শ্রীশ্রী দুর্গার প্রতিমা দেখে মনে প্রশ্ন
জাগে, এ কোন দেবী? কালী তারা প্রভৃতি দশমহাবিদ্যার ইনি তো কেউ নন। দশমহাবিদ্যার
মূর্তি দেখে মনে হয়, এঁরা মাতৃযুগের দেবতা। কেউ পুরুষদের দেহের উপর দাঁড়িয়ে
পিতৃযুগের পুরুষদের পেলেই ঘায়েল করছেন, জিহ্বা ছেদন করে পিতৃশত্রুদের স্তুতি বন্ধ
করছেন—আরও নানাভাবে পুরুষদের উপরে নীপিড়ন, নির্যাতন করছেন। নির্বিচারে হত্যা
করছেন। মহাবিদ্যার চন্ডীর যত আক্রোশ পুরুষদের উপর। এক হাতে খড়্গ অন্য হাতে গদা
ঘুরিয়ে পিতৃগণকে বধ করেন, মুন্ডমালা গলায় পরে মুঠিতে মুন্ড ঝুলিয়ে তাথৈ তাথৈ নৃত্য
করেন, পুরুষের খন্ডিত হাত পা গেঁথে নগ্ন দেহ ঢাকেন, শবের উপর উঠে বিজেতার গৌরবে
আস্ফালন করেন, বিজিতে রক্তপান করে গোষ্ঠীর সন্তানদের কাছে শ্রদ্ধা ও পূজা আদায়
করেন। এই সব বীর মাতাদের মধ্যে শ্রীশ্রী দুর্গার স্থান নেই।
অসমের কামাখ্যা থেকে শুরু
করে কোয়েটার কাছে হিংরাজ পর্যন্ত ৫১ স্থানে পিতৃগণের সঙ্গে মাতৃগণের যে লড়াই
হয়েছিল, তাতে মাতৃগণ শহীদ হয়েছিলেন। এই সব স্থানের শহিদ মিনারগুলিকে সেদিনকার
লোকেরা পীঠস্থান বলেছিলেন। হৃতশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য মাতৃজাতি সন্তানরা
পীঠস্থানে জমায়েত হতেন, পূজা দিতেন। পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে বর্তমান শাসকরা যেমন
বিদ্রোহ দমন করেন, অতীত যুগে তেমনি পিতৃতন্ত্রের ধারক বাহকেরা প্রতি পীঠস্থানের
কাছে একটি করে ভৈরব মন্দির বসিয়ে পাহারা বসিয়েছিলেন। এ কারণে মাতৃশক্তির
পুনরুত্থান ভৈরবদের সদাজাগ্রত হুঁশিয়ারির ফলে সম্ভব হয়নি। ভৈরবগণ তাদের
পিতৃতন্ত্রের চিহ্ন লিঙ্গপূজা করতে থাকেন নিজেদের গন্ডীর মধ্যে, ভৈরব মন্দিরে।
উন্নততর প্রহরণ ত্রিশূলধারমহাদেব আজও জাগ্রত দেবতা। পিতৃযুগের শক্তির চিহ্ন পুংলিঙ্গ
এইসব মন্দিরে স্থাপিত এখনও দেখা যায়। বিজিত মাতৃজাতির সন্তানেরা ভয়ে বিভয়ে ভৈরবকে
নতুন দেবতাজ্ঞানে ফুল চন্দন বিল্বপত্র দিয়ে পূজা করতে শুরু করেন। আজও অনেকে পীঠস্থানে দেবীপূজার পর ভৈরব মন্দিরে
পূজা না করে এলে তীর্থযাত্রা সফল হয় না বলে বিশ্বাস করেন। এই ৫১ পীঠের কোন দেবী
শ্রীশ্রী দুর্গা নন।
প্রাক দ্রাবিড় যুগের
নরনারী মাতৃযুগের কৃষ্ণবর্ণের মানুষ। এরা পশুপক্ষীর নামে গোষ্ঠী গঠন করে জীবিকার যেমন
সংগ্রাম করতেন, তেমনি বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতেন। আভিজাত্যের ক্রমবিকাশে
কৃষ্ণকায় জাতি ‘অসুর’ এবং শ্বেতকায় জাতি ‘সুর’ বলে খ্যাতিলাভ করেন। ইংল্যান্ডের
নাইটদের আর্মর দেখে যেমন বলা যেত এরা কোন দুর্গের যোদ্ধা, তেমনি সন্তানগণ কেউ কেউ
সিংহ, কেউ সর্প, কেহ মহিষ প্রভৃতি চিহ্নে চিহ্নিত ছিলেন। শ্রীশ্রী দুর্গা
যোদ্ধাবেশে সজ্জিতা, স্বভাবতঃ প্রশ্ন জাগে, ইনি মাতৃযুগের কোন সময়ের দেবী ছিলেন?
শ্রীশ্রী দুর্গার গায়ের রং পিতৃজাতির নারীদের মত শ্বেতকায়া কেন?
মাতৃযুগে মাতৃজাতির
প্রহরণ ছিল গদা ও খড়্গ। মহিষাসুরকে বধ করতে ভৈরবের হাতের ত্রিশূল শ্রীশ্রী দুর্গা
পেলেন কোন সামাজিক প্রয়োজনে? নিজসন্তান মহিষাসুরকে ত্রিশূল দিয়ে বধ করলেন কেন?
মাতৃজাতি ত্রিশূল ক্ষেপণের শিক্ষাই বা পেলেন কোন কারণে?
শ্রীশ্রী দুর্গা তবে কি
জাতিদ্রোহ করেন, না পিতৃগণের ‘কোলাবোরেটর’ হয়েছিলেন? প্রাগৈতিহাসিক যুগেও কি তবে
বিভীষণ বা ‘কুইসলিং’-দের আবির্ভাব হয়েছিল? সর্প ও সিংহ লাঞ্ছিত সন্তানের সাহায্যে
তিনি কেন জাতিদ্রোহে মেতে উঠলেন? সর্প,
সিংহ ও মহিষাসুরদের ঐক্য ও সংহতি ধ্বংস করতে তিনি জাতি কলহে প্রবৃত্ত হলেন কেন?
ষষ্ঠির দিন থেকে নবমীর দিন পর্যন্ত একই চত্বরে জড়পূজা থেকে শক্তিপূজার সমন্বয় হল
কোন সামাজিক কারণে?
সপ্তমীর দিনে শ্রীশ্রী
দুর্গাপূজার অবশ্য একটি উপকরণ বেশ্যার মাটি। এই দিনে এই মাটি এত শুচি হল কেন?
দেবীপক্ষ শুরু হয় অমাবস্যার দিন (মহালয়া) থেকে, মহালয়া নামটাই বা বেছে নেওয়া হল
কেন? এই দিনে এটা পালন করে পিতৃতর্পন বা পিতৃপুরুষের নাম উচ্চারণ হয় কেন?
বিসর্জনের দিন প্রতিমাকে উলটো করে ধরে বহন করা হয় কেন?
এতগুলো ‘কেন’-র উত্তর আমি
এই নিবন্ধে সুধীজনের কাছে নিবেদন করব। পন্ডিতজনের সমালোচনা পেলে আমি কৃতজ্ঞ ও ধন্য
হব।
আর্যদের, বর্ণহিন্দুদের
পূর্বপুরুষদের মধ্য এশিয়া থেকে আগমনের পূর্বে সুদূর গ্রীক দেশের কাছাকাছি কোন এক
শ্বেতকায় জাতি পুরুষদের আধিপত্যে সমাজ সংগঠন ও বিন্যাস করেছিলেন। এঁদের মধ্যে
স্ত্রী-স্বাধীনতা ছিল না। এঁদের গোষ্ঠীর প্রতীক চিহ্ন ছিল পুরুষের জননেন্দ্রিয়।
গ্রীস দেশের কাছাকাছি ভূখন্ডে লিঙ্গপূজার নিদর্শন প্রত্নতাত্বিকেরা এখনও পেয়ে
থাকেন। পিতৃতন্ত্রের এই সব গোষ্ঠী লিঙ্গপূজার মধ্যে সংহতি ও যুদ্ধোন্মদনার প্রেরণা
পেতেন।
এই সময় আসমুদ্রহিমাচল
ভূখন্ডে কৃষ্ণকায় জাতি মাতৃশক্তিকে ঘিরে সমাজ গঠন ও বিন্যাস করেছিলেন। মায়ের কাছ
থেকে তাঁরা ঐক্য সংহতি ও যুদ্ধোন্মদনা পেতেন। পুরুষেরা এত দুর্বল ছিল যে মা শত্রু
বধ করতেন, সন্তান নয়। পুরুষের সবকিছু মায়ের কাছ থেকে প্রার্থনা করে নিতে হবে--ধনং
দেহি জ্ঞানং দেহি, বিদ্যাং দেহি, দ্বিষো জহি। হে মাতঃ, আমাদের ধন দাও, বিদ্যা দাও,
শত্রু বধ কর। দ্রাবিড় যুগের পূর্বে এই জাতির অর্বাচীন সভ্যতা আসমুদ্র হিমাচল
পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সবিশেষভাবে অসমের কামাখ্যা থেকে কোয়েটার হিংরাজ পর্যন্ত
মাতৃজাতি স্বীয় শক্তিতে ও গৌরবে মাতৃতন্ত্রকে উজ্জীবিত রাখত।
এই সময়ে অর্থনৈতিক কারণে
হোক, বা নিজনিজ দেশে লোকসংখ্যার বৃদ্ধিতে হোক বা আমাদের অজ্ঞাত কারণে তাদের জীবন
জীবিকা বিকাশে বাধা পেয়েই হোক, পিতৃপুরুষ তুরস্ক ইরাক ইরাণ অতিক্রম করে উপনিবেশ
স্থাপন করতে এই উপমহাদেশে পদার্পণ করেন। আদর্শে আদর্শে সংঘাত অনিবার্য। মাতৃগণ
পিতৃতন্ত্রের বহিরাগতদের সহ্য করতে পারলেন না। যে সংখ্যায় পিতৃগণ এসেছিলেন মাতৃগণ
সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে নিজেদের অস্ত্র গদা ও খড়্গ দিয়ে তাদের হত্যা করতে থাকেন।
পিতৃপুরুষের মুন্ডমালা গলায় পরে, মুঠিতে খন্ডিত মুন্ড ঝুলিয়ে, শত্রুর হাত পা ছিঁড়ে
নিজ দেহের নগ্নতা ঢাকলেন। পুরুষদের শবের উপর তান্ডব নৃত্য করলেন। পিতৃপুরুষদের
রক্তপান করে করাল জিহ্বা বের করে ভয়ংকর মূর্তিতে সন্তানদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও
পূজা আদায় করলেন।
যুদ্ধে জেতে তাঁরা যাঁদের
হাতে থাকে উন্নততর অস্ত্র এবং যোদ্ধা, স্বল্প হলেও পর্যাপ্ত। পিতৃগণ প্রথম পরাজয়ের
পর পর্যাপ্ত সংখ্যায় তাঁদের উন্নততর অস্ত্র ত্রিশূল নিয়ে এবার মাতৃগণকে নির্মূল
করতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন। গদা খড়্গ দিয়ে এই আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হল
না। গদা ও খড়্গ হাতিয়ার, কিন্তু ত্রিশূল নিরাপদ দুরত্ব থেকে নিক্ষেপ করা সহজ। এই
উপমহাদেশে, বিশেষতঃ পূর্ব সীমান্ত কামাখ্যা থেকে পশ্চিম সীমান্ত হিংরাজ পর্যন্ত,
দুই তন্ত্রের যোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই বাঁধল। পিতৃগণের হাতে মাতৃগণ খন্ডবিখন্ড
হলেন। ৫১ স্থানে মাতৃগণ পিতৃগণের হাতে পরাস্ত হলেন। এই সব যুদ্ধস্থল শহীদ
মাতৃসন্তানদের ও মাতৃগণের পূণ্য স্মৃতি বহন করে ৫১ পীঠস্থানে তীর্থস্থানের
মর্য্যাদা লাভ করল।
পিতৃগণের যুদ্ধ করবার সাংগঠনিক
কৌশলও উন্নততর ছিল। যুদ্ধের আগে অমাবস্যার অন্ধকারে একটি সুবৃহৎ মন্ডপে পিতৃগণ
সমবেত হতেন। এইখানে শহিদান পিতৃগণের নাম স্মরণ করে তাঁরা মরণপণের শপথ নিতেন। এই
মন্ডপ ‘মহালয়’ বলে খ্যাতি লাভ করে। যে সব দেশ থেকে পিতৃগণ ভারতে প্রবেশ করেন, সেখানেও
এই মহালয়ের অস্তিত্ব ছিল। মহালয়ে পিতৃগণ মিলিত হয়ে পিতৃপুরুষের স্মৃতিচারণ করে তর্পন
করতেন। পরবর্তীকালে পিতৃগণের পুরোহিতগণ এই মন্ডপকে ‘মহালয়া’ এবং শহিদানের
স্মৃতিতর্পনকে পারিবারিক মৃতব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে তিল জলাঞ্জলি প্রদানের অনুষ্ঠানে
রূপান্তরিত করেন। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগে মহালয়ের সমাবেশে যোদ্ধারা আত্মত্যাগ ও
তিতিক্ষার শপথ নেবার সময় পূর্বপুরুষের বীরত্বের গাথা বেঁধে গান করতেন, শহীদদের অমর
স্মৃতি স্মরণ করে মাতৃবধে উদ্দীপ্ত হতেন।
মহালয়া ভারতবর্ষের
পিতৃগণের একচেটিয়া ইতিহ্য নয়। আরবের মুসলমানদের মসজিদ, ইহুদিদের যিহোবা মন্দির,
এবং খৃষ্টানদের গীর্জা হত না ধর্মমন্ডপ যোদ্ধাগণের সম্মিলন স্থান। আরবদেশের লোক, ইহুদী এবং
খৃষ্টান ঐ আদিযুগে পিতৃতন্ত্রের সামিল ছিলেন। বিবর্তনের মধ্যে এঁদের বিশিষ্ট রূপ
আপাতদৃষ্টিতে দেখা গেলেও সামাজিক সংগঠনে এঁদের মধ্যে পিতৃতন্ত্রের ছাপ খুঁজে পাওয়া
যায়। মেরীর উপাসনা খৃষ্টানগণ মাতা বলে করেন না, হযরত খ্রীষ্টের জননী বলে করেন।
ভারতবর্ষের অনেক স্থানে মাতৃপূজা প্রচলিত তো আছেই, সামাজিক পরিবিন্যাসে হিন্দু
ব্যতীত আরও অনেকে মাতার প্রভাব অস্বীকার করতে পারেন না। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার প্রারম্ভে
অমাবস্যা তারিখে মহালয়ার ক্রিয়াকান্ডের তাৎপর্য বুঝতে সমর্থ হলেই পরবর্তী ষষ্ঠী,
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পূজা এবং বিজয়া দশমীর মধ্যে প্রাচীনকালের ইতিহাসের একটি
বিরাট সমাহার দেখতে পারব।
মাতৃজাতি এক সময় পুরুষদের
মুন্ডমালা ধারণ করেন, শবদেহ পদদলিত করেন, সামরিক শক্তির প্রদর্শনীতে অকল্পনীয়
নিষ্ঠুর হয়েছেন। বিজয়ী পিতৃজাতির আজ বদলা নেবার মওকা এসেছে। যেখানেই মাতৃগণ সংগঠিত
হয়েছে বলে পিতৃগণ অনুমান করেন সেখানেই তাঁরা মাতৃগণের মস্তক ত্রিশূল দিয়ে বিদ্ধ
করেন। মাতৃগণের হাতের গদা ও খড়্গ কেড়ে নিয়ে নিরস্ত্র করেন। স্বভাবতই বিজিতরা
বিজেতাদের কাছে শান্তির প্রস্তাব করেন। পরাজিত মাতৃগণ জাতির অস্ত্র খড়্গাদি গলিয়ে
হাতে ‘নোয়া’ ধারণ করেন, মস্তক বিদ্ধ হবার আগেই সিঁদুর দিয়ে ফোঁটা পরেন এবং সিঁথিতে
সিঁদুর মেখে পরাজয়ের গ্লানি হজম করেন। পরবর্তীকালে পিতৃগণের পুরোহিতরা এই গ্লানি
মুছে ফেলার জন্য নোয়া ও সিঁদুরকে এয়ো চিহ্ন বলে সংশোধিত সংস্কার চালু করেন।
পিতৃতন্ত্রের পুরুষদের শাসন ও শোষন অটুট রাখতে ঋষিরাও অনেক সূত্র ধর্মগ্রন্থে
লিপিবদ্ধ করেন। পিতৃতন্ত্রের শেষ ঋষি মনু তাঁর সংহিতায় ঘোষণা করে গেছেনঃ ‘পিতা
রক্ষৌতি কৌমারে; ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে / পুত্র রক্ষতি বার্দ্ধক্যে, ন স্ত্রীস্বাতন্দ্র্যমহতি।।‘ অর্থাৎ, স্ত্রীজাতি
বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর, বার্দ্ধক্যে পুত্রের অধীন থাকবে।
কিন্তু বিজিতেরা চিরকাল
বিজিতদের ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করতে পারে না। ক্লান্ত হয়ে পড়া উপনিবেশে শান্তি
শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শান্তির ললিতবাণী উচ্চারণ করতে হয়। সমাজকেও নূতন পরিবেশে
নূতন পোষাকে সাজাতে হয়। কিন্তু দুই তন্ত্রের মধ্যে সংঘাত আর সংঘর্ষে গণমানস সহজে
শান্তির অনুকূলে উদবুদ্ধ হয় না। দৈহিক হিংসা বিদ্বেষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে প্রকট
না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে সেসব দীর্ঘস্থায়ী হয়। বিজেতাগণ এজন্য বিজিতের শ্রদ্ধা
আকর্ষণ করতে কিছুটা গোঁড়ামি ত্যাগ করেন, নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংশোধন করেন। এজন্য
সাংস্কৃতিক অভিযান করা আবশ্যক হয়। ভাষা একটি সাংস্কৃতিক অভিযানের সূক্ষ্ম ও মোক্ষম
অস্ত্র। আমরা তাই দেখি, পিতৃ ও মাতৃজাতির বংশধররা একই ভাষায় কথা বলেন।
মন্ত্রোচ্চারণ করেন, শ্লোক ও গাথা রচনা করেন। আর একটি সূক্ষ্ম ও মোক্ষম অস্ত্র হল,
বিজিতদের সান্নিধ্যে আসার জন্য, বিজিতদের পূজা-উৎসব আচার অনুষ্ঠানকে যুগোপযোগী
সংশোধন করা। বিজেতাদের এই কূটনীতি একদিনে সফল না হলেও যুগান্তকারী হয়েছিল।
শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার ষষ্ঠির দিনের আচার আচরণ লক্ষ্য করলে আমাদের বক্তব্য সঠিক
অনুধাবন করা যাবে।
পূর্বেই বলেছি, মাতৃগণ ও
পিতৃগণের মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। সুতরাং ওদের মধ্যে শান্তির প্রচেষ্টা সহজে সফল
হবে না। বুদ্ধিমান পিতৃগণ ভালো করেই এ কথা জানতেন। এজন্য তাদের লক্ষ্য পড়ে
জড়বাদীদের উপরে। মাতৃতন্ত্রের পাশাপাশি এ দেশে জড়বাদীরাও ছিলেন। এরা একান্তে পাথর
ও বৃক্ষ পূজা করতেন, সামান্য উপকরণ দিয়ে। অন্যদিকে পরাজিত মাতৃজাতি ছোট ছোট
ভূখন্ডে নিজেদের উৎসব, পূজা, আচার অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ করে বৈশিষ্ঠ রক্ষার প্রয়াস
করতেন। পিতৃগণ একটি বৃহত্তর সমাজ গঠন করার উদ্দেশ্যে মহালয়ার উৎসবের পরে কদলী ও বিল্ববৃক্ষের
পূজাকে উপলক্ষ করে মাতৃগণের এলাকার বাইরে জড়বাদীদের এলাকায় উৎসব শুরু করে দিলেন।
পিতৃগণ স্থির করলেন, দেবীর মন্ডপে পূজা না করে একদিকে কলাগাছকে তেল সিঁদুর পরিয়ে পূজা
হবে। মহালয়ার জেরটি টেনে এই পূজা ষষ্ঠ দিনে হয়ে যাবে। পুরোহিতরা কলাগাছ ও
বিল্ববৃক্ষের নীচে শালগ্রাম শিলা স্থাপন
করে দেবত্ব আরোপ করে পূজা করবেন। জড়পূজার ভক্তগণ এতে খুশি হয়ে নাট্যকার মন্মথ
রায়ের ভাষায় নিশ্চয় বলেছেন, ‘সম্রাট মহানুভব’। জড়বাদীরা এখনও বটগাছ, তুলসি গাছ,
বেলগাছ পূজা করেন। জড়বাদীদের একখন্ড পাথর শালগ্রাম শিলা তো বিষ্ণু দেবতার অবয়ব।
বর্তমানে বৃক্ষপূজার সংশোধিত রূপ আদিকালের রূপ কিন্তু নয়। বর্তমানে কলাগাছ, ‘কলা
বৌ’, শ্রী গনেশের গৃহিনী। তিনি এখন লালপেড়ে শাড়ি পরে বীড়াবনত দেহে দাঁড়িয়ে থাকেন।
পুরোহিতরা নারীরূপ আরও প্রকট করতে গিয়ে একজোড়া বেল ব্রেসার বেঁধে স্তনের লাবণ্য
এনে থাকেন। জড়বাদীরা না পিতৃতন্ত্রের না মাতৃতন্ত্রের। এজন্য বেচারা কলা বৌ
‘শিড্যুলড কাস্ট’ হয়ে মন্ডপের বাইরে অচ্ছ্যুৎ হয়ে রয়েছেন।
উৎসবটা যখন চালু হয়ে গেল,
মাতৃভক্তগণের অভিমান কমে এলো। সপ্তমী তিথিতে মাতৃজাতি সমবেত হতে রাজি হলেন, তবে
একটি শর্তেঃ তাদের মাটির উপরে তাদের পূজা নিজস্ব পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। গরজ
বড় বালাই। মাতৃগণের এলাকা থেকে মাটি এনে লতাপল্লব, নবপত্রিকা ও নানাবিধ শস্য
উপকরণে মহালয়ার মন্ডপে ধুমধামের সঙ্গে মহামিলনের মাঙ্গলিক আয়োজন সম্পন্ন করা হল।
সপ্তমীদিনের পূজায় ওই মাটি এবং যতরকম নবপত্রিকা, শস্য, লতাপল্লব এই দল ব্যবহার
করতেন, তা আজও সপ্তমী পূজার অপরিহার্য উপকরণ।
মাতৃজাতি ও পিতৃজাতির
সবাই প্রতিমার চালচিত্রে স্থান পেলেন। মাতৃজাতি থেকে এলেন স্বয়ং শ্রীশ্রী দুর্গা,
লক্ষ্মী, সরস্বতী; পিতৃজাতি থেকে এলেন কার্তিক ও গনেশ। গায়ের বর্ণ কৃষ্ণবর্ণ থেকে
লাল, লাল থেকে শ্বেতবর্ণ। তারও ইতিহাস আছে। সে দীর্ঘ ইতিহাস পরে সুযোগ পেলে বলা
যাবে।
পুরোহিতরা এখনও বেশ্যা গৃহ
থেকে মাটি সংগ্রহ করেন। কেননা, বেশ্যার মত কোন নারী আজকাল স্বাধীন নয়। জীবিকার
জন্য তাঁরা দেহপসারিনী, কিন্তু তাঁরা পুরুষের অধীন নয়—তাঁরা ‘নহ মাতা, নহ কন্যা,
নহ বধূ’। বর্তমানে ষষ্ঠী এবং সপ্তমী তিথিতেই প্রতিমা পূজা মন্ডপে আসে। কিন্তু
শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা প্রকৃতপক্ষে অষ্টমীর দিন থেকে শুরু হয়। অষ্টমীতে সন্ধি পূজা
নির্দিষ্ট। এই দিনে মাতৃগণ ও পিতৃগণের মধ্যে সন্ধি হয়েছিল। প্রতিমাতে ওদের দুই
তন্ত্রের প্রতীকও খুঁজে পাওয়া যাবে। মাতৃতন্ত্রের পক্ষে শ্রীশ্রী দুর্গা স্বয়ং, লক্ষ্মী
ও সরস্বতী; পিতৃতন্ত্রের পক্ষে থাকেন কার্তিক ও গণেশ। কৃষির দেবত্ব বিকাশ হয়েছে
লক্ষ্মীর মূর্তিতে। বিদ্যা পিতৃগণের মধ্যে ছিল কিনা জানি না, কিন্তু মাতৃগণের মত
দশমহাবিদ্যার প্রচুর নিদর্শন ‘কীলক, কাচ, সুর্ত্ত, ধ্যান’ প্রভৃতি স্তুতিতে পাওয়া
যায়। সরস্বতী বিদ্যার দেবতা ঐ যুগেও সর্বজনবিদিত। পিতৃগণের জাত্যাভিমানে লাগে বলে
সরস্বতীকে পিতৃগণের মত শ্বেতকায়া করা হল, আর ওদের চোখে পবিত্র বলে প্রতিষ্ঠা করা
হল। যত বড় ঘটা করা হোক, বিজেতাদের আভিজাত্য মানসিক দিক থেকে পার্থক্য টানবেই।
কার্তিক বেচারা কিশোর।
ছেলে ছোকরাদের দিয়ে মিলনের কাজ সাড়া গেল। বেচারা গণেশ একটি বিতর্কমূলক দেবতা। জাতে
মাতৃতন্ত্রের মানুষ। কিন্তু বিপাক হল তার নাম নিয়ে। গণ+ঈশ= জননেতা। বিজিতদের
জননেতা কখনো বিজেতাদের কাছে পূজনীয় নয়। মহাত্মা
গান্ধীর মত জননেতা বৃটিশ সম্রাটের লোকজনের কাছে নেংটা ফকির। মাতৃসন্তানদের জননায়ক
গণেশকে তেমনি হেয় করার জন্য হস্তিমূর্খ বলে চিত্রিত করা হল। হস্তীর মত মুখ
পৃথিবীতে দুর্লভ। মহীরূহকে শুঁড় দিয়ে দূরে নিক্ষেপ করতে পারে যে হাতী, সে সাড়ে চার
হাতের মাহুতটিকে শূঁড় দিয়ে পদদলিত করতে পারে না। সুতরাং বিজিতের জননেতার মাথাটি
হস্তীর মাথাই বটে।
শান্তির বৈঠক ডাকা হয়েছে।
বিজেতা বিজিতের মহামিলন। কিন্তু বিজেতাদের সমরনায়ক বিজয়ী মহাদেব কোথায়?
ত্রিশূলধারী মহাদেব আছেন, তবে অতি ক্ষুদ্রাকায়। সিংহের পেটের নীচে, অথবা
চালচিত্রের মাথার উপরে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙ্গল না।
শ্রীশ্রীদুর্গার নেতৃত্বে
এই সন্ধি বা মহামিলন কোন কোন দুর্দ্ধর্ষ গোষ্ঠী মেনে নিতে পারে নি। মহিষাসুর এই
রূপ এক বিদ্রোহী। মাতৃজাতির কলঙ্ক, ইউরোপীয়দের কাছে ‘কুইসলিং’, বাংলাদেশের
‘কোলাবোরেটর’ এই দেবীর বিরুদ্ধে মহিষাসুর ভীষণ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন। কুইসলিং
ইতিমধ্যে মাতৃসন্তানদের মধ্যে বিভেদ আনতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি লাঞ্ছিত সিংহ ও সর্প সন্তানদের
সহযোগে মহিষাসুরকে আক্রমণ করলেন। প্রতিমায় সেই রূপই ফুটে উঠেছে। সর্প মহিষাসুরের
অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেঁধে ফেলেছে, সিংহ মহিষাসুরের বিশাল পেশীবহুল বাহু কামড়ে ধরেছে আর
মাতৃজাতির কলঙ্ক শ্রীশ্রী দুর্গা পিতৃগণের ত্রিশূল ক্ষেপনে মহিষাসুরের বক্ষভেদ করে
তাকে নিহত করলেন। মাতৃজাতির মহিষাসুরকে মাতৃজাতির দেবী দুর্গা বধ করলেন। এই দেশের
মানুষ কুইসলিং-কে পূজা করতে শিখল।এই যুদ্ধে শ্রীশ্রীদুর্গা নিজজাতি এবং পিতৃজাতির
কাছ থেকে প্রচুর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছেন। দেবী যেন দশবাহু দিয়ে সেই সব অস্ত্রশস্ত্র
ব্যবহার করে দুর্দ্ধর্ষ মাতৃভক্ত মহিষাসুরকে বধ করলেন।
শ্রীশ্রীদুর্গা মাতৃজাতির
অবশেষ। তিনি কৃষ্ণকায়া, পিতৃজাতির পুরোহিতরা কৃষ্ণকায়াকে দেবী বলে পূজা করতে লজ্জা
পেতেন। আজ শ্রীশ্রীদুর্গার প্রতিমা এজন্য পিতৃজাতির জনৈকা নারীর মত, শ্বেতকায়া।
সঙ্গে সঙ্গে মাতৃজাতির সরস্বতীও বিদ্যার্থীদের হাতে পড়ে শ্বেতকায়া হয়ে গেলেন।
কার্তিক শ্বেতকায় জাতির রূপবান যুবক।
নবমী-তিথিতে
শ্রীশ্রীদুর্গা পূজা মূল পূজার জের টেনে সমাপ্ত হয়। সামন্তযুগে ব্যবসা বাণিজ্যে
নিযুক্ত ব্যবসায়ী য় মুৎসুদ্দিরা একে রাম নবমীতে পরিণত করে হালখাতা খোলেন। অষ্টমীতে
যে সমুদয় পশু বলি হত, তার ভোজপর্ব আজকার দিনেও চলত। নবমীতে পূজা শেষ।
ধুমধামের সঙ্গে প্রতিমার
মুখ পিছন করে নদী বা দীঘিতে বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হল। উপনিবেশবাদীদের কূটনীতি
সফল হল। পিতৃজাতির পুরোহিতদের সাংস্কৃতিক বিপ্লব সফল হল। পরস্পর পরস্পরের
কোলাকুলিতে খুসীর পরিসীমা নেই। বিজেতাদের জাতীয় উৎসবে এখন বিজিতদের স্বকীয়তা
হারিয়ে যাচ্ছে।
বিজিতদের মধ্যে স্বাধিকার
প্রতিষ্ঠার জন্য মহিষাসুরের যুদ্ধ একটি মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা। শ্রীশ্রীদুর্গা
মহিষাসুরকে বধ করেই ক্ষান্ত হন নি, মাতৃজাতির মধুকৈটভ, শম্ভু-নিশম্ভু, ধুম্রলোচন,
চন্ডমুন্ড, রক্তবীজ প্রভৃতি অগণিত বীরশ্রেষ্ঠদের বধ করেন। কাব্য, নাটক, মহাকাব্য,
পুরাণে, উপাখ্যানে এদের অসুর বলে চিত্রিত করা হলেও তাঁদের শৌর্য বীর্য কলঙ্কিত করা
সম্ভব হয়নি। এইভাবে বিজিতদের দিয়েই বিজিতদের স্বর্ণসিংহাসন নিষ্কন্টক হয়েছিল।
জাতিপ্রেমের তাজা ফুলগুলি ঝরে গিয়ে বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
পিছন দিকে প্রতিমার মুখ
করে বিসর্জনের মিছিল সম্বন্ধে রমেশচন্দ্র মজুমদার একটি দ্রাবিড়ী প্রথার উল্লেখ
করেছেন। মাদ্রাজের পাহাড়ে জঙ্গলে বহু দ্রাবিড় জাতি এখনও তাদের নিজ সংস্কৃতি রক্ষা
করে আসছে। এরা তাঁদের বৃক্ষ দেবতাকে তেল সিঁদুর দিয়ে চিত্র বিচিত্রিত করে—পশুপাখী
বলি দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে পূজা করে। পূজা
শেষে কাঠের দেবতাকে ঢাক ঢোল সানাই প্রভৃতি বাজিয়ে গ্রামের দিকে মুখ করে একেবারে
গ্রামের সীমানায় পুঁতে খাড়া করে রাখে। তাদের বিশ্বাস, সারা বছর ঐখানে দাঁড়িয়ে
দেবতা জ্বরা মাহামারী রোগ শোক তাপ জ্বালা থেকে গ্রামকে রক্ষা করবেন। জনগণের চাপে পুরোহিতরা
দ্রাবীড়ীদের আদি বাস বাস বঙ্গভূমি থেকে বিলুপ্ত করতে পরেন নি ঐ দ্রাবিড়ী প্রথা।
_____________আমার পিতা
পণ্ডিত বরদাভূষণ চক্রবর্তী, কাব্যতীর্থ, রাষ্ট্রভাষাবিশারদের রচনা। পণ্ডিতসমাজের
এক আসরে পঠিত। নিউ জলপাইগুড়ি, ১১ আশ্বিন, ১৩৭৮ (মহাষ্টমী), ২৮ সেপ্টেম্বর,১৯৭১________________________