12 July, 2014 // স্মৃতি // মধ্য কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের 'রুবী বোর্ডিং'. ১৯৬৬ সালে এই বোর্ডিংয়ে এসে উঠি। ছবিতে ডানদিকের দ্বিতীয় জানালাটার পাশেই ছিল আমার বেড। এই ঘরটায় ছিলো আরো তিনজন। একজন আমার বয়সী, সুভাষ। একজন রাখালদা (?), রাণাঘাটের মানুষ। কলেজ স্ট্রিটের ইউবিআইয়ে কাজ করতেন। রবিবার বাড়ি যেতেন। সোমবার থেকে শনিবার সন্ধ্যে অব্ধি বোর্ডিংয়ে থাকতেন। সজ্জন মানুষ। প্রথম জানালার পাশে থাকতেন একজন, খিটখিটে, আমাদের থেকে বড়। এই বোর্ডিংয়ে আমার অনেক বন্ধু হয়েছিল। আমরা খুব আন্তরিকতা আর মজায় সময় কাটাতাম। আমি ছন্নছাড়া বাড়ি পালানী বলে, সবাই আমাকে খুব ভালোবাসত। অঞ্জন, মলয়, সুভাষ, ভাদুড়ি আর চার পাঁচ জন। সবার নাম মনে নেই। আমার বয়স তখন উনিশ কুড়ি, ছাত্র। ওদের মধ্যে কেউ ছাত্র, কেউ ওই বয়সেই চাকুরে। প্রতি রাতে ছাতে বসে দারুণ আড্ডা হত। নো রাখঢাক। কী আলোচনাই না হত। কোনো টপিক বাদ নেই। আমরা কিন্তু তখনও মদ্যপান কাকে বলে কেউ জানতাম না। রাখালদারা হয়ত জানতেন। আমরা কোনদিন টের পাইনি। আমাদের দেখাশুনো, খাওয়ানো ইত্যাদির দায়িত্বে ছিলেন বলাইদা, বোর্ডিংয়ের ডে টু ডে ম্যানেজার-কাম-কুক-কাম-চৌকি // স্মৃতি // // বাবা //
আমাদের বাবার কতগুলো মজার ব্যাপার ছিল। মা বলতেন, বাতিক। এসব ঘটত, দেশে এক একটা রাজনৈতিক ঘটনায় বন্দী হয়ে কয়েক মাস বা বছর পরে বাড়ি ফেরার পর। মামা বলতেন, জেলে বসে যা যা করে সময় কাটাতেন, বাড়ি ফিরে কিছুদিন সেইটা না চালু রাখলে, জামাইবাবুর ওকালতির পসার ফিরে জমাতে মন বসত না। মানে, যে যেমন নিজের অ্যাঙ্গল থেকে ব্যাখ্যা করতেন। আমার জীবনের প্রথম সতেরো বছর বয়স কালে (এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি) বাবা বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন, তাই আমিও তার কয়েকটি বাতিকের সাক্ষী। একবার বাবা খৈনী খেতে শুরু করলেন নিয়মিত। একবার শুরু করলেন হোমিওপ্যাথির পড়াশুনা আর চিকিৎসা। একবার প্রতি ছুটির দিনে সিনেমা হলে গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখা শুরু করলেন। মা কিছুতেই এই সবে সঙ্গ দিতেন না তাঁকে। একবার সকাল সকাল কোলে হার্মোনিয়াম টেনে তারস্বরে ধ্রুপদী গান। আর একবার লম্বা ডাইনিং টেবিল বানিয়ে তাতে আট ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে খাওয়া দাওয়া করবেন, রাজনীতি, জেল আর ওকালতির ব্যাস্ততার ফাঁকে পারিবারিক পরিমন্ডলে খানিক সময় কাটাবার বাসনা।
যেবার, খৈনী খেতে লাগলেন। একবার স্নান কর্তে করতে হুড়মুড়িয়ে বালতির ওপর পড়ে গেলেন। খৈনী বাদ হয়ে গেলো। যেবার হোমিও শুরু করলেন, বাড়িতে মেথর জমাদার, নানা বাড়ির কাজের লোক, নিজের মক্কেল থেকে শুরু করে সকাল-বিকাল এত লোকের ভীড় শুরু হয়ে গেলো, ওকালতি মাথায়, রাজনীতিও প্রায় ঘর ছাড়া। বন্ধ হয়ে গেলো হোমিও-দান। মাস দুই তিনেক হিন্দি সিনেমা দেখার পর, নিজেই নিজেকে ফতোয়া দিলেন, শুধু প্রেম করে এই সমাজের কিছু হবে না। সমাজ না-গড়ার কাজে ঐ সব গাল-গল্প, গান বিষ মাত্র। যেবার গান শুরু করলেন, আমরা ভাই বোনেরাই বলাবলি শুরু করলাম, বাবা কী করছেন বলত? গলায় সুর নেই এক ফোঁটা, আকাশ পাতাল চিৎকার করলেই কি ক্লাসিক্যাল গান হয়? আমরা বলাবলি করি, কিন্তু বাবার গান-সাধা চলতেই থাকে। একদিন বোনের তবলা টিচার বাবার গানের সঙ্গে মাথা হেলিয়ে তবলায় কয়েকটা চাটি মেরে বাবাকে দ্বিগুণ উৎসাহিত করে তুললেন। মেজদা বলল, কী করা যায় বলত? বুদ্ধি আসে না। একদিন দেখি, মেজদা বাবাকে খুব বকছে, এই সব ভাল্লাগে? আমার বন্ধুর দাদা, আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'আচ্ছা বলত পিন্টু, তোদের বাড়ির ওদিকে কোন শালা সকাল বেলা ফাটা গলায় চিৎকার করে গান গায় রে? সকাল বেলায় দূরে বসে শুনলেও বিরক্ত লাগে.. তুই চিনিস? আমি কী করব, বলতেই হল, আমি তো কানে কম শুনি, শুনতে পাই নি তো! বাবা গান গাওয়া ছেড়ে দিলেন। বাড়ির একটা লম্বাটে ঘর খালি করা হল। কয়েকদিন ধরে খসড় খসড় করে একটা লম্বা ডাইনিং টেবিল তৈরি করা হল। অত বড় টেবিল দরজা দিয়ে ঢুকবে না, তাই ঘরের ভেতর বানানো হল। দুপাশে ছাড়া ছাড়া ভাবে দশটা চেয়ার। আমরা আট ভাই-বোন আর বাবা-মা। টেবিলের ওপরে লম্বা রবার ক্লথ। নীল রঙের। ঝকঝকে কাপডিস, ডাইনিং প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট, গ্লাস.. কাঁচের আর চীনামাটির। দেয়ালে একটা ঘন্টাও লাগানো হল। তার দড়িটা ঝুলছে। ঘড়ি ধরে মা সবাইকে খেতে আসতে ডাকবেন, দেরি করা চলবে না। আমাদের জন্য যে নিয়ম, বাবার জন্যও তা। ছুটির দিনের লাঞ্চ দিয়ে শুরু হল। দারুণ অভিজ্ঞতা! সিনেমায় দেখেছি, রাজার বাড়িতে দেখেছি। টেবিলে বসে খাওয়া সেই প্রথম। ডিনারেও সমান উত্তেজনা। পরদিন সকাল থেকেই আমি জেগে। মা কখন ঘন্টা বাজাবেন। একসময় বাজল। সেদিন লুচি আর আলুর দম, মনে আছে। মেজদা রোগা পটকা, তাই তার প্লেটে একটা বাড়তি ধবধবে ফর্সা ডিম। ব্রেকফাস্ট শেষ। সবাইকে অবাক করে মা একটা বড় নতুন চায়ের কেটলি আনলেন এবার। কেটলির গলা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মা কেটলিটা টেবিলে রাখলেন। বাবার নির্দেশে আমরা যে যার কাপ উল্টে দিলাম। বাবা মাকে এবার চা দিতে বললেন। কিন্তু মা টেবিল থেকে কেটলি তুলতেই রবারের গোটা টেবিল ক্লথটাই কেটলির সঙ্গে উড়ান দিলো! কাপ ডিস প্লেট সব চারপাশে ছত্রাখান। বাবা উঠে চলে গেলেন তার কাছারি ঘরে। সেই ডাইনিং টেবিল এবার কেটে কেটে আমাদের পড়ার টেবিল তৈরি হল। আমরা ফিরে গেলাম আসন পেতে খাওয়া দাওয়ায়। // দারোগা //
একুশের
ওপার-এপার
১৯৫২ সালে আমি সাত। ক্লাশ টু। বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে প্রাইমারি
স্কুল।
শহরের
মধ্যিখানে।
সেখানে
পড়ি।
আমাদের
বাড়ির
বারান্দায়,
বৈঠকখানায়,
উঠানে,
চায়ের
আসরে,
ভাতের
থালায়,
রান্না
ঘরে
রাজনীতি,
দেশ,
স্বাধীনতা,
রাষ্ট্রভাষা।
বাবা
তেভাগার
নেতা,
জেলা
সদরের
ইন-চার্জ,
মা
গ্রামাঞ্চলের
মেয়েদের
সংগঠনে
দায়িত্বে।
দুজনেই
জেলখাটা
মানুষ।
জেলা
শহরে
শ্রদ্ধার
পাত্র।
তেভাগার
কবর
হয়েছে
৮/৯
বছর
আগে।
দেশ
এখন
স্বাধীন
পাকিস্তান।
স্বাধীনতা
মানে
তিনভাগ
সবুজের
বুকে
সাদা
চাঁদ-তারা।
তো
এমন
আকাশ
বাতাসে
আমি
ভাষা
আন্দোলনের
গন্ধ
নাকে
পাব,
এটাই
স্বাভাবিক।
কিন্তু
তা
নয়।
মাকে
ভাষা
আন্দোলনের
মিছিলের
প্রথম
সারিতে
দেখলেও
কখনো
মনে
হয়
নি,
এটা
অন্য
রকম
বেঁচে
থাকা।
বা
অন্য
জীবন।
আমি
নিশ্চিন্তে
এই
সময়
ডান্ডা-গুলি
আর
মার্বেল
খেলা
নিয়ে
ব্যাস্ত
থাকতাম।
পরের বছর, ১৯৫৩ সালে, কান্নাকাটি জুড়ে যখন দূরের স্কুল পিছনে ফেলে
বাড়ির কাছেই হাই স্কুলে ভর্তি হলাম, তার কিছুদিন পরেই ২১ ফেব্রুয়ারি এক বড় বিষয় হয়ে
উঠল আমার জীবনে। একদিন স্কুলের মাঠে পা দিতেই, উঁচু ক্লাশের নিখিলদা, যিনি স্কুলে খেলা,
ব্যায়াম, দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদিতে সেরা, আমার বুকে একটা আয়তাকার ব্যাজ সেঁটে দিলেনঃ 'রক্তাক্ত
বৃহস্পতিবারকে ভুলিব না'. লাল কালিতে ছাপা। সারাদিন ক্লাশে সেটা বুকে সাঁটা থাকল। দারুণ
দৃশ্য। আমাদের সবার বুকে লাল অক্ষর। খেলার মাঠে, বাথরুমে, হল ঘরে, টিফিনের সময় আমাদের
সবার বুকে লাল লাল ছোপ। এই পরিণত বয়সে ঐ দৃশ্যগুলো খুব প্রতীকী মনে হচ্ছে। রাতে পড়ার
শেষেও বুকে সাঁটা ব্যাজ। মেজদার বয়স তখন ১৪, এটা কী বলত? পারলাম না। লজ্জাও পেলাম না।
এবার মেজদা ম্যাপ খুলে ধরলেন। বললেন সব কথা। বোঝালেন আমাদের বাবাকে কিছুদিন আগে কেনো
পুলিশে জেলে নিয়ে গিয়েছে। সেই রাতে আমার রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে গেলো। মেজদার পাশে বসে
কাঠির আগায় ন্যাকড়া বেঁধে তুলি, বাটিতে আলতার রঙ, খবরের কাগজের শিটে পোস্টার লেখা শুরু
হয়ে গেলো। মেজদা একটা কাগজে লিখে দিলেন, কোন অক্ষরের পিছনে কী লিখতে হবে। মা দেখে বললেন,
বাবলুকে দিয়েই লেখা, ওর হাতের লেখা সুন্দর। মা'র প্রশ্রয়, আমাকে আর পায় কে?
এরপরে আমাকে আর পায় কে? পাড়ার শিশু কিশোরদের নিয়ে চালু করলাম প্রভাত
ফেরী। পাড়ায় গড়ে তুললাম ইঁটের ত্রিকোণ শহীদ মিনার। মোক্তার জ্যেঠিমা তাঁর জবা গাছের
ডাল হেলিয়ে ধরে আমাদের পারতে দিলেন লাল টুকটুকে জবা। পাড়ার মেয়েরা ইয়া বিশাল লম্বা
জবার লাল মালায় জড়িয়ে দিল শহীদ মিনার। প্রতি বছর। দিনে দিনে বাড়তে থাকে শরীর, বাড়তে
থাকে একুশকে ভালোবাসা, ভাষার প্রতি অপার দায়িত্ববোধ। যে মিছিলে মা'র আঙুলের আংটায় কচি
তর্জনি আঁকড়ে দৌড়ে দৌড়ে চলতাম, সেই আমি একদিন মিছিলের সামনে চলে গেলাম। স্কুল পেরুলাম।
কলেজ। একুশের উদ্দীপনা অব্যাহত থাকে। বেড়ে যায় ভাষার প্রতি ভালবাসা, বেড়ে যায় বাংলার
মুখের প্রতি ভালবাসা, দায়িত্ববোধ। বাংলার মুখ গ্রামের সজীবতায় যতটা, আবালবৃদ্ধবনিতার
জী র্ণ তায়, দারিদ্র্যেও ততটাই দেখতে পাই। সে মুখ শহরের অ্যাসফল্টে, সে মুখ গ্রামের
মাঠে, নদীর বুকে, বাজারের শোরগোলে। একুশ ক্রমশ আমার ভেতরে বাঙালি থেকে মানুষ হবার তাগাদা
তৈরি করতে থাকে। ভাষা আমার রক্তে সুর তুলতে থাকে।
একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ পাল্টে দিল সব। একুশের ভাষা রক্ষার
প্রত্যয় বদলে গেল দেশ রক্ষার মহান ব্রতে। একুশ আটকে গেল সানস্কৃতির স্বাধীনতা উৎসবে।
আর ১৬ ডিসেম্বর সামনে এল রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিবসের বিশালত্ব নিয়ে। ২১ এখন স্মৃতিমেদুর
গান গায়, ১৬ বীরদ র্পে কুচকাওয়াজ করে বাঙালির পদক্ষেপে পৃথিবী জুড়ে দামামা বাজাতে।
এ ছবি ওপারের। এপারে?
এরপর এপারের বাংলায় একুশ এলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে সরকারী মদতের ঢেউয়ে
চেপে। সেটা আশির শেষার্ধ ও নব্বুই দশকের শুরুর সময়। বাংলায় এক সময়ের ভিয়েতনাম বিরোধী
আন্দোলনের নায়ক, পরবর্তিতে তথ্য মন্ত্রী এবং কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর
পদে বৃত ব্যক্তি, চলমান সরকার-বিরোধী প্রচারের মুখ বন্ধ করতে নতুন নীতি গ্রহণ করলেন।
বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারাগুলোকে তোষণ করে সরকার বিরোধী সমালোচনার ঝড় স্তিমিত
করার ব্যাবস্থা করলেন। বুদ্ধিজীবী মহলে আন্ত্রজাতিক মানসিকতা নামিয়ে আনলেন তলানীতে।
বামপন্থী মানসিকতার যে লড়াকু মুঠি তা করলেন শিথিল। বাংলার সমগ্র পটভূমি জুড়েই সাফল্যের
সঙ্গে প্রোথিত হল এই নতুন বীজ। বুদ্ধিজীবীর দল গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে অজান্তেই সরে
গিয়ে একমুখীনতার ভয় ঙ্ক র পথে পা বাড়ালেন আশ্চর্য অন্ধতায়।
এই সময়েই গড়ে উঠল নগর ভিত্তিক সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজ্য আকাডেমিগুলো।
আলাদাভাবে গড়ে তোলা হল লোক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলি। নানা অনুষ্ঠানের অন্যতম অনুষ্ঠান
হয়ে উঠল, ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন। অনুষ্ঠানে গান বাজনা বক্তৃতা, সেমিনার সব যুক্ত হল।
দু দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান্ও শুরু হল। দল বেঁধে
এপার বাংলার লেখক কবিরা বাংলাদেশে একুশ উদযাপন করতে যান অবশ্য ওপারের কতজন এই উদযাপ্নে
এপার বাংলায় আসেন, আমার জানা নেই। সেই থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি ২১ উদযাপিত হয়ে আসছে,
অনুষ্ঠান হয়। তবে ইতিহাস থাকে কবরেই। ফলে প্রাণ পায় না এপারের একুশ-স্মৃতি, আবেগ ধায়
না বুক থেকে আগল খুলে। স্বাভাবিক, এপারের একুশের জন্ম তো আর ভাষার প্রতি ভালবাসার বাগানে
ফোটেনি!
'সাম্প্রতিক কাল' বললাম এই কারণে, গত কয়েক বছর ধরে একুশকে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসে চিহ্নিত করে, এপার বাংলায় এখন একুশে বাংলার লেখকদের অস্তিত্ব রক্ষার
মৌখিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র।
----------------------------
// আমার কলিগ //
// ছোটবেলার খেলাধুলা //
ছবিটা 'দলিল মিঞার দোকান'র। আমরা তখন ছোট। এই নামটাই ছিল দোকানটার। ছবিতে দলিল মিঞার ছেলে, আমারই বন্ধু, দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবেলা ছেড়ে বড়বেলায় এসে ছেলে-মেয়ে বউ নিয়ে ফিরেছিলাম আমাদের শহরে, তখন তোলা এই ছবি। আমার জীবনে এই দোকানটার অনেক মূল্য। আমি এই দোকানে বসে প্রায়-ই নানা মশলাপাতি, ডাল চাল দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে ঠোঙায় ভরে ক্রেতাদের দিতাম। দলিল মিঞা নিশ্চয়্ই খুব খুশি হতেন। উকিলবাবুর ছেলে তার দোকান আলো করে বসে আছে, এতে তার সামাজিক গর্ব হবারই তো কথা। আমি কেনো ঐ দোকানে হেল্পারের কাজ করতে ভালো বাসতাম, এখন এত দূরে বসে তা ঠিকঠাক বলতে পারব না। তবু অনুমান করা যায় কারণটা।
আমরা ছোটবেলায়, ছুটির দিনের ভর দুপুরে বা বৃষ্টির দিনে দুপুরে একটা খেলা খুব খেলতাম। 'দোকান দোকান' খেলা। আমরা, একদল দোকানী, কাঁচি দিয়ে কাগজে আঁকা নানা জিনিসের, যেমন ঘড়ি, কাপ-ডিস, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার এই সবের আউটলাইন কেটে কেটে বিক্রিযোগ্য জিনিস বানিয়ে দোকান খুলে বসতাম। আমার দোকানের জিনিসের চাহিদা বেশি, কেননা, আমি ছবি আঁকতে পারতাম অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো। আর আমার ওপরের ভাই (দাদা বলি না আজো, বাচ্চু, এখন শিলিগুড়িতে নাম করা চোখের ডাক্তার) খুলে বসত আর একটা দোকান। সরাসরি কম্পিটিশন। ক্রেতাদের বেশির ভাগ আমার বন্ধু। খেলা শেষে আমি সবেয়চেয়ে বেশি টাকার নোটের তোড়া নিয়ে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতাম। টাকা মানে খাতার পাতা-ছেঁড়া কাগজের নানা আঙ্কের টাকার সাইজে কেটে নেয়া অংশ, তাতে পেনসিলে লেখা, ১ টাকা, ৫ টাকা.. এই সব। এক হাজার টাকা মানে, খাতার কাগজের অর্ধেক। বাচ্চু খুব ভালো সেলসম্যান। মিষ্টি করে গ্রাহকদের সহজেই টেনে নিতে পারত, আমার মত একটুতেই মাথা গরম করত না। আমাদের ক্রেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিল, অপু। পকেট ভর্তি শুধুই হাজার টাকা। বাচ্চু ওকে এমন পটাতো, বলতে গেলে ম্যাক্সিমাম হাজার টাকা ওর বাক্সে জমা পড়তে লাগল। একদিন প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে অপুর কাছে আমার দোকানে আসতে অনুরোধ জানালাম, 'তুই আমার ক্লাশমেট আর তুই কিনা উঁচু ক্লাশের লোকের দোকানে যাবি?' অপু ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সহজ সরল। ওর মা বলত, 'আমার হাবা গোবা ছেলে।' অপুর একদিন দয়া হল। আমার দোকানে এল। অনেক কিছু কিনল। বেশ কয়েক হাজার টাকা দাম। অপু ফস ফস করে টাকা বের করে দিল। ওমা! দেখি, সব ক'টা হাজার টাকার নোট, আমাদের ক্লাশের অঙ্কের বইয়ের পাতা কেটে তৈরি। 'এটা কী করেছিস? অঙ্কের বইটা তো গেলো!' অপুবাবু, মুখ বাঁকিয়ে বলল, ' তো কী? আর একটা কিনে নেব! অত কথা বলবি তো আমি বাচ্চুর দোকানে চলে যাব।' আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। আমাকে ধমক দিচ্ছে? গিয়ে অপুর মা'কে সব বলে দিলাম। বিধবা মায়ের সে কি বিলাপ আর কান্না! পরের দিন অপুকে হেডমাস্টার মশয় খুব পেটালেন। আমাদের খেলা মাকে বলে বন্ধ করে দিলেন অপুর মা। এই সময়েই হয়ত ফুটে উঠে থাকবে 'দলিল মিঞার দোকান'. ঠিক বলতে পারছি না। আমাদের দোকান আগে নাকি দলিল মিঞার দোকান আগে। যাই হোক, একদিন দলিল মিঞার দোকানে আমি যখন জিনিসের ওজন ঠোঙায় ভরে গ্রাহকদের হাতে তা তুলে দিয়ে পয়সা নিয়ে দলিল কাকুর বাক্সের দিকে এগিয়ে দিতে মহা ব্যাস্ত, হঠাৎ দেখি, সামনে মেজদা। আমাকেই বললেন, কি একটা জিনিস দিতে। দলিল মিঞা জিভ কেটে উঠে এসে মেজদাকে বললেন, 'থাক থাক আমি দিচ্ছি তোমাকে।' মেজদা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না থাক ওই দিক।' আমার তো মহা স্ফূর্তি। মেজদাও মজা পাচ্ছে বোঝা গেল। জিনিসটা হাতে নিয়ে আমাকে মেজদা বললেন, 'দৌড়ে মা'কে দিয়ে আয়। মা'র দরকার।' আমি স্ফূর্তিতে ঘোড়া! একদৌড়ে বাড়ি। খানিক পরে মেজদা এলেন। বাইরের ঘর থেকেই আমাকে ডাকলেন। ছুটে যাই... মাগো, এখনো দুই গাল আর পাছা বোধয় লাল হয়ে আছে। চিৎকার করতে পারলাম না, চোখের জলও না। কেননা, মেজদার নিয়ম ছিল, অপরাধ করে যত চিৎকার, যত কান্না, ততই পিটুনি... আমরা ছোটবেলায়, ছুটির দিনের ভর দুপুরে বা বৃষ্টির দিনে দুপুরে একটা খেলা খুব খেলতাম। 'দোকান দোকান' খেলা। আমরা, একদল দোকানী, কাঁচি দিয়ে কাগজে আঁকা নানা জিনিসের, যেমন ঘড়ি, কাপ-ডিস, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার এই সবের আউটলাইন কেটে কেটে বিক্রিযোগ্য জিনিস বানিয়ে দোকান খুলে বসতাম। আমার দোকানের জিনিসের চাহিদা বেশি, কেননা, আমি ছবি আঁকতে পারতাম অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো। আর আমার ওপরের ভাই (দাদা বলি না আজো, বাচ্চু, এখন শিলিগুড়িতে নাম করা চোখের ডাক্তার) খুলে বসত আর একটা দোকান। সরাসরি কম্পিটিশন। ক্রেতাদের বেশির ভাগ আমার বন্ধু। খেলা শেষে আমি সবেয়চেয়ে বেশি টাকার নোটের তোড়া নিয়ে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতাম। টাকা মানে খাতার পাতা-ছেঁড়া কাগজের নানা আঙ্কের টাকার সাইজে কেটে নেয়া অংশ, তাতে পেনসিলে লেখা, ১ টাকা, ৫ টাকা.. এই সব। এক হাজার টাকা মানে, খাতার কাগজের অর্ধেক। বাচ্চু খুব ভালো সেলসম্যান। মিষ্টি করে গ্রাহকদের সহজেই টেনে নিতে পারত, আমার মত একটুতেই মাথা গরম করত না। আমাদের ক্রেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিল, অপু। পকেট ভর্তি শুধুই হাজার টাকা। বাচ্চু ওকে এমন পটাতো, বলতে গেলে ম্যাক্সিমাম হাজার টাকা ওর বাক্সে জমা পড়তে লাগল। একদিন প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে অপুর কাছে আমার দোকানে আসতে অনুরোধ জানালাম, 'তুই আমার ক্লাশমেট আর তুই কিনা উঁচু ক্লাশের লোকের দোকানে যাবি?' অপু ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সহজ সরল। ওর মা বলত, 'আমার হাবা গোবা ছেলে।' অপুর একদিন দয়া হল। আমার দোকানে এল। অনেক কিছু কিনল। বেশ কয়েক হাজার টাকা দাম। অপু ফস ফস করে টাকা বের করে দিল। ওমা! দেখি, সব ক'টা হাজার টাকার নোট, আমাদের ক্লাশের অঙ্কের বইয়ের পাতা কেটে তৈরি। 'এটা কী করেছিস? অঙ্কের বইটা তো গেলো!' অপুবাবু, মুখ বাঁকিয়ে বলল, ' তো কী? আর একটা কিনে নেব! অত কথা বলবি তো আমি বাচ্চুর দোকানে চলে যাব।' আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। আমাকে ধমক দিচ্ছে? গিয়ে অপুর মা'কে সব বলে দিলাম। বিধবা মায়ের সে কি বিলাপ আর কান্না! পরের দিন অপুকে হেডমাস্টার মশয় খুব পেটালেন। আমাদের খেলা মাকে বলে বন্ধ করে দিলেন অপুর মা। এই সময়েই হয়ত ফুটে উঠে থাকবে 'দলিল মিঞার দোকান'. ঠিক বলতে পারছি না। আমাদের দোকান আগে নাকি দলিল মিঞার দোকান আগে। যাই হোক, একদিন দলিল মিঞার দোকানে আমি যখন জিনিসের ওজন ঠোঙায় ভরে গ্রাহকদের হাতে তা তুলে দিয়ে পয়সা নিয়ে দলিল কাকুর বাক্সের দিকে এগিয়ে দিতে মহা ব্যাস্ত, হঠাৎ দেখি, সামনে মেজদা। আমাকেই বললেন, কি একটা জিনিস দিতে। দলিল মিঞা জিভ কেটে উঠে এসে মেজদাকে বললেন, 'থাক থাক আমি দিচ্ছি তোমাকে।' মেজদা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না থাক ওই দিক।' আমার তো মহা স্ফূর্তি। মেজদাও মজা পাচ্ছে বোঝা গেল। জিনিসটা হাতে নিয়ে আমাকে মেজদা বললেন, 'দৌড়ে মা'কে দিয়ে আয়। মা'র দরকার।' আমি স্ফূর্তিতে ঘোড়া! একদৌড়ে বাড়ি। খানিক পরে মেজদা এলেন। বাইরের ঘর থেকেই আমাকে ডাকলেন। ছুটে যাই... মাগো, এখনো দুই গাল আর পাছা বোধয় লাল হয়ে আছে। চিৎকার করতে পারলাম না, চোখের জলও না। কেননা, মেজদার নিয়ম ছিল, অপরাধ করে যত চিৎকার, যত কান্না, ততই পিটুনি... |
// Didima //
I usually called her Didima (granny). She was a frail, fair, and smiling oldie, living alone and guarding spacious mud buildings and the courtyard with stack of harvests. All her children left the town and crossed over to India. She didn’t follow them. Didima was a mother to our Ma. When upright educated lawyer groom refused to go to a remote village in Pabna to marry a small land owner village brahmin’s daughter, the girl was brought to Dinajpur town and put up in the same locality in Balubari. Didima received the girl from her village as her daughter and the groom came to this courtyard to marry the beautiful young school going girl, eleven years younger to him. The groom was my father, and bride my mother. Thus Didima’s place became my mother’s home and my indulgence.
Didima would visit our house once in a while, with a purpose. Carefully slipping a post card inside a thin magazine or like she would reach our house. Obviously, Ma would receive her as the most favourite guest of the day. Didima walking down our dusty lane from east, her rosy face absorbed with mellowing afternoon sky, stooping humbly, would instantly attract me away from my any favourite game. Once I reach her running, she would place her soft hand on my shoulder and lead me inside.
I know what was next. I will run into our study to return with an ink pen. By then Ma would spread a corn mat on the floor of our varanda. Didima would sit on it, give me her post card, and I would ask, ‘How many lines, Dida (kato line, Didai)? She would indicate and start dictating. I was her writer.
Thus I learnt to write, at that early age, in different font size. I was known then for my ‘good handwriting’, and it’s Didima, who taught me how to use that in writing. It’s a strange experience ever in my life, how her dictation could be so precise! She would dictate letters to her sons and daughters and else living at distant places, yet so precisely! I don’t remember if those were too emotive or just matter-of-facts. Wonder of wonders, once she would say like, ‘with love, yours Ma’, there would be no space left to write anything more. Whether the letter is 12 liners or 15 or 20, it would leave no space at the end.
Thus she unknowingly taught me, an innocent pretty shoot, what to write, how much to write and, more importantly. what not to write. The sad part is, did I learn it?
Didima would visit our house once in a while, with a purpose. Carefully slipping a post card inside a thin magazine or like she would reach our house. Obviously, Ma would receive her as the most favourite guest of the day. Didima walking down our dusty lane from east, her rosy face absorbed with mellowing afternoon sky, stooping humbly, would instantly attract me away from my any favourite game. Once I reach her running, she would place her soft hand on my shoulder and lead me inside.
I know what was next. I will run into our study to return with an ink pen. By then Ma would spread a corn mat on the floor of our varanda. Didima would sit on it, give me her post card, and I would ask, ‘How many lines, Dida (kato line, Didai)? She would indicate and start dictating. I was her writer.
Thus I learnt to write, at that early age, in different font size. I was known then for my ‘good handwriting’, and it’s Didima, who taught me how to use that in writing. It’s a strange experience ever in my life, how her dictation could be so precise! She would dictate letters to her sons and daughters and else living at distant places, yet so precisely! I don’t remember if those were too emotive or just matter-of-facts. Wonder of wonders, once she would say like, ‘with love, yours Ma’, there would be no space left to write anything more. Whether the letter is 12 liners or 15 or 20, it would leave no space at the end.
Thus she unknowingly taught me, an innocent pretty shoot, what to write, how much to write and, more importantly. what not to write. The sad part is, did I learn it?
------
13 September, 2013
সত্তর আশির দশকে দিল্লিতে সুনীলদা (গঙ্গোপাধ্যায়) এলেই চিত্তরঞ্জন পার্কে আড্ডা বসত । তখনও সুনীলদাকে পেলেই হামলে কবিতা পাঠের আসর করে ফেলা চালু হয় নি। নিছক আড্ডা হত। কৃত্তিবাসের গল্প, নানা সমসাময়িক লেখালেখির গল্প, কল্লোল, কবিতা ভবন, পরিচয়, দেশ, শক্তিদা-তারাপদার কূটকাচালি এমনতর। আমাদের লীডার ছিলেন সুনীলদার কাছের মানুষ দিল্লি কলেজের বাংলার অধ্যাপক, মিহির রায়চৌধুরি। আমি দুজনের কাছেই ছোট। একসময় আনন্দবাজারে সুনীলদার কলিগ, এটা ফাউ। আড্ডা মামেই মদ্যপান। মিহিরদা আর সুনীলদার মধ্যে এই কমিস্ট্রিটা ছিল বেশি। আমি প্লেটের রোস্টেড বাদাম।
একবার। আমাদের প্রাংশু অফিসে সুনীলদাকে নিয়ে রাতে আড্ডা খাওয়া-দাওয়া। সঙ্গে স্বাতী বৌদি। বেশ কয়েকজন আমন্ত্রিত। আমি আয়োজক। দুপুরে সুনীলদারা মিহিরদার বাড়িতে খাবেন। বিকেলে অফিস ফেরতা মিহিরদার বাড়িতে গিয়ে শুনি, এক বোতল ওল্ড মঙ্ক শেষ, দ্বিতীয় চলছে। আমার মাথায় হাত, ‘রাতের আড্ডার কী হবে?’ সুনীলদা-- ‘কেনো? ওটাও হবে। ওখানে যেন রাম থাকবে তো? নাও খাও, মিহির, অরুণকে... ‘। বাধা দিয়ে বলি, ‘আমি এখন ছোঁবনা, রাতে ঘুম পেয়ে যাবে। তখন খুব খাবো। বউ যেন বাধা না-দেয় দেখবেন।‘ আমি ছুটে গিয়ে আরো দুটো রামের বোতল কিনে প্রাংশুর শশঙ্কশেখর মশায়ের কাছে জমা রেখে এলাম।
রাতে সবাই এলো। আড্ডা আর আড্ডা। সুনীলদা দীপ্তিকেও একমাত্র ধরিয়ে দিয়ে আমাকে চোখ টিপলেন। আমাকে আর রোখে কে...
আসর কখন ভেঙে গেছে খেয়াল নেই। একসময় আধো ঘুমে টের পেলাম, সুনীলদা তাঁর কোল থেকে আমার মাথাটা আদরের সঙ্গে ফরাসে নামাচ্ছেন। স্বাতী বৌদি বা গৃহকর্ত্রী দুর্গা বৌদির কেউ বলছেন, ‘বেচারা! কত প্ল্যানই না করেছিল!’ কে যেন ড্রাইভ করে বাড়িতে পৌঁছে দিল। বাড়িতে বিছানায় বউয়ের গলা ভেসে এলো, ‘দুর্গা বৌদি খাবার প্যাক করে দিয়েছেন। খাবে?'
একবার। আমাদের প্রাংশু অফিসে সুনীলদাকে নিয়ে রাতে আড্ডা খাওয়া-দাওয়া। সঙ্গে স্বাতী বৌদি। বেশ কয়েকজন আমন্ত্রিত। আমি আয়োজক। দুপুরে সুনীলদারা মিহিরদার বাড়িতে খাবেন। বিকেলে অফিস ফেরতা মিহিরদার বাড়িতে গিয়ে শুনি, এক বোতল ওল্ড মঙ্ক শেষ, দ্বিতীয় চলছে। আমার মাথায় হাত, ‘রাতের আড্ডার কী হবে?’ সুনীলদা-- ‘কেনো? ওটাও হবে। ওখানে যেন রাম থাকবে তো? নাও খাও, মিহির, অরুণকে... ‘। বাধা দিয়ে বলি, ‘আমি এখন ছোঁবনা, রাতে ঘুম পেয়ে যাবে। তখন খুব খাবো। বউ যেন বাধা না-দেয় দেখবেন।‘ আমি ছুটে গিয়ে আরো দুটো রামের বোতল কিনে প্রাংশুর শশঙ্কশেখর মশায়ের কাছে জমা রেখে এলাম।
রাতে সবাই এলো। আড্ডা আর আড্ডা। সুনীলদা দীপ্তিকেও একমাত্র ধরিয়ে দিয়ে আমাকে চোখ টিপলেন। আমাকে আর রোখে কে...
আসর কখন ভেঙে গেছে খেয়াল নেই। একসময় আধো ঘুমে টের পেলাম, সুনীলদা তাঁর কোল থেকে আমার মাথাটা আদরের সঙ্গে ফরাসে নামাচ্ছেন। স্বাতী বৌদি বা গৃহকর্ত্রী দুর্গা বৌদির কেউ বলছেন, ‘বেচারা! কত প্ল্যানই না করেছিল!’ কে যেন ড্রাইভ করে বাড়িতে পৌঁছে দিল। বাড়িতে বিছানায় বউয়ের গলা ভেসে এলো, ‘দুর্গা বৌদি খাবার প্যাক করে দিয়েছেন। খাবে?'
13 September, 2013
শ্যামলদাকে বলে গেলাম, আপনিও আসবেন।‘ আমার রাজি না-রাজির সুযোগ ছিল না। শক্তিদা আমার দ্বিধা দেখেই বলে বসলেন, ‘সঙ্গে মিহির (রায়চৌধুরি) না-থাকলে যাব না।‘
---------
11 September, 2013
শ্যামল
গঙ্গোপাধ্যায় তখন সাহিত্যের
বাঘ, আমি যখন
আনন্দবাজারে তার সহকর্মী
হলাম। আমি টগবগে
যুবক, যুদ্ধ ফেরত
সাংবাদিক, সাংবাদিকতা নিয়ে
অনেক গর্ব। নানা
কথায় প্রায়ই খোটাখুটি
লাগত দুজনের। খানিক
মান অভিমান, কথাবার্তা
বন্ধ, আবার চা
খাওয়াখায়ী, শ্যামলদাকে অমান্য
করবে কে? একদিনের
কথা বলি।
আমাদের
রাতের ডিউটি। একদিন
‘ইমপ্রিন্ট’ পত্রিকায়
সদ্য জন্ম নেয়া
বাংলাদেশের ওপরে কুলদীপ
নায়ারের একটা লেখা
পড়ে দারুণ লেগেছে
বলছিলাম আমার সমবয়সী
কলিগ রথীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শ্যামলদা টেবিলের
ওপারে এসে বসে
সব শুনলেন। মাথা
নাড়লেন।
পরদিন
ডিউটিতে এসেই শ্যামলদার
পেশীবহুল খিঁচোনো মুখের
সামনে। ভাগ্যিস ভগবান
তাঁর চিকণ দাঁতের
পাটি মুখের হা-র
ভেতরে সেট করেছেন,
নইলে..., ‘তোরা সাংবাদিকতা
করিস? ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি
আছে বলেই মস্ত
সাংবাদিক? মাথার ওপর
দিয়ে কয়েকটা গোলাগুলি
লাফিয়ে গেল আর
অমনি বড় সাংবাদিক?...’
কিছু বোঝার আগেই
রথীনের চোখে ইশারা
ঝলকে ওঠে। চুপ
করে থাকি। দুম
করে ‘ইমপ্রিন্ট’-র
পরিচিত কপিটা ছুটে
গায়ে ধাক্কা দিয়ে
মেঝেতে পড়ল। ‘খামোকা
তোদের কথা শুনে
পয়সা খরচ করে
কিনতে হল! প্রভাতদা,
আজকের লীড নিউজটা
অরুণ লিখবে। আমি
মূর্খ। লিখব না।‘
রাগ না বালাই
ষাট। সেই আমার
প্রথম লীড নিউজ
লেখা। শ্যামলদার সঙ্গে
কথা বন্ধ। পাতা
ছেড়ে আমরা যে
যার টেবিলে যার
যার বিছানা পেতে,
আলো নিভিয়ে শুয়ে
পড়লাম।
তখনও
ভোর কাকের বুকের
মতোও ধোঁয়াশা নয়।
কে যেন, আস্তে
আস্তে আদরে আদরে
ঘুম ভাঙাচ্ছে আমার,’
অরুণ, ভাইরে আমার।
উঠে পড়্, চল
আমার বাড়িতে। চা
খাব তিনজনে। এই
তোর পা ধরি,
ভাই আমার, এমন
ভুল আর করব
না! আমি তড়াক
করে লাফিয়ে উঠি।
দেখি, রথীনকে তার
আগেই জগিয়ে দিয়েছেন
শ্যামালদা। সে বিছানায়
বসে পা দুলাচ্ছে...
---------------
১৮ এপ্রিল, ২০১৩
---------------
দিল্লিতে গরম পড়ল অবশেষে। পড়ল না, ঝাঁপিয়ে নামল। ৪০ ডিগ্রি পার। এরমধ্যেই
শাকসব্জি যৌবনেই চর্মসার বৃদ্ধ। তাই সকাল সকাল সব্জি বোঝাই ঠেলাওয়ালারা হাঁক দিয়ে
ঘুম ভাঙাচ্ছে সবার। গৃহিনীরাও তাজা সব্জি ফ্রিজে ভরতে দৌড়ে মেলছে দরজার কবাট।
কেনাবেচা মোটামুটি সকালেই চুকেবুকে যাচ্ছে।
এমন পরিমন্ডলে দুপুর দেড়টা নাগাদ হঠাৎ ‘স ব জি!’ হাঁক শুনে অবাকই হলাম। বারান্দায় গিয়ে
দেখি, এক ঠেলাওয়ালা, অন্যদের তুলনায় একটু দুর্বল, বয়সেও বা, প্রাণপণে দরজা খোলার
মন্ত্র হেঁকে যাচ্ছে। আশেপাশের দু চারটে দরজা খুলছে না, এমন না, তবে কেনাবেচা নজরে
এলো না।
আমিও দরজা বন্ধ করতে যাব, নজর পড়ল ঠেলায়। পালং, ঢ্যাঁড়স, পটল, শুটি, লেবু, করলা্,...
সবই দু পাঁচ কেজির থুপ। কারো গায়ে যৌবনের রেখামাত্র নেই, একমাত্র আলু আর পেঁয়াজ
ছাড়া। সবার গায়ের চামড়া কুঁকড়ে গরুর খাবার। সব্জীওয়ালাকে ডাকলাম। বললাম,
‘ঠেহরো!’। বাথরুমের কলে লম্বা প্লাস্টিক নল লাগিয়ে ওর ঠেলাটাকে স্নান করাতে
লাগলাম। ঠেলাওয়ালা তাড়াতাড়ি প্লাস্টিক দিয়ে পেঁয়াজগুলো ঢেকে দিল। সব্জীগুলো
মুহূর্তে যেন সোনার কাঠির ছোঁয়ায় যৌবন ফিরে পেতে লাগল। আহা! ঠেলাওয়ালার মুখটা
তখন দেখবার মতো। আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার এমন মিশেল... আমার মনটা ভরে উঠল। ভেতরে
ভেতরে গর্বও হচ্ছিল।
দিল্লিতে গরম পড়ল অবশেষে। পড়ল না, ঝাঁপিয়ে নামল। ৪০ ডিগ্রি পার। এরমধ্যেই
শাকসব্জি যৌবনেই চর্মসার বৃদ্ধ। তাই সকাল সকাল সব্জি বোঝাই ঠেলাওয়ালারা হাঁক দিয়ে
ঘুম ভাঙাচ্ছে সবার। গৃহিনীরাও তাজা সব্জি ফ্রিজে ভরতে দৌড়ে মেলছে দরজার কবাট।
কেনাবেচা মোটামুটি সকালেই চুকেবুকে যাচ্ছে।
এমন পরিমন্ডলে দুপুর দেড়টা নাগাদ হঠাৎ ‘স ব জি!’ হাঁক শুনে অবাকই হলাম। বারান্দায় গিয়ে
দেখি, এক ঠেলাওয়ালা, অন্যদের তুলনায় একটু দুর্বল, বয়সেও বা, প্রাণপণে দরজা খোলার
মন্ত্র হেঁকে যাচ্ছে। আশেপাশের দু চারটে দরজা খুলছে না, এমন না, তবে কেনাবেচা নজরে
এলো না।
আমিও দরজা বন্ধ করতে যাব, নজর পড়ল ঠেলায়। পালং, ঢ্যাঁড়স, পটল, শুটি, লেবু, করলা্,...
সবই দু পাঁচ কেজির থুপ। কারো গায়ে যৌবনের রেখামাত্র নেই, একমাত্র আলু আর পেঁয়াজ
ছাড়া। সবার গায়ের চামড়া কুঁকড়ে গরুর খাবার। সব্জীওয়ালাকে ডাকলাম। বললাম,
‘ঠেহরো!’। বাথরুমের কলে লম্বা প্লাস্টিক নল লাগিয়ে ওর ঠেলাটাকে স্নান করাতে
লাগলাম। ঠেলাওয়ালা তাড়াতাড়ি প্লাস্টিক দিয়ে পেঁয়াজগুলো ঢেকে দিল। সব্জীগুলো
মুহূর্তে যেন সোনার কাঠির ছোঁয়ায় যৌবন ফিরে পেতে লাগল। আহা! ঠেলাওয়ালার মুখটা
তখন দেখবার মতো। আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার এমন মিশেল... আমার মনটা ভরে উঠল। ভেতরে
ভেতরে গর্বও হচ্ছিল।
------------------------------
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
কলকাতায়
অনেকগুলো দিন কাটিয়ে এবার দিল্লিমুখো--আমার কাজের শহরে, প্রাণবন্তার শহরে। এবার কলকাতায় আমার ডানা
দুটো হঠাৎ দৈত্যাকার হয়ে উঠেছিল। এক ঝাপটায় গোটা কলকাতাটাকেই পেয়েছি ডানার নিচে।
এত মানুষ, এত সবকিছু!
কলকাতা আমার কাজের শহর না, প্রাণের শহর। প্রাণবন্তার শহর না, দুঃখিনী মায়ের আঁচল মেলা শহর। এখানে কেঁদে
প্রাণ জুড়ায়। মৌসুমী ভৌমিক বার বার ছুঁয়ে যায় গোটা
আমাকে। মেঝেতে চাদরের পাশে চাদর পাতি, তরুণ বন্ধুদের
জুতোর পাহাড় জমে দরজার বাইরে। পুলকিত আকাশ। মৌসুমী না। আমার বড়রা সবাই এখনো বড়।
আমার একলা চটি তাঁদের দরজা পাহারায় থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। ঘষা কাঁচ স্বচ্ছ উচ্চারণ
করে, ‘তোমার কথা প্রায়ই মনে পড়ে।‘ মনে পড়ে? আজও? ৪৭ বছর কলকাতা ছাড়া এই আমি! আহা এই তো জীবন!
পরিপূর্ণ জীবন। একমাত্র আমারই। কলকাতা, তোমায় ভালবাসি? না। সে মিথ্যে উচ্চারণ আমার। আমাকে ভালোবাস
তুমি? মিথ্যে উচ্চারণ তাও। তবু ভালোবাসা ছুঁয়ে
ছুঁয়ে যায় আমাকে। কেন?
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, জীবনানন্দের মৃত্যুদিন
জীবনানন্দ স্মৃতি। এই শতকের প্রথম দিকে আমি আর জীবনানন্দ-জীবনীকার,
কবি ভূমেন্দ্র গুহ দিল্লিতে জীবনানন্দের তিন বছরের কার্যকালের (১৯৩৫-৩৭) শুলুক সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। আমাদের আকর-- জীবনানন্দের ২৩ নম্বর খাতা-ডায়েরি। আমাদের
সন্ধান-সমাধান পরে ‘বিষয়মুখ’ পত্রিকায় ডায়েরির দিন ধরে ধরে ছাপা হয়। (হাতের কাছে
সব তথ্য নেই তাই বিশদে বলতে পারছি না)। আমরা যা জেনেছি, তার সংক্ষিপ্তসারঃ দিল্লির
বর্তমান করোল বাগের পশ্চিমে আনন্দ পর্বতে রামযশ কলেজে জীবনানন্দ ইংরেজীর অধ্যাপনায়
নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইংরেজি ছেড়ে কবিতা আর অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাতেন বেশি। আনমনা
আত্মভোলা চাদর মোড়া অধ্যাপক অচিরেই অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। দূরের দিল্লি কলেজের নানা
অধ্যাপকের সঙ্গেও ইংরেজি আর অঙ্কের পঠন পদ্ধতি বা উপলব্ধি নিয়ে বিবাদ হত। উত্তর
প্রদেশের ছাত্ররা তাঁকে অত্যন্ত উত্যক্ত করত। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, অবসরপ্রাপ্ত
হরিয়ানভী সরকারী কর্মী, কেদার নাথ সিং, যিনি অশিক্ষিত গ্রাম্য হরিয়ানভীদের ইংরেজী
শিক্ষায় দীক্ষিত করতে রামযশ স্কুল ও পরে কলেজ স্থাপন করেছিলেন, তাঁর কাছে কাব্যিক বাঙালীয়ানা
তার লক্ষ্য পূরণের বিপরীত ছিল। তাই তিনি কার্যত জীবনানন্দকে কলেজ থেকে বরখাস্ত
করেছিলেন।
------------------
অনেক গাড়ির ব্যাক
গিয়ারে মিউজিক বাজে। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে সাবধান করতে। কোথাও বাচ্চার
কান্না, কারো টুঁই টুঁই, কারো জিংগল বেল... কত কি! গত দুদিন প্রায়ই আমাদের
এপারটমেন্টের নিচে থেকে মোরগের ‘কক্কড়অ ক্ক’ শুনতে পাই। নিচেই দেয়াল ঘেঁষে অস্থায়ী
বাজার, হয়ত তাই, লোক সরাতে, মোরগের ব্যাক গিয়ার ‘মিউজিক’। নয়ত মাঝরাতে জ্যান্ত
মোরগ ডাকার কোন কারণই নেই। আবার মাঝ রাতে বেশ কয়েকবার মোরগের আওয়াজ শুনে সন্দেহও
হয়, কোনো ফ্ল্যাটে অসুখ বিসুখ নয় তো। তিনটি টাওয়ারে ৬২টা ফ্ল্যাট, সবার খবর তো
জানি না। সকালে বাজারে যাওয়ার সময় তাই সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করি, ‘কোনো সিরিয়াস
ব্যাপার? অত রাতে এতবার গাড়ির যাতায়াত?’ সিকিউরিটি তো অবাক। ‘না তো? কাল বেশি রাতে
তো কোন গাড়ি বের হয় নি, স্যার!’ শুনে স্বস্তি হল।
বাজারে গিয়ে রহস্য
ভেদ। খাঁচায় একটা জ্যান্ত মোরগ, প্রাণপণে ‘কক্কড়অ ক্ক ডেকে উঠল। ছোটবেলা থেকে এই
ডাক চিনি, ঠাকুমা মিথলজির মিশেল দিয়ে বলতেন, কৃষ্ণের হাত থেকে কংসকে বাঁচাতে কে
একজন বলে উঠেছিল, ‘কংস রে সর!’ আর তাইতে শ্রীকৃষ্ণের রাগ গিয়ে পরে লোকটার ওপর,
‘তুই সারাজীবন মোরগ হয়ে এই একটাই কথা বলবি।‘ সেই থেকে মোরগ ভোর হলেই ডেকে ওঠে,’কংস
রে সর, ‘কক্কড়অ ক্ক!’ আজকের রবিবারের সকালেও সে একই ডাক দিল। ডাকটা চেনা বলেই মজা
লাগল।
রাতে কান পেতে থাকি,
কখন মোরগের সেই মিথলজি প্রাণ পাবে। ডাক শোনার আগেই ঘুম পেয়ে গেল। ঘুমিয়েও পড়ি।
সকালেও ডাকটা কানে এলো না। দেরি করে ঘুম ভেঙেছে। রিটায়ারড মানুষ। আমাদের যাহা
রোববার, তাহা সোমবার! পরে গিন্নির চাহিদায় বিস্কিট কিনতে বাজারে যেতেই হল। দেখি,
মোরগটা নেই। ‘নোটন, মোরগ ছিল না একটা? কোথায়?’ নোটন জিভে কামড় দেয়, ‘কী যে করেন
কাকা? আগে বলবেন তো, ওটায় নজর ছিল আপনার! রবিবারের বাজার, মাংসের চাহিদা এমনিতেই কুলোতে
পারি না। কাল বিক্রি হয়ে গেছে। দারুণ পিস ছিল, কাকা! দুশ কম দুই কেজি......’ চমকে
উঠি। কক্কড়অ ক্ক তাহলে ‘কংস রে সর’ বলে নি! ছিল আর্ত চিৎকার। সকালের অপেক্ষা না
করেই!
--------------------------
২৮ নভেম্বর, ২০১২
আমাদের বাড়িতে ছাগল পোষা হত।
একবার একটা ছাগল বাচ্চা দিল। মা বলেছিলেন, নতুন বিয়নো ছাগলের দুধ খেতে
নেই। ফেলে দিতে হয়। ছাগ শিশু বড় হলে আমরা ওই দুধ খেতে পারি। তার আগে না। তখন কত
বয়স আমার? মনে নেই। পাড়ার দিদিরা
রান্না বাটি খেলে। আমি আর ক্যাবলা চাকর। বাজারে যাই। আতা পাতাকে মাছ কল্পনায় কিনে
আনি। দিদিরা রসিয়ে রসিয়ে রান্না করেন,খাওয়া দাওয়া হয়। এক দিদি বলল, 'চল ছাগলের দুধ নিয়ে আসি।' আমি ছাগলের দুই ঠ্যাং চেপে ধরি, ক্যাবলা ছাগলটাকে জাপটে ধরে
থাকে, দুধ দোয়ানো হয়। একটা বালতিতে
ওই দুধ রেখে অনেকখানি জল ঢেলে দিদিটি আমাকে বলে, 'বাবলু, আমরা খুব বড় লোক। আমরা দুধ
দিয়ে হাত ধুই, পা ধুই। আমি রাজকুমারী।' বলেই হাত পা ধুতে থাকে। আমি
বললাম, 'আমি রাজা! আমি দুধ দিয়ে
স্নান করি' বলেই বালতি উলটে আমার সারা গায়ে মাথায় ঢেলে
দিই। উরি সব্বোনাশ! সারা গায়ে কী দুর্গন্ধ! ভয় পেয়ে যাই। মা'র কাছে ধরা পড়ে যাবই। কূয়োর
পাড়ে গিয়ে ন্যাংটো হয়ে সারা গা হাত পায়ে সাবান-ছোবরা ঘষেও লাভ হলো না। রাতে শোবার
আগে জামা-কাপড় পাল্টাবার সময় ধরা পড়ে গেলাম... আর মনে পড়ছে না এখন।
আজ
রাস্তায় একটা দুগ্ধবতী ছাগল দেখে সারা গায়ে সেই ফেলে আসা গন্ধটা ধেয়ে এলো! সেটা
তেমন খারাপ লাগল না।
--------------
14
November, 2012
আজ আমার ছোটবোনের কাছ থেকে ফোঁটা নেব। ১৯৭১
সালের পর মাঝখানে কোন বছর ওর হাতের ফোঁটা পাইনি, মনেই পড়ে না। আমরা দিল্লিতে কাছাকাছি থাকি। মনে
পড়ে, ছোটবেলায় ও থাকত আমার পিঠে সেঁটে, আর আমি ওকে পিঠে নইয়েই খেলতাম লুকোচুরি, মার্বেল যা কিছুই। এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল, বোনটা পিঠে না থাকলে খেলতেই পারতাম না। জিততেও
না।
---------
12
November, 2012
আমাদের ছোটবেলার শহরটা ছিল ছোট একটা জেলা সদর।
আমার কৈশোরের শেষ বেলা অবধি বিদ্যুৎ আসে নি সেখানে। তাই পুজোর সময় যেমন আকাশ
ঝলমলিয়ে মলিন চাঁদ ফুটত, কালিপূজার রাতে তেমনি সারা শহর কালি মেখে অন্ধকারে ডুবে যেত। দূর কোনো বাড়ির
প্রদীপের শিখাতেই পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়ত সারা পথ জুড়ে। সে এক দুরন্ত অনুভূতি। মা
অন্ধকারে বের হতে দিতেন। তবু, মা না-চাইতেও, আমরা মাকে আশ্বস্ত করতাম। দুর্গাপূজায় নাড়ুর জন্য ব্যবহৃত নাড়
কোলের আধখানা খোলের গর্তে আধখানা মোমবাতি
জ্বেলে, টর্চ বানাতাম। মা হাসতেন। আজও সেই হাসিমুখটা
চোখে ভাসে।
আমরা গরীব ছিলাম
অন্য কারণে। বাবা রাজনীতির মানুষ, নেতা। প্রায়ই চলে যেতেন জেলে। সরকারের নানা অছিলায়। মা সংসার চালাতেন বাবার
কিছু দিনের ওকালতির জমা টাকায়। আমরা আট ভাই-বোন। আমরা প্রত্যেকে এটা বুঝতাম ষোল
আনা। শহরের গুদরি বাজারের এক প্রান্তে ছিল চাবিওয়ালাদের চালা। আমরা দু ভাই সেখান
থেকে ফুটোওয়ালা লোহার চাবি কিনে, সেই চাবিকে হাত- ফুট বাতার মাথায় কষে বেঁধে, দিয়াশালাইয়ের কাঠির মাথা চেঁছে বারুদ নিয়ে
চাবির ফুটোয় সেই বারুদ ঠেসে, ভোঁতা একটা পেরেক দিয়ে ফুটোটাকে টাইট বন্ধ করে, চাবিটা উল্টো করে পাথর-শক্ত কিছুতে দরাম করে
হাতুড়ির মতো মারলেই, দুম! মানে, আমাদের ছোটবেলার এটম বোমা!
কালিপূজার
পরেরদিন সকালে মাঠ রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত তারাবাতির দগ্ধ শিক, ফাটা বোমার ছিন্নভিন্ন কাগজ, বোমা ফাটার ধূসর ছ্যাতরানো দাগ আরো কত কি।
সবকিছুই শিশিরের চোখের জলে ভেজা ভেজা। মন খারাপ হয়ে যেত। কান্না পেয়ে যেত। আমি
কোনদিনই মহান নই। আমি আজও নানা জায়গায় ঈর্ষান্বিত মানুষ। জানি না, বড় হয়ে অনেক অনেক বাজি পোড়াবার শপথ সেই সব দিনে
নিয়ে ছিলাম কিনা। কিন্তু কী এক অসামান্য মানসিক রসায়নে, যত বড় হয়েছি ততই বাজি পোড়ানোর শখ ধীরে ধীরে
স্তিমিত হয়ে গেছে। এত স্তিমিত হয়ে গেছে এক সময়, আমার দু ছেলেমেয়ের একজনকেও অনেক বাজির মজা পেতে
দিতে পারিনি। ওদের একজনও বাজির প্রতি আগ্রহী হতে পারে নি। এই নির্মমতার জন্য
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। ওদের ছোটবেলার একটা উত্তেজনা আমার কারণেই উধাও হয়ে
গেছে।
-----------------------
11 October, 2012
--------------
---------
12 November, 2012
আমরা গরীব ছিলাম অন্য কারণে। বাবা রাজনীতির মানুষ, নেতা। প্রায়ই চলে যেতেন জেলে। সরকারের নানা অছিলায়। মা সংসার চালাতেন বাবার কিছু দিনের ওকালতির জমা টাকায়। আমরা আট ভাই-বোন। আমরা প্রত্যেকে এটা বুঝতাম ষোল আনা। শহরের গুদরি বাজারের এক প্রান্তে ছিল চাবিওয়ালাদের চালা। আমরা দু ভাই সেখান থেকে ফুটোওয়ালা লোহার চাবি কিনে, সেই চাবিকে হাত- ফুট বাতার মাথায় কষে বেঁধে, দিয়াশালাইয়ের কাঠির মাথা চেঁছে বারুদ নিয়ে চাবির ফুটোয় সেই বারুদ ঠেসে, ভোঁতা একটা পেরেক দিয়ে ফুটোটাকে টাইট বন্ধ করে, চাবিটা উল্টো করে পাথর-শক্ত কিছুতে দরাম করে হাতুড়ির মতো মারলেই, দুম! মানে, আমাদের ছোটবেলার এটম বোমা!
কালিপূজার পরেরদিন সকালে মাঠ রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত তারাবাতির দগ্ধ শিক, ফাটা বোমার ছিন্নভিন্ন কাগজ, বোমা ফাটার ধূসর ছ্যাতরানো দাগ আরো কত কি। সবকিছুই শিশিরের চোখের জলে ভেজা ভেজা। মন খারাপ হয়ে যেত। কান্না পেয়ে যেত। আমি কোনদিনই মহান নই। আমি আজও নানা জায়গায় ঈর্ষান্বিত মানুষ। জানি না, বড় হয়ে অনেক অনেক বাজি পোড়াবার শপথ সেই সব দিনে নিয়ে ছিলাম কিনা। কিন্তু কী এক অসামান্য মানসিক রসায়নে, যত বড় হয়েছি ততই বাজি পোড়ানোর শখ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে গেছে। এত স্তিমিত হয়ে গেছে এক সময়, আমার দু ছেলেমেয়ের একজনকেও অনেক বাজির মজা পেতে দিতে পারিনি। ওদের একজনও বাজির প্রতি আগ্রহী হতে পারে নি। এই নির্মমতার জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। ওদের ছোটবেলার একটা উত্তেজনা আমার কারণেই উধাও হয়ে গেছে।
-----------------------
১৯৬২ সাল। বয়স সতেরো। তিন-চার মাস হল কলকাতায়, প্রথম। এসেই শিয়ালদায় তিনতলার সাত বাই ছয় সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে রাত-দিন। এক সকালে চোখ মেলে চিলতে জানালাটার কাছে দাঁড়াতেই, দেখি, নিচে বাঁশ জড় করা হচ্ছে। পুজোর প্রস্তুতি। তখন কাইজার স্ট্রিটের কোয়ার্টারের মাঝখানে ছিল মাঠ। ফুটবল পায়ে দৌড়াদৌড়ি চলত। সেখানে পুজো। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় ধবধবে শাদা পেঁজা মেঘ ধুপের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
এখনো মনে আছে সেই ক্ষণটাকে। মেঘের মসলিন সরিয়ে সরিয়ে ফেলে আসা পাড়ার পুজো ফুটে উঠতে থাকে । উত্তরবঙ্গের পুজো আসে আকাশে, রদ্দুরের মিষ্টি ওমে। কাশ ফুলে না। কাশফুল আমি দেখিনি। গ্রামে থাকিনি বলেই হয়ত।
জানালা গলে ওপরে তাকিয়ে দেখি, অন্য আকাশ। স্কয়্যার ফুটে মাপা যায়। মনটা
বিষন্ন হয়ে গেল। দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ছোট বোন দুটোর জন্য, দাদাদের জন্য। মা’র জন্য। পাড়ার দুর্গা ঠাকুরের জন্য। আমি
কেঁদেই ফেললাম।
আমাদের দুর্গা ছিল আমাদের মার মতো। দুপাশের ছড়ানো হাতে আমাদের
মা’কে দেখাত জটায়ূর পাখির মতো। বিশাল। আমাদের
আট ভাই-বোনকে দশ হাতে সাপটে আগলে রাখতেন। বাবা তো রাজনীতিতে অনমনীয় থেকে শহরের
জেলখানাটাকেই বাড়ি বানিয়েছিলেন।
এই একটি আকুতি ছাড়া, আমার আর কোন দুঃখ ছিল না। কলকাতার পুজোয় পকেটে
পয়সা থাকা দরকার, এইটে ওই তিন
মাসে অনুমান করতে পারিনি। আকাশ বাতাস আর রদ্দুর নিয়েই খুশি আমি। হেঁটে শিয়ালদায়
যাই। ফ্লাইওভার এসেছে অনেক পরে। বৈঠকখানা বাজারের গলির মুখে পুজো, আর শিয়ালদা জুড়ে নতুন কেনাকাটার হুল্লোড়।
ওই সময়ে মির্জাপুরের মুখ থেকে প্রাচী সিনেমা অবধি দোকানগুলোর ব্যস্ততা দেখেই
উত্তমকুমারের কলকাতাকে খুঁজে পেতাম। মরিস- অস্টিনকে তখনো এমবাসাডর বাজার ছাড়া
করেনি। দোতলা বাস, জবুথুবু
ট্রাম, আর স্টেটবাস, প্রাইভেট এসেছে ৬৭-৬৮ নাগাদ, এই সব দেখেই আমি কলকাতার বিস্ময়ে আবিষ্ট ও
কলকাতায় আসার গর্বে বুক টান। বুঝে ফেললাম, বদলে-যাওয়া পূজাতেই লুকিয়ে আছে আনন্দ, ভালোলাগা না-থাকলেও।
পুজো এসেই গেল। মহালয়া কী, আমরা জানতাম না। কিন্তু এখানে মহালয়ার ভোরে জেগে
উঠল সারা পাড়া। ছোটদের চিৎকারে পাখিদের কলখল বোঝাই গেল না। আমি জানালা দিয়েই দেখতে
থাকি কলকাতার পুজো। এতো আগে শুরু হয়?
ষষ্ঠী আসতেই জল ঢালতে থাকে কেউ আমার খুশিতে। আমার কান্না পেতে
থাকে। কেঁদেও ফেলি। ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লজ্জা কী? চোখের জল শুকোতে না শুকোতেই সপ্তমীর সকালে
বেজে উঠল ঢাক। ঘরে থাকা দায়। প্যান্ডেলেও। স্টেটসম্যানটা নিয়ে খবর খুঁজতে থাকি।
এমন সময় প্যান্ডেলের মাইকে বেজে উঠল পুজোর গান। শ্যামলের। আগে
শুনিনি। বাষট্টির পুজোর গানঃ ‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে... মনহরিণি
করুণ তার তান তুলেছে, এমন দিনে
তুমি মোর কাছে নাই, হায়।
স্মৃতিরা যেন জোনাকীরই ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি... আপন নীড়ে ফিরে গেছে পাখি, নীড় হারায়ে আমি পথে থাকি...
এমন একটি করুণ আবহে এমন স্ফূর্তির উৎসার কিশোর আমাকে অন্য
দিশা দিয়ে বসল। আমি কোয়ার্টারের উল্টো ফুটে সার্কুলার রোডের আমজাদিয়ার চিলতে রকে
গিয়ে বসে পড়ি। সারা কলকাতা তখন পুজোর উথাল স্রোতে ঘূর্ণি তুলেছে। দেখতে থাকি।
বুঝতে থাকি এখন থেকে এই পূজাতেই খুঁজে নিতে হবে আনন্দ, ভালোলাগা না-থাকলেও।
------------------
No comments:
Post a Comment