বাস স্ট্যাণ্ডে নয়, মধুদা দাঁড়িয়ে আছেন আরো একটু এগিয়ে পঞ্চশীল ক্লাবের গেটের সামনে। একই সময়ে। অর্থাৎ, পৌনে ছ-টা থেকে ছ-টার মধ্যে। এখানে মধুদা কখনো মধুদা দাঁড়ান না। তা ছাড়া, গত মাস দুই-তিন মধুদা এ-পথেও আসেন না। তাই তাঁর পরিচিত শরীরটা চোখে পড়ামাত্র আশে পাশের গাড়িকে সামলে এড়িয়ে ব্রেক কষতে কষতে অনেকটা এগিয়ে যাই। গাড়ি থেকে নেমে দেখি, দূরে, পরিচিত ভঙ্গিতে, তিনি পশ্চিমের অস্তরাঙা আকাশমুখো দাঁড়িয়ে। পিছনে দুহাত দু হাতে সঁপে দিয়ে, বুক টান, দৃপ্ত ভঙ্গি। মধ্যদার বয়স ৮৫ তো বটেই, বেশিও হতে পারে। কানে কম শোনেন। ডেকে লাভ নেই, তাই গাড়ির ডোর লক ঘুরিয়ে এগিয়ে যাই।
মধুসূদন ভট্টাচার্য। এককালের পণ্ডিত, এখন সভা ভন্ডুলের রাজা। সবাই আতঙ্কে থাকেন। সভায় এক একজন বক্তাকে নাজেহাল করে ছাড়েন। কেউ মুখ টিপে বলেন ‘পাগলা’। কেউ বলেন ‘নুইসেন্স’। কেউবা ওঁকে অগ্রাহ্য করে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘ওঁর কথা ছাড়ুন, আপনি বলে যান!’
আমার কাছে মধুদা গুণীজন। সেন্সিটিভ। ডিসিপ্লিনড। এবং সর্বোপরি তাঁর সামাজিক চেতনার আভিজাত্য। বৃটিশ আমলের সরকারী অফিসার। প্রবাসী বাঙালি চরিত্রের প্রতিভূ। অসংখ্য বিষয়ে সমান আগ্রহ। প্রখর স্মৃতিশক্তি। শুদ্ধবাদী। অসম্পূর্ণতাকে ঘৃণা করেন। একবার, এক সভা পরিচালনার সময়, বিষয় সম্পর্কে আমার হোমওয়ার্ক কম থাকায়, সবার সামনে মাইক কেড়ে নিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘গেট ডাউন। সভার সঞ্চালক হতে গেলে উপযুক্ত পড়াশুনো করে এসো।‘ সেদিনের মতো অপ্রস্তুত আর কোথাও হই নি।
এমন মানুষটাকে রোজ অফিস ফেরার পথে লিফট দিই। হাউজ খাসে তাঁর বাড়ি। বিকেলে ৭ কিলোমিটার দূরে চিত্তরঞ্জন পার্কে যান বাজার করতে। নয়ত কালীমন্দিরে বৃদ্ধদের আড্ডায় সামিল হতে, কিংবা বাংলার স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও পলিটিক্যাল কলামনিস্টদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। বাড়ির বাগানের লাউ, কুমড়ো, নয়ত কলা, আম এসব নিয়েও যান বাঙালি পাড়ায় ভালোলাগার মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে।
মাস দুই-তিনেক মধুদাকে লিফট দেয়া হয়নি। মাঝখানে দু-তিনবার ফোনও করেছিলাম। জানিয়েছিলেন, ‘বয়স হয়েছে ভাই। রোজ আর শরীর দেয় না। তোমার গাড়ি ধরতেও তো প্রায় পৌনে কিলোমিটার হাঁটতে হয়! বাড়িতে বসেই বই পড়ে কেটে যাচ্ছে সময়।‘ দীর্ঘস্বাস ফেলে আরও বলেছিলেন, ‘আসতে চাও, আসতে পার। কিন্তু বকবক করতেও আর শরীর দিচ্ছে না। ছেলে বউমা শাসনে রাখছে।‘ স্বভাবতই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। সেই মানুষটাকে ঋজু ভঙ্গিতে আবার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাকই হয়েছিলাম তাই।
যেহেতু বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে নন, তার মানে, চিত্তরঞ্জন পার্কের বিকেলের আড্ডায় এখনো যাতায়াত শুরু করেন নি। অসুস্থ? তাও সম্ভব নয়। এটা ডাক্তারদের পাড়া নয়। তবে হয়ত পড়ন্ত সূর্যের লাল ছটায় মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু এখানে কেন? প্রিয়-অপ্রিয় মানুষটাকে কেন্দ্র করে এমন নানা প্রশ্ন ঘিরে ধরছিল।
পিছন থেকে হাত ধরে টান দিই। চমকে যান না। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ান। আমাকে দেখেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, ‘এই যে তুমি! ভালোই হলো। গাড়ি কোথায়? ঠিক আছে। একটু অপেক্ষা করো। আমি আমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি।---যেন গত ক-দিন নিয়মিত যাচ্ছেন আমার সঙ্গে।
আমি বলি, ‘তাহলে সাইড লেনে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছি, আপনি আসুন। টেক ইওর ওন টাইম।‘--আমি চলে যাই গাড়ির কাছে। গাড়ি নিয়ে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আমার গাড়িটা নিচু। ড্রাইভিং সিটে বসে মধুদার পেট অবধি দেখা যাচ্ছে। আমার পাশের দরজাটা মেলে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। ‘না না। এখানে। মেয়েরা কখনো পুরুষদের পিছনে বসে না। ইটস আ কার্টসি।‘
একজন সুন্দরী মেয়ে আমার পাশে এসে বসল। বয়স? ত্রিশ হবে কি? হয়ত বা। আমাকে দু-হাত তুলে সুন্দরী নমস্কার করলেন। নিটোল শরীর। নিটোল আঙুলের গড়ন। টলটলে দৃষ্টি। মধুদা ততক্ষণে পিছনের সিটে বসে পড়েছেন। বললেন, মাই গর্ল ফ্রেণ্ড। হাই ইজ সি?
রসিকতা বুঝতেই পারছিলাম। আমিও রসিকতা করি- ‘এত সুন্দরী বান্ধবী পেলেন কী করে? দেখছি, সারাজীবন আমার এই ড্রাইভারি করেই কাটবে।‘
‘রাস্তায়। বাস স্ট্যান্ডে। আমরা রোজ বাসে করে যাই।‘ মধুদা আমার রসিকতাকে ছাপিয়ে জবাব দেন। আমি চট জলদি আবার প্রশ্ন করি—‘তাই বাস স্ট্যান্ড এড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন? যাতে দেখতে না পাই? তার মানে, আপনি চিত্তরঞ্জন পার্কে যাওয়া ছাড়েননি? আমাকে এড়াচ্ছিলেন?
মধুদার গাড়ি কাঁপানো হাসির ঝঙ্কার থেকে বুঝতে পারি, আমি সত্যের অনেকখানি গা ছুঁয়ে ফেলেছি। মেয়েটার দিকে তাকাই। তার পায়ের দিকেও। সালোয়াড় মোড়া পায়ে জুতি। জুতোর মধ্যে তার বুড়ো আঙুল যেন মাটি খুঁটছে। অবাক হই, কৌতুহলও বাড়ে।
‘কী করেন?’ সুন্দরীকে জিজ্ঞেস করি। গাড়ি তখন স্পিডে। টের পাই সে তার টলটলে চোখে চাইল। উত্তর এলো পেছন থেকে—‘ক্লাবের কম্প্যুটার অপারেটর। খুব পরিশ্রমের কাজ। খুব লেবোরিয়াস মেয়ে।‘
‘খুব সুন্দরীও!’—বলি। মধুদা গর্বিত হয়ে পড়লেন,’সো? আমার সিলেকশন ইজ নো ব্যাড!’ মেয়েটা যেন লজ্জায় গলে গলে ফুটম্যাটে ঝরে যাচ্ছে।
‘কোথায় নামবেন?—মেয়েটার কাছে জানতে চাই।
‘এনিহোয়্যার। সূরজকুণ্ডে নিয়ে যাবে? বাই দ্য লেক। আজ ফুল মুন।‘ আউটার রিং রোড তখন বাড়িমুখো গাড়ির ভিড়ে ঠাসা। ঘাড় ঘোরাতে পারি না। রিয়ার ভিউ মিররে মধুদার ঝকঝকে চোখ, বলিরেখা আর হাসি দেখতে পাই। আমি হঠাৎ যেন রসিকতার ভাষা ও উপকরণ হারিয়ে ফেলেছি। বলে বসি, ‘আজ আমি ভীষণ ব্যস্ত, মধুদা। সাম আদার ডে।‘
চারপাশে গাড়ির হট্টগোল আকাশ-পাতাল এক করলেও মধুদার গভীর কণ্ঠস্বর কানে আসে, ‘ওয়েল। সাম আদার ডে।‘
মেয়েটা হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, ‘দাদু, দ্যাটস টু মাচ। সূরজকুণ্ডে গেলে বরকে নিয়ে যাব, তোমাকে কেন?’
মধুদাও যেন দম পেলেন, আমার কাঁধে হাত রাখেন—‘কী মেয়ে রে বাবা! তিন মাস ধরে এসকর্ট করে আসছি, তাও বরকে ভোলে না? তোমার বরকে তো তা হলে একদিন সত্যিই দেখতে হয়!’
মধুদার ইঙ্গিতে গাড়ি থামাতে হয়। সাবিত্রী সিনেমার পাশে স্টপ। সুন্দরী এখান থেকে আর একটা বাস ধরে বাড়ি যাবে। চিত্তরঞ্জন পার্কে মধুদার আড্ডা আর দু স্টপ দূরে। তিনি নামলেন না। সুন্দরী দাঁড়িয়ে রইল। আমরা এগিয়ে যাই।
মধুদা পিছন থেকে আমার দু কাঁধ ধরে বলেন, ‘একটা অনুরোধ রাখবে? কোনদিন কাউকে রিকোয়েস্ট করি না । মেয়েটাকে নেহরু প্লেস এলাকায় একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পার? ওখান থেকে রোজ বাড়ি ফেরার খুব কষ্ট হয়। বাচ্চা মেয়ে। বাড়িতে ছোট্ট একটা ছেলে। স্বামী। পারবে কেন? রোজ রোজ আমাদের পাড়ায় যাতায়াত করা সোজা কথা?
রসিকতা করি—‘আপকা ক্যা হোগা মধুদা?’
মধুদা হঠাৎ চুপ করে গেলেন।
--------------
*এর বছর খানেক পরে মধুদার বাড়িতে একদিন ফোন করেছিলাম। বউমা বললেন, ‘বাবা তো মাস তিনেক হল চলে গেছেন!’
*দৈনিক ‘সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকা’য় আমার সাপ্তাহিক কলাম’ ‘কতকথা’-য় প্রকাশিত। ১৩ মার্চ, ১৯৯৯।
No comments:
Post a Comment