ্রহও কম ছিল না। হাট থেকে ফেরার সময় রিকশা না করে কাঁধে করে হাট নিয়ে এলে মা আমাকে দিতেন চার আনা (পঞ্চাশের দশক). বাজারের ফ্লয়াট রেট এক আনা। রসগোল্লা জিলিপি বোঁদে চানাচুর কমলা লজেনস টোস্ট বিস্কুট... সপ্তাহে একদিন তো আমি টাটা-বিড়লা! এর আরো একটা কারণ ছিল, স্কুলে চন্দ্রবাবু স্যার সকলের সামনে আমার 'সংগ্রামী' চরিত্রের প্রশংসা করেছিলেন। 'হাটের কাছে আমার বাড়ি। নিজে চোখে প্রতি হাটবারে অরুণকে পাহাড় কাঁধে মাল বইতে দেখি। ওর মত নিরহঙ্কারি পরিশ্রমী হতে হবে সবাইকে..', তিনি একদিন ক্লাশে তার পাশে আমাকে ডেকে সবাইকে বলেছিলেন। স্যার জানতেন না, এজন্য আমি রীতিমত চার আনা পয়সা পেতাম। সবার কাছ থেকে হাততালি পেতে কার না সাধ হয়?

আমরা দুই ভাই পিঠাপিঠি হলে কী হবে, আমাদের দুই চরিত্রে কোন মিল ছিল না। আমি ওর সব স্বভাবের উল্টো স্বভাবের। বাচ্চু শান্ত, ধীর স্থির। পড়াশুনো ফার্সট প্রেফারেনস। সুস্বাস্থ্য, বড়দা ওকে আদর করে নাম দিয়েছিল 'ভুটু'. বাচ্চু পড়াশুনো নিয়ে ব্যাস্ত থাকত বলে ওর বন্ধু সংখ্যা কম ছিল। মিথ্যে কথা বলা সে জন্যেই শেখেনি সে। স্থির মস্তিষ্ক, মা'কে পরামর্শ দিত একবার মাত্র, আমার মত ঘ্যান ঘ্যান করত না। তাই বাচ্চুকে নিয়ে কারো নালিশ ছিল না। চিন্তাও না। অন্যদিকে আমাকে উঠতে বসতে মেজদার কাছে ধাতানি খেতে হত, 'বাচ্চুকে দ্যাখ!' সবার মত বাচ্চুরও ধারণা হয়েগিয়েছিল আমি বখে গেছি। তাই আমাকে শাসনে রাখা ওর যেন একস্ট্রা ডিউটি। একসঙ্গে থাকতাম বলেই এই দায়িত্বটা বাচ্চু নিজেই নিয়েছিল মনে হয়। আমার সঙ্গে ওর লড়াইয়ের মূল এইখানে। ও পড়তে বসত, আর আমি আটটা বাজলেই, 'একটু ঘুমিয়ে নি। তুই শুতে যাবার আগে ডেকে দিস।' বাচ্চু ঘুমোতে যেত রাত এগারোটায়। ঘড়ির কাঁটা ধরে। এগারটায় আমাকে তুলে দিত। আমি পড়তে বসতাম। বাচ্চুর নাক ডাকতে পনেরো মিনিটও লাগত না। আর আমি ঠিক তখনই টেবিল ঘড়ির কাঁটা পোঁ পোঁ করে আড়াইটায় এনে, টেবিল খাট ইত্যাদিতে দুমদাম আওয়াজ তুলে পড়তে মন দিতাম। আওয়াজে বাচ্চুর ঘুম ভেঙ্গে যেত, ঘুম চোখে বাথ্রুমে যাবার সময় দেখত আমি রাত আড়াইটাতেও জেগে পড়ছি। আমাকে বকাঝকা করে লন্ঠন নিভিয়ে দিত, 'এত রাত জেগে পড়িস না। শরীর খারাপ হয়ে যাবে, ঘুমোতে যা'. পরদিন বাবা মা মেজদা ঘটনা শুনে আমাকে প্রশংসা করত। বেশ কিছুদিন এই রকমটা চলল, একদিন হাতে নাতে ধরা পড়ে গেলাম। বাচ্চু মিছিমিছি নাক ডাকছিল, চোখ পিটপিট করে আমার কীর্তি দেখে একইভাবে আমাকে শুতে বলে পরদিন সকালে সব ফাঁস করে দিল। মেজদার হাতে সে যে কী পিটুনি, কী আর বলব।
আমার সঙ্গে ওর শত্রুতার হাজার খানেক ঘটনা আছে। আর একটা বলি। মেজদার আদেশ ছিল, স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষা দেবার সময় কোশ্চেন পেপারের পাশে উত্তর লিখে আনতে হবে। আমি লিখলাম। কিন্তু বাইরে এসে ফার্সট বয় মলয়ের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখি প্রায় সত্তর ভাগ অঙ্ক ভুল করেছি। এইবার উপায়? উত্তর তো কাটা যাবে না! তখন দোয়াত কলমে পরীক্ষা দিতাম আমরা। আমি দোয়াতের কালি কোশ্চেন পেপারের ডানদিক বরাবর ঢেলে দিলাম। উত্তর হাওয়া! বাচ্চু একই স্কুলে, তিন ক্লাশ ওপরে পড়ত। দেখেছিল নাকি শুনেছিল, মেজদাকে গিয়ে আমার কীর্তি ফাঁস করে দিল, আবার পিটুনি! মেজদার হাত ব্যয়াথা করতে লাগল। মা কিচ্ছু বলল না। বাচ্চুর সে কি হাসি!

আমি ভালো ছেলে ছিলাম না বাড়িতে। পড়াশুনো করতে ভালো লাগত না। সারাদিন টোটোবাজি। কৃষি ফার্মে আঁখ চুরি করা, স্কুল পালিয়ে টম্যাটো ক্ষেত থেকে টম্যাটো চুরি করে খাওয়া, গরুর গাড়ির পিছনে ঝুলে ঝুলে মাইল খানেক চলে যাওয়া, কাঁটাপাড়ায় প্রতিমা শিল্পী রাখালদার চালাঘরে বসে থাকা, হড়মুড় করে এ ওর বাড়িতে ঢুকে খেতে বসে যাওয়া, সাইকেল চড়ে গার্লস স্কুলের আশেপাশে পাক খাওয়া, গেটকীপার কালুয়াদাকে পটিয়ে লিলি টকিজে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখা, স্টেশন রোডের এ দোকান সে দোকানে গল্প করা, চায়ের টেবিলে বসে পড়া... বাচ্চু যা কল্পনাই করতে পারত না। কৈশোরের মধ্য গগনের আগুন তখন আমার বুকে সর্বক্ষণ। ভিটেমাটি থেকে উৎখাত বিহারীদের কাছে তাঁদের জীবন সংগ্রামের কথা শুনতাম, আর মনে হত, নিজভূম বলে কি কিছু হয়? সারা পৃথিবীটাই তো নিজভূম, নইলে মানুষ আবার শিকড় খুঁজে পায় কী করে? ওই বয়সে প্রশ্ন থাকলেও উত্তর তো খুঁজতাম না! তবে পৃথিবিটা অনেক বড় হয়ে উঠত আমার কাছে। রেডিওতে অজয়দা আর কমলদার কথায় ভেসে চলে যেতাম কলকাতার ফুটবলের মাঠে, ক্রিকেটের কমেনন্টারি শুনতে শুনতে চলে যেতাম বোম্বাই। তখন তো টেলিভিশন নেই (শহরে বিদ্যুৎই আসে নি!) তাই দেখা নয়, ভাবনায় পৃথিবীটায় ঘুরপাক খেতাম।

বিপরীতে বাচ্চুর পৃথিবী ছিল সরল সহজ আর প্রত্যয়ের। আমার না। আমার ছিল উড়ান। শুধুই উড়ান। সারা বিশ্ব জুড়ে। আর্জেন্টিনা, সুইডেন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, সেই সঙ্গে কলকাতা বোম্বাই দিল্লি... তাই যেদিন সকালে বাড়ি থেকে পালাচ্ছি, রেল গেটের কাছে ট্রেনের অপেক্ষায় (যাতে স্টেশনে কেউ জানতে না পারে কোথায় যাচ্ছি) মাদারির খেলা দেখছি, কাঁধে টোকা। মুখ ঘুরিয়ে দেখি, বাচ্চু। বললঃ 'তুই আজ বাড়ি থেকে পালাচ্ছিস?' আমি থ। 'যাস না বাবলু। এ কাজ আমাদের পরিবারে মানায় না। বাবা এখনো জেলে। দাদা সবে ডাক্তারি শুরু করেছেন, কষ্ট করছেন আমাদের জন্য, আমাদের কলেজ জীবনই শেষ হল না। যাস না।' আমি জোরে হেসে উঠলাম। 'পাগল? তোকে কে এই সব আজগুবী খবর দিয়েছে? আমি তো কোর্টে যাচ্ছি! মা'র কাজ আছে।' বাচ্চু সরল, ভাই বোনদের কথায় তার অগাধ বিশ্বাস। বললঃ 'তাহলে ঠিক আছে।' বাচ্চু বাড়ির পথ ধরল। খানিক পরে আমি লুকিয়ে দৌড়ে লাফিয়ে ট্রেনে চড়ে বসলাম....


6. // আমাদের মেজদা //

আমাদের মেজদা আমার থেকে ছয় বছরের বড়। আমাদের ছোটবেলার হোম মিনিস্টার। ভাই বোনেরা কে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে কী বলছে সে সব লক্ষ করে শাস্তি বিধানের ক্ষমতা তাকে যে কে কবে দিয়েছিল জানি না। কিন্তু বড়দার অনুপস্থিতিতে (বড়দা চিরকাল বাইরে বাইরে) মেজদাই আমাদের ডিফ্যাক্টো গার্জিয়ান। আমরা নিষ্ঠুর মারের ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারতাম না। মা'র কাছে নালিশ করার সাহসও জুটত না, ওই একই কারণে। মা টের পেতেন কিনা জানি না। আমাদের ভাই বোনের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার এক্সপোর্টার ছিলেন মেজদা। বড়দার সাংস্কৃতিক প্রবাহ আর মেজদার রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ির ছোটদের মধ্যে এক চমৎকার রসায়ণ তৈরি করেছিল। বাড়ির পরিমন্ডল তো সেসবের অনুকূল ছিলই। বাবা রাজনৈতিক বন্দী হয়ে প্রায়শই জেলে, মা আশেপাশের তরুণ ও যুবাদের কাছে রাজনীতির শ্রদ্ধেয় গুরুজন। এত সব আমাদের রাজনীতি থেকে কখনই দূরে থাকতে দেয়নি।
মেজদা ছিলেন দুরন্ত সাহসী। ভাষা আন্দোলনের সময় রাতে আমাকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে ঝাঁটার শলার ডগায় কাপড় জড়িয়ে, বাটিতে আলতা ঢেলে বসিয়ে দিত পোস্টার লিখতে, কেননা, আমার হাতের লেখা ভালো। আমি আগে থেকে খাতার পাতায় লেখা স্লোগান দেখে দেখে লিখতাম গোটা গোটা অক্ষরে, খবরের কাগজের শিটে। কে যে বাটি ভর্তি আটার আঠা জ্বাল দিয়ে রাখত মনে নেই। মা কি? নাকি পাশের বাড়ির রেণু কাকিমা? বাচ্চু আমি আর মেজদা এই তিন ভাই মিলে মাঝরাতে পাড়ার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটতাম গভীর রাতে। আমার বয়স তখন সাত-আট, বাচ্চুর  দশ-এগার, মেজদা তের-চোদ্দ। আমি ঐ বয়সী মেজদার বক্তৃতা শুনেছি দিনাজপুর ইনস্টিট্যুটের চত্বরে। মেজদা প্রতিবাদ করছিলেন কী করে বন্দীদের 'গরু ছাগলের মত' কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হছে। মেজদা শক্ত মুঠি তুলে প্রতিবাদ তুলছেন, উপস্থিত জনতা সাবাসী দিয়ে চলেছে গলা মিলিয়ে, হাতে তালি দিয়ে। একবার দিনাজপুর কোর্টে এসডিও-কে যখন ঘেরাও করে রাখা হয়েছে, মেজদা পাঁচিলে উঠে এসডিওর জানালার শিক ধরে ঝুলে চোঙা মুখে চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকে, 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, কালা কানুন বাতিল কর।' পুলিশ ছুটে গিয়ে মেজদাকে পাঁজা কোলে নামিয়ে আনে।
একবার, বাবা তখন জেলে, আমরা দু সপ্তাহে একবার সবাই মিলে বাবার সঙ্গে জেলে দেখা করতে যেতে পারতাম। একবার পারমিশন মিলছিল না কিছুতেই। মেজদা, সোজা বড় মাঠের ধারে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের রেসিডেনসে গিয়ে হাজির। মেজদাকে অফিস ঘরে অপেক্ষা করতে বলা হল, 'সাহেব ব্রেকফাস্ট করছেন। পরে নামবেন।' মেজদা বসে থেকতে থাকতে হঠাৎ দে দৌড়! দৌড়ে বাড়ির বাগান পেরিয়ে একেবারে দোতলায়। এঘর সেঘর করেই ডাইনিং রুমেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। 'আমরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই!' পিছনে ছুটে আসা পুলিশদের চলে যেতে বলে সাহেব মেজদাকে চেয়ারে বসিয়ে ফল খেতে দিলেন, বললেন, 'পারমিশন দেব, যদি তুমি আমাকে একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও।' আবৃত্তিতে ওইটুকু বয়সেই শহরে মেজদার সুনাম ছিল। মেজদা পরে বলেছেন, 'আমিও সুযোগ পেয়ে কায়কোবাদের কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালামঃ 'রবীন্দ্রানাথ, এই যে রাজপথ তোমার চোখের সামনে প্রসারিত... সে পথে তো পা ফেলার উপায় নেই, হাঁটবার উপায় নেই সে পথ ধরে, তবু যদি দাঁতে দাঁত চেপে, দু চোখে হাত রেখে হাঁটতে চাই, তখুনি লাখ লাখ ক্ষুধার্ত নরনারী এসে সে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে... দাঁড়িয়ে থাকে আমার শীর্ণা জন্মভূমি...' (উদ্ধৃতে ভুল হতে পারে। এই কবিতাটি আমরা সব ভাই বোন আবৃত্তি করতাম নানা অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রনাথ বাদ দিয়ে নজরুল, নজরুল বাদ দিয়ে সুকান্ত এই ভাবে বদল করে করে। এটা সত্যই কায়কোবাদের লেখা কিনা জানি না। জেলখানার এক খাতায় বাবার হাতের লেখায় এই কবিতাটি ছিল, আমরা টুকে নিতাম। কবির নাম ছিল কায়কোবাদ। জানা হয় নি। সরকারি রোষকে স্তিমিত করতে বাবা ছদ্মনামে কবিতাটি লিখেছিলেন কিনা।)
মেজদা প্রচন্ড বদ রাগী ছিলেন। মিতব্যায়ীতা ছিল তাঁর বাঁচার মন্ত্র। এটা না থাকলে আমরা সবাই আমাদের সংগ্রামী জীবনকে জলভাত করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। আমি ছিলাম উল্টো, তাই মেজদার হাতে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছি আমি। আমি আর সবার মত মেজদার শাসন মানতে চাইতাম না। মা বলতেন মেজদাকে, 'ওকে বাদ দে।' মেজদা বলতেন, 'বাদ দিলে ওর কারণেই বাকিরা নষ্ট হয়ে যাবে।'... এ সব গল্প আর একদিন।


5. // আমাদের বড়দা //

আমাদের বড়দা। আমার থেকে ১৩ বছরের বড়। দাদা ছিলেন আমাদের বাড়ির সংস্কৃতির ক্রিস্টোফার কলোম্বাস। আমরা ছোটবেলায় দাদার মধ্য দিয়েই জেনেছিলেম আইপিটিএ-কে। দাদার কলেজ জীবন ছিল কলকাতায়। তাই জড়িয়ে ছিলেন সেই সময়ের টগবগে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে, ছুটি ছাটায় আসতেন দিনাজপুরে। সঙ্গে গান নাটক কবিতা। দাদার লেখা নাটক পাড়ার ছেলেরা মঞ্চস্থ করত। 'মহেশ' গল্পের রূপান্তর করেছিলেন, সিঞ্জের 'রাইড টু দ্য সী' নাটকটির অনুবাদ করেছিলেন, তাতে যুক্ত করেছিলেন আইপিটিএ-র নানা গান। দাদার কবিতা আমাদের মেজদা আবৃত্তি করতেন নানা অনুষ্ঠানে।

দাদা ছিলেন সুপুরুষ, আমৃত্যু। দুধে আলতা গায়ের রং, এক গোছা কাল চুল, মুখে ভূবনমোহনী হাসি। দাদার হাসি দেখে বড় বড় গুন্ডাদের শান্ত হতে দেখেছি, এমন কি আমাদের ডাক্তার দাদার চিকিৎসার পরেও এক গুণ্ডার মার মৃত্যুতে মার্মুখী গুন্ডাকেও। দাদা আমাদের জন্য কলকাতা থেকে দম দেওয়া কলের গান এনেছিলেন। সেই কলের গানেই আমরা শুনতাম 'গাঁয়ের বঁধূ' 'রানার' 'আলোর পথ যাত্রী' 'শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান'... এই সব। দাদা রানারের ছায়া-নাটক করিয়েছেন আমাদের দিয়ে, গায়ের বঁধূ নিয়ে নৃত্য নাট্য আরও কত কী।

একদিন সব বন্ধ হয়ে গেল। দাদা ভর্তি হলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। আমরা পাড়ার সবাই ততদিনে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে জড়িয়ে গেছি, এমন কি কখনো সখনো পড়াশুনোর ক্ষতি করেও। বাবার ক্রমাগত জেলে বন্দী হওয়ায় আমাদের সংসারে তখন খুব আর্থিক সঙ্কট। আমি আর আমার ওপরের ভাই সাবানের কারখানে থেকে বাঁশের বাঁকে সাবানের জল বালতিতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছি মা'র কুয়োর পাড়ে, মা কাপড় কাঁচেন তা দিয়ে। পুজোয় আমাদের পায়ে ক্যাম্বিসের কেডস জুতো, পরনে দড়ি বাঁধা ইজের। মা কিন্তু দাদার ডাক্তারি পড়া বন্ধ হতে দেন নি। অন্যদিকে দাদাও প্রতি বছর ডাক্তারি ক্লাশে সেরা রেজাল্ট করে বাবার বন্দী জীবনের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে চলেছেন। এভাবেই একদিন দাদা সম্পূর্ণভাবে ছিটকে গেলেন সংস্কৃতি আর সাহিত্যের জগত থেকে। আমরা সংগ্রাম কাকে বলে কোনদিন শেখার সুযোগ পাই নি। জানতাম বাবা জেলে থাকলে অমন জীবনই আমাদের সংস্কৃতি। দাদাও মানতেন। কৃচ্ছতায়ও জীবনে সেরা ডাক্তার হওয়া যায়, মানতেন। এ ছাড়া ওই সময়কালে বাকি সাত ভাই বোনকে বড় করার আর কোন উপায় দাদার কাছে ছিল না। রাতদিন ডাক্তারি। ছুটিতে বাড়িতে এলেও কুয়োর পাড়ে রোগা লিকলিকে আমি তার কাছে ব্যাঙ। আমাকে খালি গা করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাড় মাস পেট টিপে পরখ করতেন নিজের অ্যানাটমি বিদ্যার দৌড়। এভাবে একদিন দাদা শুধু ডাক্তার হয়ে গেলেন। সারা শরীরে ভাইবোন আর সমাজের তাবৎ মানুষের জন্য অপার মমতা ছাড়া দাদার কাছে আর সব মূল্যহীন হয়ে গেল।

দাদা বিলেত যাবার সুযোগ থেকে মুখ ফেরালেন, '....দিদি'র প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করলেন, ফিরে এলেন দিনাজপুরে। মা'র পাশে দাঁড়িয়ে বাকি সাত ভাইবোনদের জীবন স্থিত করার কাজে লেগে পড়লেন। আজো মনে পড়ে সেই দৃশ্য। বাড়ি ফিরে দেখি, রান্নাঘরের মেঝেতে দাদা খেতে বসেছেন। মুখ চোখ উত্তেজনায় লাল। আমি রান্নাঘরে উঁকি মারতেই বললেন, 'এই বাবলু, শোন শোন। আমি আজ দশ টাকা ফি পেয়েছি। কলে গেছিলাম। আমার জীবনের প্রথম ভিজিট, প্রথম ফি..'
দাদা আমাদের মধ্যে আর নেই। তবে আজো দাদার সেই আনন্দমুহূর্ত আমার চোখ ভিজিয়ে তোলে।



4. // আমাদের মা'র বন্ধু সঙ্গীরা //

আমাদের মা'র কথা মনে পড়লে ছোট ছোট স্মৃতি-ছবির মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। মা হাঁটছেন ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ মিছিলের পুরোভাগে, সঙ্গে আরো অনেকে। আমি মা'র পাশে পাশে, কখনো মা'র আঙুলে আঙুল আংটা করে, কখনো ছোট্ট প্লয়াকার্ড কাঁধে, কখনো পাশে পাশে দৌড়ে দৌড়ে... সন্ধ্যেয় পুজো মন্ডপে আরতির ধুনুচিতে ছোবড়া গুঁজতেই ছুটে গিয়ে মাকে খবর দিতাম, 'এখন আরতি শুরু হবে!'. মা দ্রুত বাড়ি থেকে বের হতেন, সপ্তমী-অষ্টমীর মৃদু চাঁদের আলোয় আমরা মা-বেটা দ্রুত পা ফেলে ফেলে বারোয়ারি পুজো মন্ডপে। মাকে নিয়ে আমার পুজোর স্মৃতি এই একটাই। প্রতি বছরের একই ছবি। মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ধোঁয়া সরিয়ে সরিয়ে দুর্গার মুখ  নিরীক্ষণ করছেন।  আজো দুর্গার মুখে চোখ পড়লেই কখনো সখনো সেখানে বদলে ভেসে ওঠে মা'র মুখ। মা'র স্বভাব কোমলতা আমাকে দুর্বল করে রাখত সব সময়। এসব নানা কারণে। কিন্তু মা কি সত্যি খুব কোমল ছিলেন? সব সময় হয়ত না। একটা ঘটনা বলি।

সমাজ সচেতনতা আর সংসার সচেতনতার মিশেল মা'র চরিত্রে কোমলতা আর কঠোরতার বৈপরীত্য এনে থাকবে। আমি তখন ছোট। মা'র আঁচল ধরা অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী থাকে যে ছোটরা, তাদের মত আমি বরাবর। একদিন সারাদিন ধরে বাড়িতে অনেক মহিলার আনাগোণার পর সন্ধ্যার সময় মা বললেন, 'চলত আমার সঙ্গে!' আমি খালি পায়েই, যেমন থাকি, মা'র সঙ্গে পায়ে পায়ে। পাড়াতেই এক গোয়ালা পরিবার থাকতেন, গরু বাছুর ছোটবড় বালতি আর বাড়ি জুড়ে মজার দুধ দুধ গন্ধ। আমি অনেক দিন ওদের কাঁসার ঢাউস গ্লাসে করে দুধ খেয়েছি। মাগনায়। ওরা আমাদের পরিবারকে খুব সমীহ করত। এখন অত ডিটেইল মনে নেই। মা ওদের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন, বাড়ির মাসীমাকে বললেন, 'দিদি, অমুককে (নাম মনে নেই) ওদের বাড়ি থেকে ডেকে আনতে পারেন?' দুটো বাড়ি দূরে ওই দাদাদের বাড়ি। দাদাটি ঘরে ঢুকতেই মা বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে যান, কাছে গিয়েই সেই বড়দার বয়সী দাদাটার দু'গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষালেন। মা রেগে কাঁই। 'এ পাড়ায় কোনরকম বাঁদরামো চলবে না। আর একটিবার যদি এসব কথা কানে আসে তোমার বাবা-মা'র সামনে আমি সব ফয়সালা করব।' ছেলেটি হাঁ. আমি থতমত। গোয়ালিনী মাসীমাকে দেখে মনে হল তিনি সব জানতেন। শুধু সেই দাদাটাকে বললেন, 'তুই এখন বাড়ি যা। ভালো ছেলে হবার চেষ্টা কর।'

মা'র বন্ধু বলব না, সঙ্গী ছিলেন অনেকে। সবাই সাধারণ মানুষ। মা'কে খুব স্নেহ আর সম্মান করতেন তাঁরা। মা'র এই সব সঙ্গীদের কারণেই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে নিজেদের কেউ কেটা ভাবার মানসিকতার ছায়াটুকুও পড়েনি। আমার মনে কোনদিন প্রশ্ন ওঠেনি আমাদের পরিবারের মত সারা শহরে পরিচিত পরিবারের গৃহবঁধূ, ডাক্সাঁইটে উকিল এবং একজন স্বীকৃত পন্ডিত ব্যাক্তির স্ত্রী হয়ে অমন মানুষদের সঙ্গে মা মিশতেন কেন। এই এত বড় বয়সেও আমার সে কথা মনে হয় নি কখনো। গোটা পাড়াটাই ছিল আমাদের যৌথ পরিবার। মা ছিলেন ঘুঁটে কুড়ুনি দিদিমার কাছে 'ঠাকুর্ঝি', রিকশাওয়ালা পূণ্যদার 'বৌদি', কলেজ কেরানীর স্ত্রীর কাছে 'ননো মা', স্কুল মাস্টারের ছেলেমেয়েরা মাকে ডাকত, 'পিসিমা', অন্যদের কাছে কাকিমা জ্যেঠিমা তো ছিলেনই। স্বামী পরিতক্তাকে মা ডাকতেন 'বৌদি' বলে, স্কুল মাস্টারকে দাদা, মা ভাদুড়িবাড়ির দিদিমাকে 'মা' বলে ডাকতেন, কোমর ভাঙ্গা হতদরিদ্র দিদিমাকে ডাকতেন 'মাসিমা' বলে... মনে আছে মা এদের কারো কারো সঙ্গে মাইল খানেক দূরের লিলি টকিজে হেঁটে হেঁটে সিনেমা দেখতে যেতেন। মা চলতেন। পিছনে পাড়া পড়শির মিছিল। একবার হাত পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি জুড়ে মায়েদের সঙ্গ নিয়েছিলাম। ঘুঁটে কুড়ুনি দিদিমা বললেন, 'ওকে সঙ্গে নেন ঠাকুর্ঝি। ও অত শত বুঝবে না।' মনে আছে, সিনেমাটির নাম ছিল 'দাসীপুত্র'. ফেরার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দিদিমার হ্যাচকা টান সামলাতে সামলাতে অতি কষ্টে বাড়ি ফিরি। মা'র কি এই বৃহৎ পরিবারের দায়িত্ব নেবার কোন প্রয়োজন ছিল? আমাদের খোলা মনের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে তো এসবের দরকার ছিল না। তবে? প্রশ্নগুলো এখন মাথায় আসছে বটে এর আগে কখনো আসেনি। কারণটা জেনেছি মা'র মৃত্যুর বছর ষোল-সতের পরে। এই কিছুদিন আগে।

তেভাগা আন্দোলনে দিনাজপুরের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন এখন কলকাতাবাসী শ্যামল সেন। তিনিই আমাকে একদিন এক হোমিও ডাক্তারের 
স্ত্রীর সঙ্গে মা'র সম্পর্কের ডিটেইল জানতে চাইলেন। আমি তো তাঁকে আমাদের পাড়ার জ্যেঠিমা বলে জানি, তার বেশি না। তিনি বললেন, ' এই সাধারণ মানুষগুলো আপনার মা'র কাছে ছিলেন তাঁর বিপ্লবী সময়ের এজেন্ট। কেউ বিপ্লবীদের সঙ্গে চিঠিপত্র চালাচালি করতেন। কেউ বা অস্ত্র, কেউ বা বোমা এই সব। লুকিয়ে। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে এই পন্থা নেয়া হত। পুলিশের গোপন নথিতে এঁদের কয়েকজনের নাম পেয়েছি, যাঁরা আপনার মা'র আন্ডার্গ্রাউন্ড কানেক্টরের কাজ করতেন... আমি আজো থ হয়ে আছি। আমরা ভাইবোনরা কেউ কোনদিন জানতাম না! বাবা কি জানতেন? বোধয় না।

3. // আমাদের মা //

আমাদের মা ছিলেন অধুনা বাংলাদেশের যমুনাপারের মানুষ। সাত্তিক ব্রাক্ষ্মণ পরিবার। পাঁচ বোন দুই ভাই। ছোট্ট জমি আর বাড়ি। যজমানি উপায় সম্বল। মাটি বুরবুরি কাটলেই বাক্স পেঁটরা নিয়ে দৌড়। পিছনে নদীর পেটে তলিয়ে যেত সাধের টেম্পোরারি সংসার। আবার যুদ্ধ। বাবা মা'র পাশাপাশি সব হাত জোট বাঁধত। এহেন পরিবারের মেয়ে আশালতা, তৃতীয় কন্যা, ১১ বছর বয়স, পাড়ি দিলেন দিনাজপুর। আত্মীয়সম পড়শির বাড়ি। সেখানে এমএ পাশ করা বর আসবে বিয়ে করতে। একই পাড়ার ২২ বছরী টগবগে যুবক, বরদাভূষণ। ছেলেটা পাগল প্রায়। স্বাধীনতা স্বাধীনতা লড়াই লড়াই ছাড়া কিছুই বোঝে না। লোহার মত শক্ত জিদ। কৃচ্ছতায় ক্ষোভ নেই, দান ধ্যানে নেই কৃপণতা। আশালতার কাছে সে কোন নতুন জীবন নয়। সংগ্রাম তো তার কচি বয়সেরই সঙ্গী! কিছুদিনের মধ্যে ওই অল্প বয়সেই আশালতা জড়িয়ে গেলেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে। প্রথমটায় বরদাভূষণের আড়ালে। সমবয়সী দেবর ও তার বন্ধুদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন সশস্ত্র বিপ্লবে। প্রখ্যাত হিলি মেইল ডাকাতিতে অংশ নিয়ে ব্যার্থ হয়ে বন্দী হলেন। আলিপুর দেউলি বহরমপুর জেলে বন্দী থাকলেন। সঙ্গীদের কারো হল আন্দামানে যাবজ্জীবন, কারো দীর্ঘ কারাবাস। ডাকাতিতে সরাসরি যুক্ত থাকার অপরাধ অপ্রমাণিত হওয়ায় আশালতা মুক্তি পেলেন বটে কিন্তু ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অপরাধে স্বামী বরদাভূষণের হল সাত বছরের কারাদন্ড। প্রথম সন্তানকে কোলে নিয়ে আশালতা এরপর সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সরে এলেন। নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন দিনাজপুরের নানা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। কিছুদিনের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন উত্তরবঙ্গের তেভাগা আন্দোলনে। কৃষক ফ্রন্টের মহিলা সংগঠনের দায়িত্ব পেলেন। আশালতা হয়ে উঠলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন 'আশাদি'।


2. // বাবার টীচারি  //

আমাদের বাবা আমাদের পড়াশুনো করাতে পারতেন না। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন একদম বাজে। অথচ নিজে পন্ডিত মানুষ। 'পন্ডিত' উপাধিধারী, 'কাব্যতীর্থ' এবং 'রাষ্ট্রভাষাবিশারদ'; তার ওপর এমএ আর আইনের গ্রাজুয়েট। মস্ত মস্ত বিচারকদের বোঝাতে পারতেন অনেক কিছু, আমাদের ছিটেফোঁটাও না। তেমনি আমাদের আট ভাইবোনের একজনও আমরা নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোয় কোন কাজেই লাগিনি বলা যায়। বাবা রাজনীতি করতেন, প্রত্যক্ষ। মা শুরুতে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকলেও, পরে আট সন্তানের মুখ চেয়ে তা থেকে বিরত ছিলেন, তবে পরোক্ষে জড়িয়ে থাকতেন। বাবা প্রায় সব রাজনৈতিক আন্দোলনেই জেলখানায় ঢুকে যেতেন, মানে, সরকার তাকে বাইরে রাখতে সাহস পেত না। তো আমাদের সংসার চলত মা'র নেতৃত্বে কঠোর সংগ্রামের আনন্দধারায়। তাই আমাদের শিক্ষা ছিল জীবন সংগ্রামের। জীবনের প্রতি লগ্নে, প্রতি মুহুর্তে, প্রতিদিন। বোধয় এজন্যেই আমাদের মধ্যে দুজন বাদে চাকুরিজীবী একজনও না। তাই আমাদের মধ্যে তিন ডাক্তার, দুই চারটারড একাউন্টেন্ট, এক পোস্টগ্রাজুয়েট (ভূগোল), উচ্ছন্নের আমি। আর আমাদের প্রতিবন্ধী ছোট ভাই। বাবা আমাদের মধ্যে যে শিক্ষাটা রক্তে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, তা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। সেই সঙ্গে ্মিশেল ছিল মা'র সংগ্রামের শিক্ষা। মনে আছে, বাবা একদিন আচমকা আমার টেবিলের এক পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। ইংরেজী পড়াবেন। ব্যাস, আমি তো শুরুতেই আরটিকলে গোল করে ফেলি। বাবা নেসফিল্ডের গ্রামার আনালেন। কিছু বোঝালেন না। একটা চ্যাপটার বের করে বললেন, 'এটা পড়। সব জেনে যাবি'। বলে চলে গেলেন। আমার আজো A আর An'র সঠিক প্রয়োগ শেখা হয় নি। 



// বাবার বাতিক//
আমাদের বাবার কতগুলো মজার ব্যাপার ছিল। মা বলতেন, বাতিক। এসব ঘটত, দেশে এক একটা রাজনৈতিক ঘটনায় বন্দী হয়ে কয়েক মাস বা বছর পরে বাড়ি ফেরার পর। মামা বলতেন, জেলে বসে যা যা করে সময় কাটাতেন, বাড়ি ফিরে কিছুদিন সেইটা না চালু রাখলে, জামাইবাবুর ওকালতির পসার ফিরে জমাতে মন বসত না। মানে, যে যেমন নিজের অ্যাঙ্গল থেকে ব্যাখ্যা করতেন। আমার জীবনের প্রথম সতেরো বছর বয়স কালে (এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি) বাবা বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন, তাই আমিও তার কয়েকটি বাতিকের সাক্ষী। একবার বাবা খৈনী খেতে শুরু করলেন নিয়মিত। একবার শুরু করলেন হোমিওপ্যাথির পড়াশুনা আর চিকিৎসা। একবার প্রতি ছুটির দিনে সিনেমা হলে গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখা শুরু করলেন। মা কিছুতেই এই সবে সঙ্গ দিতেন না তাঁকে। একবার সকাল সকাল কোলে হার্মোনিয়াম টেনে তারস্বরে ধ্রুপদী গান। আর একবার লম্বা ডাইনিং টেবিল বানিয়ে তাতে আট ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে খাওয়া দাওয়া করবেন, রাজনীতি, জেল আর ওকালতির ব্যাস্ততার ফাঁকে পারিবারিক পরিমন্ডলে খানিক সময় কাটাবার বাসনা।

যেবার, খৈনী খেতে লাগলেন। একবার স্নান করতে করতে হুড়মুড়িয়ে বালতির ওপর পড়ে গেলেন। খৈনী বাদ হয়ে গেলো। যেবার হোমিও শুরু করলেন, বাড়িতে মেথর জমাদার, নানা বাড়ির কাজের লোক, নিজের মক্কেল থেকে শুরু করে সকাল-বিকাল এত লোকের ভীড় শুরু হয়ে গেলো, ওকালতি মাথায়, রাজনীতিও প্রায় ঘর ছাড়া। বন্ধ হয়ে গেলো হোমিও-দান। মাস দুই তিনেক হিন্দি সিনেমা দেখার পর, নিজেই নিজেকে ফতোয়া দিলেন, শুধু প্রেম করে এই সমাজের কিছু হবে না। সমাজ না-গড়ার কাজে ঐ সব গাল-গল্প, গান বিষ মাত্র।

যেবার গান শুরু করলেন, আমরা ভাই বোনেরাই বলাবলি শুরু করলাম, বাবা কী করছেন বলত? গলায় সুর নেই এক ফোঁটা, আকাশ পাতাল চিৎকার করলেই কি ক্লাসিক্যাল গান হয়? আমরা বলাবলি করি, কিন্তু বাবার গান-সাধা চলতেই থাকে। একদিন বোনের তবলা টিচার বাবার গানের সঙ্গে মাথা হেলিয়ে তবলায় কয়েকটা চাটি মেরে বাবাকে দ্বিগুণ উৎসাহিত করে তুললেন। মেজদা বলল, কী করা যায় বলত? বুদ্ধি আসে না। একদিন দেখি, মেজদা বাবাকে খুব বকছে, এই সব ভাল্লাগে? আমার বন্ধুর দাদা, আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'আচ্ছা বলত পিন্টু, তোদের বাড়ির ওদিকে কোন শালা সকাল বেলা ফাটা গলায় চিৎকার করে গান গায় রে? সকাল বেলায় দূরে বসে শুনলেও বিরক্ত লাগে.. তুই চিনিস? আমি কী করব, বলতেই হল, আমি তো কানে কম শুনি, শুনতে পাই নি তো! বাবা গান গাওয়া ছেড়ে দিলেন।

বাড়ির একটা লম্বাটে ঘর খালি করা হল। কয়েকদিন ধরে খসড় খসড় করে একটা লম্বা ডাইনিং টেবিল তৈরি করা হল। অত বড় টেবিল দরজা দিয়ে ঢুকবে না, তাই ঘরের ভেতর বানানো হল। দুপাশে ছাড়া ছাড়া ভাবে দশটা চেয়ার। আমরা আট ভাই-বোন আর বাবা-মা। টেবিলের ওপরে লম্বা রবার ক্লথ। নীল রঙের। ঝকঝকে কাপডিস, ডাইনিং প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট, গ্লাস.. কাঁচের আর চীনামাটির। দেয়ালে একটা ঘন্টাও লাগানো হল। তার দড়িটা ঝুলছে। ঘড়ি ধরে মা সবাইকে খেতে আসতে ডাকবেন, দেরি করা চলবে না। আমাদের জন্য যে নিয়ম, বাবার জন্যও তা। ছুটির দিনের লাঞ্চ দিয়ে শুরু হল। দারুণ অভিজ্ঞতা! সিনেমায় দেখেছি, রাজার বাড়িতে দেখেছি। টেবিলে বসে খাওয়া সেই প্রথম। ডিনারেও সমান উত্তেজনা। পরদিন সকাল থেকেই আমি জেগে। মা কখন ঘন্টা বাজাবেন। একসময় বাজল। সেদিন লুচি আর আলুর দম, মনে আছে। মেজদা রোগা পটকা, তাই তার প্লেটে একটা বাড়তি ধবধবে ফর্সা ডিম। ব্রেকফাস্ট শেষ। সবাইকে অবাক করে মা একটা বড় নতুন চায়ের কেটলি আনলেন এবার। কেটলির গলা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মা কেটলিটা টেবিলে রাখলেন। বাবার নির্দেশে আমরা যে যার কাপ উল্টে দিলাম। বাবা মাকে এবার চা দিতে বললেন। কিন্তু মা টেবিল থেকে কেটলি তুলতেই রবারের গোটা টেবিল ক্লথটাই কেটলির সঙ্গে উড়ান দিলো! কাপ ডিস প্লেট সব চারপাশে ছত্রাখান। বাবা উঠে চলে গেলেন তার কাছারি ঘরে। সেই ডাইনিং টেবিল এবার কেটে কেটে আমাদের পড়ার টেবিল তৈরি হল। আমরা ফিরে গেলাম আসন পেতে খাওয়া দাওয়ায়।

** বাবার বিষয়ে জানা যায় Wiki-তে, এখানে :http://en.wikipedia.org/wiki/Barada_Bhushan_Chakraborty


1. // ধলেশ্বরীর বরদাভূষণ //

চারাবাড়ির বিন্যাফৈর গ্রামে আমাদের দেশের বাড়ি। টাঙ্গাইল শহর থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে, সে সময়ের ধলেশ্বরী নদীর তীরে। আমি গ্রামের বাড়ির শেষ রমরমা দেখেছি ১৯৫২-৫৩ সালে। বাড়িতে ঠাকুমা ছিলেন, ছোটকাকা, কাকিমা। আমরা থাকতাম দিনাজপুরে, মা প্রতি বছর ঠাকুমার কাছে নিয়ে যেতেন, শীতে। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল মস্ত একটা পুকুর। সেখানেই চলত বাড়ির কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া, চান করা। আমাদের বাড়িতে টিনের চালার মন্দির ছিল। তাতে কষ্ঠিপাথরের কালী মূর্তি ছিল। শুনেছি, আমার ঠাকুর্দা কোন এক বিধবার বাড়ি থেকে মূর্তিটি কাঁধে নিয়ে ছুটে বাড়িতে এসে বেদী পেতে দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। থানা পুলিশেও কিছু হয় নি। আমি ঠাকুর্দাকে দেখিনি। দাদুর কথায়, দেবী তাঁকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন। জাগ্রত এই কালীকে গ্রামের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানতেন। 

ঠাকুরদাকে সবাই ‘পাগলা ঠাকুর’ বলে ডাকতেন। বরদেশ্বরী চুরির কারণ ছিল। দাদুর কোন সন্তান বাঁচত না। কালি প্রতিষ্ঠার পরে, আমার দুই পিসিমা, এবং পরে ঠাকুমার অষ্টম গর্ভে আমার বাবার জন্ম (১৯০১)। তাই নাম বরদাভূষণ।

ঠাকুমার কাছে শুনেছি, সেই সময় গ্রামে শেয়াল আর বুনো শূয়োরের খুব অত্যাচার ছিল (এটা আমিও দেখেছি)। আতুর ঘরের পাটকাঠির বেড়া ভেঙে এই সব শয়তান জন্তুজানোয়াররা সদ্যজাতদের মুখে নিয়ে পালাত, খুবলে খুবলে খাওয়ার চেষ্টা করত। ঠাকুমার ভয় ছিল না। বাবাকে বরদেশ্বরীর সামনে কলাপাতায় শুইয়ে পুকুরে ঘরের কাজ করতে চলে যেতেন। বলতেন, মা বরদেশ্বরী রক্ষা করবেন।

বাবা ছোটবেলাতেই দিনাজপুরে চলে যান দাদুর সঙ্গে। সেই সময়ে ঠাকুর্দা দিনাজপুর শহরের বালুবাড়িতে এক জমিদারের সেরেস্তায় নায়েব ছিলেন। বাবা একাডেমী স্কুলে পড়তেন। স্কুলে থাকতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেটা সমাজের ন্যায় অন্যায়ের এক্কাদোক্কায়। তার বেশী নয়। এখানেই পাবনার নদীপাড়ের এক গ্রামের ব্রাক্ষ্মণ কন্যা, আশালতার সঙ্গে বাবার বিয়ে হয়। বাবা তখন দিনাজপুর কোর্টে উকিল। ঘোর কালী তপস্বী।

আমাদের মা’র সমবয়সী ছিলেন আমাদের ছোটকাকা (কুলদা) এবং তার খুড়তুতো ভাই, সত্যপ্রিয়। মার এই দুই দেবর ছিলেন বিপ্লবী দল, অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য। মাকে তাঁরা সহজেই প্রভাবিত করলেন, এবং মা’ও বিপ্লবী দলে যোগ দিলেন। বাবা 

এসবের কিছুই জানতেন না। কালী প্রণাম করে কোর্টে যান, বাড়ি ফিরে কালী প্রণাম করেন।

বাবাকে দলে টানার জন্য দুই ভাই আর বউ বাড়ির এখানে সেখানে নানা প্রচার পুস্তিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতেন। বাবা পড়তেন, কিন্তু কিছু প্রকাশ করতেন না। মৌণং সম্মতি মেনে দেবররা ও বৌদি তিনজন দলের অন্যন্যদের সঙ্গে দুঃসাহসিক কাজ করে বসলেন। বিখ্যাত হিলি মেইল ডাকাতির ছক কষে ফেললেন। ডাকাতি হল, স্টেশনের এক চৌকিদার গুলিবিদ্ধ হল। কিন্ত ডেরায় ফেরার পথে ধরা পড়লেন অনেকে। ছোটকাকা পালিয়ে গেলেন মুঙ্গেরে সাধুর ছদ্মবেশে। বিচার হবার সময়ই মারা গেলেন চৌকিদার। ফাঁসির আদেশ হল সত্যব্রত কাকার এবং আরো কয়েকজনের। মা’র হল জেল। এই সময় বাবাকেও গ্রেফতার করা হল। ডাকাতির ষড়যন্ত্র করার অপরাধে। আপীলে ফাঁসির হুকুম মকুব হলেও, আন্দামানে নির্বাসন দেয়া হল ফাঁসির আসামীদের।

বাবার হল সাত বছরের জেল। মেধাবী বরদাভূষণ জেলে বসেই সংস্কৃত সাহিত্যে দু দুটি উপাধী অর্জন করলেন—রাষ্ট্রভাষাবিশারদ এবং কাব্যতীর্থ—খ্যাত হলেন ‘পন্ডিত হিসেবে। তবে এর ফলে তিনি ত্যাগ করলেন তাঁর ধর্মাচার। বললেন, ধর্ম ইতিহাস বই কিছু নয়। হয়ে উঠলেন কট্টর কম্যুনিস্ট। নেতৃত্ব দিলেন তেভাগা আন্দোলনে। সঙ্গে মা।
এরপর দেশভাগ। বাবা দেশত্যাগ করলেন না। টাঙ্গাইলে ছোটভাই কুলদা তখন মোক্তার। আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব প্রায় সবাই পাড়ি দিলেন সীমান্তের ওপারে। এই দুই ভাই যাবেন না। ছোট দিদি (আমাদের ছোট পিসিমা) বললেন, থাক, ওদের যা মন চায় তাই করতে দে। অনেক সয়েছে। থাকুক। বাবা কলকাতায় পড়তে থাকা আমাদের বড়দাকে (সমর) ডাকিয়ে এনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু এতেও নতুন পাকিস্তানী সরকার, সোহরাবর্দীর হোক বা নাজিমুদ্দিনের কিংবা আইয়ূব বা ইস্কান্দার বা ভুট্টো, কারো চোখেই বাবা দেশভক্ত তা প্রমাণিত হয় না। প্রমাণের অভাবে দন্ডিত হতে থাকেন। তাঁকে বারাবার জেলে পাঠিয়েছে সবাই। তবে নতজানু করতে পারে নি কেউ। বাবা রাজনীতিও ছাড়েন নি। কৃষক সমাজের জম্য কাজ করতে থাকেন। এই সময়েই মৌলানা ভাসানীর সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা, ন্যাপ ভাসানীর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩ দিন দিনাজপুর শহরকে পাক সেনামুক্ত রাখতে কম্যান্ড সামলেছেন। ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে। স্বাধীন হতেই আবার ফিরে গেছেন দিনজপুরের বাড়িতে। সেখানে একটি টেবিল আর একটি ইজি চেয়ার ছাড়া লুঠেরারা অবশিষ্ট রাখে নি আর কিছুই। এই সময়, ৭৪ বছর বয়স তাঁর। আক্রান্ত হলেন ক্যান্সারে। মুজিবর রহমান তখন স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতায়। বাবার চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করলেন মুজিব। সিদ্ধান্ত-- অপারেশন একমাত্র চিকিৎসা। সুপারিশ-- ভারতে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হোক। বাবা রাজি নন। ভারতে যাবেন না। তাঁর তিন চিকিৎসক সন্তান তাঁদের বন্ধু বান্ধবদের নিয়েও বাবাকে রাজি করাতে পারলেন না। শেষটায় চিকিৎসক সন্তানেরা মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত বিধস্ত প্রায় বিকল মনা পিতাকে বলা হল--’তোমাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে’। বাবা রাজি।

সকালের ফ্লাইটে বাবা এলেন কলকাতা বিমান বন্দরে। কলকাতার এয়ারপোর্টে আমাকে দেখে তাঁর মৃতপ্রায় শরীরটা যেন বিদ্যুৎপৃষ্ঠে কঁকিয়ে ওঠে। তিনি হতবাক। অপমানিত।

সেই যাত্রাতেই মারা গেলেন (১৯৭৪)। কিন্তু নিজভূমে নয়।

যেটা আমার মত নাস্তিককে বিমূঢ় করে রেখেছে আজও, তা মা বরদেশ্বরীর অন্তর্ধান। বাবা যেদিন কলকাতায় নামলেন, সেই রাত থেকেই বরদেশ্বরী তাঁর প্রায় দেড়শ বছরের আসন ত্যাগ করে উধাও হয়ে গেছেন। আমি বলি, বরদেশ্বরী চুরি হয়ে গেছেন। ছোট কাকা মানেন না, বলেন, 'মন্দিরে না ছিল তালা, না শক্তপোক্ত দরজা। বহু বছর ধরেই। বরদেশ্বরী আমাদের পরিবারকে ত্যাগ করেছেন।' বরদেশ্বরীকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আজো না।

আমি বাবার চিতা থেকে তার অদাহ্য নাভিমূল চুরি করে, রেকটিফায়েড স্পিরিটে তা চুবিয়ে কাঁচের পাত্রে বন্দী করে বরদেশ্বরীর শুন্য বেদীর পাশে প্রোথিত করে রেখেছি। আজো তা বিন্যাফৈর গ্রামে শূণ্য বেদীর মন্দিরে বর্তমান।

** ** বাবার বিষয়ে জানা যায় Wiki-তে, এখানে : http://en.wikipedia.org/wiki/Barada_Bhushan_Chakraborty
-----------------------