My Readers

Friday, August 9, 2013

দৈনিক প্রতিদিন ও বাংলা সাংবাদিকতা



আজ আগস্ট। ১৯৯২ সালের এই দিনে কলকাতার কাগজ, ‘সংবাদ প্রতিদিন যাত্রা শুরু হয়েছিল।

আমি তখন দিল্লিতে, ১২ বছর। যুগান্তরের দিল্লি অফিসে্র দায়িত্বে ছিলেন এক সুভদ্র মানুষ, কমল ভট্টাচার্য। বেশ কয়েক বছরের পরিচিত। একদিন জানালেন, নতুন কাগজ বের হচ্ছে কলকাতায়। অঞ্জন এডিটর, সার্বিক দায়িত্বেও সেই- কমল বলল, ‘আপনাকে এই কাগজে সপ্তাহে একটা করে কলাম লিখতে হবে, দিল্লি কেন্দ্রিক। অঞ্জন বলে পাঠিয়েছে।

অঞ্জন বসু। আমার অনেক দিনের পরিচিত। আনন্দবাজারে থাকতেই। তখন ট্রেইনি। পরে সারকুলার রোডের যুগান্তরে। অঞ্জন ব্রিলিয়ান্ট নিউ ফেস ইন জার্নালিজম, আমি মানতাম। আমার কথায় পূর্ণ সায় দিয়েছিলেন অঞ্জনেরই জয়েন্ট এডিটর, বাংলা সাংবাদিকতার আর এক প্রবাদ-প্রতীম সাংবাদিক, অমিতাভ চৌধুরি। আমি তাই অঞ্জনের ফোনের অপেক্ষা না করেই রাজি হয়ে গেলাম। কাগজের ডামি থেকে শুরু করে ২০০৪ অবধি, প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখেছি ওই কাগজে। কয়েক বছর তো দুটো করে, একটা আর্ট ক্রিটিক হিসেবে এর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল আরো একটা, ‘সান্ধ্য প্রতিদিন’- জন্য।

এত কথা বলার কারণ, সংবাদ প্রতিদিনের প্রথম ১২ বছরের নানা অবস্থানের সঙ্গে আমার পরোক্ষ, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল, সেটা বোঝাতে।
কাগজটা বেরুবার কিছুদিনের মধ্যে ট্যাংরার এক পাটের গুদামের একাংশেপ্রতিদিনঅফিসে যেদিন প্রথম ঢুকলাম, দেখি, ব্যস্ত করিডোরের এক পাশে সার বাঁধা টেবিলে সার বাঁধা কিছু সাব এডিটর- রিপোর্টার, উলটো দিকে, খুব বেশি ৬ফুট বাই ৪ফুট প্লাইউডের পার্টিশনের ভেতরে ছোট্ট টেবিলের এক পাশে অঞ্জন, আর উলটো দিকে দুটো চেয়াড়। দৈনিক প্রতিদিনেরএকজিকিউটিভ এডিটর’- চেম্বার।

বছর খানেকের মধ্যে অঞ্জন বাংলা সাংবাদিকতার মুখটা পাল্টাতে শুরু করল। আমরা দেখতে পেলাম, বাংলা সাংবাদিকতার খবরের কাগজকে সে পালটে দিচ্ছিল এক নতুন দিশায়, খবর-তথ্যের কাগজে। অঞ্জনের পাঠককুল অজান্তেই ক্রমশ ওয়াকিবহাল হয়ে উঠছিল খবরের চারপাশে ঢাকা পড়ে থাকা নানা তাজা তথ্য সম্পর্কে। মনে আছে, আমি তখন শিয়ালদা স্টেশনের অদূরে এক হোটেলের পাঁচ তলায়, শিয়ালদা স্টেশনের আনেকখানি জায়গা দেখা যায়। বিনা টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে রেল পুলিশের সংঘর্ষ, গুলি, মৃত্যু। আমার চোখের সামনেই। অঞ্জনকে ফোন করে জানলাম, খবর পৌঁছে গেছে। পরদিন সকালে বেশ কিছু কাগজ কিনলাম, সবার থেকে আলাদা দৈনিক প্রতিদিন। নিখুঁত। শুধুমাত্র খবর নির্ভর নয়, তথ্য নির্ভর। আমি বাংলা সাংবাদিকাতার েই নতুন রিপোর্টিং শৈলীতে অভিভূত। ফোন। দু হাত তুলে অভিনন্দন। বুঝলাম, রিপোর্টার হিসেবে নয়, মূলত সে স্টেশনে তার ছেলেদের পাঠিয়েছিল পাঠক হিসেবে।

প্রথম থেকেই অঞ্জন আফটা্র-এডিট পেজকে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব। নানাজনের সাপ্তাহিক কলামে সে সাজাতো সংবাদ, তথ্য বিশ্লেষণের সম্ভার, যা অলক্ষ্যে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত পাঠকের দৈনিন্দিন বৌদ্ধিক সমৃদ্ধির চাহিদা।

বলতে দ্বিধা নেই, অঞ্জনের হাতেই বাংলা সাংবাদিকতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের বৌদ্ধিক তথা ধার্মিক তথ্যের পরিবেষণ প্রথম গুরুত্ব পায় দৈনিক প্রতিদিন- প্রথম নিয়মিতভাবে সম্প্রদায়ের নানা ধার্মিক অনুষ্ঠানের খবর, তথ্য বিশ্লেষণ যথযথ বিশদে, কোথাও কোথাও ছবিসহ ছাপত।

বাংলা সাংবাদিকতায় অঞ্জন চালু করেছিল সম্পাদকের দায়বদ্ধতার কলাম। পাঠকরা খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করতেন পরিবেশিত কোন খবর বা ছবির যৌক্তিকতা, যথার্থতা নিয়ে। অঞ্জন নিজে এই সব প্রশ্নের মুখোমুখি হত, প্রকারান্তরে পাঠককে সে হাত ধরে নিয়ে যেত, রিপোর্টিং টেবিলে, সাব-এডিটরের ডেস্কে, এডিটরের টেবিলে, এমন কি সম্পাদকদের মিটিং-এর সিদ্ধান্তের মুহূর্তেও।

এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন বছর সাত আটের মধ্যে দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন বাংলার তৃতীয় বৃহত্তম কাগজ হিসেবে আনান্দবাজার আর বর্তমানের পরেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল আর কেনই বা এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মালিক তথা অন্যান্য লগ্নীকারকরা একটি শিশু কাগজ’-কে নিয়ে ফাটকা খেলতে এগিয়ে আসছিল।
এক সময় বাইরের কাগজ থেকে, অপটূ ব্যর্থ সাংবাদিকরা ভীড় জমাতে শুরু করল প্রাতিদিনের চারপাশে, অঞ্জনের অগোচরে। অসাংবাদিক ব্যবসায়ী মালিক সাংবাদিক হবার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন, খুঁজতে লাগলেন সম্পাদক হয়ে বকলমে কাউকে বাগে পাওয়া যায় কিনা। বাংলা সাংবাদিকতা্য় দখলদারির লড়াইয়ে স্বার্থপরতা কোন নতুন পন্থা নয়।

অঞ্জন বসু, প্রতিষ্ঠাতা দিশারী কার্যনির্বাহী সম্পাদককে তার চেম্বারে বন্দী শাহজাহান করে আনান্দবাজার ফেরত এক সাংবাদিক নবীন মালিকের বকলমে কাগজের হাল ধরলেন। অঞ্জনের হাতে গড়ে তোলা বাংলা সাংবাদিকতার নতুন নেশা বদলে গেলো পুরানো পেশায়, অসাংবাদিক পেশাদারিত্বে। অঞ্জন বসু পদত্যাগ করলেন  না। নানা কথায় মনে হল, বিতাড়িত না হলে, সন্তানের নাড়ি কেটে বেরুবে না বাংলা সাংবাদিকতার এই তৃতীয় প্রবাদ প্রতীম সাংবাদিক। নবীনরাও দুর্ণামের ভয়ে তাকে বিতাড়িত করলেন না। মাসে প্রতি দিন আট ঘন্টার ডিউটিতে অঞ্জন সপ্তাহে একটি সম্পাদকীয় লেখার দায়িত্ব পেলো মাত্র।

এরপর আর যোগাযোগ হয় নি কারো সঙ্গে। একটি ঐতিহাসিক ফেনোমেনাল সাংবাদপত্র কী করে আজকেরদৈনিক সংবাদ প্রতিদিন’- রূপান্তরিত হল, তাও খেয়াল করিনি আর।

সাংবাদিকাতার একজন হিসেবে শুধু মানি, বাংলা সাংবাদিকতার তিন মোড়ের তিন ট্রাফিক পুলিশের শেষ জন হলেন এই অঞ্জন বসু। বাকি দুজনের প্রথম জন সন্তোষকুমার ঘোষ, দ্বিতীয় জন অমিতাভ চৌধুরি।

---------------------------------------------------


No comments: