My Readers

Monday, August 12, 2013

রাজধানী এক্সপ্রেসের স্টুয়ার্ড নির্মল বোসকে মনে পড়ে আজও




ট্রেন ছাড়তে তখন বেশ দেরি। প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছিলাম। আচমকা একজন বেঁটেখাটো লোক আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘কতদিন দেখি না, দাদা!’ বুক থেকে তাঁকে আলগা করে চেয়ে দেখি, অবাক কান্ড! সেকেন্ড দুই পরেই বুঝতে পারি, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্টুয়ার্ড, আশির দশকের সুদর্শন, সুকন্ঠ, উষ্ণ হৃৎপিণ্ডের মানুষটি সময়ের তফাতে একটু অন্যরকম হয়ে গেছেন। বুকের মধ্যে কী একটা মোচড় খেল, কী যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরছে, টের পাই। মিথ্যে কথা বলি, ‘আরে মশাই, এখনও সৌন্দর্যটাকে মলিন হতে দিলেন না? খাচ্ছেনটা কী? রাজধানী এক্সপ্রেসের খাবারটি তো আর তেমনটি নেই!’ লক্ষ করলাম, মানুষটির সব বদলেছে, শুধু হাসিটা নয়। বললেন, ‘সে আপনার চোখের দোষ। আমি আলবৎ তেমনটা নেই।

ট্রেন যখন ছাড়ল হাল্কা নীল কাচের ওপারে তখনও চলন্ত পৃথিবী দৃশ্যমান। আমার মাথায় কেন যে গেঁথে গেছে স্টুয়ার্ড নির্মল বোসের ছবিটা, সরাতে পারি না। নীরবে ছুটে চলা বাইরের দৃশ্যগুলোর মতই ধেয়ে আসে ওর সঙ্গে প্রথম আলাপের স্মৃতিটি।

১৯৮৫। সেবার কোথাও জায়গা নয়া পেয়ে রাজধানীর প্যান্ট্রি কারে একটা সিট মিলেছিল। রাজধানীতে তখন চেয়ার কার ছিল। ট্রেনটাও চলত দু-ভাগে। মাঝখানে জেনারেটর। সামনের ভাগের সঙ্গে পেছনের ভাগের যোগাযোগ বলতে ইন্টারনাল টেলিফোন। ট্রেন ছাড়ার বেশ খানিক্ষণ পরে শুনি হই হট্টগোল, উত্তেজনা। উৎকন্ঠার শোরগোলই বেশি। এক সুদর্শন স্টুয়ার্ড কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্রকে আশ্বস্ত করতে ঘেমে নেয়ে উঠছেন। সামনের ভাগে তাদের দামি দামি মালপত্র। ভেবেছিল কোন একটা কামরায় উঠলেই সেখানে যাওয়া চলবে, কিন্তু এখন উপায়? সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পরে কানপুর, তার আগে ট্রেন থামবে না।

নির্মল বোস প্রথমে তাদের কফি খাওয়ালেন। তারপর একজনকে সঙ্গে নিয়ে ফোনে ফোনে অন্যভাগের সঙ্গে কথা বলে একজন রেলকর্মীকে ওদের সিটের আশেপাশের মালগুলিকে আইডেনটিফায়েড করিয়ে, পাহারায় বহাল রাখলেন। বাংলাদেশী ছাত্রদের সে কী নিশ্চিন্তির উল্লাস! ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, ভারতের সর্বত্রই এই নিশ্চিন্তির আশ্বাস মেলে, বিষয়ে ওরা স্থির।

ফেরার ট্রিপে আমি নির্মল তার সহযোগিদের জন্য উপহার এনেছিলাম, ‘অন বিহাফ অফ অল দ্য প্যাসেঞ্জার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ডএগুলো আপনারা গ্রহণ করুন।সেইও থেকে আমি ওদের পরিচিত। প্রতি ট্রিপেই একটা বাড়তি নমস্কার, এক টুকরো বাড়তি হাসি আর এমন হৃৎপিণ্ডের অধিকারী হয়ে গেছি সেই থেকে।

সবার সঙ্গে তো সবসময় দেখা হয় না। এক দু-বছর বাদে কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়। এবার, নির্মল বোসের সঙ্গে দেখা, অনেক বছর বাদে। বছর পাঁচেক তো বটেই, বেশিও হতে পারে। বেশ বুড়িয়ে গেছেন। মাথার পিছনে টাক। কোঁকড়া চুলের ঝোপ হাল্কা। হাতের চামড়াও হয়েছে ঢিলে। গায়ের রঙের উজ্জ্বলতা কিছুটা ফিকে। কষ্টবোধ করছিলাম।

ঘন্টা দুয়েকের জার্নি কাটতেই নির্মল বোসের খোঁজে বের হই। কতটা বুড়ো হয়েছে সে, এককালের সুদর্শন, ভরাট আন্তরিক কণ্ঠের অ্যানাউন্সারের উচ্চারণে কতটা কাঁপন লেগেছে, কতটা ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে এককালের টগবগেমানুষটাকে--- দেখতে জানতে বুঝতে ইচ্ছে করছিল খুব। ট্রেনের গতির উলটো স্রোতে হাঁটতে হাঁটতে যখন আমি ক্লান্ত, দেখি, একদল যাত্রী উত্তেজনায় কী সব বলাবলি করছে।দেশের সম্মান’, ‘সোনার ছেলেমেয়ে’, অকর্মণ্য সরকারইত্যাদি নানা শব্দ ট্রেনের শব্দকে ছাপিয়ে ঘট ঘটাং আওয়াজ তুলছে। থমকে দাঁড়াতেই দেখি, অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে একটি মান্যুষের বিরুদ্ধেয়া, তার মাথার পিছন টুকু দেখা যাচ্ছে, বসে আছেন, মাথায় টাক। এবং চিনে ফেললাম, নির্মল বোস। আমি যাত্রীদের ভিড়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখে দেখতে থাকি। ট্রেন জার্নিতে ঝগড়া-টগড়া আমার দারুণ লাগে। এমন তাৎক্ষণিক এন্টারটেইনমেন্ট আর কিছুতে পাই না।

বোঝা গেলদেশের চার অ্যাথেলিটশ্রীলঙ্কার সাফ গেমস থেকে যাঁরা তিনটি সোনা, দুটি রূপা আর দুটি ব্রোঞ্জ জিতে কলকাতায় যাচ্ছে পরদিন এশিয়াডের ফাইনাল সিলেকশনে ভাগ নিতে, রেল তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েও রিজার্ভেশন দেয় নি। তাই  তাঁরা রাজধানীর কঠোর নিয়ম লঙ্ঘন করে ট্রেনে উঠেছে, বাথরুমের পাশে বসে যাব, খাবার চাই না।

এককালের সুদর্শন এবার কী করবেন? আমি মজা দেখতে থাকি। কিন্তু কাহিনী আরও জটিল। হাইজাম্পে সোনা আর রূপা জয়ী জে সি টমাস নির্মল বোসকে ধরে এনেছে। কেননা, প্ল্যাটফর্মে ওদের বিপদের কথা শুনে নির্মলই বলেছিল, ‘ট্রেনে উঠে পড়। তোমরা কলকাতার মিটে আংশ নিচ্ছই। প্রমিস। ভয় পেয়ো না।

২০০ মিটারের রূপা পাওয়া আর কিষণ, তিন হাজার স্টেপলে সোনা আর ব্রোঞ্জ জেতা অরুণ ডি-সুজা আর লং জাম্পে সোনা আর ব্রোঞ্জ পাওয়া জি জি প্রমীলা নিজেদের মেডেলগুলো বোসের সামনে মেলে ধরে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলছে, ‘তুমি বললে চড়তে আর ওরা বলছে নামিয়ে দেবে। এখন কী করব?’ যাত্রীরা নির্মলকে ছিঁড়ে খায় আর কি! রেলের খেলা বিভাগের গাফিলাতিই হোক, বা প্রোটোকলের কিংবা প্রেস-বিভাগের, হাতের কাছে রেল বলতে তো রেলের কোনো না কো্ন কর্মী। এক সময় ছোটখাট মানুষটা নিজেকে বাঁচিয়ে খাড়া করলেন। বললেন, ‘তোমরা যাবেই যাবে। আমি তোমাদের মিল দেব। তোমরা শান্তিতে ঘুমাও। খাবার পাঠাচ্ছি। সেভ ইওর এনার্জি। ইউ মাস্ট উইন। শুধু কলকাতায় নয়, এশিয়াডেও।

নির্মল ওদের মেডেলগুলো ফেরত দিতে দিতে হাসতে থাকে আর আমি দেখি, নির্মলের সব পালটালেও ওর একটা জিনিস পালটায় নি, সেটা ওর বুকে সাঁটা মেডেলটা। ওই মেডেলটায় লেখা আছেএন কে বাসু


*দৈনিকসংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায়  আমার সাপ্তাহিক কলাম’ ‘কতকথা’-য় প্রকাশিত। ২১ নভেম্বর, ১৯৯৮। এই বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে নির্মল বসু বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন।
*এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পরে, নির্মল অবসর নেন। পরে ক্যান্সারে মারা যান। কর্মরত অবস্থাতেই  বিপত্নিক হয়েছিলেন।