My Readers

Wednesday, April 3, 2013

আমজাদীয়ার ফরিদ মিঞা






আমজাদীয়ার ফরিদ মিঞা

ফরিদ, সিরাজ, মস্তান... আর কোনো নাম মনে পড়ছে না, তবে মুখগুলো মনে আছে। ষাটের দশকের শুরুতে মির্জাপুরের আমজাদীয়া রেস্টুরেন্টের বেয়ারা ছিল এরা। এখন আমজাদীয়া নেই। ভিতর-বাহির পালটে কিছুদিন চলল অন্য নামের রেস্টুরেন্ট হিসেবে, পরে আর এক নাম, শেষটায় বন্ধ এখন।

আমার মতো কিছু চালচুলোহীন মানুষেরসেকেন্ড হোমছিল এই আমজাদীয়া। চা ছাড়া আমার পক্ষে বেশি কিছুর খরিদ্দার হওয়া সম্ভব ছিল না। তবু শ্রদ্ধা-স্নেহ হাসি-মস্করায় বেয়ারাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতাম আমরা।  আমার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ঋজুদেহী ফরিদ মিঞার। উত্তরপ্রদেশ আর বিহার সীমান্তের কোন এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সে এসেছিল কলকাতায় দশ বছর বয়সে। এসপ্ল্যানেডের আমিনিয়ায় টেবিল সাফাইয়ের কাজ নিয়ে। পরে, বড় হয়ে আমজাদীয়ায়।

আমার বয়স সতেরো-আঠারো, যখন ফরিদের সঙ্গে পরিচয়। থাকতাম আমজাদীয়ার উলটো দিকের রেল কলোনির এক সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। পড়তাম আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের রাতের সিটি কলেজে (আনন্দমোহন কলেজ), প্রি-ইউনির্ভাসিটি। দেহশ্রম আর মেধাশ্রম এই দুই ছিল আমার অর্থোপায়ের উৎস। ফরিদ কী ভাবে যেন তা টের পেয়ে যায়। বয়সে সে আমার দ্বিগুণ হলেও বন্ধুত্বের সেটাই কারণ। কেননা, কলকাতার মতো সর্বগ্রাসী মহানগরে আমাদের দুজনের জীবনসংগ্রাম ভিন্ন ছিল না।

ফরিদের বাবা নিরুদ্দেশ ছিলেন। মামাবাড়ির ছায়ায় মা- দুঃস্থতার অবসান হয়নি। তাই গ্রামের এক বয়স্ক, কলকাতার আমিনিয়ার বেয়ারা, ফরিদকে নিয়ে আসে কলকাতায়।

আমিনিয়া তখন নামকরা হোটেলও বটে। ফরিদ প্রথম কাজ পায় এর হোটেল অংশে। একদিন সেখানেই পরিচয় হয় রেঙ্গুনের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সেই ব্যবসায়ী হোটেলের ছাদে, রাতে, আড্ডা দিতেন, কখনো সখনো বেয়ারাদের সঙ্গেও। কলকাতায় তাঁর পাকা ঠিকানা ছিল এই আমিনিয়া। একবার এমন আড্ডাতেই ফরিদের আদি জেলা আর গ্রামের নাম শুনে বলেছিলেন, ‘আমার এক বন্ধু তোদের গ্রামের লোক। তোর আব্বার নাম কী?’ অবাক কান্ড, ফরিদের বাবার নামের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল তার বন্ধুর নাম। ফরিদের বাবা নিরুদ্দেশ শুনে তিনি আরো খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছিলেন।

কিন্তু তবু ফরিদ তার যুবা বয়েস পেরিয়েও থেকে গেছে একজন বেয়ারা। পরে বিয়ে করেছে। কলাবাগানের কাছাকাছি এক ডেরায় থাকত নিঃসন্তান স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই ধর্মপ্রাণ। পবিত্র কোরানের বাণী মেনে অভুক্তকে না খাইয়ে দুজনে দাঁতে কাটত না কোনো রুটির টুকরোও। কোনদিনই না। আর এজন্যেই, আমজাদীয়ার বেয়ারাদের বরাদ্দ সকালের এক কাপ চা দু-ভাগ করে আমি আর ফরিদ খেতাম। ফরিদের পুণ্যি হত। ঈদের দিন আমার না-দেখা ভাবিজী ভাঁড় বর্তি করে পাঠাতেন সেমাই। ফরিদ প্রায়ই বলত, ‘আপ বড়ে হোঙ্গে, ম্যায় আপকা বাবুর্চি বনেঙ্গে। হম দোনো আপকে লিয়ে বঢ়িয়া সে বঢ়িয়া খানা পকায়েঙ্গে।


ফরিদের গল্পে ফিরে আসি। পরের বার সেই ব্যবসায়ী ফরিদের জন্য একরাশ উপহার নিয়ে এলেন। আব্বাজানের ছবিও। অনেক টফি, জামাকাপড়, খেলনা। নতুন জামাকাপড় পরিয়ে কিশোর ফরিদের ছবি তুলে নিয়ে গেলেন তিনি। ফরিদ গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের হাতে পাঠিয়ে দিল মা- উপহারগুলো। তারপর নিজে গ্রামে গিয়ে মা- সঙ্গে কাটাল কয়েকটি সুখী দিন-রাত।

এভাবেই কাটতে থাকে দিন। বাবার প্রতীক্ষায় থাকে ফরিদ। আমিনিয়ার কাজ ছাড়ে না। বলে, ‘আব্বাকে কাছে না-পেলে কাজ ছাড়ি কী করে? পাঠানো টাকা-পয়সা পোস্টাপিসে জমাতে থাকি।কেটে গেল বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর, বিশ বছরও। মা মারা গেলেন। বাবার ছবি বুকে সেঁটে বড় হয়ে গেল ফরিদ। টেবিল বয় থেকে উর্দি পরা বেয়ারা।

এমন সময় রেঙ্গুন থেকে ভারতীয়দের ঢল নামতে থাকে ভারতের মাটিতে। খবর এলো, ফরিদের বাবা দমদমে নামবেন শনিবার। দুই দশকের ভিতে তোলা বাবার মূর্তিটাকে মাথায় গেঁথে ফরিদ বিমানবন্দরে পৌঁছে যায় অনেক আগেই। আব্বাজান এলেন, নামলেন, এগিয়ে এলেন। হাতে খাপে-বন্দী হুইস্কির বোতল ঝুলছে। বললেন, ‘জিনিসপত্র নিয়ে তুমি আমিনিয়ায় যাও। আমি ময়দান ঘুরে আসছি।
এরপর ফরিদের আর্তিটা এখনও কানে বাজে, স্পষ্ট।হারুনবাবু, শরাবী আঔর জুয়ারি কি দিল মে প্যার কভী নহি বস সকতা।এই বিশ্বাসে অটল ফরিদ একটিও রাতও কাটায়নি তার বাবার সঙ্গে। আমিনিয়া ছেড়ে আমজাদীয়ায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে। এভাবেই কুড়ি বছর ধরে স্বপ্নে দেখা বাবাকে সে পরিত্যক্ত কাগজের মতো দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়েছে। বিয়ের সময় অনেক উপহার আর টাকা দিতে এসেছিলেন বাবা--- ফরিদ নেয় নি। দারিদ্র্যকেই বন্ধু করেছে খাঁটি ধর্মপ্রাণের মতো।


আমার সঙ্গে ফরিদের দেখা এই সময়। অর্থাৎ যখন সে সর্বত্যাগী একটি আত্মবিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ আর আমি-- অনুজ, দেশান্তরী, চালচুলোহীন এবং মানবতার আশায় ভিক্ষা-দাঁড়ানি।
আমাদের সম্পর্ক বছর ছয়-সাতের বেশি ছিল ন। কেননা, ওই সময়ের মধ্যে মির্জাপুরের আমজাদীয়ার মালিকানার বদল হয়েছে, পালটে গেছে তার ইসলামী কারুকার্যের দেওয়াল, হারিয়ে গেছে চাঁপের খুশবু, ফিরনির মিঠাস, বিরিয়ানির স্বাদ আর চায়ের আভিজাত্য। একদিন মস্তানকে দেখলাম, চাঁদনির ব্রাঞ্চে। সিরাজকে ডালহৌসি পাড়ার এক রেস্তোঁরায়। দুজনের কেউই বলতে পারল না ফরিদের ঠিকানা। জানাল, ওয়াটগঞ্জের কোথাও সে কাজ করে।বালাবাচ্চা হয় নি। কিন্তু কোথায় তাকে পাওয়া যাবে, বলতে পারল না কেউ। ঠিক এই সময়ই ঘটল আমার শহর-বদল। এলোমেলো হয়ে গেল আরও  কিছু সময়।

কতদিন পরে জানি না। একবার কলকাতায় গিয়ে সিরাজকে খুঁজে বের করলাম। শুনলাম, আমি ফরিদের খোঁজ করছি শুনে সেও হন্যে হয়ে খুঁজছে আমায়। কিন্তু ঠিকানা কোথায়? কাইজার স্ট্রিটের সার্ভেন্টস কোয়ার্টার ছেড়ে এক টিউটোরিয়াল হোমের কোণে, সেখান থেকে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের রুবি বোর্ডিং, বেলেঘাটা, দিল্লি--- আমার হদিশ সে পায় নি শত চেষ্টাতেও। সিরাজ জানাল, ফরিদ মারা গেছে অভাবে, যক্ষ্মায়। তার স্ত্রীকে আব্বাজান অনেক টাকা পয়সা দিতে পেরেছিলেন ফরিদের মৃত্যুর পর, আগে নয়। এদের খবর তখন সিরাজের জানা নেই।

ইদানীং কলকাতায় কোনো পরিবারের সম্মিলিত মদ্যপানের আসরে উপস্থিত থাকলেই ফরিদের কথা মনে পড়ে। এই দশকে অভাবে তার মৃত্যু তো হতই না, বরং ফরিদ মিঞা যথার্থই একদিন ফরিদ খান হয়ে উঠতে পারত।
­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­_______________________________

No comments: