My Readers

Monday, October 22, 2012

আমি নীললোহিত তুমি সুনীল






আমেরিকার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন সেবার আন্টাল্যান্টিক সিটিতে।  প্রকাশক লেখক ছাড়াও মিডিয়া আর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডার লোভে সেখানে যাওয়া। সুনীলদা এসেছেন আগেই শুনেছি। শুনেছি শীর্ষেন্দুদাও আছেন, সমরেশ মজুমদার, পুরানো বন্ধু পঙ্কজ সাহা এবং নবকুমার বসু (ওর দাদা আমার বন্ধু)। প্রকাশকদের (প্রবীর মজুমদার, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, অপু দে প্রমুখ) সঙ্গে আড্ডা সেরে বেরুতেই, এক সার দোকানের গলির  সামনে এক মহিলা পথ আগলে ধরলেন, এখনো সুন্দরী, বেঁটে খাটো, স্নেহশীলা চোখে প্রশ্রয়। ‘তুমি অরুণ না? চিনতে পারছ?’ পাশে দীপ্তি, আমার স্ত্রী। তার সতর্ক চিমটি খাবার আগেই, আমার চোখে থতমত ভাব দেখে বললেন, ‘আমি সুনীলের স্ত্রী।’ তখন মাটিতে মিশে যাই আর কী! দুহাতে জড়িয়ে ধরি স্বাতী বৌদিকে, ক্ষমা চাইতেই হল। বেশ কয়েকবার।

এই অনুষঙ্গটা উল্লেখ করার কারণ, সুনীলদার সঙ্গে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে পরিচয় সত্ত্বেও, সুনীলদার বাড়িতে বারকয়েক গেলেও, আমি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘণিষ্ঠ বৃত্তের মানুষ নই, সেটা বোঝাতে। নইলে, স্বাতী বৌদির মুখটা কেউ ভুলতে পারে, বিশেষ করে যার ঔদার্য-প্রশ্রয় আমার মতো এক কণিষ্ঠকে নানা উৎকট মুহূর্তে তরী পার করেছে?

সুনীলদার সঙ্গে দেখা বা পরিচয় ঠিক কবে মনে নেই। আনন্দবাজারে আমার চাকরি, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় থেকে, তখন আমার বয়স ২৬। শক্তিদা (চট্টোপাধ্যায়) আনন্দমেলা পাতার দায়িত্বে ছিলেন, তাই একটা যোগাযোগ ছিল। সুনীলদার সঙ্গে তেমনটা ছিল না।

সুনীলদার সঙ্গে আত্মিক পরিচয় অবশ্য অনেক আগে থেকে। আমি তখন কলেজের ছাত্র। ‘নীললোহিত’-এর পাঠক। বিস্ময়, আমার এক নিবিঢ় অস্তিত্ব থেকে নীললোহিত আমাকে আজও ছেড়ে যায়নি। আমার  ভাবনা চিন্তা চলন বলনে নীললোহিত তার পূর্ণ অবয়বে আজও বিরাজ করছে।
কী ছিল নীললোহিত তথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই সব লেখায়? সেসব তো বাস্তবের ধরতাইয়ে এক একটি গল্প মাত্র। তবু তার রেশ এই প্রায়-বৃদ্ধ বয়সেও আমার মধ্যে সমান কাজ করে চলেছে। কী করে? বলতে পারব না, যদিও হাতের কাছে নেই নীললোহিত সমগ্র, আমিও দাঁড়িয়ে আছি নীললোহিতের সোনালী দিনগুলি থেকে ৫০ বছর দূরে।

আমি ১৭ বছর বয়সে বাড়ি পালানো ছেলে। এই বয়সের বাড়ি পালানোয় অবশ্যই নিছক রোম্যান্টিকতা ছাড়া আর কিছু ছিল না। উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল শহরের কলকাতা না-দেখা কিশোরের কাছে সেই ১৯৬২ খুব সুখকর ছিল না। মাত্র ১৫ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়া কলকাতায় তখন জীবন সংগ্রাম নিরন্তর। একদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তুহারা বাঙালিরা বাংশাল কোর্টে, শিয়ালদা কোর্টে কলম পিষছেন, বড়বাজারে মালিকের রক্তচক্ষুর সামনে নতজানু, সিনেমা হলের গেটকীপার, নয়ত দেশবন্ধু পার্ক, দেশপ্রিয় পার্কের ২৪ ঘন্টার বেড়ানি কিংবা চুরি করে ভিক্ষে করে সেই সময়ের হিন্দুস্তানের নিরাপদতম ফুটপাথে শায়িত। অন্যদিকে স্বাধীন কলকাতার বৃহত্তর বৃত্তের হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর থেকে নতুন স্বাচ্ছন্দ জীবনের ভিত স্থাপনে মরিয়া ঈষৎ অর্থবান সমাজের ভিন্ন মাত্রার সংগ্রাম। কৈশোর সংগ্রাম চেনে না, স্বপ্ন চেনে। তাই কলকাতার পথে পথে আমার চোখ দুটো সংগ্রাম দেখতে পেত না, খুঁজে পেত স্বপ্ন, কোন একদিন জিতে যাবার স্বপ্ন।

নীললোহিতের আবির্ভাব এই সময়েকয়েক বছর পরে। , জীবন সংগ্রামের স্রোতের  ওই বয়সে সাহিত্যের হদিশথাকার কথা নয়ছিলও না। কে যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন ‘টাইমস’ পত্রিকার। নতুন ইস্যু কেনার পয়সা ছিল না। পুরানোই পড়তাম, নইলে এসপ্ল্যানেডের ইউসিস (USIS) লাইব্রেরিতে। আর এভাবেই বাড়ি পালানো কৈশোরের পৃথিবী ভ্রমণ সম্পূর্ণ হত। বিশ্ব জুড়ে মানুষের বাস্তব গল্প পড়া হয়ে যেত, যৌবনের উদ্ভট জীবনযাত্রার হদিশ পাওয়া যেত।আএই সময়টায় মনের গভীরে চারপাশের এমন পৃথিবীই চোখের সামনে ফুটে উঠত। নীললোহিতের আবির্ভাব এমনই নিস্তরঙ্গ ভিতর আর টালমাটাল বাহিরের পরিমন্ডলে। আ পারফেক্ট টাইমিং।

সে-সময় বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের বড় মাঠ তোলপাড় করে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক একজন দিকপাল। তাঁদের সৃষ্টিতে ছেয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার রক্তাক্ত গর্ভযন্ত্রণা ও ছিন্নমূলের জীবন সংগ্রাম, সেইসব ক্লাসিকগুলোকে সম্যক উপলব্ধি করার জন্য আমরা কিশোর তরুণ যুবাদল সেই সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সুনীল হইচই ফেলে দিলেন পাড়ার ছোট্ট মাঠটিতে। কবিদলের এক গল্পকার! আমেরিকার বোহেমিয়নতা আর বাংলার রক্ষণশীলতার এক নতুন রসায়নের টানে দর্শকরা বড় মাঠ ফেলে ছুটে গেলেন ছোট এই মাঠটির দিকে। কোন যাদুবলে এই কান্ড সম্ভব হল, সেটা আপাত বিস্ময়ের মনে হলেও, আমার কাছে কোন অঘটন ছিল না।

নীললোহিত তথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁর জীবন ও লেখালেখিকে নানা অর্থে ব্যখ্যা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের পাঁচমাথার মোড়ের এই লেখক এখন, ৫০ বছরের ব্যবধানে, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর লেখার চুলচেড়া বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শুধু আজ নয়, আগামী বহু বছর ধরে সুনীল চর্চিত হবেন, আমার ক্ষুদ্র অনুভবে এমনটা মনেও হয়।

আনন্দবাজারে নীললোহিতের সাড়া জাগানো কলামের পর আমার পড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বই, ‘যুবক যুবতীরা’। বইটি কেন কিনেছিলাম,সম্ভবত তার ইঙ্গিত আছে ওই শিরোনামেই। তবে কলেজ জীবনের শুরুতে পড়া এই বইয়ে আমার একটা খোঁজও ছিল বলে মনে হয়। সেই খোঁজ ছিল নিজেকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোয় গড়ে তোলার কোন উপায়ের খোঁজ। এই উপন্যাসে তা মোটেই পাওয়া গেল না। উল্টে যা পেলাম, তা সংগ্রামবিমুখ এক ফুরফুরে জীবন-যাপনের দিশা। যেখানে  উদাসীন মনে স্ফূর্তিই জীবন-যাপনের সোনার কাঠি। বাঙালির হিপি সংস্কৃতি বলে যদি থাকে, তাই ফুটে উঠতে থাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই সময়ের লেখাগুলোতে, যার পূর্ণ প্রকাশ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’-র পাতায়। বাড়ি পালানো বল্গাহীন একটি যুবকের প্রথম জীবনে এর চেয়ে পরম আকর্ষণীয় আর কী থাকতে পারে?

আমি তাই বারবার ফিরে যেতে থাকি একটি ললোহিতের যাদুর দুনিয়ায়। সেটা আনন্দবাজারের পাতার মধ্যে এমন  না। নীললোহিতকে পড়তে পড়তে মনের অতল অবচেতনায় যে গভীর জীবনবোধের নির্যাস চুইয়ে চুইয়ে জমা হতে থাকে, তা পান করতে করতে।

আমি যৎকিঞ্চিৎ যতটুকু সততা নিজের মধ্যে প্রোথিত করতে পেরেছি, তা আমার প্রাক-যৌবনের আত্মসচেতন সেন্সিসিটিভ মানুষ নীললোহিতের কাছ থেকে। আমার দিগভ্রষ্ট সময়ে জীবন-চেতনা এই নিরাবয়ব যুবকের জীবন-চেতনার অনুসরণেই নিজেকে সাজিয়েছে। আজ ‘আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও’ উচ্চারিত হলেই যদিও সম্মানের ঢলে ঢেকে যাচ্ছে যুবাদলের মুখ, মনে রাখতে হবে,  ৫০ বছর আগে নিজেই নিজের মতো করে আপন শরীরে নীল রক্ত ছড়িয়ে নীললোহিত রাজা হয়ে বসেছিলেন নতুন এক সমাজের কিশোর তরুণদের সাম্রাজ্যে।

পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার কাছে সুনীলদা হয়ে উঠেছেন বটে। কোন সূত্রে, ঠিক কীভাবে, মনে পড়ছে না। তবে নানা করণে দিল্লি আসার পর সুনীলদার সঙ্গে যোগাযোগটা বেড়েছিল। তিনটি কারণে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের কর্মসূত্রে, আমাদের দিল্লির পত্রিকা, প্রাংশুর সূত্রে এবং সবচেয়ে বেশি, মিহিরদার কারণে। দিল্লির প্রাচীনতম দিল্লি কলেজের বাংলার অধ্যাপক মিহিরদার সঙ্গে সুনীলদার সঃম্পর্ক ছিল ভক্ত আর ভগবানের। ষাটের দশকের ফুটপাথ বদলের সময় থেকেই। মিহিরদা তখন কলেজ স্ট্রিটের যুবক।

তাই মনে পড়ে সুনীলদার সঙ্গে ৪০-৪৫ বছরে অনেক অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ আড্ডার কথা (একান্তে নয় একবারও)।  মিহিরদার বাড়িতে, দিল্লির আইআইসি-তে। সবসময়েই সবখানেই, সব পরিবেশে লক্ষ করেছি, সুনীলদা নীললোহিতের মতই স্পষ্টবাদী, সৎ, এবং আপনতায় ভরপুর। কলকাতার এক নম্বর সেক্সপীয়ার সরনীর বহুতলে, ম্যান্ডাভিল গার্ডেন্সের নয় তলায়, বই মেলায়, দিল্লির সাহিত্য একাডেমীতে, প্রাংশুর দফতরে, বিদেশের বুল্গারিয়ায় বা আমেরিকায়... সবখানেই সুনীলদা থেকেছেন নীললোহিত হয়ে। নিজের বিশ্বাসে অটুট, নিজের ভাবনা চিন্তায় ফুরফুরে। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে খুশি করতে বা প্রভাবিত করতে তার একটি কথাও না, একটি শব্দও নয় ।

এজন্যই সুনীলদাকে কোনদিন আত্মার আত্মীয় ভাবতে পারিনি আমি। আমার বাইরে, তিনি যেন আমারই আর একটি অস্তিত্ব, কিন্তু আমি না। এজন্যই আমার কোন কাজেই সুনীলদাকে আমি জড়াই নি, জড়াইও নি। একবার নিয়মভঙ্গ করতে সুনীলদাকে এনবিটির বাংলা ভাষার উপদেষ্টা করেছিলাম। তিনি আমাকে উপদেষ্টার উপদেষ্টা করে ছেড়েছিলেন।  অফিসের বাইরেও কোন কিছুতেই তিনি আলাদা করে আমাকে উৎসাহ দেন নি, পরামর্শ দেন নি, সেসবের প্রস্তুতিতে অংশও নেন নি। এখনো কানে বাজে -- ‘তোমরা যা করছ, বেশ করছ। আমাকে ডেকো না। আমি পারব না।‘

এভাবে কোন সাকসেসফুল মানুষকে আমি সমাজে চলতে দেখিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলেন, চলে এসেছেন এবং চলছেন। আর এজন্যেই আমার সময়ে এবং আমার জীবনে সুনীলদা একজন স্বচ্ছতম মানুষ। যার ফলে অজান্তেই আমার কাছে তিনি এক অনুকরণীয় এক চরিত্র হয়ে উঠেছেন।

-----------------------

Tuesday, October 16, 2012

শ্রীশ্রীদুর্গা নিজজাতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন

শ্রীশ্রী দুর্গার প্রতিমা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এ কোন দেবী? কালী তারা প্রভৃতি দশমহাবিদ্যার ইনি তো কেউ নন। দশমহাবিদ্যার মূর্তি দেখে মনে হয়, এঁরা মাতৃযুগের দেবতা। কেউ পুরুষদের দেহের উপর দাঁড়িয়ে পিতৃযুগের পুরুষদের পেলেই ঘায়েল করছেন, জিহ্বা ছেদন করে পিতৃশত্রুদের স্তুতি বন্ধ করছেন—আরও নানাভাবে পুরুষদের উপরে নীপিড়ন, নির্যাতন করছেন। নির্বিচারে হত্যা করছেন। মহাবিদ্যার চন্ডীর যত আক্রোশ পুরুষদের উপর। এক হাতে খড়্গ অন্য হাতে গদা ঘুরিয়ে পিতৃগণকে বধ করেন, মুন্ডমালা গলায় পরে মুঠিতে মুন্ড ঝুলিয়ে তাথৈ তাথৈ নৃত্য করেন, পুরুষের খন্ডিত হাত পা গেঁথে নগ্ন দেহ ঢাকেন, শবের উপর উঠে বিজেতার গৌরবে আস্ফালন করেন, বিজিতে রক্তপান করে গোষ্ঠীর সন্তানদের কাছে শ্রদ্ধা ও পূজা আদায় করেন। এই সব বীর মাতাদের মধ্যে শ্রীশ্রী দুর্গার স্থান নেই।

অসমের কামাখ্যা থেকে শুরু করে কোয়েটার কাছে হিংরাজ পর্যন্ত ৫১ স্থানে পিতৃগণের সঙ্গে মাতৃগণের যে লড়াই হয়েছিল, তাতে মাতৃগণ শহীদ হয়েছিলেন। এই সব স্থানের শহিদ মিনারগুলিকে সেদিনকার লোকেরা পীঠস্থান বলেছিলেন। হৃতশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য মাতৃজাতি সন্তানরা পীঠস্থানে জমায়েত হতেন, পূজা দিতেন। পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে বর্তমান শাসকরা যেমন বিদ্রোহ দমন করেন, অতীত যুগে তেমনি পিতৃতন্ত্রের ধারক বাহকেরা প্রতি পীঠস্থানের কাছে একটি করে ভৈরব মন্দির বসিয়ে পাহারা বসিয়েছিলেন। এ কারণে মাতৃশক্তির পুনরুত্থান ভৈরবদের সদাজাগ্রত হুঁশিয়ারির ফলে সম্ভব হয়নি। ভৈরবগণ তাদের পিতৃতন্ত্রের চিহ্ন লিঙ্গপূজা করতে থাকেন নিজেদের গন্ডীর মধ্যে, ভৈরব মন্দিরে। উন্নততর প্রহরণ ত্রিশূলধারমহাদেব আজও জাগ্রত দেবতা। পিতৃযুগের শক্তির চিহ্ন পুংলিঙ্গ এইসব মন্দিরে স্থাপিত এখনও দেখা যায়। বিজিত মাতৃজাতির সন্তানেরা ভয়ে বিভয়ে ভৈরবকে নতুন দেবতাজ্ঞানে ফুল চন্দন বিল্বপত্র দিয়ে পূজা করতে শুরু করেন।  আজও অনেকে পীঠস্থানে দেবীপূজার পর ভৈরব মন্দিরে পূজা না করে এলে তীর্থযাত্রা সফল হয় না বলে বিশ্বাস করেন। এই ৫১ পীঠের কোন দেবী শ্রীশ্রী দুর্গা নন।

প্রাক দ্রাবিড় যুগের নরনারী মাতৃযুগের কৃষ্ণবর্ণের মানুষ। এরা পশুপক্ষীর নামে গোষ্ঠী গঠন করে জীবিকার যেমন সংগ্রাম করতেন, তেমনি বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতেন। আভিজাত্যের ক্রমবিকাশে কৃষ্ণকায় জাতি ‘অসুর’ এবং শ্বেতকায় জাতি ‘সুর’ বলে খ্যাতিলাভ করেন। ইংল্যান্ডের নাইটদের আর্মর দেখে যেমন বলা যেত এরা কোন দুর্গের যোদ্ধা, তেমনি সন্তানগণ কেউ কেউ সিংহ, কেউ সর্প, কেহ মহিষ প্রভৃতি চিহ্নে চিহ্নিত ছিলেন। শ্রীশ্রী দুর্গা যোদ্ধাবেশে সজ্জিতা, স্বভাবতঃ প্রশ্ন জাগে, ইনি মাতৃযুগের কোন সময়ের দেবী ছিলেন? শ্রীশ্রী দুর্গার গায়ের রং পিতৃজাতির নারীদের মত শ্বেতকায়া কেন?

মাতৃযুগে মাতৃজাতির প্রহরণ ছিল গদা ও খড়্গ। মহিষাসুরকে বধ করতে ভৈরবের হাতের ত্রিশূল শ্রীশ্রী দুর্গা পেলেন কোন সামাজিক প্রয়োজনে? নিজসন্তান মহিষাসুরকে ত্রিশূল দিয়ে বধ করলেন কেন? মাতৃজাতি ত্রিশূল ক্ষেপণের শিক্ষাই বা পেলেন কোন কারণে?

শ্রীশ্রী দুর্গা তবে কি জাতিদ্রোহ করেন, না পিতৃগণের ‘কোলাবোরেটর’ হয়েছিলেন? প্রাগৈতিহাসিক যুগেও কি তবে বিভীষণ বা ‘কুইসলিং’-দের আবির্ভাব হয়েছিল? সর্প ও সিংহ লাঞ্ছিত সন্তানের সাহায্যে তিনি কেন জাতিদ্রোহে মেতে উঠলেন?  সর্প, সিংহ ও মহিষাসুরদের ঐক্য ও সংহতি ধ্বংস করতে তিনি জাতি কলহে প্রবৃত্ত হলেন কেন? ষষ্ঠির দিন থেকে নবমীর দিন পর্যন্ত একই চত্বরে জড়পূজা থেকে শক্তিপূজার সমন্বয় হল কোন সামাজিক কারণে?

সপ্তমীর দিনে শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার অবশ্য একটি উপকরণ বেশ্যার মাটি। এই দিনে এই মাটি এত শুচি হল কেন? দেবীপক্ষ শুরু হয় অমাবস্যার দিন (মহালয়া) থেকে, মহালয়া নামটাই বা বেছে নেওয়া হল কেন? এই দিনে এটা পালন করে পিতৃতর্পন বা পিতৃপুরুষের নাম উচ্চারণ হয় কেন? বিসর্জনের দিন প্রতিমাকে উলটো করে ধরে বহন করা হয় কেন?

এতগুলো ‘কেন’-র উত্তর আমি এই নিবন্ধে সুধীজনের কাছে নিবেদন করব। পন্ডিতজনের সমালোচনা পেলে আমি কৃতজ্ঞ ও ধন্য হব।

আর্যদের, বর্ণহিন্দুদের পূর্বপুরুষদের মধ্য এশিয়া থেকে আগমনের পূর্বে সুদূর গ্রীক দেশের কাছাকাছি কোন এক শ্বেতকায় জাতি পুরুষদের আধিপত্যে সমাজ সংগঠন ও বিন্যাস করেছিলেনএঁদের মধ্যে স্ত্রী-স্বাধীনতা ছিল না। এঁদের গোষ্ঠীর প্রতীক চিহ্ন ছিল পুরুষের জননেন্দ্রিয়। গ্রীস দেশের কাছাকাছি ভূখন্ডে লিঙ্গপূজার নিদর্শন প্রত্নতাত্বিকেরা এখনও পেয়ে থাকেন। পিতৃতন্ত্রের এই সব গোষ্ঠী লিঙ্গপূজার মধ্যে সংহতি ও যুদ্ধোন্মদনার প্রেরণা পেতেন।

এই সময় আসমুদ্রহিমাচল ভূখন্ডে কৃষ্ণকায় জাতি মাতৃশক্তিকে ঘিরে সমাজ গঠন ও বিন্যাস করেছিলেন। মায়ের কাছ থেকে তাঁরা ঐক্য সংহতি ও যুদ্ধোন্মদনা পেতেন। পুরুষেরা এত দুর্বল ছিল যে মা শত্রু বধ করতেন, সন্তান নয়। পুরুষের সবকিছু মায়ের কাছ থেকে প্রার্থনা করে নিতে হবে--ধনং দেহি জ্ঞানং দেহি, বিদ্যাং দেহি, দ্বিষো জহি। হে মাতঃ, আমাদের ধন দাও, বিদ্যা দাও, শত্রু বধ কর। দ্রাবিড় যুগের পূর্বে এই জাতির অর্বাচীন সভ্যতা আসমুদ্র হিমাচল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সবিশেষভাবে অসমের কামাখ্যা থেকে কোয়েটার হিংরাজ পর্যন্ত মাতৃজাতি স্বীয় শক্তিতে ও গৌরবে মাতৃতন্ত্রকে উজ্জীবিত রাখত।

এই সময়ে অর্থনৈতিক কারণে হোক, বা নিজনিজ দেশে লোকসংখ্যার বৃদ্ধিতে হোক বা আমাদের অজ্ঞাত কারণে তাদের জীবন জীবিকা বিকাশে বাধা পেয়েই হোক, পিতৃপুরুষ তুরস্ক ইরাক ইরাণ অতিক্রম করে উপনিবেশ স্থাপন করতে এই উপমহাদেশে পদার্পণ করেন। আদর্শে আদর্শে সংঘাত অনিবার্য। মাতৃগণ পিতৃতন্ত্রের বহিরাগতদের সহ্য করতে পারলেন না। যে সংখ্যায় পিতৃগণ এসেছিলেন মাতৃগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে নিজেদের অস্ত্র গদা ও খড়্গ দিয়ে তাদের হত্যা করতে থাকেন। পিতৃপুরুষের মুন্ডমালা গলায় পরে, মুঠিতে খন্ডিত মুন্ড ঝুলিয়ে, শত্রুর হাত পা ছিঁড়ে নিজ দেহের নগ্নতা ঢাকলেন। পুরুষদের শবের উপর তান্ডব নৃত্য করলেন। পিতৃপুরুষদের রক্তপান করে করাল জিহ্বা বের করে ভয়ংকর মূর্তিতে সন্তানদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও পূজা আদায় করলেন।

যুদ্ধে জেতে তাঁরা যাঁদের হাতে থাকে উন্নততর অস্ত্র এবং যোদ্ধা, স্বল্প হলেও পর্যাপ্ত। পিতৃগণ প্রথম পরাজয়ের পর পর্যাপ্ত সংখ্যায় তাঁদের উন্নততর অস্ত্র ত্রিশূল নিয়ে এবার মাতৃগণকে নির্মূল করতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন। গদা খড়্গ দিয়ে এই আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হল না। গদা ও খড়্গ হাতিয়ার, কিন্তু ত্রিশূল নিরাপদ দুরত্ব থেকে নিক্ষেপ করা সহজ। এই উপমহাদেশে, বিশেষতঃ পূর্ব সীমান্ত কামাখ্যা থেকে পশ্চিম সীমান্ত হিংরাজ পর্যন্ত, দুই তন্ত্রের যোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই বাঁধল। পিতৃগণের হাতে মাতৃগণ খন্ডবিখন্ড হলেন। ৫১ স্থানে মাতৃগণ পিতৃগণের হাতে পরাস্ত হলেন। এই সব যুদ্ধস্থল শহীদ মাতৃসন্তানদের ও মাতৃগণের পূণ্য স্মৃতি বহন করে ৫১ পীঠস্থানে তীর্থস্থানের মর্য্যাদা লাভ করল।

পিতৃগণের যুদ্ধ করবার সাংগঠনিক কৌশলও উন্নততর ছিল। যুদ্ধের আগে অমাবস্যার অন্ধকারে একটি সুবৃহৎ মন্ডপে পিতৃগণ সমবেত হতেন। এইখানে শহিদান পিতৃগণের নাম স্মরণ করে তাঁরা মরণপণের শপথ নিতেন। এই মন্ডপ ‘মহালয়’ বলে খ্যাতি লাভ করে। যে সব দেশ থেকে পিতৃগণ ভারতে প্রবেশ করেন, সেখানেও এই মহালয়ের অস্তিত্ব ছিলমহালয়ে পিতৃগণ মিলিত হয়ে পিতৃপুরুষের স্মৃতিচারণ করে তর্পন করতেন। পরবর্তীকালে পিতৃগণের পুরোহিতগণ এই মন্ডপকে ‘মহালয়া’ এবং শহিদানের স্মৃতিতর্পনকে পারিবারিক মৃতব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে তিল জলাঞ্জলি প্রদানের অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগে মহালয়ের সমাবেশে যোদ্ধারা আত্মত্যাগ ও তিতিক্ষার শপথ নেবার সময় পূর্বপুরুষের বীরত্বের গাথা বেঁধে গান করতেন, শহীদদের অমর স্মৃতি স্মরণ করে মাতৃবধে উদ্দীপ্ত হতেন।  

মহালয়া ভারতবর্ষের পিতৃগণের একচেটিয়া ইতিহ্য নয়। আরবের মুসলমানদের মসজিদ, ইহুদিদের যিহোবা মন্দির, এবং খৃষ্টানদের গীর্জা হত না ধর্মমন্ডপ যোদ্ধাগণের সম্মিলন স্থানআরবদেশের লোক, ইহুদী এবং খৃষ্টান ঐ আদিযুগে পিতৃতন্ত্রের সামিল ছিলেন। বিবর্তনের মধ্যে এঁদের বিশিষ্ট রূপ আপাতদৃষ্টিতে দেখা গেলেও সামাজিক সংগঠনে এঁদের মধ্যে পিতৃতন্ত্রের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। মেরীর উপাসনা খৃষ্টানগণ মাতা বলে করেন না, হযরত খ্রীষ্টের জননী বলে করেন। ভারতবর্ষের অনেক স্থানে মাতৃপূজা প্রচলিত তো আছেই, সামাজিক পরিবিন্যাসে হিন্দু ব্যতীত আরও অনেকে মাতার প্রভাব অস্বীকার করতে পারেন না। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার প্রারম্ভে অমাবস্যা তারিখে মহালয়ার ক্রিয়াকান্ডের তাৎপর্য বুঝতে সমর্থ হলেই পরবর্তী ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পূজা এবং বিজয়া দশমীর মধ্যে প্রাচীনকালের ইতিহাসের একটি বিরাট সমাহার দেখতে পারব।

মাতৃজাতি এক সময় পুরুষদের মুন্ডমালা ধারণ করেন, শবদেহ পদদলিত করেন, সামরিক শক্তির প্রদর্শনীতে অকল্পনীয় নিষ্ঠুর হয়েছেন। বিজয়ী পিতৃজাতির আজ বদলা নেবার মওকা এসেছে। যেখানেই মাতৃগণ সংগঠিত হয়েছে বলে পিতৃগণ অনুমান করেন সেখানেই তাঁরা মাতৃগণের মস্তক ত্রিশূল দিয়ে বিদ্ধ করেন। মাতৃগণের হাতের গদা ও খড়্গ কেড়ে নিয়ে নিরস্ত্র করেন। স্বভাবতই বিজিতরা বিজেতাদের কাছে শান্তির প্রস্তাব করেন। পরাজিত মাতৃগণ জাতির অস্ত্র খড়্গাদি গলিয়ে হাতে ‘নোয়া’ ধারণ করেন, মস্তক বিদ্ধ হবার আগেই সিঁদুর দিয়ে ফোঁটা পরেন এবং সিঁথিতে সিঁদুর মেখে পরাজয়ের গ্লানি হজম করেন। পরবর্তীকালে পিতৃগণের পুরোহিতরা এই গ্লানি মুছে ফেলার জন্য নোয়া ও সিঁদুরকে এয়ো চিহ্ন বলে সংশোধিত সংস্কার চালু করেন। পিতৃতন্ত্রের পুরুষদের শাসন ও শোষন অটুট রাখতে ঋষিরাও অনেক সূত্র ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। পিতৃতন্ত্রের শেষ ঋষি মনু তাঁর সংহিতায় ঘোষণা করে গেছেনঃ ‘পিতা রক্ষৌতি কৌমারে; ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে / পুত্র রক্ষতি বার্দ্ধক্যে, ন  স্ত্রীস্বাতন্দ্র্যমহতি।।‘ অর্থাৎ, স্ত্রীজাতি বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর, বার্দ্ধক্যে পুত্রের অধীন থাকবে।

কিন্তু বিজিতেরা চিরকাল বিজিতদের ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করতে পারে না। ক্লান্ত হয়ে পড়া উপনিবেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শান্তির ললিতবাণী উচ্চারণ করতে হয়সমাজকেও নূতন পরিবেশে নূতন পোষাকে সাজাতে হয়। কিন্তু দুই তন্ত্রের মধ্যে সংঘাত আর সংঘর্ষে গণমানস সহজে শান্তির অনুকূলে উদবুদ্ধ হয় না। দৈহিক হিংসা বিদ্বেষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে প্রকট না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে সেসব দীর্ঘস্থায়ী হয়। বিজেতাগণ এজন্য বিজিতের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে কিছুটা গোঁড়ামি ত্যাগ করেন, নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংশোধন করেন। এজন্য সাংস্কৃতিক অভিযান করা আবশ্যক হয়। ভাষা একটি সাংস্কৃতিক অভিযানের সূক্ষ্ম ও মোক্ষম অস্ত্র। আমরা তাই দেখি, পিতৃ ও মাতৃজাতির বংশধররা একই ভাষায় কথা বলেন। মন্ত্রোচ্চারণ করেন, শ্লোক ও গাথা রচনা করেন। আর একটি সূক্ষ্ম ও মোক্ষম অস্ত্র হল, বিজিতদের সান্নিধ্যে আসার জন্য, বিজিতদের পূজা-উৎসব আচার অনুষ্ঠানকে যুগোপযোগী সংশোধন করা। বিজেতাদের এই কূটনীতি একদিনে সফল না হলেও যুগান্তকারী হয়েছিল। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার ষষ্ঠির দিনের আচার আচরণ লক্ষ্য করলে আমাদের বক্তব্য সঠিক অনুধাবন করা যাবে।

পূর্বেই বলেছি, মাতৃগণ ও পিতৃগণের মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। সুতরাং ওদের মধ্যে শান্তির প্রচেষ্টা সহজে সফল হবে না। বুদ্ধিমান পিতৃগণ ভালো করেই এ কথা জানতেন। এজন্য তাদের লক্ষ্য পড়ে জড়বাদীদের উপরে। মাতৃতন্ত্রের পাশাপাশি এ দেশে জড়বাদীরাও ছিলেন। এরা একান্তে পাথর ও বৃক্ষ পূজা করতেন, সামান্য উপকরণ দিয়ে। অন্যদিকে পরাজিত মাতৃজাতি ছোট ছোট ভূখন্ডে নিজেদের উৎসব, পূজা, আচার অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ করে বৈশিষ্ঠ রক্ষার প্রয়াস করতেন। পিতৃগণ একটি বৃহত্তর সমাজ গঠন করার উদ্দেশ্যে মহালয়ার উৎসবের পরে কদলী ও বিল্ববৃক্ষের পূজাকে উপলক্ষ করে মাতৃগণের এলাকার বাইরে জড়বাদীদের এলাকায় উৎসব শুরু করে দিলেন। পিতৃগণ স্থির করলেন, দেবীর মন্ডপে পূজা না করে একদিকে কলাগাছকে তেল সিঁদুর পরিয়ে পূজা হবে। মহালয়ার জেরটি টেনে এই পূজা ষষ্ঠ দিনে হয়ে যাবে। পুরোহিতরা কলাগাছ ও বিল্ববৃক্ষের নীচে শালগ্রাম শিলা  স্থাপন করে দেবত্ব আরোপ করে পূজা করবেন। জড়পূজার ভক্তগণ এতে খুশি হয়ে নাট্যকার মন্মথ রায়ের ভাষায় নিশ্চয় বলেছেন, ‘সম্রাট মহানুভব’। জড়বাদীরা এখনও বটগাছ, তুলসি গাছ, বেলগাছ পূজা করেন। জড়বাদীদের একখন্ড পাথর শালগ্রাম শিলা তো বিষ্ণু দেবতার অবয়ব। বর্তমানে বৃক্ষপূজার সংশোধিত রূপ আদিকালের রূপ কিন্তু নয়। বর্তমানে কলাগাছ, ‘কলা বৌ’, শ্রী গনেশের গৃহিনী। তিনি এখন লালপেড়ে শাড়ি পরে বীড়াবনত দেহে দাঁড়িয়ে থাকেন। পুরোহিতরা নারীরূপ আরও প্রকট করতে গিয়ে একজোড়া বেল ব্রেসার বেঁধে স্তনের লাবণ্য এনে থাকেন। জড়বাদীরা না পিতৃতন্ত্রের না মাতৃতন্ত্রের। এজন্য বেচারা কলা বৌ ‘শিড্যুলড কাস্ট’ হয়ে মন্ডপের বাইরে অচ্ছ্যুৎ হয়ে রয়েছেন।

উৎসবটা যখন চালু হয়ে গেল, মাতৃভক্তগণের অভিমান কমে এলো। সপ্তমী তিথিতে মাতৃজাতি সমবেত হতে রাজি হলেন, তবে একটি শর্তেঃ তাদের মাটির উপরে তাদের পূজা নিজস্ব পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। গরজ বড় বালাই। মাতৃগণের এলাকা থেকে মাটি এনে লতাপল্লব, নবপত্রিকা ও নানাবিধ শস্য উপকরণে মহালয়ার মন্ডপে ধুমধামের সঙ্গে মহামিলনের মাঙ্গলিক আয়োজন সম্পন্ন করা হল। সপ্তমীদিনের পূজায় ওই মাটি এবং যতরকম নবপত্রিকা, শস্য, লতাপল্লব এই দল ব্যবহার করতেন, তা আজও সপ্তমী পূজার অপরিহার্য উপকরণ।

মাতৃজাতি ও পিতৃজাতির সবাই প্রতিমার চালচিত্রে স্থান পেলেন। মাতৃজাতি থেকে এলেন স্বয়ং শ্রীশ্রী দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী; পিতৃজাতি থেকে এলেন কার্তিক ও গনেশ। গায়ের বর্ণ কৃষ্ণবর্ণ থেকে লাল, লাল থেকে শ্বেতবর্ণ। তারও ইতিহাস আছে। সে দীর্ঘ ইতিহাস পরে সুযোগ পেলে বলা যাবে।

পুরোহিতরা এখনও বেশ্যা গৃহ থেকে মাটি সংগ্রহ করেন। কেননা, বেশ্যার মত কোন নারী আজকাল স্বাধীন নয়। জীবিকার জন্য তাঁরা দেহপসারিনী, কিন্তু তাঁরা পুরুষের অধীন নয়—তাঁরা ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ’। বর্তমানে ষষ্ঠী এবং সপ্তমী তিথিতেই প্রতিমা পূজা মন্ডপে আসে। কিন্তু শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা প্রকৃতপক্ষে অষ্টমীর দিন থেকে শুরু হয়। অষ্টমীতে সন্ধি পূজা নির্দিষ্ট। এই দিনে মাতৃগণ ও পিতৃগণের মধ্যে সন্ধি হয়েছিল। প্রতিমাতে ওদের দুই তন্ত্রের প্রতীকও খুঁজে পাওয়া যাবে। মাতৃতন্ত্রের পক্ষে শ্রীশ্রী দুর্গা স্বয়ং, লক্ষ্মী ও সরস্বতী; পিতৃতন্ত্রের পক্ষে থাকেন কার্তিক ও গণেশ। কৃষির দেবত্ব বিকাশ হয়েছে লক্ষ্মীর মূর্তিতে। বিদ্যা পিতৃগণের মধ্যে ছিল কিনা জানি না, কিন্তু মাতৃগণের মত দশমহাবিদ্যার প্রচুর নিদর্শন ‘কীলক, কাচ, সুর্ত্ত, ধ্যান’ প্রভৃতি স্তুতিতে পাওয়া যায়। সরস্বতী বিদ্যার দেবতা ঐ যুগেও সর্বজনবিদিত। পিতৃগণের জাত্যাভিমানে লাগে বলে সরস্বতীকে পিতৃগণের মত শ্বেতকায়া করা হল, আর ওদের চোখে পবিত্র বলে প্রতিষ্ঠা করা হল। যত বড় ঘটা করা হোক, বিজেতাদের আভিজাত্য মানসিক দিক থেকে পার্থক্য টানবেই। 

কার্তিক বেচারা কিশোর। ছেলে ছোকরাদের দিয়ে মিলনের কাজ সাড়া গেল। বেচারা গণেশ একটি বিতর্কমূলক দেবতা। জাতে মাতৃতন্ত্রের মানুষ। কিন্তু বিপাক হল তার নাম নিয়ে। গণ+ঈশ= জননেতা। বিজিতদের জননেতা কখনো বিজেতাদের কাছে পূজনীয় নয়।  মহাত্মা গান্ধীর মত জননেতা বৃটিশ সম্রাটের লোকজনের কাছে নেংটা ফকির। মাতৃসন্তানদের জননায়ক গণেশকে তেমনি হেয় করার জন্য হস্তিমূর্খ বলে চিত্রিত করা হল। হস্তীর মত মুখ পৃথিবীতে দুর্লভ। মহীরূহকে শুঁড় দিয়ে দূরে নিক্ষেপ করতে পারে যে হাতী, সে সাড়ে চার হাতের মাহুতটিকে শূঁড় দিয়ে পদদলিত করতে পারে না। সুতরাং বিজিতের জননেতার মাথাটি হস্তীর মাথাই বটে।

শান্তির বৈঠক ডাকা হয়েছে। বিজেতা বিজিতের মহামিলন। কিন্তু বিজেতাদের সমরনায়ক বিজয়ী মহাদেব কোথায়? ত্রিশূলধারী মহাদেব আছেন, তবে অতি ক্ষুদ্রাকায়। সিংহের পেটের নীচে, অথবা চালচিত্রের মাথার উপরে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙ্গল না।

শ্রীশ্রীদুর্গার নেতৃত্বে এই সন্ধি বা মহামিলন কোন কোন দুর্দ্ধর্ষ গোষ্ঠী মেনে নিতে পারে নি। মহিষাসুর এই রূপ এক বিদ্রোহী। মাতৃজাতির কলঙ্ক, ইউরোপীয়দের কাছে ‘কুইসলিং’, বাংলাদেশের ‘কোলাবোরেটর’ এই দেবীর বিরুদ্ধে মহিষাসুর ভীষণ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন। কুইসলিং ইতিমধ্যে মাতৃসন্তানদের মধ্যে বিভেদ আনতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি লাঞ্ছিত সিংহ ও সর্প সন্তানদের সহযোগে মহিষাসুরকে আক্রমণ করলেন। প্রতিমায় সেই রূপই ফুটে উঠেছে। সর্প মহিষাসুরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেঁধে ফেলেছে, সিংহ মহিষাসুরের বিশাল পেশীবহুল বাহু কামড়ে ধরেছে আর মাতৃজাতির কলঙ্ক শ্রীশ্রী দুর্গা পিতৃগণের ত্রিশূল ক্ষেপনে মহিষাসুরের বক্ষভেদ করে তাকে নিহত করলেন। মাতৃজাতির মহিষাসুরকে মাতৃজাতির দেবী দুর্গা বধ করলেন। এই দেশের মানুষ কুইসলিং-কে পূজা করতে শিখল।এই যুদ্ধে শ্রীশ্রীদুর্গা নিজজাতি এবং পিতৃজাতির কাছ থেকে প্রচুর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছেন। দেবী যেন দশবাহু দিয়ে সেই সব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে দুর্দ্ধর্ষ মাতৃভক্ত মহিষাসুরকে বধ করলেন।

শ্রীশ্রীদুর্গা মাতৃজাতির অবশেষ। তিনি কৃষ্ণকায়া, পিতৃজাতির পুরোহিতরা কৃষ্ণকায়াকে দেবী বলে পূজা করতে লজ্জা পেতেন। আজ শ্রীশ্রীদুর্গার প্রতিমা এজন্য পিতৃজাতির জনৈকা নারীর মত, শ্বেতকায়া। সঙ্গে সঙ্গে মাতৃজাতির সরস্বতীও বিদ্যার্থীদের হাতে পড়ে শ্বেতকায়া হয়ে গেলেন। কার্তিক শ্বেতকায় জাতির রূপবান যুবক।

নবমী-তিথিতে শ্রীশ্রীদুর্গা পূজা মূল পূজার জের টেনে সমাপ্ত হয়। সামন্তযুগে ব্যবসা বাণিজ্যে নিযুক্ত ব্যবসায়ী য় মুৎসুদ্দিরা একে রাম নবমীতে পরিণত করে হালখাতা খোলেন। অষ্টমীতে যে সমুদয় পশু বলি হত, তার ভোজপর্ব আজকার দিনেও চলত। নবমীতে পূজা শেষ।

ধুমধামের সঙ্গে প্রতিমার মুখ পিছন করে নদী বা দীঘিতে বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হল। উপনিবেশবাদীদের কূটনীতি সফল হল। পিতৃজাতির পুরোহিতদের সাংস্কৃতিক বিপ্লব সফল হল। পরস্পর পরস্পরের কোলাকুলিতে খুসীর পরিসীমা নেই। বিজেতাদের জাতীয় উৎসবে এখন বিজিতদের স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে।

বিজিতদের মধ্যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মহিষাসুরের যুদ্ধ একটি মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা। শ্রীশ্রীদুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেই ক্ষান্ত হন নি, মাতৃজাতির মধুকৈটভ, শম্ভু-নিশম্ভু, ধুম্রলোচন, চন্ডমুন্ড, রক্তবীজ প্রভৃতি অগণিত বীরশ্রেষ্ঠদের বধ করেন। কাব্য, নাটক, মহাকাব্য, পুরাণে, উপাখ্যানে এদের অসুর বলে চিত্রিত করা হলেও তাঁদের শৌর্য বীর্য কলঙ্কিত করা সম্ভব হয়নি। এইভাবে বিজিতদের দিয়েই বিজিতদের স্বর্ণসিংহাসন নিষ্কন্টক হয়েছিল। জাতিপ্রেমের তাজা ফুলগুলি ঝরে গিয়ে বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।

পিছন দিকে প্রতিমার মুখ করে বিসর্জনের মিছিল সম্বন্ধে রমেশচন্দ্র মজুমদার একটি দ্রাবিড়ী প্রথার উল্লেখ করেছেন। মাদ্রাজের পাহাড়ে জঙ্গলে বহু দ্রাবিড় জাতি এখনও তাদের নিজ সংস্কৃতি রক্ষা করে আসছে। এরা তাঁদের বৃক্ষ দেবতাকে তেল সিঁদুর দিয়ে চিত্র বিচিত্রিত করে—পশুপাখী বলি দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে পূজা  করে। পূজা শেষে কাঠের দেবতাকে ঢাক ঢোল সানাই প্রভৃতি বাজিয়ে গ্রামের দিকে মুখ করে একেবারে গ্রামের সীমানায় পুঁতে খাড়া করে রাখে। তাদের বিশ্বাস, সারা বছর ঐখানে দাঁড়িয়ে দেবতা জ্বরা মাহামারী রোগ শোক তাপ জ্বালা থেকে গ্রামকে রক্ষা করবেনজনগণের চাপে পুরোহিতরা দ্রাবীড়ীদের আদি বাস বাস বঙ্গভূমি থেকে বিলুপ্ত করতে পরেন নি ঐ দ্রাবিড়ী প্রথা।

_____________আমার পিতা পণ্ডিত বরদাভূষণ চক্রবর্তী, কাব্যতীর্থ, রাষ্ট্রভাষাবিশারদের রচনা। পণ্ডিতসমাজের এক আসরে পঠিত। নিউ জলপাইগুড়ি, ১১ আশ্বিন, ১৩৭৮ (মহাষ্টমী), ২৮ সেপ্টেম্বর,১৯৭১________________________

Thursday, October 11, 2012

কলকাতায় আমার প্রথম দুর্গাপূজা


১৯৬২ সাল। বয়স সতেরো। তিন-চার মাস হল কলকাতায়, প্রথম। এসেই শিয়ালদায় তিনতলার সাত বাই ছয় সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে রাত-দিন। এক সকালে চোখ মেলে চিলতে জানালাটার কাছে দাঁড়াতেই, দেখি, নিচে বাঁশ জড় করা হচ্ছে। পুজোর প্রস্তুতি। তখন কাইজার স্ট্রিটের কোয়ার্টারের মাঝখানে ছিল মাঠ। ফুটবল পায়ে দৌড়াদৌড়ি চলত। সেখানে পুজো। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় ধবধবে শাদা পেঁজা মেঘ ধুপের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এখনো মনে আছে সেই ক্ষণটাকে। মেঘের মসলিন সরিয়ে সরিয়ে ফেলে আসা পাড়ার পুজো ফুটে উঠতে থাকে । উত্তরবঙ্গের পুজো আসে আকাশে, রদ্দুরের মিষ্টি ওমে। কাশ ফুলে না। কাশফুল আমি দেখিনি। গ্রামে থাকিনি বলেই হয়ত।

জানালা গলে ওপরে তাকিয়ে দেখি, অন্য আকাশ। স্কয়্যার ফুটে মাপা যায়। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ছোট বোন দুটোর জন্য, দাদাদের জন্য। মা’র জন্য। পাড়ার দুর্গা  ঠাকুরের জন্য। আমি কেঁদেই ফেললাম।
আমাদের দুর্গা ছিল আমাদের মার মতো। দুপাশের ছড়ানো হাতে আমাদের মা’কে দেখাত জটায়ূর পাখির মতো। বিশাল। আমাদের আট ভাই-বোনকে  দশ হাতে সাপটে আগলে রাখতেন। বাবা তো রাজনীতিতে অনমনীয় থেকে শহরের জেলখানাটাকেই বাড়ি বানিয়েছিলেন।  
মা
এই একটি আকুতি ছাড়া, আমার আর কোন দুঃখ ছিল না। কলকাতার পুজোয় পকেটে পয়সা থাকা দরকার, এইটে ওই তিন মাসে অনুমান করতে পারিনি। আকাশ বাতাস আর রদ্দুর নিয়েই খুশি আমি। হেঁটে শিয়ালদায় যাই। ফ্লাইওভার এসেছে অনেক পরে। বৈঠকখানা বাজারের গলির মুখে পুজো, আর  শিয়ালদা জুড়ে নতুন কেনাকাটার হুল্লোড়। ওই সময়ে মির্জাপুরের মুখ থেকে প্রাচী সিনেমা অবধি দোকানগুলোর ব্যস্ততা দেখেই উত্তমকুমারের কলকাতাকে খুঁজে পেতাম। মরিস- অস্টিনকে তখনো এমবাসাডর বাজার ছাড়া করেনি। দোতলা বাস, জবুথুবু ট্রাম, আর স্টেটবাস, প্রাইভেট এসেছে ৬৭-৬৮ নাগাদ, এই সব দেখেই আমি কলকাতার বিস্ময়ে আবিষ্ট ও কলকাতায় আসার গর্বে বুক টান। বুঝে ফেললাম, বদলে-যাওয়া পূজাতেই লুকিয়ে আছে আনন্দ, ভালোলাগা না-থাকলেও। 

পুজো এসেই গেল। মহালয়া কী, আমরা জানতাম না। কিন্তু এখানে মহালয়ার ভোরে জেগে উঠল সারা পাড়া। ছোটদের চিৎকারে পাখিদের কলখল বোঝাই গেল না। আমি জানালা দিয়েই দেখতে থাকি কলকাতার পুজো। এতো আগে শুরু হয়?
ষষ্ঠী আসতেই জল ঢালতে থাকে কেউ আমার খুশিতে। আমার কান্না পেতে থাকে। কেঁদেও ফেলি। ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লজ্জা কী? চোখের জল শুকোতে না শুকোতেই সপ্তমীর সকালে বেজে উঠল ঢাক। ঘরে থাকা দায়। প্যান্ডেলেও। স্টেটসম্যানটা নিয়ে খবর খুঁজতে থাকি।

এমন সময় প্যান্ডেলের মাইকে বেজে উঠল পুজোর গান। শ্যামলের। আগে শুনিনি। বাষট্টির পুজোর গানঃ ‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে... মনহরিণি করুণ তার তান তুলেছে, এমন দিনে তুমি মোর কাছে নাই, হায়। স্মৃতিরা যেন জোনাকীরই ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি...  আপন নীড়ে ফিরে গেছে পাখি, নীড় হারায়ে আমি পথে থাকি...

এমন একটি করুণ আবহে এমন স্ফূর্তির উৎসার কিশোর আমাকে অন্য দিশা দিয়ে বসল। আমি কোয়ার্টারের উল্টো ফুটে সার্কুলার রোডের আমজাদিয়ার চিলতে রকে গিয়ে বসে পড়ি। সারা কলকাতা তখন পুজোর উথাল স্রোতে ঘূর্ণি তুলেছে। দেখতে থাকি। বুঝতে থাকি এখন থেকে এই পূজাতেই খুঁজে নিতে হবে আনন্দ, ভালোলাগা না-থাকলেও।  

Wednesday, October 10, 2012

Malala-- Our Little Big Teacher


Malala Yousufzai

After several hours of surgery on Malala Yousufzai , the 15 year old girl ,who was shot in head by two Talibani  youth, doctors successfully removed a bullets from her head when they found one side of her brain was swelling. It’s a matter of great relief and a matter of bliss that Talibans failed in their mission. Whatever the state of Pakistan may claim, it is a fact that they failed to instill the social value of a girl child and her education in an upcoming society.
Malala braved the Talibans in her town, Mingora in the volatile Swat Valley, even when she was just 11, and when the government had effectively ceded control of  the Valley to the militants. Her determination made her a national hero, which was seen from wide spread condemnation of the shooting in her country. The front pages of national newspapers carried pictures of a bandaged and bloody Malala to inform the nation the gruesome act. The surprise part of the fact is that the Pakistani Taliban claimed responsibility and told some newsmen that they will try to kill her again if Malala survives.
Why the Talibans did this? Their arguments, they are dead against any secular education and co-education. They took Malala a “pro-West”, propagating western culture and had been speaking out against Talibans. “Any female that, by any means, plays a role in the war against mujahideen should be killed,” said a Taliban spokesman.
And why this happened to her? Malala , when just 11, at eighth standard, had  been exposing the Pakistani Taliban's cruelty in BBC’s blog posts for several day’s in the form of dairy. Instantly his posts got popular and became sources of information to the outer world about what was happening in Swat Valley. Thus, in one hand, she became a leading advocate for the education of girls in her country, and on the other she was heaping wrath of the Talibans against her, irrespective of her tender age.
To the Talibans this was too much. They were seeking to impose their austere interpretation of Sharia law and have had destroyed about 150 schools by then. Five more were blown up during when Malala had her last day in school on 15 January last. Possibly, this attack was made earlier than schedule for Malala was selected for International Children’s Peace Prize for her fearless doing and it was to be conferred on her next year.
Possibly, Pakistan lost maximum number of determined civilians who protested the Taliban’s dreadful interpretation of Shariat, and misinterpretation of the Holy Book. Yet, I wonder, what about larger Muslim world? It was all academic discussions that ran for volumes whenever the political leaders or civil society champs came frontward. In reality none of these groups systematized weightage to desist Talibans from declaring war against human in general and its own people in particular. We know any number of Malalas cannot stop them from plundering human endeavors, unless a determined Islamic state or a group of Islamic states take up the arms to fight the hazards.

Sometime I wonder, why war against Taliban does not become a religious war instead of a political one. Why the larger Muslim world do not consider Talibani acts as un-Islamic, and obnoxious. I feel more puzzled when I find Pakistanis, no less a Islamic human force, are fighting them with whatever gadget obtainable to them. Like a pen and an iron will that Malala fought at this tender age of 14.

------------------------