My Readers

Tuesday, October 26, 2010

My Father, Barada Bhushan Chakraborty

আমার বাবা বরদাভূষণ ছিলেন হরগোপাল চক্রবর্তীর জীবিত পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়, পুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমার সন্তানরা বাঁচতেন ন। উনিশ শতকের শেষার্ধের বাংলায় এটা কোন বিস্ময়ের বিষয় ছিল না।হরগোপাল টাঙ্গাইলের সন্তোষ মহারাজার রাজপুরহিতের বংশধর হলে কি হবে, নিজের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য সেই সম্মান খুইয়েছিলেন। রাজ পরিবারের সঙ্গে তাঁর আর কোন যোগাযোগ ছিল না।

টাঙ্গাইল শহরের কয়েক মাইল দূরে ধলেশ্বরী নদীতীরের চারাবাড়ি ঘাটের অদূরে বিন্যাফৈর গ্রামে মহারাজা তাঁর পূর্বপুরুষকে একখন্ড জমি দান করেছিলেন, সেই গ্রাম ও তার আশেপাশের এলাকায় হরগোপাল যজমানি করে দিনাতিপাত করতেন। পর পর পুত্র সন্তানের মৃত্যুতে তাঁরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, সদ্যজাত সন্তানকে হরগোপাল নিজহাতে প্রতিষ্ঠিত বরদেশ্বরীর নামে উৎসর্গ করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন বরদা। আমার ছোটবেলাতেও (১৯৫০) বিন্যাফৈরের গ্রামে বুনো শুয়োর ছুটতে দেখেছি, শেয়াল তো ছিলই। তারও পঞ্চাশ বছর আগে সেখানে এই সব অতিথিদের তান্ডব যে আরও বেশি ছিল অনুমান করাই যায়।

আমাদের ঠাকুমা, সেই সব জানোয়ারদের পরোয়া না করেই বরদেশ্বরীর পায়ের কাছে সদ্যজাত পুত্রসন্তানকে কলাপাতায় শুইয়ে রেখে পুকুর ঘাটে চলে যেতেন, আমাদের বাবাকে শেয়াল-শুয়োর তুলে নিয়ে যায় নি। দুই কন্যা সন্তানের জন্মের পর অষ্টম গর্ভে জাত বরদা ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ-ব্রাক্ষ্মণীর গর্বের ধন, ‘ঠাকুরমশায়ের উপর ঈশ্বরের পরম করুণা’র নিদর্শন স্বরূপ।

বরদার ছোটবেলা কেটেছে দিনাজপুরে। রাজ-পরিবারের করুণা থেকে বঞ্চিত হয়ে হরগোপালকে বিন্যাফৈর ত্যাগ করতে হয় একসময়। ঠিক কী কারণে সেই স্থানান্তর জানা নেই, কিংবা কেনই বা, দুরন্ত মেঘনা-যমুনা পার করে উত্তরবঙ্গে আসা তাও জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, শহরের পূর্বপ্রান্তের বালুবাড়ি পাড়ার জমিদার গুপ্তদের কাছারিতে হরগোপাল নায়েব পদে আসীন, বরদা পড়াশুনো করছেন দিনাজপুর জেলা স্কুলে।একসময় এন্ট্রান্স পাশ করলেন, এবং বাবা হাতে মুঠো করে ধরে নিয়ে গেলেন জমিদারের কাছারিতে। চাকরিতে জুটে যাক ছেলে, অভাবতাড়িত হরগোপালের সেটাই ইচ্ছা। জমিদারের মুখের উপর রুখে দাঁড়ালেন বরদা। চাকরি নয়, আরও পড়াশুনো করতে চান, বললেন, ‘উকিল হবো।‘ এক নায়েব সন্তানের এমন ঔদ্ধত্বে অপমানিত জমিদা্র, তিনি তখন দিনাজপুর কোর্টের একজন ডাকসাঁইটে মোক্তার, তাঁর ডান হাতের চেটো উলটে বাম হাতের তর্জনী ঠুকে ঠুকে হুঙ্কার দিলেন, ‘তুমি যেদিন উকিল হবে, সেদিন আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে, এটা জেনে রাখো।‘

অভাবের সংসারে কিশোরের তেজ অশোভন, হরগোপাল ভাবলেন, অত্যাচারী জমিদারের প্রতি স্বভাব বিরোধিতা বরদাকে তাড়িত করে থাকবে। স্থানীয় মহিলা সমিতির কেরানীর চাকরির সন্ধান নিয়ে এলেন, এবার বাধ সাধলেন আমাদের ঠাকুমা।

ঠাকুমা শিক্ষিত ছিলেন। ওই সময়েই পাড়াশুনো করেছিলেন ক্লাশ এইট অবধি। আমাদের ঠাকুর্দাকে রীতিমত যৌতুক গুণে ঘরে আনতে হয়েছিল শিক্ষিত ঘরনীকে।ঠাকুমার হুঙ্কারে কবে কোথায় কী কাজ হয়েছে আমার জানা নেই, তবে এই একটীবার যে কাজ হয়েছে অনুমান করা যায়। দেখা যাচ্ছে, ঠাকুমা গায়ের গয়না এবং তোরঙ্গ খুলে কিছু টাকা পয়সা তুলে দিচ্ছেন বাবার হাতে। এবং মা’র পায়ে হাত ছুঁইয়ে আমাদের বাবা অদূরে পার্বতিপুর স্টেশনে গাড়ি বদল করে কলকাতায় রওনা হচ্ছেন, উকিল হবেন।

এই সময়ের কথা আমার খুব বেশি জানা নেই। আমি যখন জন্মেছি, ১৯৪৫, বাবা তখন ঘোর রাজনীতিক। মা ছিলেন দিনাজপুর জেলায় তেভাগা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃ। তখন বোধয় মা রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে থাকবেন। কেননা, ততদিনে তেভাগার মুখে লেপটে গেছে সমঝোতার রঙ। সুতরাং বাবার কলকাতার সংগ্রামের ্কথা বলতে পারব না। তবে সংগ্রাম যে তাকে বিস্তর করতে হয়েছে বলা বাহুল্য। বাবার কলেজ জীবনের ৫০ বছর পরে একই কলকাতায় আমাকে একাকী যে সব পরিস্থিতি ঠেলেঠুলে নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার লড়াই চালাতে হয়েছে, তাতেই অনুমান করা যায়, কুড়ির দশকে কেমন ছিল কলকাতার প্রসারিত হাতের উষ্ণতা।

বাবার কাছে শুনেছি, তিনি পড়াশুনো করেছেন কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বিদ্যাসাগর কলেজে। কোনদিনই এই কলেজের খুব ন্নাম ডাক ছিল না, আজও নেই। বাবা থাকতেন ১০/১২ কিলমিটার দূরের ভবানীপুরে। মেস বাড়িতে। এই দীর্ঘপথ হেঁটেই কলেজে যাতায়াত করতেন। পয়সার অভাবে ঘন ঘন মেস পাল্টাতেন, কখনো সখনো বাকি টাকা পয়সা না মিটিয়েই, রাতের অন্ধকারে। রুটিন করে নিয়েছিলেন সপ্তাহের সব কটা দিন, কোন বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে কবে কখন দুপুরের খাওয়া বা ব্রেকফাস্ট, ডিনার বা টিফিন।
দক্ষিণ কলকাতাতেই, আলিপুর এলাকায়, বর্ধমান রোডে ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের যজমান, কাগমারি-সন্তোষ মহারাজাদের বাড়ি। বাবা রাজকুমারকে পড়াবার বরাত পেয়েছিলেন। থাকা খাওয়া ফ্রি। কিন্তু বেশিদিন টিঁকতে পারেন নি এখানে। একদিন পড়াতে বসে কোন কারণে রেগে গিয়ে রাজকুমারের গালে কষে চড় হাঁকিয়েছিলেন, রাজার লোকেরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের একাকালের শ্রদ্ধেয় রাজপুরোহিতের বংশধরকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে সময় নেয়নি একটুও।

বরদাভূষণ দিনাজপুরে ফিরে এলেন ওকালতি পাশ করে। বালুবাড়ির বাড়িতে বসেই অভয়দাতৃ মা কালীর ছবির নিচে বসে শুরু করলেন প্র্যাকটিস।

কিন্তু এই মানুষটিই পরে খ্যাতি পেলেন সংস্কৃত ভাষার দুর্দ্ধর্ষ পন্ডিত (কাব্যতীর্থ ও রাষ্ট্রভাষা বিশারদ) হিসেবে কিন্তু বদলে গেলেন ঘোর নাস্তি্কে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন একজন নিবেদিত কম্যুনিস্ট হিসেবে। একসময় নির্বাচিত হলেন মওলানা ভাসানীর সারা পাকিস্তান আওয়ামি পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট। একবার, ১৯৬৪-৬৫, সালে সরাসরি জড়িয়ে পড়লেন বিবাদে, দেশের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সঙ্গে। আইয়ুব এসেছিলেন দিনাজপুরে তাঁর দলের নির্বাচনী প্রচারে। আমলারা শহরের বিভিন্ন গাড়ি এজন্য সংগ্রহ করছিলেন। বাবা তাঁর বিরুদ্ধ দলের প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী প্রচারে গাড়ি দিতে অস্বীকার করলেন। নানা শাসকানীতেও যখন কাজ হল না, আইয়ূবের সেনারা বাবাকে বাড়ি থেকে, খালি গা আর লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই বন্দী করে নিয়ে গেল। সেবার সারা পাকিস্তান জুড়ে তাঁর মুক্তিতে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, আইয়ূব শেষটায় তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে আছে এই সংঘর্ষ।

সাহিত্য সংসদের চরিতাভিধান থেকে জানতে পারছি বাবা তার জীবনের ৩০ বছর কাটিয়েছেন জেলে। বৃটিশ জেল তো বটেই, পাকিস্তানের জেলেও কেটেছে অনেকগুলো বছর। মাকে হয়ত সেজন্যেই রাজনীতি ছেড়ে আট ছেলেমেয়েকে 'মানুষ' করার ব্রতে ব্রতী হতে হয়েছিল।

আমাদের সেই সব লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা আর এক দিন।

No comments: