My Readers

Friday, August 14, 2015

আমার সম্পাদনার দিনগুলো

// আমার সম্পাদনার দিনগুলো //

দেবেশ রায়ের 'মফস্বলী বৃত্তান্ত' ভারতের তেরটি ভাষায় অনুবাদের জন্য স্থির করে কলকাতায় গিয়ে দেবেশদার সঙ্গে দেখা করলাম। চৌরঙ্গীর 'প্রতিদিন'র অফিসে। ঘণিষ্ঠতা ছিল না, তাছাড়া দেবেশদা কাউকেই তুমি বলেন না। আপনি সম্বোধনে কথা বলেন।

আমার প্রস্তাবে তাঁর ঘোর আপত্তি। মফস্বলী নয়, নিতে হলে নিতে হবে 'খরার প্রতিবেদন'। এটা আমার পড়া ছিল না। আমি গুয়ার্তুমি তর্ক জুড়ে দিলাম, প্রকাশক ঠিক করেছে যে-বই, আপনি তার সম্মতি দেবেন কিনা সেটাই আসল কথা। তাঁর যুক্তি, 'লেখকের কোন বই সর্বভারতীয় ভাষায় অনুবাদের যোগ্য, তা ঠিক করবেন লেখক। অবশ্য, আপনারা যদি সেই লেখককে প্রকাশযোগ্য মনে করেন।' মহা বিপদ! এই রকম ব্যঞ্জনবর্ণ ভাষী মানুষের সম্মুখীন আমি আগে হই নি। মফস্বলী কেন সর্বভারতীয় পাঠকদের যোগ্য সে কথা সম্পূর্ণ করার আগেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন, 'আপনি যখন খরা পড়েনই নি, তো মিছিমিছি মফস্বলীর গুণগান করছেন কেন?' চুপ করে যাই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সম্পাদক-আমি বিড়ালের মত গড়গড় করতেই থাকি। এক কপি খর কিনে দিল্লি ফিরে আসি।
এসেই খরা পড়ে ফেলি। তারপর....

মস্ত একটা চিঠি লিখি দেবেশদাকে। কেন মফস্বলী সর্বভারতীয় পাঠকদের জন্য জরুরী এবং সর্বভারতীয় পাঠ্যবস্তু হলেও তুলনায় কেন খরা এক নম্বরে নয়।
এর কিছুদিনের মধ্যেই দেবেশদা 'মফস্বলী বৃত্তান্ত' ভারতের তেরটি ভাষার অনুবাদে সম্মত হয়ে চুক্তিপত্র সই করে আমার কাছে এনবিটি-তে পাঠিয়ে দেন। আর আমার জন্য হাট খুলে দেন তার স্নেহের দরজা।


// ২ //

আশির শুরু। দিল্লিতে ষান্মাসিক প্রাংশু পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক আমি, সঙ্গে ৭১ বছর বয়সী শশাঙ্কশেখর মুখোপাধ্যায়। পত্রিকায় অন্যান্য লেখার সঙ্গে নিয়ম করে প্রতি সংখ্যায় ছাপা হ'ত একটি আট পৃষ্ঠাব্যপী ছবি সহ একটি দীর্ঘ কবিতা আর একটি উপন্যাস, পরে একই প্রিন্ট আউট থেকে ছাপা হত বই আকারে উপন্যাস। প্রাংশুতে লিখেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় তারাপদ রায় পূর্ণেন্দু পত্রী (পত্রিকার প্রচ্ছদও পূর্ণেন্দু পত্রীর) প্রমুখ। তেমনি লেখক চাণক্য সেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় শেখর বসু লোকনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ। আজকের কথা বাংলার অন্যতম শক্তিশালী কবি ও ঔপন্যাসিক লোকনাথ ভট্টাচার্যকে নিয়ে।

লোকনাথ ছিলেন অফিসে আমার বস। প্রধান সম্পাদক। একসময় ছিলেন সাহিত্য আকাদেমির Indian Literature পত্রিকার সম্পাদক। 'বাবুঘাটের কুমারী মাছ' উপন্যাস লিখে সমালোচকদের কাছে অতীব আদৃত। মিটিং ফিটিংয়ের বাইরে আমি তাঁকে ডাকতাম 'লোকনাথদা' বলে। আনন্দবাজারের অমিতাভ চৌধুরি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও ডাকতেন 'লোকনাথদা', তাই আমিও।

লোকনাথদা তখন প্যারিসে। স্ত্রী সোজর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, তাই বেড়াতে গেছেন। চিঠি লিখলাম, এবার আপনার উপন্যাস ছাপতে চাই, প্লিজ। তখন প্রাংশুর খুব নামডাক। পশ্চিমবাংলা থেকে সেরা সম্পাদনার জন্য 'শিল্প ও সংস্কৃতি'র ১০০০ টাকার পুরস্কার নিয়ে এসেছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের হাত থেকে। তো রাজি করাতে বেগ পেতে হল না। পুজোর আগে আগেই ডাকে লেখা পৌঁছে গেল। বললেন, কম্পোজ শুরু করো, অল্প বাকি, পাঠাচ্ছি।

পড়ে দেখি অসাধারণ উপন্যাস ওই 'ধুলায় ঈশ্বরীর পা'। যেমন নামকরণে নতুনত্ব, তেমনি নতুনত্ব এর শৈলীতে। বাংলা লেখালেখিকে, বিজ্ঞাপনে লিখলাম, কম করে দু' দশক এগিয়ে দিলেন লোকনাথ। ফরাসী সাহিত্যের বিষয় ও শৈলী নিপূণ দক্ষতায় বিস্তার পেল বাংলা সাহিত্যে, সম্ভবত সেই প্রথম।

কিন্তু গোল বাঁধল যখন দেশে ফিরে তিনি তাঁর উপন্যাসের বাকি অংশ আমাকে দিলেন। পড়ে দেখি, অনেকাংশে পুনরাবৃত্তি। অথচ আমার কাছে যে অংশ, তা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওঁর অফিস ঘরে আলোচনায় বসি। তিনি রাজি না। প্রায় পিঁপড়ে সাইজের হাতের লেখায় ক্রাউন সাইজের পাতায় ৩১ পৃষ্ঠা, মানে অযথা প্রায় ৬০ পৃষ্ঠার ছাপা। আমি টেবিলে বাড়তি পান্ডুলিপি রেখে নিজের ঘরে ফিরে আসি। ছুটির কিছু আগে বসের ডাক, পিওন জানাল। গেলাম। লোকনাথদা, বললেন, আমি লেখক, আমি তো বলব, কোথায় আমার লেখা শেষ করব। আমার উত্তর, আমি প্রকাশক, আমি কাগজ ছাপাই বাঁধাইয়ে টাকা ঢালব, তো আমিই ঠিক করব, লেখাটায় কোন পুনরাবৃত্তি রাখব কি রাখব না। বসের লালটুকটুকে ফর্সা মুখ আরো লাল হয়ে যায়। রাজি হন না। আমি খালি হাতেই উঠে আসি।

ওমা, পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি ওই আংশিক পান্ডুলিপি আমার টেবিলে, কোন রকম রিরাইটিং নেই। খানিক পরে আমার কলিগ, বর্ষা দাস (অভিনেত্রী নন্দিতা দাসের মা, শিল্পী যতীন দাসের প্রাক্তন স্ত্রী), গুজরাতি ভাষার সম্পাদক, এলেন। বললেন, কী করছ এসব? লোকনাথের মত লেখকের পান্ডুলিপি বাতিল করছ? তোমার এ কাজ কোন অবস্থাতেই একসেপ্টেবল নয়। ওনাকে ডিটেলে বললাম, কেন কোথায় কোথায় আমার আপত্তি। সুবিধা হ'ল, লোকনাথকে মুখের ওপর যা যা বলতে পারছিলাম না, বর্ষাকে তা বলতে পারলাম। ওরা ঘণিষ্ঠ জানতাম। সব কথা লোকনাথদার কানে যাবে অনুমান করাই গেল। আমি পান্ডুলিপিটা ড্রয়ারে রেখে অন্যকাজে ব্যস্ত হলাম। ছুটির পরে, লোকনাথদা বেরিয়ে গেলে, ওর টেবিলে পান্ডুলিপিটা রেখে আসি।

যথারীতি, অফিসে ঢুকতেই পিওন, 'স্যার ডাকছেন।' নিজেকে ঠিকঠাক করে একটা পাব্লিশারের মানসিকতা নিয়ে ঢুকলাম। লোকনাথদার এবার গলার স্বর অনেকটা নরম। যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলতেই লাগল। একসময় বললাম,'আপনি যদি চান, প্রায় শেষ হয়ে আসা কম্পোজ বন্ধ করে দিচ্ছি, পান্ডুলিপিতে কালিঝুলি, প্রিন্ট আউট দিয়ে দেব। টাকার অপচয় হয় হোক, ভালো উপন্যাসকে খারাপ বানিয়ে ছাপব না।

লোকনাথদাই সমাধান দিলেন: ঠিক আছে এখন ছাপো, পরের এডিশনে এটা যুক্ত করতে হবে।আমি রাজি, পরের কথা তো পরেও হতে পারে।

বই ছাপা হল। নানা কারণে হই চই পড়ে গেল দিল্লি কলকাতা জুড়ে। লোকনাথদা আর পান্ডুলিপির অংশটুকু পাঠান নি।

---------------------------------