My Readers

Monday, August 19, 2013

চাঁদনি আবিষ্কার


পুরনো দিল্লির জামা মশজিদকে পাশে রেখে যে গলিটায় ঢুকে পড়লাম, সে পথ দিয়ে যাবার কোন প্ল্যান আমার ছিল না, থাকার কথাও নয় কেননা, রাস্তা আমার জানা নয়, চেনাও নয়। যেন কোলারাডোর গভীর খাদ। একটা গ্রানাইট-শক্ত পাহাড়ের ফাটল, পাতাল অবধি চলে গেছে, আমি হাঁটছি পাতাল দিয়ে। ওপরে তাকাতেই নজরে পড়ছে একটা ফুট স্কেলে মাপা আকাশ। নিচে অবশ্য আমি একা নই। মানুষের তিরতির স্রোত বইছে। কারও মাথায় ঝাঁকা, কারুর বা দু-হাত শিকল হয়ে ঝুলছে, আঙুলের আংটায় নানা আকারের ঝোলা নানা মালপত্রে ঠাসা।

দিল্লির কলেজ স্ট্রিট পুরনো দিল্লির নঈ সড়ক। আধুনিক প্রকাশকরা অবশ্য সাহেব দিল্লির দরিয়াগঞ্জের আসফ আলি রোডের দু-পাশে গলিঘুঁজিতে। আমি কাগজ পট্টির কাজ সেরে চাঁদনি চকে যাব, ভাবলাম বাঁয়ের গলিটা সোজা নিয়ে গিয়ে ফেলবে চাঁদনির রাস্তায়। সেই ভাবনাই কাল হল, খানিক -গলি সে-গলি বেয়ে রীতিমত গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলাম। সবাই পথনির্দেশ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সম্ভবত আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েই পথ গোলাচ্ছিলাম।

এই সময় সাধক রামপ্রসাদের মা কালীর মতো এক কালো কুটকুটে মেয়ে এসে  দাঁড়ালো সামনে। তার দু-হাতের দু-তালু জড়িয়ে আছে একটা নাড়কোল দড়ির দু-প্রান্ত। স্কিপিং। ওই আড়াই ফুট চওড়া গলিটার পথ আগলে সে স্কিপিং করতে লাগল, যেন আমি কোন স্কিপিং কম্পিটিশনের জাজ। টান টান মানসিক অবস্থানে মানুষ যে কোন বৈপিরীত্যেই আরাম অনুভাব করে, আমার অবশ্য অতটা টান টান অবস্থা ছিল না, তবে মেয়েটার পথরোধ করে খেলতে থাকাটা মন্দ লাগছিল না।

গলিটা পথচারীর ভিড়ে ব্যস্ত নয়, ওর স্কিপিং করার স্বাধীনতা সে কারণেও। মুগ্ধতার প্রকাশ অনেক সময় হারিয়ে যাওয়া রং লেপে দেয়। ক্ষেত্রেও তাই ঘটে থাকবে। মেয়েটি স্কিপিং করতে করতেই জিজ্ঞেস করে, ‘রাস্তা ভুল গয়ে আঙ্কেল?’ এই আট নয় বছরের মেয়েটির মুখে এই প্রশ্ন থেকেই অনুমান করলাম, পুরনো দিল্লির গলির জালে আটকা পড়ে যাওয়া কোনো নতুন ব্যাপার নয়, আকছারই ঘটে থাকবে, নইলে শুধু চাহনি দেখে মেয়েটা বুঝে ফেলবে কী করে যে, ফাঁপরে পড়েছি?

পরনে একটা ময়লা ছিটের ফ্রক। ফ্রকের কোমরের ফিতে দুটো ওর শরীরের তালে তালে দু-পাশে লাফাচ্ছে, পা খালি। কুটকুটে মেয়েটার মাথার চুলে জটা, দিল্লিরযাযাবারলোহার পরিবারের লোহা-কুড়ুনি ছেলে মেয়েদের যেমন থাকে।

ওর কাছের মানুষ হতে হতে বলি, ‘হাঁ বেটে, চাঁদনি ইস রাস্তা সে...?’

আমার কথাটি কেড়ে নিয়ে মেয়েটি বলে, ‘ইধর সে ভি যাতা, উধর সে ভি।বলতে বলতে আমার সামনে পিছনে দু-দিকের রাস্তার দিকেই তর্জনী টানটান করল। ওকে অবিশ্বাস করার মানে নেই। কেননা, এখানকার গলিগুলি এমনই, সর্বতোমুখী। অনেক বছর আগে কার সঙ্গে যেন এসেছিলাম জরিওয়ালি গলিতে, তখন আন্দাজ করেছিলাম কিছুটা। আজ গোলকধাঁধার এক্কেবারে মধ্যিখানে, তাই যা অস্বস্তি।

আমি রফা করতে সোজাসুজি প্রস্তাব দিই, ‘মুঝে লে যাওগি, চাঁদনি তক? আসলি রশ্সা খরিদ দুঙ্গা।

মনুষ্য সমাজে সবচেয়ে ঘুষখোর হয় শিশুরা। ঘুষ দিয়ে এক একজনের পুরো দুনিয়াটা কিনে ফেলা যায়। অনেকে কিনেও ফেলে, নইলে শিশুদের ঘিরে এত কিডন্যাপের ঘটনা নজরে পড়ত না। মেয়েটা মুহূর্তে ঘুরে চলতে শুরু করে, কথা বলে না। প্রথমে ভাবলাম ঘুষে কাজ হল না। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই যখন আমাকের ফিরে ফিরে দেখতে থাকে, বুঝতে পারি মেয়েটা আমাকে পালাতে দিতে চায় না।

আধা অন্ধকার গলিপথ, আবছা আলোর খিলান, ওপর থেকে গড়িয়ে নামা খোলা নর্দমার কুলুকুলু স্রোত, ঝলমলে জড়িওয়ালি গলি, লোক গিজগিজ কাপড় পট্টি হয়ে গুড়গুড় করে কুটকুটের পায়ের গাড়ি গড়াতে লাগল, আমি পিছনে প্রায় জগিং করতে করতে ওকে ফলো করতে থাকি। এক সময় আন্দাজ করতে পারলাম, শরীরে আর দুটো পাক দিলেই চাঁদনির ফুটপাত।

এবং তাই-ই। মেয়েটি আমার দিকে তাকায়। চোখ দুটো মেলে রাখে নীরবে, ‘দাও এবার রশ্সা!’
আমি বিপদে পড়ি। রশ্সা কিনে দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু কোথায় পাওয়া যায়?

আও মেরে সাথ আঙ্কল।বলে সে হাঁটা দিল, যে পথ দিয়ে চাঁদনি আবিষ্কার, সেই পথে। আমি আঁতকে উঠি। আবার ওই পথে!

কুটকুটেকে বলি, ‘ এক কাম কর্ আউর কুছ লে লেঁ। ক্যাস চাহতি হ্যায় বোল্

আমার প্রস্তাবে খুশি হয় না, তা ওর মাথা নিচু করে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা থেকেই টের পাই। মাটির দিকে চোখ রেখে একসময় যেন আমাকে আমার চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, ‘মুঝে রশ্সা চাহিয়ে। আচ্ছি রশ্সা। লাল লকড়িবালি।

চারপাশে কাপড়ের দোকান। ওকে সামলাতে সেসবের আশ্রয় নিই, বলি, ‘তু দেখ্‌, এক ভি রশ্সা য়হাঁ নহি হ্যায়।

চারপাশে মুখ ঘুরিয়ে ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মাথা নিচু করেই থাকে। অন্যমনস্ক হয়ে কোলের কাছে কচি হাতের তালু দুটি টেনে এনে দেখতে থাকে। অবাক কান্ড! নারকোলের পুরানো রশ্সা, মানে স্কিপিংটা, লুকালো কোথায়? জিজ্ঞেস  করি, ‘কহাঁ রক্খি হ্যায় তেরি রশ্সা?’

নালি মে ফেঁক দিয়া ?’—যেন আমার নির্দেশে, আমারই জ্ঞাতসারে সে তার স্কিপিংটা নর্দমায় ফেলে দিয়েছে। ছোট্ট মানুষটার আরও ছোট্ট হৃৎপিন্ডটা কী নির্মমতায় নিংড়াচ্ছে, ওর থমথমে মুখ আর নিথর শরীরটায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাশেই ওপর থেকে গড়াচ্ছে এক নর্দমারঝর্না ওকে নিয়ে সে-দিকটায় সরে দাঁড়াই, বলি, ‘এক কাম কর্‌’, পকেট থেকে কড়কড়ে একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলি, ‘তুম্হি আচ্ছাসা এক রশ্সা খরিদ লেনা, দোনোঁ তরফ লাল, গোল, লকড়িবালি রশ্সা খরিদনা, সমঝি?’

মাথা হেলাবার সঙ্গে সঙ্গে ওই শিশুমুখে কী আশ্চর্য দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল। স্বর্গীয় শোভা কি একেই বলে? নারকোলের স্কিপিং যেন ওপাশে বল্লিমারানের শিশু মির্জা গালিবের সময়ের কথা। মুহূর্তে মাথা হেলিয়ে আমার পরামর্শে স্বীকৃতি জানায়। ঝুঁকে ওর জটাজুট ঝাঁকড়া মাথায় আদর করেছি কি করিনি, মেয়েটা এক লাফে গলির মাকড়শা-জালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি ফিরে আসি চাঁদনির ব্যস্ততায়। শাহজাহানের কাল থেকে, এক রাত্রির জন্যও চোখ বোজেনি এই চাঁদনি। ডানে বাঁক নিয়ে কোতয়ালি, তারপর বাঁয়ে লোহার শলাকা প্রহরায় জলশূণ্য ফোয়ারা, আরও এগিয়ে হেমচন্দ্র সেনের ডাক্তারখানা, দেড়শো বছরেরও পুরনো, তাকে ছাড়িয়ে দক্ষিণ দিল্লির বাস স্ট্যাণ্ড,  ডাক্তারখানার ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে নজরে পড়ল, একটা দোকানে সারি সারি নানা রঙের স্কিপিং, ঝুলছে। হাওয়ায় দুলে দুলে স্কিপিংগুলো মাথা ঠোকাঠুকি করে খটখট করে হাসছে। কুটকুটেও হয়তো এতক্ষণ এমনই আনান্দে খটখট করে হাসছে। মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠল।

পাশে হেলে দোকানীকে জিজ্ঞেস করি, ‘এহ রশ্সা কিতনে মে দে রহে হো, ভাই?’
থারটি ফাইভ, স্যার।

অকমাৎ এক বিদ্যুৎ তরঙ্গে সারা দেহ কেঁপে উঠল। আর কোথা থেকে যেন এক দমকা হাওয়া এসে স্কিপিংগুলোর গা ছুঁয়ে শপাং শপাং বইতে লাগল...

১৯ নভেম্বর, ২০০০