১৯৬২ সাল। বয়স সতেরো। তিন-চার মাস হল কলকাতায়, প্রথম। এসেই শিয়ালদায় তিনতলার
সাত বাই ছয় সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে রাত-দিন। এক সকালে চোখ মেলে চিলতে জানালাটার কাছে
দাঁড়াতেই, দেখি, নিচে বাঁশ জড় করা হচ্ছে। পুজোর প্রস্তুতি। তখন কাইজার স্ট্রিটের
কোয়ার্টারের মাঝখানে ছিল মাঠ। ফুটবল পায়ে দৌড়াদৌড়ি চলত। সেখানে পুজো। সঙ্গে সঙ্গে আমার
মাথায় ধবধবে শাদা পেঁজা মেঘ ধুপের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এখনো মনে আছে সেই
ক্ষণটাকে। মেঘের মসলিন সরিয়ে সরিয়ে ফেলে আসা পাড়ার পুজো ফুটে উঠতে থাকে ।
উত্তরবঙ্গের পুজো আসে আকাশে, রদ্দুরের মিষ্টি ওমে। কাশ ফুলে না। কাশফুল আমি
দেখিনি। গ্রামে থাকিনি বলেই হয়ত।
জানালা গলে ওপরে তাকিয়ে দেখি, অন্য আকাশ। স্কয়্যার ফুটে মাপা যায়। মনটা বিষন্ন
হয়ে গেল। দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ছোট বোন দুটোর জন্য, দাদাদের জন্য। মা’র জন্য। পাড়ার
দুর্গা ঠাকুরের জন্য। আমি কেঁদেই ফেললাম।
আমাদের দুর্গা ছিল আমাদের মার মতো। দুপাশের ছড়ানো হাতে আমাদের মা’কে দেখাত
জটায়ূর পাখির মতো। বিশাল। আমাদের আট ভাই-বোনকে
দশ হাতে সাপটে আগলে রাখতেন। বাবা তো রাজনীতিতে অনমনীয় থেকে শহরের
জেলখানাটাকেই বাড়ি বানিয়েছিলেন।
মা
এই একটি আকুতি ছাড়া, আমার আর কোন দুঃখ ছিল না। কলকাতার পুজোয় পকেটে পয়সা থাকা
দরকার, এইটে ওই তিন মাসে অনুমান করতে পারিনি। আকাশ বাতাস আর রদ্দুর নিয়েই খুশি
আমি। হেঁটে শিয়ালদায় যাই। ফ্লাইওভার এসেছে অনেক পরে। বৈঠকখানা বাজারের গলির মুখে
পুজো, আর শিয়ালদা জুড়ে নতুন কেনাকাটার
হুল্লোড়। ওই সময়ে মির্জাপুরের মুখ থেকে প্রাচী সিনেমা অবধি দোকানগুলোর ব্যস্ততা
দেখেই উত্তমকুমারের কলকাতাকে খুঁজে পেতাম। মরিস- অস্টিনকে তখনো এমবাসাডর বাজার
ছাড়া করেনি। দোতলা বাস, জবুথুবু ট্রাম, আর স্টেটবাস, প্রাইভেট এসেছে ৬৭-৬৮ নাগাদ,
এই সব দেখেই আমি কলকাতার বিস্ময়ে আবিষ্ট ও কলকাতায় আসার গর্বে বুক টান। বুঝে
ফেললাম, বদলে-যাওয়া পূজাতেই লুকিয়ে আছে আনন্দ, ভালোলাগা না-থাকলেও।
পুজো এসেই গেল। মহালয়া কী, আমরা জানতাম না। কিন্তু এখানে মহালয়ার ভোরে জেগে
উঠল সারা পাড়া। ছোটদের চিৎকারে পাখিদের কলখল বোঝাই গেল না। আমি জানালা দিয়েই দেখতে
থাকি কলকাতার পুজো। এতো আগে শুরু হয়?
ষষ্ঠী আসতেই জল ঢালতে থাকে কেউ আমার খুশিতে। আমার কান্না পেতে থাকে। কেঁদেও
ফেলি। ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লজ্জা কী? চোখের জল শুকোতে না শুকোতেই সপ্তমীর
সকালে বেজে উঠল ঢাক। ঘরে থাকা দায়। প্যান্ডেলেও। স্টেটসম্যানটা নিয়ে খবর খুঁজতে
থাকি।
এমন সময় প্যান্ডেলের মাইকে বেজে উঠল পুজোর গান। শ্যামলের। আগে শুনিনি। বাষট্টির
পুজোর গানঃ ‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে... মনহরিণি করুণ তার তান তুলেছে,
এমন দিনে তুমি মোর কাছে নাই, হায়। স্মৃতিরা যেন জোনাকীরই ঝিকিমিকি
ঝিকিমিকি... আপন নীড়ে ফিরে গেছে পাখি, নীড়
হারায়ে আমি পথে থাকি...
এমন একটি করুণ আবহে এমন স্ফূর্তির উৎসার কিশোর আমাকে অন্য দিশা দিয়ে বসল। আমি
কোয়ার্টারের উল্টো ফুটে সার্কুলার রোডের আমজাদিয়ার চিলতে রকে গিয়ে বসে পড়ি। সারা
কলকাতা তখন পুজোর উথাল স্রোতে ঘূর্ণি তুলেছে। দেখতে থাকি। বুঝতে থাকি এখন থেকে এই
পূজাতেই খুঁজে নিতে হবে আনন্দ, ভালোলাগা না-থাকলেও।
No comments:
Post a Comment