বছর পনেরো বয়স।
মাঝারি, রোগা গড়ন। ব্যাক ব্রাশ করা চুল। সামনে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করি--ক্যা নাম
হ্যায় তেরা?
- বিশ্বম্ভর
- বাঙালি?
- হ্যাঁ।
আশ্বস্ত হই। আমাদের
গাড়ি দুটো ধোবার জন্য কত লোকই না ঠিক করলাম, সবাই ইররেগুলার। ফাঁকিবাজ। অধিকাংশ
দিনই নোংরা গাড়ি নিয়ে পথে বের হতে হয়। এ কাজে একজন বাঙালিকে পাওয়া মানে হাতে চাঁদ
পাওয়া।
বললাম—একটা মারুতি, একটা ভার্সা। কত
নিবি?
- চারশ টাকা
- কেন?
- এখন ওটাই রেট। দুশো টাকায় একটা গাড়ি।
- কিন্তু দুটো গাড়ি একদিনে, তিনশো দেব।
- কম হবেনি, কাকু।
গলায় খুলনার টান।
মানে বাংলাদেশী। মুসলমানও হতে পারে। হয়ত নাম ভাঁড়াচ্ছে। তো আমার কী। বলি-- সাড়ে
তিনশো।
- পারব না।
বলেই তরতর করে সিঁড়ি
বেয়ে নেমে যায়। তড়িঘড়ি চলে যাওয়ার কারণ বুঝি, সারাদিন অন্যত্র কাজ থাকে। সকালে
আটটা, খুব বেশি হলে সাড়ে আটটা অবধি চলে গাড়ী ধোয়া-মোছা। তার বেশি সময় নেই কারুর। অবশ্য
গাড়িও থাকে না তারপর। ওই সময়ের মধ্যেই সব গাড়িই ছোটে কাজের পাড়ায়।
আমি হতভম্ব হয়ে যাই
ওর অসম্মতিতে। ছুটে যাই বাইরের বারান্দায়। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলি-- ঠিক আছে।
কাল থেকে আসিস।
বিশ্বম্ভর দাঁড়ায়।
ঘাড় উঁচু করে আমাকে দ্যাখে। বুঝতে পারি, এক নগণ্য বালকের মুঠিতে আমি আটকা পড়ে
গেছি। এবার হয়ত কোন শর্ত, যা মানতে আমি বাধ্য হব। যেমন ভাবা, তেমনি, বিশ্বম্ভর
বলল—সকাল ছ-টায় আসব। বলেই ঝাকড়া গাছগুলোর আড়ালে মিশে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলি।
সব শুনে আমার গিন্নি
আমার বুদ্ধির তারিফ করতে পারলেন না--বাঙালি ছেলে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে কম করাই যেত,
আমাকে ডাকলে না কেন?
আমি কথা বাড়াই না।
বিশ্বম্ভরের বুক টান কথার সামনে আচমকা কুঁকড়ে যাওয়ার লজ্জা আর প্রকাশ করিনি।
গভীর রাতে হঠাৎ ডোর
বেলের আওয়াজ শুনে ঘুমটা গেল চটকে। ভাবলাম, ছেলে হয়ত বাড়ি ফিরেছে। মিডিয়ার কাজ
আজকাল সারারাত ধরেই চলে। আলো জ্বালিয়ে দেখি, ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ছ-টা। মানে রাতকে
ভোর করে বাড়ি ফিরছে সে। কিন্তু দরজা খুলে অন্য দৃশ্য--নমস্কার কাকু।
কোনোরকম পেলবতা নেই
শব্দে বা ভঙ্গিতে। বিশ্বম্ভর। ছ-টা বাজে, প্রথম দিন, আমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছে
হয়তো। ফেব্রুয়ারির শীত উপেক্ষা করে তাই
সকালেই কথা রাখতে চলে এসেছে। গাড়ি দুটর চাবি আর বালতিতে জল ভরে ওকে দিই। ঘুমের
দফারফা। বিছানায় ফিরে জানালা গলে বাইরের অন্ধকার দেখতে থাকি।
তো এক দু-দিন নয়,
প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ছ-টা বারোটায় টানটান দাঁড়ালেই ডোর বেল বাজে, বিশ্বম্ভর আসে।
জলের বালতি আর চাবি দুটো দিয়ে ফিরে আসি বিছানায়। গিন্নি কতবার প্রতিবাদ করেছেন—ওকে
বেলায় আসতে বলো।
কিন্তু আমি বলতে
পারিনি। গাড়ি ধোবার ছেলেদের অনিয়ম আমাকে বছরের পর বছর পাগল করে তুলেছে। একমাত্র
বিশ্বম্ভরই, যে, একদিনও কামাই করে না। রবিবারেও না। আমাদের দুটি গাড়িই তাই সবসময়
ঝকঝকে। মারুতি, চোদ্দ বছরের পুরান্ সেটা যেমন ঝকঝকে, চার বছরের ভার্সাও তাই।
বিশ্বম্ভরের হাতে সত্যিই যাদু আছে।
কাজে বিশ্বম্ভরের এই
নিয়মানুবর্তিতায় এবং আন্তরিকতায় আমি সত্যিই মুগ্ধ। কত জায়গায় কত প্রসঙ্গে যে বিশ্বম্ভরের এই ঘড়ির
কাঁটা মেনে কাজ করার উল্লেখ করেছি, বলার নয়। এখন সকাল ছ-টায় ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাসই
হয়ে গেছে। গিন্নিও খুশি। সকালের চা আমিই বানাই। খবরের কাগজ আসতে আসতে বার দুয়েক চা
খাওয়া হয়ে যায় আমার। বিশ্বম্ভর আমাকে এক ডিসিপ্লিনড বাঙালি করে ছেড়েছে বলা যায়।
আমি নিশ্চিত,
বিশ্বম্ভর একদিন বড় হবেই। সেটা সে নিয়মিত গাড়ি ধুয়ে দেয় বলে নয়। এ কাজে তার
অক্লান্ত অধ্যাবসায়ও আমাকে বিস্মিত করে। আমাদের পারিবারের আমরা চারজনই বিশ্বম্ভরের
ভক্ত হয়ে গেলাম ক-দিনের মধ্যে। মেয়ে আমেরিকা থেকে ফেরার সময় বিশ্বম্ভরের জন্য একটা
প্যান্ট নিয়ে এলো। ছেলে এখানে-সেখানে পাওয়া গিফটের কাজের জিনিসগুলো ওকে দেয়। পুজোয়
আমি ওকে একমাসের বোনাস দিলাম্-চারশো টাকা। নোট চারটে হাতে নিয়ে হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিল
সে। আমি জ্যেষ্ঠজনের ভাষায় বলেছিলাম, ‘পুজোয় ভালো জামা প্যান্ট কিনিস। গাড়ি ধোয়া
নয়, আরও বড় হওয়ার চেষ্টা কর। প্রয়োজন হলে আমাকে বলিস।‘ বিশ্বম্ভর সেদিন প্রথম কোমর
ঝোঁকালো। আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
পুজোর দিনগুলোতেও
কামাই নেই বিশ্বম্ভরের। নানা মন্ডপে আমাদের ঝকঝকে গাড়িগুলোর গায়ে আলো পিছলে পিছলে
গেল। এক বন্ধু গাড়ি দেখে মন্তব্য করল—সত্যিই, গাড়ির দারুণ মেইন্টেন্যান্স করিস
দেখছি! কোম্পানি জানলে তোকে মোটা গিফট দেবে।
আমার তখন
বিশ্বম্ভরের মুখটা মনে পড়ছিল, কিন্তু বন্ধুর কাছে রহস্য ভাঙিনি।
কিছুদিন আগে যথারীতি
ডোর বেল বাজল। কিন্তু আমার শরীর থেকে ঘুম নামছে না কিছুতেই, গিন্নিকে অনুরোধ করি।
তিনি পাশ ফিরে শোন, বলেন--- তোমার বিশ্বম্ভর, তুমিই সামলাও। আমার ঘুম ভাঙিয়ো না।
অগত্যা। আলো
জ্বালিয়ে দেখি, ঘড়িতে সোয়া পাঁচটা। তাহলে তো বিশ্বম্ভর নয়। কিন্তু দঃরজা খুলে
দেখি, বিশ্বম্ভর।
-- কী রে, তুই?
-- কাকু, আরো দুটি
গাড়ি নিয়েছি। এখন থেকে এ সময়েই আসব। সোয়া পাঁচটায়। আপনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে...
খুলনার ডায়ালেক্ট তখন আগুন ছড়াচ্ছিল মাথায়—তার
মানে? আমাকে রোজ এই সময় ঊঠতে হবে, অন্যের গাড়ি ধুবি বলে? মানে?
--দুটো গাড়িতে সাড়ে চারশো দেবে...
আমি অগ্নিশর্মা হয়ে
উঠি—কী? তুই যদি ছ-টায় আসতে পারিস, ওক্কে। নয়ত ফরগেট। -- বলেই দরজা বন্ধ করে দিই।
তারপর চার পাঁচ
দিনেও বিশ্বম্ভর আর আসেনি। আমাদের দুটো গাড়িতেই ধুলোর পাহাড় জমতে থাকে। রাস্তায়
ড্রাইভ করতে লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। ভাবছি, বিশ্বম্ভরের সামনে নতজানু হওয়াই
বোধহয় উত্তম হবে...
--------
No comments:
Post a Comment