(Please read from Bottom to follow the sequence)
40 // কলামনিস্ট //
39. // সাংবাদিকতার পাঠভবন //
38. // সাক্ষী রেখে //
ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিজমে ভর্তি হতেই আমার সাংবাদিক হবার সম্ভাবনা আর উৎসাহ দুইই অনেকখানি বেড়ে গেল। দুপুরের ইংরেজি ক্লাশে যাওয়া মূলত আড্ডা দিতে, পড়াশুনো গৌণ। আমার কাছে মাছের চোখ সাংবাদিকতায় , ইংরেজি পড়ে মাস্টারি করা না। এখন ঠিক মনে নেই ওই সময় ঢাকা থেকে বের হ’ত একটা দৈনিক, ‘সংগ্রাম’। যতদূর মনে পড়ে, সংগ্রামই। আমার কাছে রীতিমত আসত। আমি সেখানে টুকিটাকি খবর পাঠাতাম। ‘সংগ্রাম’ কে পাঠাত আমার কাছে, মনে পড়ছে না। সম্ভবত বুলু ভাই।
বুলু ভাই আমাদের পাড়ায় থাকতেন। আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। রিটায়ার্ড জজ সাহেবের ছেলে। বস্তুত তাঁর হাতেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। তখন ম্যাট্রিক দিয়েছি । রেজাল্ট বের হয় নি। বের হলে স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকব। স্টেশন রোডের ওপরে এক রেস্ট্যুরেন্টে বসে বুলু ভাইয়ের কাছেই প্রথম জেনেছিলাম, সাংবাদিক হবার সহজ পথ। জেনেছিলাম একটা শব্দ, স্ট্রিঞ্জার। কোন কাগজ বা এজেন্সির লোক না হয়েও যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁরাই স্ট্রিঞ্জার। এদের জোগাড় করা খবরের যদি নিউজ ভাল্যু থাকে, তবে তা ছাপা হয়। কাগজে ছাপা খবরের লাইন মেপে পয়সা।
এ কথা জানার পরদিনই চুপি চুপি একটা খবর লিখলাম, বাড়িতে ইত্তেফাক পত্রিকা রাখা হত, তাদের ঠিকানায়, ঢাকায়, পাঠিয়ে দিলাম। ‘দিনাজপুরে পাগলা কুকুরের আধিক্য’। অবাক, সেই খবরটা ছাপা হয়ে গেল। ‘সংবাদদাতা’র বাই লাইনে।
একদিন দিনাজপুরে আকাশ কালো করে পঙ্গপাল ধেয়ে এলো। আমরা ছোট, কিশোর যুবা বুড়ো সেই কালো মেঘের পিছু পিছু ছুটে গেলাম। বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতে পঙ্গপালদের কচকচ কুটকুট আওয়াজ কানে এলো। বড়রা বলল, সব ফলন ওরা খেয়ে ছিবড়ে করে দেবে। আমি বাড়িতে ছুটে আসি। একটা খবর লিখি। আঁঠার অভাবে জিগা গাছের রস দিয়ে খামের মুখ বন্ধ করে সোজা ডাকবাক্সে। সে খবর ছাপা হয় নি। পরদিন বিকেলে যখন ঢাকা থেকে কাগজ এলো, সেখানে পঙ্গপালের খবর অনেক বড় বড় করে ছাপা হয়েছে। কিন্তু আমার পাঠানো খবর কোথাও নেই। ‘থাকবেই না তো।‘, বুলু ভাই বললেন, ‘তোর খবর তো পৌঁছেছে একদিন পার করে। এসব খবর ডাকবাক্সে যায় না। ফোনে যায়।‘ সেদিন জানলাম, খবর দৌড়য়, হাঁটে না--‘রানার রানার রানার ছুটেছে খবরের বোঝা বয়ে’।
মনে হয়, এই বুলু ভাই দৈনিক সংগ্রামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে থাকবেন। ফেলে আসা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে এই ‘সংগ্রাম’ ছিল আমার একমাত্র যোগসূত্র। আর সেই সূত্রেই কলকাতার সাংবাদিকতায় আমার প্রবেশ, ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতায় ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েই।
সাংবাদিকতায় আমাদের মাস্টার মশয় ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার। যুগান্তরের নিউজ এডিটর। যুগান্তরে আমার যাতায়াত ছিল। ‘সংগ্রামে’ যেসব ছবি বের হত, বিশেষ করে আয়ূব বিরোধী মিছিল লড়াই, সেইসব ছবি তাঁকে দিয়ে আসতাম, তিনি ছাপতেন। কোথাও অবশ্য আমার নাম থাকত না। তাই মনটা ভরত না। ক্লাশে বলতাম, এই ছবি আমি দিয়েছি। বন্ধুরা মানত না। হাসত। বিশেষ করে, নীহার। নীহাররঞ্জন মজুমদার। পরে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের চীফ পিআরও হয়ে অবসর নিয়েছে। নীহারের কথা বলতেই হয়। খুব মজামদার সদা হাস্যময়। বেঁটেখাটো, অভিনেতা রবি ঘোষের মত চটপটে, উইটি। তাৎক্ষণিক রিফ্লেক্সে নীহারের জুরি মেলা ভার। আমরা ওকে রবি ঘোষ বলেও ডাকতাম। রাগ করত না, সাড়া দিত। নীহাররা থাকত মধ্য কলকাতার কেশব চন্দ্র স্ট্রীট আর আমহার্স্ট স্ট্রিটের জংশনের কাছে। মানে, পাক্কা কলকাতার ছেলে সে। আমার মত সে বাঙাল রিফ্যুজি না। কলকাতা সম্পর্কে কম জানাটা অপরাধ না হলেও, একটা গাঁয়ের ছেলের গন্ধ আমার গায়ে তো ছিলই। তাই নীহারের রসিকতার টার্গেট হতে হত আমাকে প্রায়ই।
একদিন ক্লাশে, তখন মাত্র কয়েকমাস এসেছি ক্লাশে, নীহার বলল, ‘আজ যুগান্তরে একটা লেখা বেরিয়েছে। অরুণ চক্রবর্তীর নামে। অরুণ, ব্যাটা, চালিয়ে দে তোর নামে।‘
আমার বুকে ছলাৎ করে ওঠে রক্ত। জিজ্ঞেস করি, ‘হেডলাইনটা কী?’ নীহার তাচ্ছিল্যে বলে ওঠে, ‘ঐ পূর্ব পাকিস্তান টাকিস্তান নিয়ে।‘ আমি কি মাটিতে বসে পড়ব? পা কাঁপছে। অবশ হয়ে আসছে আমার শরীর। এও সম্ভব? হতে পারে? কলকাতার কাগজে! তাও যুগান্তরের মত এক নম্বর দৈনিকে? বিবেকানন্দ মুখার্জী ছিলেন যার সম্পাদক! সেখানে আমার লেখা?
কাউকে কিছু না বলে পা টিপে টিপে আশুতোষ বিল্ডিং থেকে নেমে কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম লাইনে পৌঁছেই ছুটতে থাকি কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে। হাঁফাতে হাঁফাতে হকারের সামনে মেলে রাখা ধুলো মলিন যুগান্তরের কপি নিয়ে মেলে ধরি। একই হেড লাইন—‘ছাত্রশক্তিই আয়ুবকে টেমে নামাচ্ছে’, যুগান্তরের তারিখ, ২৮ জুলাই, ১৯৬৮।
যেদিন সকালে লেখাটা লিখে ফেলেছিলাম। সেদিনই স্নান খাওয়া সেরেই ছুটে গিয়েছিলাম বাগবাজারে। সেই সময় আনন্দমোহন লেনের গলিতে ছিল যুগান্তরের অফিস ও প্রেস, বিশাল কয়েকতলা বিল্ডিং জুড়ে। শুধু এডিটোরিয়ালটা ছিল বাগবাজার স্ট্রিটে, একটু দূরে, বড় রাস্তার ওপরে। লাল রঙের পুরানো দিনের উঠোনওয়ালা বাড়ি। চারপাশে ্লম্বা লম্বা গোলাকার থাম, কারুকাজের রেলিং চারপাশের বারান্দায়। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলেই লম্বালম্বি টেবিলের পর টেবিল, পাশাপাশি। সবাই অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর। প্রথম দরজার মুখোমুখি টেবিলে যিনি বসে ছিলেন, পরে জেনেছি, তিনি কৃষ্ণ ধর। স্বনামধন্য কবি। আমি অতসব জানতাম না। সোজা তার কাছে চলে যাই। বলি, ‘আমি সাংবাদিকতা পড়ি, একটা লেখা লিখেছি। আপনাকে একটু পড়ে দেখার জন্য দিতে চাই। ছাপার জন্য না।‘
কৃষ্ণ ধর স্বল্পভাষীই শুধু নন, মৃদুভাষীও। টেবিলের মাথায়, একপাশে, কতগুলো লেখার ডাঁই, দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে রাখো, সময় করে দেখব। ‘ লেখাটা সযত্নে পাট পাট করে রেখে দিলাম, বললাম, ‘ আমি ক’দিন পরে জেনে যাব।‘ কৃষ্ণদা মুখ তুললেন, বললেন, ‘এসো।‘ কথাটার দুটো অর্থ, এক, ‘আবার এসো’, দুই, ‘এখন আসতে পার।‘
মন ভরল না। ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বিকেলের সাংবাদিকতা ক্লাশে চলে যাই। আজ ছিল সেদিনের পরে তৃতীয় দিন। ভাবা যায়?
---------------------------------------------------------------------------
আমার আত্মজীবনী, ‘যে জীবন আমার ছিল না’ থেকে
39. // সাংবাদিকতার পাঠভবন //
মঞ্জুল গুপ্ত। কফি হাউসে কী করে যেন আলাপ। ছিমছাম। মাঝারি গড়ন। মেটাল ফ্রেমের চশমা। মুখে স্নেহশীল হাসি। মাঝারি গৌরবর্ণ। আমার আকর্ষণ, তিনি ইংরেজি অমৃতবাজার পত্রিকার সাব-এডিটর। আর আমি বিএ পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায়। ভবিষ্যতের খসড়া মকশ করছি। তাই, দেখা হলেই মঞ্জুলদার সঙ্গে কফি হাউসে আড্ডায় বসে যাই। সাংবাদিকতাই আমাদের দুজনের একান্ত আলোচনায় জায়গা নেয় বেশি। এর মধ্যে রেজাল্ট বেরুল। পাশ। এবার?
মঞ্জুলদাই পরামর্শ দিলেন, ‘জার্নালিজম ক্লাশের জন্য ফর্ম ভরো। তোমার ইংলিশ অনর্স, প্রেফারেন্স পাবেই।‘ একদিন বললেন, ‘ফর্মটা ফিল আপ করে আমাকে দিও, দক্ষিণাবাবুকে দিয়ে রিকমেন্ড করিয়ে নেব। ‘দক্ষিণাবাবু’ মানে দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার। যুগান্তরের নিউজ এডিটর, ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা পড়ান। সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান, চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক, এককালীন সাংসদও ছিলেন। এই চপলাবাবুর প্রিয়ভাজন দক্ষিণাবাবু, বললেন মঞ্জুলদা।
একদিন হাতে এলো দক্ষিণাবাবুর সই করা ফর্ম। জমা দিয়ে এলাম। আশুতোষ বিল্ডিং আর দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং-এর জোড় যেখানে, তার দোতলায় জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট। দুটো টেবিলে দুটো মানুষ। স্টুলে একজন বেয়ারা। কাঠের পারটিশনের ওপারে ডিপার্টমেন্টাল হেডের টেবিল চেয়ার। এই চারজনের ডিপার্টমেন্ট। অফিসের লোকদুটোকে পছন্দ হল না। বড়বাবু গোছের যিনি, তাঁর নাম জয়দেব, ঈষৎ ফর্সা, লম্বা ভারি চেহারা। দ্বিতীয়জন, তাঁর অফিস এসিস্টেন্ট দেবুবাবু, ময়লা রঙ, বেঁটে খাটো, মাথায় চুল কম, একটু লেংচে হাঁটেন। জয়দেব অনেক অনিচ্ছায় ফর্মটা নিলেন। দক্ষিণাবাবুর সই দেখে মুখ বাঁকালেন, ‘খুব এলেমদার তো তুমি! সইফই করিয়েই এনেছ দেখছি!’ ইচ্ছে ছিল, চপলাবাবুকে দেখি। অত নাম শুনেছি, অত বড় সাংবাদিক! ছিলেন না সেদিন।
দেখা হল ইন্টারভ্যুর দিন। দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং-এর কোন এক ঘরে। অনেকেই ছিলেন। চপলাবাবুও। লম্বাটে মুখের নিচে থুতনিটা ঝুলে আছে। মাথায় পুরো টাক, দু’ একটা কালো চুলের রেখা এখানে সেখানে। ঝুঁকে বসেছেন, টিপিক্যাল কংগ্রেসী বেশ। ধুতি পাঞ্জাবি, কাঁধে সাদা চাদর, নিটোল ভাঁজ। অনেকটা রাজাগোপালাচারির মত। আমার কুন্ঠা বা ভয়ের কারণ নেই। লেখার ব্যাপারে এফ এল লুকাস, রাজ্য আর দেশের খবরাখবরের জন্য স্টেটসম্যান, আন্তর্জাতিক জগতের হাল হকিকতের জন্য টাইম পত্রিকা। রিডার্স ডাইজেস্ট তো আছেই প্রত্যয়ী জীবনের হদিশ দিতে। মূলত এই চারটি সুত্র উৎসেই আমার স্নান। ফুরফুরে মন নিয়ে ঢুকেছি ইন্টারভ্যুয়ে। অন্যদের তুলনায় চপলাবাবুই বেশি প্রশ্ন করলেন। এখন অত ডিটেইল মনে পড়ছে না। তবে আমি যে ভালো উত্তর দিয়েছি, অনুমান করতে পারি। চপলাবাবু একসময় জিজ্ঞেস করলেন, ‘অন্য কোন সাবজেক্টে অ্যাপ্লাই করনি ?’ আমি বুকে ফুলিয়ে বলি, ‘করেছি স্যার। ইংরেজিতে।‘ চপলাবাবু একটু চমকেই গিয়েছিলেন আমার উত্তরে, মনে আছে।
ইংলিশ নিয়ে এমএ পড়ার ফর্ম জমা দিয়েছি আগেই। ভাবনা আমার তখন, দুটি সাবজেক্ট নিয়ে এমএ ক্লাশের পড়া সামলাব কী করে। মনে মনে প্রত্যয়ের শিকড় চাড়িয়ে দিলাম তবু, আসুক তো ব্রিজ, তা পেরুবার কথা প্ল্যান করা যাবে তখন।
কিন্তু ব্রিজ এলো যখন, দেখি তা দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে। জার্নালিজমের ফাইন্যাল লিস্ট বেরিয়েছে। আমার নাম নেই। কেনো? কে উত্তর দেবে? মঞ্জুলদা লজ্জায় পড়ে গেলেন, তা তো হবার নয়। পাশেই বসেছিলেন তাঁর এক বন্ধু, মঞ্জুলদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দক্ষিণাবাবু ফর্মের ডান দিকে সই করেছিলেন, নাকি বাম দিকে? দক্ষিণাবাবু এই ভাবেই মুখ রক্ষা আর রিকমেন্ডেশানকে ভাগ করে নেন শুনেছি।‘ মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু এও স্থির করলাম, এভাবে জীবনের স্বপ্নকে বইয়ে দেয়া যায় না। ঠিক করলাম, জার্নালিজমে ভর্তি হওয়ার জন্য উইল কিপ নো স্টোন আনটার্ন্ড।
ডিপার্টমেন্টে চপলাবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে যাই, ‘লিস্টে আমার নাম না থাকার তো কারণ থাকবে স্যার, সেটা কী?’ উনি একটা বই বা কাগজ বা ফাইল দেখছিলেন, মনে নেই, সেভাবেই বললেন, ‘সেটা তোমাকে বলব কেন? তুমি ইন্টারভ্যু থ্রু করো নি, তো করো নি। এখন আমি কী করে বলব, কেন তোমার নেই।‘ সোজা সাপটা আমাকে পাত্তা না দেওয়া। একটু রেগেই গেলাম, ‘আমি জার্নালিজমে আনফিট এটা কী করে জানলেন? আপনি আমার ইন্টারভ্যু নিয়েছেন। বলুন, আমাকে আনফিট মনে হয়েছে?‘ এবার মুখ তুললেন, ‘অ্যাম নট সাপোসড টু রিমেম্বার ইয়োর পারফরম্যান্স এনিওয়ে! তুমি এখন যেতে পার।‘ আমি গলার স্বর নরম করলাম, তার পায়ে পড়লাম যেন, কাতর হয়ে উঠি আমার অন্ধকার ব্যর্থ ভবিষ্যতের কথা ভেবে, বললাম, ‘স্যার, আমি বাড়ি পালিয়েছি, শুধুমাত্র জার্নালিজম করব বলে। আই উইল বি রুইন্ড, স্যার, যদি অ্যাডমিশিন না পাই।‘ চপলাবাবু যেন এতে আরো রুষ্ট হয়ে উঠলেন, ‘পরের বছর চেষ্টা কোর। এখন যাও। কথা বাড়িও না।‘ আমি পায়ের নিচে শিকড় চারিয়ে দিই, ‘স্যার এখন যাচ্ছি, তবে যেদিন আপনার লিস্টের একটি ছেলেও জার্নালিজম পড়া ছেড়ে দেবে, সেদিন আবার আসব এবং সেদিন আমি এডমিশন নিতে আসব না।‘
চপলাবাবু এবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। দেবু! একে বের করে দাও এখান থেকে।‘ দেবু বোধয় শুনতে পাচ্ছিলেন সব কথা। আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে আলতো টান দেন, ‘চলো চলো, স্যার বলছেন যখন, চলো।‘
বেরিয়ে আসি। গোলদিঘির পাড়ে গিয়ে বসি। এবার?
কান্না পেয়ে গেল। মা’র কথা মনে পড়ল। মা আজ কষ্ট পাচ্ছেন খুব। কিছদিন বাদে মা’র চিঠি যখন আসবে, তখন মিথ্যে বলব কী করে? এ তো আর জ্বর নয় বা অঙ্ক পরীক্ষায় ৪৫ পাওয়া নয় যে, মিথ্যে বলেই মাকে খুশি করা যায় সহজে? কেঁদেই ফেললাম। দু’ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামল। আজো কখনো সখনো গোলদীঘিতে গেলে জায়গাটার দিকে নজরে পড়ে। উত্তর ঘেঁষা পশ্চিম পাড়ে, মাটিতে জল ছুঁই ছুঁই করে বসেছিলাম। গাল থেকে জল মুছি না। এ হার তো আমার নয়, আমি তো ফেল করিনি, কেউ কোথাও বসে আমাকে ফেল করালো মাত্র। হঠাৎ মনে এলো, নিজেকে শোনানো নিজেরই প্রত্যয়ের কথা, উইল কিপ নো স্টোন আনটার্ন্ড। তখন থাকি সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের রুবি বোর্ডিং-এ। হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই ফিরে যাই। পরবর্তী আনটার্ন্ড স্টোনটার খোঁজে।
রুম মেট ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের মাখন দা, সেদিন গ্রামের বাড়ি গেছেন। তাঁরই উল্টো দিকে আমার খাট। একদিকে দেয়াল বরাবর আর একজন স্বল্পভাষী সিনিয়ার। তিনি শুয়ে। ঘরটা শান্ত হয়ে আছে। মাঝেমধ্যে জানালার পাশেই সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট বেয়ে রিকশার টুংটাং। পথচারির চাপা কন্ঠস্বর। ভাবতে থাকি, আর কি স্টোন বাকি থাকতে পারে যা আনটার্ন্ড করে দেখা দরকার? দক্ষিণাবাবুর সঙ্গে দেখা করব? লাভ নেই। চপলাবাবু চ্যালেঞ্জ তুলে নিয়েছেন। আমাকে বের করে দিয়েছেন ডিপার্ট্মেন্ট থেকে। বাকি মঞ্জুলদা। তিনিও তো হাত তুলে বলে দিয়েছেন, ‘এমনটা তো হবার কথা নয়?’ নয়ই তো! তবু তো হয়েছে। সারা কলকাতায় আমার আর দ্বিতীয় কারো সঙ্গে পরিচয় নেই, কোন না কোনভাবে যে সাংবাদিকতার কারো সঙ্গে পরিচিত। গোলদীঘির কান্না তখনো মুখে গালে শুকনো পরত ফেলে রেখেছে। হতাশায় শরীর ক্লান্ত হয়ে আসে।
এই সময় একটা রিকশা ক্রমাগত টুংটাং টুংটাং করতে করতে জানালার পাশ দিয়ে ছুটে যায়। লাফিয়ে জানালার জালের ঘেরাটোপে নাক সেঁটে দেখার চেষ্টা করি রিকশাওয়ালাকে, সে দূরে, টুংটাং টুংটাং করতে করতে ডান দিকে নরেন সেন স্কোয়ারের দিকে বেঁকে গেল।
বেশ মজা লাগল। একটা রিকশাওয়ালা প্রত্যয়ের সঙ্গে তাঁর রাস্তা করে করে ছুটে গেল, অথচ আমার রিকশার চাকা কাদায় গেঁথে বসে গেছে। নিজে থেকে তা তুলে আনা সম্ভব না। যদি আর কেউ এসে হাত লাগায় তবেই যদি বা ওঠে...
একসময় খাতা খুলে লিখতে বসে গেলাম। ‘পরমশ্রদ্ধাভাজনেষু,...। চিঠি। চপলাকান্ত ভট্টাচার্যকে।
অভিমানী চিঠিটায় সাংবাদিকতার প্রতি আমার আকাঙ্খা, বিশ্বাস, মনোভাব এবং সর্বোপরি সাংবাদিকতার প্রতি আমার প্রত্যয়ের কথা এমনভাবে লিখলাম, যেন সেখানেই ফুটে ওঠে সাংবাদিকতায় আমার ইতিমধ্যে অর্জিত দক্ষতা। এখন মনে নেই, আমি তাতে কী লিখেছিলাম। তুষারকান্তি ঘোষ, বিবেকানন্দ মুখার্জি, জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘গ্রাজুয়েট হও আগে’ উল্লেখে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথা কি লিখেছিলাম? আমি কী ভাবে সাংবাদিক হবার জন্য সতের বছর বয়সে বাড়ি পালিয়েছি, সে কথা? মনে নেই কিছু। শুধু এটুকুই মনে আছে, সে চিঠি সাজিয়েছিলাম সাংবাদিকতার জন্য ইতিমধ্যে আমার অর্জিত ক্ষমতা প্রকাশ করতে, এবং ওই বিপুলাকার মানুষটাকে তাঁর ভুল সিদ্ধান্তে লজ্জা দিতে। সেই চিঠিতে ভর্তি হবার জন্য বিন্দুমাত্র আর্জি রইল না। আমি কোন উত্তরের আশায় সেই চিঠি লিখলাম না। ক্ষোভে চিঠিতে আমার ঠিকানাও দিলাম না। পরদিনই, কাছেই আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠিটা খামে পুরে ডাক বাক্সে ফেলে দিলাম। ঠিকানা-- পরমশ্রদ্ধাভাজনেষু চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ জার্নালিজম, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, কলকাতা-৭
আমি কেমন পাগল পাগল হয়ে গেলাম। তবে কি সরকারী অফিসের কেরানীই আমার জীবন-লক্ষ্য? চলতে লাগল, সকালে ট্যুশান আর সারাদিন কফি হাউস, নয়ত বোর্ডিং-এর বিছানায়। চন্ডীদের বাড়ি কয়েকটা বাড়ি পরেই, অভীকরাও কাছে, এই পাড়াতেই। বোর্ডিং-এ আমার একগাদা মজার বন্ধু। তবু ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না জীবন। এর বেশি কিছু মনে পড়ে না এখন।এভাবে অনেকগুলো দিন কেটে গেল।
আবদার করতেই অভীকের মা ভর্তির ফি দিলেন। ইংরেজির এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়ে গেলাম। ক্লাশ শুরু হয়ে গেল। স্থির করলাম, মারো গুলি জার্নালিজম। ইংরেজি পড়ে ঘুরপথেই যাব সাংবাদিকতায়। আমেরিক্যান সেন্টারের লাইব্রেরি যতদিন আছে, আমার জার্নালিজমের ক্লাশও ততদিন থাকবে। নিজেকে বোঝালাম। তাছাড়া, ক্লাশে দ্রুত অনেক বন্ধু পেয়ে গেলাম। মন খারাপ ক’দিন পরেই উধাও। কফি হাউস ক্লাশ শেষের আমজাদীয়া হয়ে উঠল। অভীকদের বাড়ি কাছেই। তাই পাঁচ বন্ধুর আড্ডা বসতে লাগল হয় অভীকদের বাড়িতে, নয়ত কফি হাউসে।
একদিন বিকেলে কফি হাউসে ঢুকতেই দেখি, দূরের একটা টেবিল থেকে উর্দ্ধশ্বাস হাত নাড়তে নাড়তে মঞ্জুলদা আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। ‘আরে, কবে থেকে তোমাকে খুঁজছি! তোমার এডমিশন হয়ে গেছে। ডিপার্টমেন্টে চলে যাও। দক্ষিণাবাবু আমাকে বললেন, ‘তুমি যার ফর্মে আমার সই করতে এনেছিলে, সেই ছেলেটাকে বলো, এডমিশন হয়ে গেছে।‘ তোমাকে পাচ্ছিই না। কতবার কফি হাউসে খোঁজ করলাম, তোমার পাত্তা নেই। তুমি কোথায় থাক, তাও তো জানি না। আর দেরি কোর না...
আমি দিশাহারা হয়ে পড়ি।
পরদিন সকাল সকাল ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে যাই। জয়দেববাবু আমাকে দেখেই, ‘এই যে! কোথায় থাকো? সবাই এডমিশন নিয়ে ফেলল, এক তুমিই বাকি। টাকা এনেছ?’ পাশ থেকে দেবু বললেন, ‘তোমার চিঠি পড়ে চপলাবাবুর দু’চোখে জল’, একটু ব্যঙ্গ করেই বলেলেন, ‘কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে দিলেন। আমাদের বললেন, ‘যেভাবে পার ছেলেটাকে খুঁজে বার করো।‘
জয়দেব বললেন, ‘এ জন্যেই জমা ফর্ম আমরা খুঁটিয়ে দেখি। দক্ষিণাবাবু রিকমেন্ড করেছিলেন, আমি দেখেছিলাম, তাই তাঁকেই বললাম, আপনি ছেলেটাকে পেয়ে যাবেন। দেখুন না। যাও টাকা জমা করে দাও।‘
আমি আবার দিশাহারা। ইউনিভার্সিটি থেকেই ছুটলাম ঢাকুরিয়ায়। সেখানে আমার স্কুলের বন্ধু, মলয় সাহা থাকে। থ্রি থেকে নাইন অবধি একসঙ্গে পড়েছি। ওদের পারিবারিক ব্যবসা। টাকা চাইতেই মলয় দিয়ে দিল।
আমি সাংবাদিকতার ছাত্র হয়ে গেলাম! বিশ্ববিদ্যালয়ে।
-------------------------------------
38. // সাক্ষী রেখে //
দীপ্তি প্রায়ই এসে বলে অমুক দিনে অমুকে তাকে দেখতে আসবে এসেছে, মানে তাকে বিয়ের কনে হয়ে প্রায়ই বসতে হচ্ছে হবে। আপত্তির উপায় নেই, কেননা, আমিই ওর মাকে বুক ঠুকে বলে এসেছি, আপনারা বিয়ে দিলেও আমাদের আপত্তি নেই। এক বছরের আগে, গ্রাজুয়েট না হওয়া পর্যন্ত তো নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার উপায় নেই! তাই দীপ্তির বিয়ে যদি আপনারা দেনই, আমি বিয়ের দিনে এসে অতিথিদের খাবার পরিবেষণ করে যাব। নো প্রবলেম। তো? এখন বুকে জ্বালা কেন? দীপ্তিকে বললাম, পাত্ররা চলে যাবার পর তোমার মতামত চাইলে তোমার বাবাকে, শুধু বাবাকেই, বলবে, ‘পাত্র ভালো। তবে তোমরা আমায় জিজ্ঞেস করলে বলব, অরুণের জন্য একটা বছর অপেক্ষা করলে ভালো হয়?’ কিন্তু এতেও কোন ফল হল না। একদিন দীপ্তি জানালো, অল ইন্ডিয়া রেডিওর খুব নামী ব্যক্তির ভাই, ডাক্তার, আসবে তাকে দেখতে। সারা বাড়িতে শোরগোল। দিদিরা এসে প্রায়ই তাকে বোঝাচ্ছে। সেজদি মেডিক্যালে পড়ে, সে তো বলেই চলে, ‘তুই অরুণকে যত বড় ভাবিস, সে মোটে তা নয়। একটা লাফাঙা। ওর পিছু আর ছুটিস না। ও কোন ছেলে হল? তোর উপযুক্ত? চাল নেই চুলো নেই। বেশভূষা দেখো না! একটা ট্যাশ মার্কা ভ্যাগাবন্ড...’
জিজ্ঞেস করি, ‘আমাকে তোমার কী মনে হয়?’ দীপ্তি একটু লজ্জা আর ভয় মিশিয়ে বলে, ‘দেখতে তুমি ট্যাশই, আর স্বভাবেও ভ্যাগাবন্ড। সেজদির কথায় প্রতিবাদ করব কী করে?’ এইখানেই দীপ্তি অন্যরকম। ওর কাছে আবেগকেও যুক্তিগ্রাহ্য হতে হয়।
ডাক্তার ছেলে দীপ্তিকে দেখতে আসবে শুনে ঘাবড়ে যাই। এবার উপায়? বাড়ির সবাই তো এমন পাত্রকে পহন্দ করবেই। তাহলে তো দীপ্তিকে বিদ্রোহ করতে হয়। সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। আমিও চাই না, ব্যাপারটা এখানে এসে দাঁড়াক। আমরা কোন হঠকারিতায় যাব না, এতে আমরা আন্তরিক এবং দৃঢ় বরাবর। একদিন সাহস করে দীপ্তির বাবাকেই ফোন করে বসলাম, ‘মেশমশায়, আমি দীপ্তির ক্লাশমেট, অরুণ চক্রবর্তী। আপনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে চাই।‘ তিনি কোন সময় না নিয়েই স্নেহভরে বললেন, ‘বেশ তো এসো, কাল এসো। বেলা তিনটের পরে।‘
দীপ্তির মা ডেকে পাঠালে যে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, এখানেও তাই করলাম। কাঁধের কাছ থেকে জামার ক্লিফ রিচার্ডিয় স্লিভের গুটি ছাড়িয়ে নামিয়ে আনলাম কব্জিতে, বোতাম আঁটলাম। ডান হাতের ঘড়ি চলে গেল বাম হাতে, পয়েন্টেড শু পাল্টে স্যাণ্ডেল। ড্রেন পাইপ প্যান্ট ছেড়ে পাজামা। ওদের ছোট্ট ড্রইং রুমে বসলাম। হঠাৎ, একটু জোরেই, কোন মহিলাকন্ঠ গেয়ে উঠল বাড়ির ভেতর থেকে (পরে জেনেছি, দীপ্তির মেজদি)—‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে!’ কোন সংকেত নয় তো? দীপ্তিকে কলেজে অপেক্ষা করতে বলে এসেছি। তাই খুব নিসঙ্গ লাগছিল। কিছুটা ভয়ও। দীপ্তির বাবা ডাক্তার , পূর্ব কলকাতার জাস্টিস অফ পীস। রীতিমত মত ঘাবড়ে গেলাম। কোন কথাই যেন আর মাথায় নেই, সব পেটে এসে নেমেছে। গা গুলোচ্ছিল।
পরনে ধবধবে হাফ হাতা গেঞ্জি আর তেমনি ধবধবে লুঙ্গি। ভারিক্কি চেহারা। আমি আমার রিহার্সাল দেয়া কথাগুলো উগলে দিলাম। সব শুনে বললেন, ‘আই ডোন্ট ডিসএগ্রি উইথ ইওর ম্যাচ।‘ আমি অবাক। দুটি নেগেটিভ মানে তো ইয়েস! সহজ বোধ করতে থাকি।
বললেন, ‘তবে আমার কিছু কথা আছে।‘ ধপাস। মাটিতে যেন বসে পড়ি। ‘তুমি হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ এটার প্রমাণ চাই। তুমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা মুসলমান নও, তা প্রমাণ করতে হবে।‘ আমি মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করি, ‘ঠিক আছে। সে প্রমাণ আমি অবশ্যই দেব।‘
‘আর একটা কথা’, ভদ্রলোক আমাকে খদের দিকে ঠেলে ঠেলে নিচ্ছেন না তো, ভাবতে থাকি, ‘যতদিন বিয়ে না হচ্ছে, তোমরা কলেজের বাইরে ঘোরাফেরা করতে পারবে না। তুমি ওকে আদৌ বিয়ে করবে কি করবে না, আমাকে তো আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে? মেয়ের দুর্ণাম হোক তা তো মানব না।‘ হ্যাঁ হ্যাঁ করতে করতে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলাম, প্রায় হয়রান হয়ে বলে ফেলি, ‘ঠিক আছে। আমরা আপনার কথা মেনে চলব।‘
তাঁর শেষ কথা, ‘দেখো, আমি সুস্থ নই। হার্টের অসুখ, যে কোন সময় মরে যেতে পারি। আমি তাই মেয়েদের বিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে চাই। আমি দীপ্তিকে ভালো ভালো খাবার এনে তো দেবই। সে খাবে কিনা তার ব্যাপার। পাত্র দেখানো বন্ধ করব না।‘ আমাদের আশঙ্কার জায়গাটা তিনি ধরে ফেলেছিলেন বোধয়। আরো এক বছর সময় চাওয়ার মুখটা ঝট করে বন্ধ করে দিলেন। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য সময় চাওয়ার চালাকিটা কী করে ধরে ফেললেন ? এ কথা ভাবতে ভাবতে কলেজে ফিরে আসি। ঢিপঢাপ বুকে তখন দীপ্তি অপেক্ষা করছিল কলেজে।
আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের পাহাড় ডিঙোতে হবে না। আমি পড়াশুনায় মন দিলাম, দীপ্তিও। ভালো মার্কস নিয়ে আমাদের গ্রাজুয়েট হতেই হবে। মেলামেশা আগের মতই চলতে লাগল, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানও। দীপ্তিদের বাড়ির সঙ্গে লুকোচুরি চলতে থাকে। ধরা পড়ে গেলে, দীপ্তি দাদাদের কাছে দেদার বকাঝকা খায়। তবে বাবা মা সরাসরি বকেন না। তাই কষ্ট কম। ‘দৈনিক বিশেষ বার্তা’য় মনের আনন্দে কাজ করতে থাকি। ওদের বাড়িতেও জেনে যায়, ছোট হলেও ডেইলি কাগজের রিপোর্টার আমি। একেবারে ফ্যালনা ছেলে নই।
একদিন মৃদুলা, দীপ্তির স্কুলের বান্ধবী, দীপ্তিদের বাড়িতে গিয়ে বলল, ‘মাসীমা আমরা পরশু পিকনিকে যাব। স্কুলের পুরানো বান্ধবীরা মিলে।‘ ওরা পড়ত ফুলবাগানের শুঁড়া কন্যা বিদ্যালয়ে। কো-এড তো নয়। সবাই মেয়ে। তাছাড়া মৃদুলা বেলেঘাটারই মেয়ে। ধনী কন্যা। পারমিশন মিলে গেল। ‘ফিরতে দেরি হতে পারে, আমরা যাব শরৎচন্দ্রের জন্মভিটায়। নারায়ণপুরে,’ মৃদুলা সময়টাকে দীর্ঘ করে নিল।
মৃদুলা সব সত্যি কথা বলল, একটা কথা বাদে। পিকনিকের দলে দীপ্তি ছাড়া শুঁড়া কন্যার আর কেউ নেই। মৃদুলাও না। দলে রইল অভীক, অর্জুন, চন্ডী, সত্য এবং অভীর স্কটিশ চার্চ কলেজের বন্ধু বান্ধবীরা। শহরের বাইরে সেই প্রথম আমার আর দীপ্তির যাওয়া। সেই প্রথম আমরা সারাদিন জুড়ে ছিলাম স্বাধীন, মুক্ত এবং দুরন্ত উড়ানে। এই ভ্রমণ আমাদের গভীর ঘণিষ্ঠতায় বেঁধে ফেলল। প্রতিদিনই আমরা আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করছিলাম বটে, কিন্তু এই দিনটি যেন আমাদের যৌথ জীবনে সিলমোহর দিয়ে দিল।
সবাই ফিরতে রাজি না হলেও আমরা আগে রওনা হলাম। বেশি রিস্ক নিতে চাইনি। বাড়িতে সত্যি কথা বলে তো আসিনি! কিন্তু হাঁটতে অন্ধকার হয়ে এল। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। গাছ গাছালি ছাওয়া রাস্তাটায় চাঁদের আলো আলপনা এঁকে দিল। নিথর পাতাদের ফাঁকে একে একে পাখিরাও নীরব হয়ে আসছিল। আমরা দু’জনের হাতে দু’জন হাত রেখে হাঁটছিলাম। রাস্তা দিয়ে অন্য কেউ যায় নি কি? গেছে হয়ত। এখন আর মনে পড়ছে না। এখন মনে হয়, ওই নির্জন পূর্ণিমার আলপনা-রাস্তায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। নিশ্চয়ই ছিল না। নৈঃশব্দের ওই চরাচরে একসময় আমরা এক হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। দীপ্তির চোখে মুখে ঢল দিয়ে বৃষ্টি নামে। আমি দু’ আঁজলা ভরে জল তুলে আনি অনন্ত বহমান খরস্রোতার বুক ছেঁচে। বৃক্ষ, তুমি সাক্ষী। চাঁদ, তুমি সাক্ষী। সাক্ষী জ্যোৎস্না ধোয়া আকাশ, সাক্ষী ঝুমন্ত পাখ পাখালি।
কলকাতায় ফিরে মৃদুলাদের বাড়ি দীপ্তিকে পৌঁছে দিই। মৃদুলা সঙ্গে করে দীপ্তিকে ওদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে।
-----------------------
37. // দো দিন কা সাংবাদিক //
আমার কারণেই একদিন ‘দৈনিক বিশেষ বার্তা’ বন্ধ হয়ে গেল। অথচ এখানেই শুরু হয়েছিল আমার স্বপ্লপূরণের যাত্রা। সাংবাদিকতার জন্য বাড়ি পালানো, সাংবাদিকতার জন্য চাকরি না করে কলকাতার রাস্তাঘাটে মজুরের জীবন, সাংবাদিকতার জন্য রাতদিন এক করে পড়াশুনো, আর এখন যখন সেই সাংবাদিকতা আমাকে জড়িয়ে ধরল, সে আমার গা থেকে খসেও পড়ল তেমনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই।
ডালহৌসি থেকে শিয়ালদায় ফিরছিলাম। ডালহৌসির চার্টার্ড ব্যাংকে আমার একাউন্ট। সেও এক কাহিনী। শিয়ালদায় কি আর কোন ব্যাংক ছিল না? ছিল। কিন্তু একটাও আমার মনমত ছিল না। স্বাধীনতার ১৪/১৫ পরের ওই সময়ে কলকাতা শহরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিস্ময়গুলো আমাকে সবসময় আকৃষ্ট করত। সেই ঘোর কাটিয়ে আমি বিশাল শহরটার স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় তখনো সড়গড় হইনি। তাই শহরটার যা কিছু সুন্দর যা কিছু আধুনিক, যার সম্মুখীন আমি আমাদের মফস্বল শহরে কখনো হইনি, সে-সব আমাকে আকন্ঠ আকৃষ্ট করত। মনে পড়ে না, আমাদের বাড়িতে কখনো ব্যাংকের ব্যাপার স্যাপার ছিল। রাজনৈতিক বন্দী বাবা জেলের বাইরে আসতেন, ওকালতি করতেন, আবার জেলে যেতেন, আবার বাইরে এসে ওকালতি করতেন। বাবা জেলে থাকার সময় মা আমাকে পোস্ট অফিসে পাঠাতেন। সম্ভবত পোস্টাল সেভিংসের কাগজ দিয়ে। পোস্ট মাস্টার সাহেব সে কাগজ নিয়ে টাকা দিতেন, আমি তা মা’কে এনে দিতাম। কলকাতায় এসে আমার তাই একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ইচ্ছে হয়েছিল খুব। ডালহৌসি পাড়ায় সোভিয়েত দেশের ইংরেজি ও বাংলার নানা পত্র-পত্রিকার গ্রাহক সংগ্রহ করার দিনগুলোতে একবার রাইটারসের পিছনে বৃটিশ স্থাপত্যের বিশাল চূড়া বাঁধা বিল্ডিংটা দেখেছিলাম। আগ্রহে ভিতরে ঢুকেছিলাম। ঢুকেই অবাক। যেন ইংরেজি সিনেমার সেট। ঝকঝকে মানুষ, কাঠের চকচকে আসবাব, খোলামেলা। অন্যান্য ব্যাংকের মত ডাকাতের ভয়ে কেউ লোহার খাঁচার ভেতরে বসে নেই। একদিন এখানে অ্যাকাউন্ট খুলে বসলাম।
আমি তখন বিশেষ বার্তার সাংবাদিক। একদিন এই ব্যাংক থেকেই শিয়ালদা ফিরছিলাম। গোড়ালিতে বেঁচে থাকার কনফিডেন্স। চলতে চলতে দেখি, অ্যান্ড্রু ইয়ুল কোম্পানি। গেটের সামনে প্ল্যাকার্ডে প্ল্যাকার্ডে ছয়লাপ। কোথাও স্লোগান, কোনটায় কার্টুন। খুবই আক্রমণাত্মক। খবরের গন্ধ নাকে এলো। গেটের কাছে পিকেটিং চলছে। তবে অফিসে ধর্মঘট না, উচ্চস্বরে স্লোগান দেয়াও নয়। শান্ত, কিন্তু অস্থির পরিবেশ। ভেতরে ঢুকে যাই। একজনকে বলি, খবরের কাগজে কাজ করি। কী হয়েছে?' ১৯/২০ বছরের এক ছোকড়া সাংবাদিককে পেয়েও যেন ওরা হাতে চাঁদ পেয়েছে। একজন ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে কাউকে ডেকে আনল। নেতা গোছের কেউ, ধুতির কোচা সামলাতে সামলাতে এলেন। কোন কাগজের জানতে চাইলেন। জেনে আমাকে মহা খাতিরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। অফিস দালানের পাশেই চাতাল, তার পাশে একটা আলগা ঘর। কর্মীদের এসোসিয়েশনের অফিস। মুশকিল হল, আমি ঠিক জানি না, অ্যান্ড্রু ইয়ুলের কিসের ব্যবসা, কীই বা তাদের কাজ। কোম্পানিটা বড় না ছোট, তাও জানি না। তবে আমার না-জানাটা গোপন রাখলাম। বুঝলাম, বৃটিশ কোম্পানি, মালিকদের অধিকাংশ লালমুখো সাহেব, নয়ত চ্যাটার্জি ব্যানার্জি বোস দাশগুপ্ত সাহেব। কর্মীদের অভিযোগ-- দেশের টাকা এই কোম্পানি লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে বিলেতে, মদত করছে বাঙালি তাঁবেদাররা।
টিফিন টাইম। আমার জন্য এলো কর্মীদের জন্য বরাদ্দ যে অফিস-টিফিন, তাই। কাগজের প্লেট উপচে পড়া সেই টফিন দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া। কলা, সন্দেশ, মাখনের পরতে মোড়া টোস্ট, একট বয়েলড ডিম, আরো বেশ কিছু লোভনীয় আইটেম, এখন সেসব মনে পড়ছে না। তবু অভিযোগ, তবু স্লোগান, পোস্টার, কার্টুন? মনে খটকা জাগল। এরা অন্য কোন স্বার্থে এই ‘সংগ্রামে’ নামে নি তো? তাই বলি, 'আপনাদের মুখের কথা শুনে কি আর রিপোর্ট করা যায়? প্রমাণ দিতে পারলে পাতা জোড়া স্টোরি করতেও (বিশেষ বার্তা ট্যাবলয়েড, কোনদিন ছয় বা কোন দিন আট পাতার কাগজ) আমাদের আপত্তি নেই।' আমার উদ্দেশ্য অন্য। যদি স্ক্যুপ কিছু পেয়ে যাই, কেল্লা ফতে। সাংবাদিক হিসেবে আমার নাম তখন ছড়িয়ে পড়তে লাগবে এক তুড়ি সময়। ওদের সব অভিযোগ নোট করলাম। ওদের কর্তা, ওয়াটসন সাহেব, কবে কোথায় কোন খাতে কত টাকা চুরি করে আত্মসাৎ করেছেন সে সব জানলাম, কোন কোন জায়গা থেকে মেশিন গাড়ি সম্পত্তির কত টাকা কোন পথে বিলেতে পাচার হয়েছে তার বিশদ, অ্যান্ড্রু ইয়ুলের নামে বেনামে কোন কোন কোম্পানীতে লগ্নী হয়েছে সেসবও। এমন কি, বৃষ্টিতে আটকে পড়া ওয়াটসনের গাড়ি হেয়ার স্ট্রিট থেকে অ্যান্ড্রু ইউল অব্দি ঠেলে ঠেলে আনার হাইলি ইনফ্লেটেড ভাউচারটা অব্দি। বললাম, কাল আসব, আপনারা কাগজ পত্র যদি দেখাতে পারেন, রিপোর্টের গ্যারান্টি দিচ্ছি। ইউনিয়নের লীডারবাবু পালটা বললেন, ‘যদি ছাপেন, আমরা তিন হাজার কপি কিনব।‘
প্রায় ছুটতে ছুটতে অফিসে গিয়ে পৌঁছাই। মুরারীদা তখন একা। দু'হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপার থেকে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গি করলেন পঙ্গু মানুষটা। ‘দারুণ করেছ, অরুণ, দারুণ। খুব নামী দামী কোম্পানি অ্যান্ড্রু ইয়ুল। পাকা বৃটিশ ফার্ম। হাওড়া ব্রিজ এরাই তৈরি করেছে। ওরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু তিন হাজার কপি কিনবে বলেছে? পরে যদি না কেনে?’ বললাম, ‘ওরা আমাদের এক হাজার কপির দাম অ্যাডভান্স করবে বলেছে। আমি সে চুক্তি না করেই সব মেনে নেব নাকি?’ লোকগুলোকে আমার খুব সুবিধের মনে হয় নি, তাও বললাম।
খানিক পরে দুই মালিক এলেন। কথা হল। ওরা খুব উৎসাহ দেখালেন, মনে হল না। আমি যে মস্ত এক কান্ড করতে চলেছি, তাতে বিশেষ বার্তার যে সুনাম বাড়বে নিঃসন্দেহ। কিন্তু তবু। মনে হল, ওরা আমাকে ভরসা করতে পারছিলেন না। আমার জিদটা বাড়িয়ে দিলেন ওরা।
পরদিন দুপুর নাগাদ অ্যান্ড্রু ইয়ুলে পৌঁছে গেলাম । এবার ওরা নিয়ে গেল গ্যাড়ির গ্যারাজের দিকে অন্য একটা ঘরে। আমি আমার নোটবুক খুলে একটার পর একটা বিষয় তুলে ধরলাম, ওরা একটার পর একটা প্রমাণ-- দলিল, ফাইল, নোটিংস, ভাউচার আমাকে দেখালেন। সে সব টুকে নিতে নিতে প্রায় বিকেল। আমার সঙ্গে একজন অফিসে এলেন। মুরারীদাকে বারান্দায় ডেকে নিলাম। ওঁর হাতে এক হাজার কপির অ্যাডভান্স জমা করলেন ইউনিয়নওয়ালা। লোকটা চলে গেলে, মুরারীদা আমার দিকে তাকিয়ে গাল ভরা হাসলেন, ‘এবার দেখব তোমার কীর্তি।‘ রঞ্জিত রায় আর কণকেন্দু মজুমদার দু’জনেই সেখানে উপস্থিত। ওদের সামনে মুরারীদা সবটা ভাঙলেন না, ওদের শুধু বললেন, ‘অরুণ একটা খবর করছে, খুব রিভিলিঙ। বিকেলের কাগজের জন্য দারুণ হবে।‘ আমি বাড়ি ফিরে খুব সুন্দর করে সাজালাম রিপোর্টটাকে। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা স্বপ্ন ভালোলাগা অভিনবত্ব যা কিছু উজার করে এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লিখলাম। অনেক বড় হয়ে গেল যদিও।
পরের দিন মুরারীদা দু’পাতা জুড়ে খবরটা সাজালেন। প্রথম পাতা থেকে জাম্প করিয়ে সেকেন্ড পাতায়। বাকি এক পাতার রিপোরট ধরে রাখলেন পরের দিনের জন্য। বিশেষ বার্তা ছাপা হত বিশাল আকারের একটা ফ্ল্যাট বেড মেশিনে। তার রোলারটা পাক খেতেই এক পিঠের কাগজ ছাপা হত। লোহার শলাকার কয়েকটা হাত ছাপা কাগজটা তুলে নিয়ে ফেলত সামনে। প্রথম পাতাটা সামনে পড়তেই সেটা তুলে নিয়ে ছুটে যাই মুরারীদার কাছে। তিনি চোখ বোলান। দ্রুত। তারপরেই ওপরের দিকে লিখে দিলেন, ইংরেজিতে, ‘প্লিজ প্রিন্ট’। ঝপ ঝপ ঝপ কাগজ ছাপা হতে থাকে। আমি বেশ মেজাজ নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসি। ‘আই অ্যাম আ জারনালিস্ট নাও। নো ওয়ান ক্যান স্টপ মী।’ মনে মনে বলতে থাকি, বলতেই থাকি।
রঞ্জিতদা আর কণকেন্দুদা কাগজ হাতে নিয়ে অবাক। এত ইনফরমেশন পেলে কী করে? ‘কী বিচ্ছু রে বাবা’, রঞ্জিতদা বলে ফেলেন। কণকেন্দুদা শান্ত প্রকৃতির মানুষ। শুধু বললেন, ‘এই লাইন ছেড় না, অরুণ। ক্যারি অন।‘ মুরাররীদা খুব খুশি। অফিসের ছেলেটাকে সিঙ্গারা আনতে পাঠালেন। প্রেসের মালিক, ওই বাড়িতেই থাকেন, হাতে কাগজ আর সিঙ্গারা নিয়ে বেরিয়ে আসেন ছাপাখানা থেকে, ‘ও মুরারীবাবু, এতো সাঙ্ঘাতিক রিপোর্ট, সবটা ঠিক তো, সত্যি তো?’ দুই মালিক, যুগান্তরের অনিল ভট্টাচার্য আর ব্যবসায়ী অমর চক্রবর্তী এলেন। কাগজ খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লেন। আমার দিকে তাকালেন, শুধু বললেন, ‘ভালো কাজ।‘
ইউনিয়নওয়ালারা এলেন। তিন হাজার কপির পয়সা দিয়ে পরের সংখ্যার এক হাজার কপির জন্য অ্যাডভান্স জমা দিয়ে সেগুলো নিয়ে গেলেন।
গেট পেরিয়ে সার্কুলার রোডে ওদের পৌঁছে দিই। ওরা জানালেন, অ্যান্ড্রু ইয়ুলের সব ব্রাঞ্চে এবং অন্যান্য অফিসে এগুলো ডিস্ট্রিব্যুট করবেন ওরা, কিছু কপি অনুবাদ করে পাঠাবেন বিলেতে। আমি উত্তেজনায় মাটিতে পা ফেলতে পারছিলাম না। আমার লেখা কলকাতার সর্বত্র এমনকি বিলেতেও পড়া হবে! ফিরে এসে সবাইকে জানাই, এত বেশি সংখ্যায় আমাদের কাগজের কপি কেনার গোপন কথাটা।
পরদিন মুরারীদা পাতা সাজালেন। দেড় পাতা। প্রথম দেড় পাতা সবটা জুড়ে অ্যান্ড্রু ইয়ুল। তথ্যে তথ্যে ঠাসা। একের পর এক। মেশিনে সাজানো পেজ পাতা হল, এবার রোলার ঘুরবে, পাতা ছাপা হবে, ঝপ ঝপ কাগজ জমা পড়বে। কিন্তু না। ছাপা হচ্ছে না। মুরারীদার কাছে গেলাম। মুরারীদার মুখ কালো। বললেন, 'কাগজ ছাপা হবে না। প্রেসের মালিকের অনেক টাকা বাকি রেখেছে মালিকরা। সেই বকেয়া টাকা হাতে না পেলে, আর না। কোনদিনই কাগজ ছাপা হবে না তার মেশিন থেকে।'
আমি ছুটে যাই প্রেস মালিকের কাছে। আগে কথা হয় নি, দেখা হয়েছে মাত্র। ধুতি আর হাফ হাতা গেঞ্জি পরেন। একটা হাতলওলা চেয়ারে পা তুলে বসে থাকেন। বললাম, 'দাদা (নামটা জানতাম, এখন মনে পড়ছে না), আমার জীবনের এত বড় সাফল্য। এভাবে শেষ হয়ে যাবে? অন্তত একটা কাগজ ছেপে দিন, দাদা। পায়ে পড়ি। আমার ফাইলে থাকবে তাহলে পুরো রিপোর্ট, প্লিজ।‘ মেনে গেলেন। মেশিনম্যানকে ইঙ্গিত করলেন, ঘটাং ঘট, ঘটাং ঘট, কাগজের একটিমাত্র কপি ছেপে বের হল।
কিন্তু বিশেষ বার্তা বন্ধ হয়ে গেল সেদিন থেকে।
36 //গঙ্গাবক্ষে //
দীপ্তি যেদিন বলল, 'মা তোমাকে দেখা করতে বলেছেন,
বুঝে গেছি, দীপ্তিকে লেখা আমার চিঠিগুলোর বেশ কয়েকটা তাঁর হাতে পড়েছে। মানে, দীপ্তির
বাবার কাছেও। আমি দীপ্তিকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম, প্রতিদিন কলেজে দেখা হলেও, সে তো
এই কারণেই! যাতে ওদের হাতে চিঠি যায় এবং তা পড়ে জানতে পারেন, আমরা কতটা বাবা-মা'র প্রতি
অনুগত। তাঁদের অমতে কখনোই কিছু করব না, এবেং কেন। এসব কথা যে আমার প্লয়ান্ড চালাকি
সেটা তো দীপ্তিকেও জানাই নি। তাই নিজের বেশ
বাস ভদ্রস্থ করে, মানে, জামার গোটানো ক্লিভ রিচার্ডি স্লিভ কব্জী অবধি টেনে, বাম হাতের
ঘড়ি ডান হাতে বেঁধে, নাল লাগানো পয়েন্টেড শু ছেড়ে চটি পায়ে, প্যান্টের ওপরে শার্ট ছেড়ে
দিয়ে রঙমহল সিনেমার দোতলায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে দীপ্তির মা'র সেলাইয়ের স্কুল।
তিনি আমাকে কী কী প্রশ্নের মুখে ফেলে যাচাই করেছিলেন,
এখন আর মনে নেই। তবে নিশ্চয় এক কলেজ পড়ুয়া ক্লাশমেটের হাত থেকে নিজের মেয়েকে উদ্ধার
করার সব চেষ্টা যে করেছেন অনুমান করাই যায়। আমার তো কোন হাত গরম পরিচয় ছিল না। সবই
গল্প কথা-- বাবা এডভোকেট, মা-বাবা দু'জনেই জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী, দাদা ডাক্তার,
মেজদা চার্টার্ড, আট ভাই বোন। পূর্ব পাকিস্তানের ছেলে, বাড়ি পালিয়ে ইন্ডিয়ায়, পার্ট
ওয়ান পাশ করেছি মাত্র, গ্রাজুয়েট হতে এখনো এক বছর.... এসব কথায় কোন মায়ের, মনে চিড়ে
যে ভিজবে না, আমার জানাই ছিল। তাই তো ওই চিঠি লেখা, সেগুলো হাপিস হওয়ার সুযোগ করে দেয়া।
বাবা-মা'কে ইমোশন্যালি ব্লয়াকমেইল করার ফন্দী আর কি। একসময় জিজ্ঞেস করলেন, 'নারীর মূল্য'
পড়েছ? আমার চোখমুখ দেখে হয়ত বুঝেছেন, আমি উত্তর হাতড়াচ্ছি। বললেন, 'শরৎচন্দ্রের লেখা।'
আমি যেন লাফিয়ে উঠি, 'ও হ্যাঁ, পড়েছি তো।' আসলে তখন ঐ লেখার কথা একদমই জানতাম না। পড়া
তো দূরের কথা। আজো তা পড়া হয় নি। বললেন, 'দেখ, তোমরা সমবয়সী। মেয়েরা তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে
যায়। ছেলেরা না। তখন নানা সমস্যা হয়। এজন্যেই ছেলেদের মেয়েদের থেকে বয়সে বড় হতে হয়।'
ইঙ্গিত স্পষ্ট। মিস ম্যাচ। মানে, বাড়ি যাও। আমি বলি, না না না, দীপ্তি আমার থেকে বেশ
কয়েক বছরের ছোট। অনেকগুলো বছর নানা কারণে আমার পড়াশুনো করা হয় নি। বলেই থতমত খেয়ে যাই,
আমাকে ফেলটুস ছেলে ভাবছেন না তো? তবু বলতে পারলাম না, মানে, বললাম না আমার জীবনের ঐ
বছর নষ্ট করার কর্মকান্ডের কথা। সবাই কি আর সব সত্যকে সত্য বলে মানে? তাই আমি যে কথা
বলার জন্য রিহার্সাল দিয়ে এসেছিলাম, এবার তা উগলে দিলাম, তোতাপাখির মত এক নিশ্বাসে
বলে গেলাম, 'সে আপনাদের ব্যাপার। আমাদের বিষয়ে আপনাদের আপত্তি থাকলে আমরা তা মেনে নেব।
কথা দিচ্ছি, দীপ্তির যদি অন্যত্র বিয়ে দেন, আমি এসে ওর বিয়েতে পরিবেষন করব। মনে করবেন
না, আমি মুখে এক গাল দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াব। আমি জানি, আমার বিয়ে করার সময় হয় নি, দীপ্তির
হয়েছে, আপনারা হয়ত চেষ্টাও করছেন। আমার ইচ্ছা, আপনারা একটি বছর অপেক্ষা করলে, আমি আমার
যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পেতাম। আমি গ্রাজুয়েট না হলে তো কিছুই প্রমাণ করতে পারব
না।' তিনি কি আমায় মিষ্টি খাইয়েছিলেন? মনে নেই। আমি কাউকে প্রণাম করি না, সেদিন তাকে
প্রণাম করেছিলাম। তিনি আমার মাথাটা আদরে একটু মুছে দিয়েছিলেন মনে আছে।
আমি উড়তে উড়তে ঘরে ফিরি। পরদিন কলেজে গিয়েই বলি,
'চলো, বেরিয়ে পড়ি।' 'হঠাৎ?' 'তোমার মা জেনে গেছেন, মানে, বাড়ির সবাই জেনে গেছে। তোমার
বাবাও। তো আর লুকোচুরি করব কেন?' টেবিলের ওপর বই ছিল, গুটিয়ে লাইব্রেরিয়ানের হাতে ফেরত
দিয়ে এসে দীপ্তি বলে, 'বাইরে চলো, বলছি সব।'
'কাল রাতে বাড়িতে ধুন্ধুমার। মেজদা আর সেজদি
আকাশ পাতাল এক করেছে। মা-বাবা কিছু বলার অবকাশ পায় নি। আজ দিদি আর মেজবৌদি আসছেন। বড়দাকে
বলেনি কেউ। দাদা থাকেন বেলঘরিয়া। দাদা জানলে আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। আজ একটু পরেই
বাড়ি যেতে হবে। পাড়ার কলেজ। এখানে অনেকেই আমাকে চেনে। পরে দেখা করব।' বলে দীপ্তি বাড়ির
পথে হাঁটা দেয়। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। ওদের বাড়ির জটিলতাকে মাপার চেষ্টা করতে আমজাদীয়ায়
ফিরে যাই।
হক কথা। কে আমি, যার সঙ্গে হৈ হৈ করে দীপ্তির
বাড়ির সবাই, তার মা বাবা, দাদা দিদি ভাই বোন, আমার সঙ্গে তাদের মেয়ের, বোনের বিয়ে দেবেন?
দীপ্তিরা ন' ভাই বোন। বাবা জনপ্রিয় ডাক্তার। পূর্ব কলকাতার জাস্টিস অফ পীস। আর আমি?
বাবা মা'র পরিচয় আমার মুখে মাত্র। ভাইবোনের পরিচয়ও আমি যা বলব তাই। প্রমাণ করার উপায়
নেই। পরনে ড্রেন পাইপ ট্রাউজার, পায়ে নাল লাগানো
পয়েন্টেড শু, জামার ফুল হাতা ক্লিফ রিচার্ডের স্টাইল নকল করে গুটিয়ে কাঁধে, ডান হাতে
ঘড়ি, বাম হাতের দু' আঙুলের ফাঁকে দোলে একটা নোট খাতা, ডান হাতে দু'তিনটে পেন পেনসিল,
কিংবা অনর্গল পাক খাওয়া চাবির চেন। পার্ট ওয়ান পাশ। গ্রাজুয়েট হতে আরো এক বছর... খুব
স্বাভাবিক, আমাকে তারা বাধা দেবেনই, দীপ্তিকেও তালা বন্ধ করে ঘরবন্দী করা অবাকের না।
আমার ছোট বোনটার কথা মনে পড়ে। সে আমার মত একটা ছেলের প্রেমে.... ব্যপারটা ভাবতেই ভয়ে
চোখ বন্ধ করে নিই। আমি দীপ্তির কাছে সব শুনে তাই কষ্ট পাই না। উল্টে ঝরঝরে বোধ করি।
ফরিদ মিঞা চা এগিয়ে দেয়। স্থির করি, দেখাই যাক, ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়ায়। আমি তো জানিই,
এক অসম্ভবের স্বপ্ন মাথায় পাক খাচ্ছে।
তবে আমরা আমাদের মতই থাকি। দু'জনেই স্থির করলাম,
হ'লে ভালো, না হ'লে আর কী করা! চারপাশে সতর্কতার নজর রেখে রেখে মাঝেমধ্যে আমরা কলেজ
কেটে বেরিয়ে পড়তাম। আমাদের যাওয়া ছিল, ভিক্টোরিয়ার বাগান, গঙ্গার আউটরাম ঘাট ঘাট, ইডেন
গার্ডেন, গড়ের মাঠ। শান্তি কি ছিল? মাছি ভনভন সবখানেই। কোথাও চৌকিদার, কোথাও বা ফচকে
ছেলেছোকরার দল। সিনেমা হলের অন্ধকার আমাদের
পছন্দ ছিল না, কথা বলা যেত না বলে। আর দু'একটা সিনেমায় গেলেও, ছবি শেষ হবার আগেই আমরা
বেরিয়ে পড়তাম। সূর্য ডোবার আগে বাড়ি ফিরলে, প্রশ্ন নেই, কেউ কেউ ভ্রু কোঁচকালেও কোঁচকাতে
পারে অবশ্য।
তবু দু'টি জায়গার ভ্রমণের স্মৃতি ভুলতে পারি
না। আমরা খোলামেলায় নিজেদের স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম বেশি। আড়ালের আকাঙক্ষা থাকলেও, তা
মনে জায়গা নিত না নানা কারণে। মুখ্য, ততদিনে আমরা দুজনেই দুজনকে বাঁচিয়ে চলার মন্ত্র
শিখে নিয়েছি। সম্ভবত দীপ্তিদের পরিবারে আমাদের বিষয়ে তীব্র বাদ-প্রতিবাদ আমাদের বার
বার সতর্ক রাখছিল, তাই যখন বেশ কয়েকজনের মুখে শুনলাম, ব্যারাকপুরের গান্ধীঘাট খুব সুন্দর
জায়গা, আমরা স্থির করলাম, কলেজে পৌঁছুবার আগেই বেরিয়ে পড়ব, বিকেল বিকেল ফিরে আসব। সিপাহী
বিদ্রোহের কারণে ব্যারাকপুর আমার কাছে খুব রোম্যান্টিক জায়গা। তবে গান্ধীঘাট ওখানে
কেন, জানতাম না। তবু, পৌঁছে গেলাম।
আউটরাম ঘাটে গঙ্গা ব্যস্ত। একটা মিউজিয়ামের মত।
সবাই যেন সার দিয়ে সেই মিউজিয়াম দেখতে আসে। গান্ধীঘাটে গোটা ব্যাপারটাই আলাদা। জল চরাচরে
ভেজা পলির সুবাস, নীল আকাশ, ভাসছে পেঁজা তুলো মেঘ। প্রশান্ত গঙ্গা খোলা আকাশের নিচে
ছলাৎছল। পূব বাংলার মত। মন ভালো করা। ঝকঝকে তকতকে চারপাশ। যেন, এই মাত্র চশমার কাঁচটা
মুছে নিয়েছি। এমন মুক্তি, এমন মুক্ত জীবন! বুকের ভেতর গান-তোলা এক অপূর্ব অনুভূতি।
সামনে বেশ কিছু নৌকো, যাত্রী পারাপার করে। সাঁতার জানি না দু'জনের কেউ। তাই শান বাঁধানো
ঘাটের একপাশে গিয়ে বসি। কিন্তু মাঝি ছাড়বে না। 'এপার ওপার অল্প সময়। অল্প পয়সা।' রাজি
হয়ে গেলাম, ওপারে কোন্নগর। যাইনি কোনদিন। শর্তঃ আর কাউকে নেবে না। শুধু আমরা তিনজন।
বললাম না, আমাদের দু'জনের কেউ সাঁতার জানি না। এই কথাটা বলতে লজ্জা লাগল।
দীপ্তিকে ছইয়ের নিচে বসিয়ে আমি নৌকোর প্রান্তে,
গলুইয়ে বসলাম। নৌকো দুলছে মাঝির বৈঠা আর জলের ছলাৎছলে। দীপ্তির পটভূমিতে মাঝি, ব্যস্ত
তার হাত, হাতের পেশি। মাঝি নিজেও দুলছে বৈঠার ছন্দে ছন্দে। দৃশ্যটায় মজা পেলাম। দীপ্তি
বালিকা বধূ। পাশে টিনের ছোট্ট বাক্স, দীপ্তির খালি হাতে গলায় ঝলমলিয়ে উঠল একরাশ সোনার
অলঙ্কার। মাথায় ঘোমটা, হাওয়ায় উড়ে উড়ে খসে পড়ছে। আমি বৌ নিয়ে ধলেশ্বরীতে। চারাবাড়ি
যাচ্ছি। মা খোলা লেপা উঠানের পাশে শিউলিতলায় উদগ্রীব চেয়ে আছেন, পুকুর পাড় ঘেষে সরে
সরে যাচ্ছে তাঁর দৃষ্টি। 'কখন বাবলু বাড়ি ফিরবে' সঙ্গে নতুন বৌ। মা'র হাতে ধরা বরণ
ডালায় কাঁপছে প্রদীপ শিখা।
আমাদের ওই উনিশ কুড়ি বছর বয়সের সময়কালে পকেটে
ফোন ক্যামেরা থাকত না সর্বক্ষণ। নইলে কি এমন
এক রোমাঞ্চিত মুহূর্তকে মনে মনে বয়ে বেড়াতে হত সারাজীবন? আমার একটা কোডাক বক্স ক্যামেরা
ছিল। সেটাও ফেলে এসেছি ঘরে।
এভাবেই পৌঁছে গেলাম ওপারে। একদল লোক, আমাদের
চেয়ে বয়সী, বসে ছিল নদীঘাটে। ওদের সঙ্গে একটা ট্রানজিস্টার। উদার নদী-আকাশ ধেয়ে তাতে
বাজছিল 'ধরো, কোন এক শ্বতপাথয়ের প্রাসাদে...' শ্যামল মিত্রের গান। গানটা শোনা মাত্র
ফিসফিসিয়ে দীপ্তিকে বলি, 'গানটা মনে রেখো, এ গান আর আমাদের জীবন থেকে মুছে যাবার যো
নেই।' এই সময়, ওই ভিড়ের একজন, বয়সে অন্যদের থেকে বড় মনে হ'ল, ডাকলেন আমাদের। সস্নেহে,
তাই ভয় করল না। 'এই ছেলে! কী নাম তোমার?' আমি আমাদের দুজ'নেরই নাম বলি।
বাহ! অরুণ, সঙ্গে অরুণের দীপ্তি! চমৎকার!' সবাই
হেসে ওঠে। আমরাও। 'তোমরা বিয়ে করবে তো?' মাথা নাড়ি। বিয়ের সময় আমাদের নেমন্তন্ন করবে
তো? সত্যি আমরা তোমাদের বিয়েতে যাব, ভুলো না।' ঠিকানা বলেছিলেন। দীপ্তির খাতায় তা টুকেও
নিলাম আমরা। কিন্তু বিয়ের সময় কিছুতেই আর সেই খাতা দীপ্তি খুঁজে পেল না। নদীঘাটের দাদাদের
কথা আমরা দু'জন আজো ভুলিনি। ওই অচেনা অজানা মানুষগুলোই আমাদের দু'জনের জীবনকে প্রথম
স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
বড় রাস্তায় এসে দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করি, মানুষ
আমাদের এত ভালোবাসে কেন, জানি না।' দীপ্তির কুটুস উত্তর, 'আমরা ভালো, তাই। এতে জানার
কী আছে?'
35, // সাংবাদিক //
আমজাদীয়ার কাছেই। রাজাবাজারের দিকে কয়েক পা গেলে মান্ধাতা আমলের গাড়ি বারান্দাওয়ালা লাল বিল্ডিঙ, মাথায় সাইন বোর্ড, সাদা কালোয়ঃ 'দৈনিক বিশেষ বার্তা'. ততদিনে যুগান্তরে তুষারকান্তি ঘোষের শীতল ঘায়ে জেগে উঠে ফিরে এসেছি, সে অনেকদিন হল। ডালহৌসি পাড়ায় রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকার লালমুখো সাহেব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাড়িতে বসে তাঁর চিঠির অপেক্ষায় থাকতে ফেরত পাঠিয়েছেন। সবার এক কথা, গ্রাজুয়েট হও আগে। মানে, শুধু উৎসাহ আর উদ্দীপনা দিয়ে সাংবাদিকতা হয় না, সঙ্গে লেখাপড়াটাও চাই। তাই সাইন বোর্ড টা দেখে খুব উৎফুল্ল হলাম তা নয়। তবু ঢুকে গেলাম।
সিঁড়ির কয়েক ধাপ পরেই এক চিলতে বারান্দা, ডান দিকে পার্টিশন করা একটা ঘর। দুটো টেবিল, একটা সামনে, একটা সাইডে। ডানপাশে একটা টেলিপ্রিন্টার। খটখট করে লম্বা টাইপ করা কাগজ উগলাচ্ছে। সামনের টেবিলে বেঁটে খাটো টাক মাথা, কিছুটা গোলগাল, ঈষৎ ময়লা ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক, 'কী চাই?' আমাকে আপাদমস্তক দেখলেন। আমার বয়স তখন আঠারো/উনিশ। হাতে বাজারের থলে। সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন, 'সাংবাদিক হতে চাও। বেশ।' এরপরেই ছিল আকাশ ভাঙা চমক, 'অফিসে তো দুটোর আগে কেউ আসে না। দুটোর সময় এসো!' বেরিয়ে আসি। সারা শরীরে উত্তেজনা। এই প্রথম সাংবাদিক হবার রূপালী রেখা। মনে পড়ল, তুষার কান্তি ঘোষের টেবিলের ওপরে বসে আমাকে নিরস্ত্র করার কথা; মুসুদ্দির দিকে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ঠেলে দেয়া, সেখান থেকে নিস্তরঙ্গ জীবনময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে... আমার ঘরে দ্রুত ফিরে যাই, আরো দ্রুত স্নান খাওয়া সেরে বেলা দুটোর অপেক্ষা করতে থাকি। বড় রাস্তার ওপারেই তো 'বিশেষ বার্তা'!
গেলাম, কিন্তু কোণের এক চেয়ার দেখিয়ে টাকমাথা মানুষটা বললেন, 'ওখানে বসো।' বসেই আছি। তিনি এখানে সেখানে ফোন করলেন। ব্যস্ত, চোখেমুখে একটু উৎকন্ঠাও। আর কোন দ্বিতীয় মানুষ নেই সেখানে।
একসময় আমাকে ডাকলেন। জানতাম না, দুটোর সময় আমি জীবনের সেরা ও মধুর চমকটির সামনে দাঁড়াব। অফিসের এই ভদ্রলোকের নাম মুরারী দে। কালান্তর পত্রিকায় কাজ করতেন। সেখান থেকে, সম্ভবত রীট্যায়ার করে, এখানে। একটা পায়ের পাতা ওল্টানো, পোলিওতে। বললেন, 'রিপোর্টিং করতে পারবে?' আমি বোধয় 'হ্যাঁ' বলতে ডানপাশে মাথাটাকে হেলিয়ে মাটি ছুঁয়ে ফেলেছিলাম। অফিসের দু'জন রিপোর্টার, কনকেন্দু মজুমদার (পরে যুগান্তরে চলে যান) এবং রঞ্জিত রায় (পরে স্টেটসম্যানের নামকরা) দু'জনেই সেদিন অ্যাবসেন্ট, তাই শিকেটা ছিঁড়ল আমার কপালেই। মুরারীদা বললেন, 'আজ রবীন্দ্র সদনে ইন্দিরা গান্ধী আসবেন। উৎপল দত্তের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিরোধ করছে। খুব গোলমাল চলছে। চারটের মধ্যে কাগজ ছাড়তে হবে। দৌড়ে যাও। চারটের মধ্যে ফিরে আসা চাই।' এখন মনে পড়ছে না, কী ছিল অনুষ্ঠান। উদবোধন কি?
সামনেই ৩ নং বাস। সটান দোতলায়। কলকাতা তখন পায়ের নীচে। কলকাতায় আমার প্রথম সাংবাদিকতার দিন। রক্ত টগবগ করছে। আমি কলকাতার একটি কাগজের রিপোর্টার? অবিশ্বাস্য। চোখের সামনে ভেসে এলো বাড়ি পালানোর দিনটা। তারপর তারপর... আজকের সকালটাও। আজকের দিনটার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল জেলখানায়। আইএসসি পরীক্ষা না দিতে পারার যন্ত্রণা, দু' দু'টি বছর জীবন থেকে মুছে যাওয়ার বেদনা যখন আমার জীবন থেকে রাজনীতিকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। জেলখানাতে বসেই স্থির করেছিলাম। বাবা বলতেন, ' সমাজয়র ঋণ শোধ তোমায় করতেই হবে। কোন পথে বা পন্থায়, সে সিদ্ধান্ত তোমার'। আমি সেদিন ঠিক করেছিলাম, সাংবাদিকতা। ততদিনে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে, অবশ্য নিজে থেকেই এপিপিকে ছোটখাট খবর পাঠিয়ে সাংবাদিকতার স্বাদ পেয়ে গিয়েছিলাম। আজ সব সার্থক হয়ে উঠল। বাস্তবিক আমার পা তখন মাটিতে নেই। কিন্তু... এক লহমায় সব লণ্ডভন্ড হয়ে গেল যেন।
রবীন্দ্র সদনের কাছে গিয়ে দেখি, কেউ নেই, কিচ্ছুটি নেই। সদনের বাইরের দুটি ফটকেই তালা ঝুলছে। সার্কুলার রোড দিয়ে মাঝে মাঝে ছুটছে বাস। চারপাশ শুনশান। কী হল? মুরারীবাবুর কাছে ঠিকঠাক খবর ছিল তো? এ জন্যেই কি দুই রিপোর্টারের একজনও এই কাজে আসেন নি? এখন আমার কাজ কী হবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। জীবনের প্রথম ফুল ফ্লেজেড সাংবাদিক হবার দিনটাতেই সব গুবলেট হয়ে গেল। গেট দিয়ে ভেতরের কাঁচে ঘেরা ফয়ারের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকি। যদি কিছু মেলে। একজন, কর্মী গোছের কেউ, এগিয়ে এলেন।
তিনিই হলেন আমার সোর্স। শুনলাম, ইন্দিরা গান্ধী আসেন নি। মেসেজ পাঠিয়েছেন। উৎপল দত্তের নেতৃত্বে একদল মানুষ রবীন্দ্র সদন চত্বরে এসে খুব স্লোগান দিয়েছেন, প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। উৎপল দত্তের পরনে কী ধরনের পোশাক ছিল, কী কী স্লোগান দিলেন, টুকে নিলাম। পরে পুলিশ এসে তাঁদের পিজি হাসপাতালের দিকে ধাইয়ে নিয়ে যায়। সাংস্কৃতিক কর্মীরা সেখানে দাঁড়িয়েই স্লোগান দিতে থাকে। ইন্দিরা গান্ধীর মেসেজে কী বলা হল, কে কে বক্তৃতা দিলেন তাদের নাম টুকে নিলাম। কী বিষয়ে কে কি বললেন তার ছিটেফোঁটা। মঞ্চ কেমন সাজানো হয়েছিল, আন্দাজ কত লোক হয়েছিল, তাদের মধ্যে ভিআইপি কারা এই সব। তড়িঘড়ি এই সব টুকে নিয়েই দে ছুট চৌরঙ্গির রাস্তায়। কিন্তু বাসের দেখা নেই। হাতে সময়ও নেই। আমার সাংবাদিক হবার স্বপ্নের ভরাডুবি চোখের উপর দেখতে পেলাম। শিয়ালদায় পৌঁছে, অফিসে ঢুকে, রিপোর্ট লিখে জমা দিলে তারপর ছাপা! অসম্ভব। অত সময় কোথায়, কী করেই বা পারব? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল। এক্সাইড অফিসের একতলায়, চৌরঙ্গির দিকে মুখ করে, অ্যাপলো টায়ারের মস্ত সাইনবোর্ডওয়ালা একটা দোকান। ঢুকে পড়ি। বলি, আমি রিপোর্টার। ফোন করতে চাই। পেমেন্ট করব। বলতেই দোকানের ম্যানেজার গোছের সর্দারজী রাজি। ফোনে তো রিপোর্টই পাঠালাম। মুরারীদা ঝটপট লিখে নিলেন। সর্দারজী পয়সা নিলেন না। ওফ, কী শান্তি আর গর্ব! তবু বাস ধরার তড়িঘড়ি কমে না। ছাপার অক্ষরে একটা দৈনিকের পাতায়, হোক না বিকেলের কাগজ, আমার লেখা ছাপা হবে! টগবগ টগবগ।
34. //প্রত্যাবর্তন
//
প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমার কথা শুনে বললেন, 'আমারও তাই মনে হয়। তুমি রিএগজামিন চাও। তোমার ফেল করার কারণ দেখি না। আমি চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। আধ ঘন্টা পরে এসো।' বলে খাস পিওন নারাণদার জন্য ঘন্টা ট্যাপ করলেন বার কয়েক। আম বাইরে বেরিয়ে আসি।
তখনও
ক্লাশের সবাই আসেনি, আমি তার আগেই চলে যেতে চাই। সবচেয়ে ভয়, যদি দীপ্তি এসে হাজির হয়। আমি কলেজ বিল্ডিংয়ের বাইরে, পার্কে, এক গাছের ছায়ার নিচে বেঞ্চে শুয়ে, সেটা কেউ ভাববে না। সারারাত জাগা, শরীরটাও ভেঙে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রায় ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে জেগেও উঠছিলাম। 'আই লাভ ইউ, দীপ্তি!' হো হো করে হেসে উঠেছিল। চোখেমুখে রাতের কয়েকটা ঝিকমিক তারা নামিয়ে জানতে চায়, 'আচ্ছা? আমি কত নম্বর তোমার জীবনে?' থতমত খেয়ে যাই এমন আকস্মিক প্রশ্নে, 'তোমার এমনটা মনে হবার কারণ?' 'তুমি হ্যান্ডসাম। তোমাকে কারো ভালোলাগেনি, তা তো হতে পারে না?’ হারব কেন? বললাম, 'অফকোর্স নট। ক্লাশের কতজন আমাকে পছন্দ করে, তা জানো?' কথাটা মিথ্যে বলিনি একটুকুও। রুমা, সুকন্যা, রিমলি... 'জানি বলেই তো জানতে চাইলাম।' গম্ভীর হয়ে যাই, 'হাউ ক্যান আই প্রুভ, তুমিই ওনলি ওয়ান ইন মাই লাইফ?' বলেই ভয় পেয়ে যাই, লাইব্রেরির দেয়াল ঘেষা বারান্দায় দুজনে দাঁড়িয়ে, যদি বলে এখান থেকে ঝাঁপ দাও? মনে মনে নিজেকে তৈরি করি, না অতটা পারব না। দীপ্তি বলে, 'আমার জন্য সিগ্রেট ছাড়তে পারবে?' খানিক ভাবি। দীপ্তির এই কথার পিছনে চালাকি আছে, টের পাই। সেটা আমাকে আর সিগ্রেটকে আলাদা করার চালাকি। একদিন পলস্কোতে বসে বলেছিল, 'সিগ্রেটের পিছনে এত পয়সা নষ্ট করো তুমি, অথচ এক জামা এক প্যান্ট।' হাতের জলন্ত সিগ্রেটটা নিভিয়ে জোরসে অনেক দূরে, তেতলা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিই। …হাত দুটো ভাঁজ করে চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম বেঞ্চে। আচমকা চন্ডী এসে হাতের কবাট দুপাশে সরিয়ে গাছটাকে তার মোটা মুখাবয়বে আড়াল করে জিজ্ঞেস করে, এখানে কী করছিস?
প্রিনসিপ্যালের সঙ্গে কী কথা হয়েছে চন্ডীকে বলি। ও উৎসাহ দেয়, 'ঠিক করেছিস।' এমন ভাব, যেন রিএগজামিন মানেই পাশ। আমি যে এ ব্যাপারে খুব উদ্যমী হয়ে উঠেছি, তা তো নয়। আমি শুধু জানতে চাই, কেন পাশ করতে পারলাম না। কোন কোন পেপারে কেন কম নম্বর পেলাম সেটা আমার কাছে বড় নয়। আমি ভালোমতই জানি, রিএগজামিন করা হয় জানতে, প্রশ্ন করতে নয়। প্রিনসিপ্যালই
বলেছেন, তোমার এটা জানা দরকার আরো এই কারণে, পরের বছর যাতে তুমি আরো ভালো প্রিপারেশন নিতে পার। মনে মনে কষ্ট বোধ করি, স্যার তো বাইরের ঝড় বাদলের খবর জানেন না! এ বছরেই কোথায় আবার ছিটকে যাব ঠিক নেই, তো পরের বছর! বিস্ময় আর মমতা চন্ডীর চোখ দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছিল মনে হ'ল। বললাম, 'কই বাত নহীঁ গুরু! অরুণ চক্রবর্তী হারতে জানে না জানবি। দীপ্তি অর নো দীপ্তি। আই কান্ট বি ডিফিটেড বাই এনি ওয়ান
অর এনি সিচুয়েশন।''
চন্ডী
আমাকে
মিথ্যে
আস্বস্ত
করে,
'আমরা
সবাই
তা
জানি।'
অর্জুন,
অভীক
আর
সত্য
আসবে
বলল।
বললাম,
'সবাই
আমজাদীয়ায়
আয়। ইউনিভার্সিটিতে স্যারের চিঠিটা জমা দিয়ে আমজাদীয়ায় যাব।'
দ্বার্ভাঙ্গা
বিল্ডিংয়ের পাঁচ কি ছয়তলা, মানে ছাদের কোন অফিস ঘরে চিঠিটা জমা দিতে হবে। ঝড়ে বিধস্ত
রাতজাগা পা দু'টোতে আর জোর পাচ্ছিলাম না। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে কিছুটা উঠে মনে হ'ল, থাক।
দরকার নেই। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষকরা কি আর এতটা ভুল করবেন যে, একটা পাশের ছেলে ফেল
করে যাবে? খাতা চ্যালেঞ্জ করার পরেও যদি ফেল করি? নিজেকে সুরক্ষিত করার সব কৌশল নিশ্চিহ্ণ
হয়ে যাবে তবে। দীপ্তির মুখটা মনে পড়ল। সারাদিন পরিশ্রম করে ডেরায় ফেরার সময় ওকে অনেক
সময় ফোন করতাম, ফোনে সুবীর সেনকে চুরি করে বলতাম, 'সারাদিন তোমায় ভেবে হ'ল না আমার
কোন কাজ।' আজ মনে পড়ল। এত কিছু করেও হ'ল না আমার পাশ করা। কিন্তু প্রিন্সিপ্যালের
চিঠিটা হাতে। পৌঁছে না দিলে, স্যারকে গিয়ে বলব কী? আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকি। আবার কিছুটা
উঠে থমকে যাই। এমনটা, আমি যেন চাইনি রিএগজামিনেশন, চেয়েছেন প্রিস্সিপ্যাল। আমার শরীর
বা মনের কোথাও কোন আগ্রহ বোধ করি না। তবু এ টেবিল ও টেবিল ঘুরে চিঠিটা জমা দিই।
'কে
বললে তুমি ফেল করেছ? তুমি তো পাশ! তোমার রেজাল্ট উইথহেল্ড করা হয়েছে। তোমার ক্লাশ এটেনড্যানস
এর উল্লেখ নেই তোমার ফর্মে।' খিঁকিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। আমার হাত পা হিম হয়ে আসে। চেয়ার
টেনে বসে পড়ি তার সামনেই। অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম কি?
মনে
করতে পারছি না। আমি ইউনিভার্সিটি থেকে কলেজে কী করে পৌঁছে গেলাম। আমি কি সারা রাস্তা
ছুটে এসেছিলাম? নাকি শিয়ালদা অবধি দৌড়ে, তারপর বাস? মনে নেই। মনে আছে, অ্যানেক্সির
দোতলায় দাঁড়িয়ে থাকা দীপ্তির সামনে দাঁড়াতেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল বাইরের দিকে, শূণ্যে।
ওর চোখে কি জল ছিল? মনে নেই। আমি কি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার
করেছিলাম, 'আমি পাশ করেছি, দীপ্তি!' মনে নেই মনে নেই। মনে পড়ছেও না।
বস্তুত
সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের যৌথ জীবন। খোলামেলা। কেননা ওই দেড় দিনে ক্লাশের সব
ক'টি বন্ধু বান্ধবী, এমন কি কলেজের পিওন, স্যারদের অনেকে, এবং অন্যান্য কিছু ক্লাশের
ছেলেমেয়েদের কাছে আমাদের স্পম্প্রক উন্মুক্ত হয়ে গেছে। লুকোবার কিছু থাকল না আর। একদিন
দীপ্তি আর আমি ক্লাশ কাটার প্লয়ান করলাম। বেলেঘাটা লেকে বেড়াতে যাব। দীপ্তি দোতলা থেকে
নামছে, আমি নিচে। পিএস অপরে কোন ক্লাশে যাচ্ছিলেন। আমি নমস্কার করলাম। মাথা ঝাঁকালেন।
কিন্তু সিঁড়িতে উঠতেই দীপ্তিকে দেখলেন, নামছে। ঘুরে একবার আমাকে দেখলেন। তারপর দীপ্তির
সামনে দাঁড়িয়ে হুকুম করলেন, 'ওপরে। ওপরে চলো। ক্লাশ আছে না? দীপ্তির ফিলজফির ক্লাশ
ছিল, আমার না। ফলজফির স্যারের নামোল্লেখ করে পিএস বললেন, 'ওঁর ক্লাশ ফাঁকি দিও না।
তুমি নিজেই ফাঁকিতে পড়ে যাবে।' দীপ্তি ওপরে উঠে যায় স্যারের পিছু পিছু, আমি ক্যান্টিনে
গিয়ে বসি।
তো
আমাদের কান্না হাসির গল্প যে এক কিলোমিটারেরও কম দুরত্বে দীপ্তিদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকবে
না, তা তো হয় না! পাড়ার সিনিয়রদের সবাই, যাঁরা আমাদের কলেজে পড়তেন, ছিলেন দীপ্তির স্বঘোষিত
গার্জিয়ান। দীপ্তি বাড়ির ষষ্ঠ সন্তান। মানে এমনিতে বাড়িতেই মা-বাবা ছাড়া অনেক গার্জিয়ান,
প্লাস পাড়ার গার্জিয়ানের দল। আমি সেটা টের পেয়েছিলাম দীপ্তির খরগোসের মত ভিরু আচরণে।
কোনদিন কোন সিনেমাই আমাদের পক্ষে পুরো দেখা হত না। দীপ্তি ঘড়ির কাঁটা দেখেই লাফিয়ে
বাইরে চলে যেত, 'সূর্য ডুবে গেলে বাড়ি ফেরা খুব রিস্ক।' সিনেমা হলে ঢকার আগে চারপাশ
জরিপ করত, পাড়ার কেউ নেই তো?
এই
অবস্থার মোকাবিলায় আমি একটা ফন্দী কাজে লাগালাম। দীপ্তিকে তার বাড়ির ঠিকানায় একদিন
দুদিন অন্তর অন্তর চিঠি লিখতে লাগলাম, যদিও সপ্তাহের ছয়দিনই কলেজে আমাদের দেখা হত।
ওদের বাড়ির ঠিকানাতেই ইনল্যান্ডে নয়ত খামে লিখতে শুরু করলাম। লোকের মুখে শোনার আগে
আমাদের কথা আমাদের মুখ থেকেই শুনুক না সবাই! চিঠি তো একদিন চুরি হবেই। বাড়িতে অত লোক,
দীপ্তির নামের চিঠি চুরি হবে না, সেটা অসম্ভব। চিঠিতে আমি ভালো ভালো কথা লিখতাম। আমরা
বড় হব। বড় হয়ে কী করব। এখন আমরা কী কী করতে ভালোবাসব এই সব। সঙ্গে তিন ভাগের এক ভাগ
জায়গায় লেখা থাকত, আমরা কেন বাবা মা'কে দুঃখ পেতে দেব না। যদি অন্য কোথাও তোমার বিয়ে
ঠিক হয়ে যায়, ভেবো না, আমি দাড়ি রেখে দেবদাস হব। মা-বাবার সম্মান রাখতে তুমি সেই বিয়েতে
রাজি হবে, আমি তোমার বিয়েতে কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেষন করব। দুঃখ? তাকে বলি দেব আমরা
মা-বাবার পায়ে। কেননা, তাঁরা ছিলেন বলেই তো তুমি আছ আজও। এমন বয়ানই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখতে
লাগলাম সব চিঠিতেই। এমন সব কথা, যা পড়ে বাবা-মা
দাদা-দিদির দল আমাদের দুজনকে আলাদা করার নিষ্ঠুর দায়টা নিজেদের কাঁধে অনুভব করে কষ্ট
পান। কেননা, দীপ্তির কাছে ওদের বাড়ির নানা গল্প থেকে জেনেছিলাম, ও বাড়ির সবার খুব আদরের
মেয়ে, বোন। ওর শান্ত আর সবার জন্য মমতাময় মনটাকে সবাই ভালোবাসে। আমার এমনতর সব হিসাব
মিলে গেল শেষটায়।
দীপ্তি
একদিন বলল, 'মা তোমাকে দেখা করতে বলেছেন, তাঁর স্কুলে...'
33. //পলাতক //
বর্ধমানআসতে কামরার দরজা ঠেলেঠুলে আরো মানুষ
ঢুকে পড়ে। আমি তাদের বাক্স পেঁটরা পায়ের গুঁতো লাথি খেতে খেতে দরজা থেকে সরে বসি, দেয়ালে
পিঠ। কাঁধের ঝোলাটা কোলে পোটলা করি। হুটোপুটিতে
আমার মন খারাপটাও যেন পুরানো হয়ে গেল। আমার জীবনটা স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব? সরস্বতী
পূজা। ঘড়ির কাঁটা ধরে দীপ্তি হাজির। ওর ঘড়ি ধরে চলার ব্যামো। আমার বাসটা দেরি করল পৌঁছুতে,
ছুটে গিয়ে দেখি, একটা আনকোরা ধূসর রঙের শাড়ি পরে ঠাকুরের সামনে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে
কথা বলছে। খানিক সময় কাটিয়ে বলি, 'চলো, আজ একসঙ্গে বাইরে যাব।' কলেজের বাইরে এর আগে
এক সাথে যাইনি কখনো। রাজি না, 'বাড়িতে পুজো।
আত্মীয় স্বজন আসবে, হবে না।' দীপ্তি বাড়ির পথে হাঁটা দেয়, আমি সঙ্গ ছাড়ি না। আমার পকেটে
এত পয়সা নেই যে, খুব একটা ঘুরতে পারব, তবু ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকি। কলকাতার পথ তো অল্প
না, না হয় হাঁটব একসঙ্গে। কথা বলব আর হাঁটব, কথা বলব আর হাঁটব। কলেজ থেকে চন্ডীতলা
পৌঁছে যাই। রেলব্রিজের পাশে, ডানদিকের গলিপথ ধরে দীপ্তিদের বাড়ির পথ। সেদিকে মুখ ফিরিয়ে
চলতে চলতে একটা কাঁচা ড্রেন একটু লাফিয় পার হয়ে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল, 'ঠিক আছে। বারোটার
সময় কলেজে এসো।' অমনি চারপাশে কাঁসর ঘন্টা বেজে ওঠে, কচি কাঁচা বড়দের দল হই হই করে
ওঠে, মাইকে ফুল ভল্যুমে বেজে ওঠে আধুনিক গান,
রাস্তায় ব্যান্ড বাজিয়ে মিছিল করে বেরিয়ে পরে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা শিশু পড়ুয়ারা। সেটা ছিল ১৯৬৬ সালের ২৬ জানুয়ারি। সারা কলকাতা সেদিন
সরস্বতী পূজা আর গণতন্ত্র দিবসের ডবল উৎসবের কোলাহলে মুখর। আমি লাফিয়ে বাস ধরি। শঙ্করদার
কাছে গিয়ে বলি, 'আমায় দশটা টাকা দেবেন, দাদা?' আমি তাঁর আশ্রয়ে আছি। তিনি জানতেন, আমি
কত ধরণের সংগ্রামে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি। কোন কথা না বলে, মানি ব্যাগ হাতড়ে দুটো পাঁচ
টাকার নোট দিলেন...
হাত ঘড়ি জমা দিয়ে যে আশি টাকা জোগাড় করেছি ঝোলার
তলা হাতড়ে তা আবার পরখ করে নিই, আছে। এই সময়
আমার সুখ ভাবনার রেশটা কেটে গল। চোখের সামনে সাদা প্যান্ট আর কালো জুতো। থামছে,
আবার ভীড় ঠেলে সরে দাঁড়াচ্ছে, আবার একটু, আবার একটু... নিজেকে প্রস্তুত করি, মাথা নিচু
করে থাকি। যতই উশকোখুশকো হোক না চুল, যতই গুটিশুটি মেরে মেঝেয় বসে থাকি না কেন, জানি,
মুখ তুললেই ধরা পড়ে যাব। আমার কাছে টিকিটের টাকা নেই, লোকটা বিশ্বাস করবে না। তখন হয়ত
ওই আশি টাকাতেও কুলোবে না। মাথায় টোকা পড়ে, 'টিকেট।' মুখ গুঁজে থাকি। 'এই ছেলে, টিকেট?
টিকেট দেখাও', বুঝলাম, ধরা পড়ে গেছি, 'টিকেট দ্যাখা' না নয়, বলছে, 'টিকেট দেখাও'! মাথা
উঁচু করে বলি, 'নেই।' 'তবে ফাইন লাগবে' বলে কালো কোটের সাইড পকেট থেকে একটা রসিদ বই
বের করে। বলি, 'আমার ফাইন দেবারও পয়সা নেই।', 'তবে নেমে যাও।' আমি দুই চোখে আলো জ্বেলে
বলি, 'এই লাইনের কোন স্টেশন চিনি না। যেখানে বলবেন, নেমে যাব।' থতমত খেয়ে যান শক্তপোক্ত
বেঁটেখাটো টিকিট চেকার। খুব রুঢ় স্বরে বললেন, 'আচ্ছা? এখান থেকে নড়বি না। আমি বগি চেক
করে আসছি' কামরার ভেতরে চলে গেলেন।
'এই থামুন থামুন!' ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলি।
দীপ্তিকে বলি, 'এক টাকা দশ পয়সা, এর বেশি ট্যাক্সি চড়া যাবে না। এবার বাসে চড়ব। চলো,
এবার হাঁটি।' দীপ্তিও চমকে ওঠে, বাপরে! এক টাকা দশ!' নামো নামো!. সামনে হাঁটলেই এলিট
সিনেমা, জায়গাটা জানবাজার। 'ওই যে রানী ভবানীর জমিদার বাড়ি,' দীপ্তিকে দেখাই। মনে মনে
হিসাব করি, কাঁকুড়গাছি ফিরতে দুজনের দশ দশ
কুড়ি পয়সা, কুড়ি কুড়ি চল্লিশ, আমার শিয়ালদা ফেরা আরো দশ। বাকি পয়সায় কোন রেস্ট্যুরেন্টে
বসা যায়?' দীপ্তি বলে, রেস্তোঁরায় কি বেশি কথা হবে? তারচেয়ে বরং হাঁটি। বড় রাস্তা ছেড়ে।
কেউ যদি দেখে?' আমরা হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলা আর চৌরঙ্গির ক্রশিং-এ পৌঁছে যাই। 'ধুর,
তারচেয়ে চলো, আমার ডেরায়। হাঁটাও নেই, কারু দেখার ভয়ও না। শুধুই গল্প।' দীপ্ত রাজি।
আমরা ট্রাম ধরে আমজাদীয়ায় পৌঁছে যাই। সেখান থেকে আমার ডেরায়। দরজা হাট মেলে ধরে নাটকীয়
ভঙ্গিতে বলি, 'এই আমার সাত বাই দশের সংসার।’ উত্তরে দীপ্তির
মুখের আজো ভুলতে না-পারা প্রশ্রয়ী প্রশান্ত তৃপ্ত হাসি... আজ সব, সব জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছি গুরুদাস কলেজের দুই
বিল্ডিঙ্গের শূণ্যতায়। এর ওর গায়ে ঢুলে ঢলে গাড়ির আমরা ঘরঘর ঘটাং ঘট করে দৌড়ুতে থাকি,
প্রতি মুহূর্তে কলকাতা থেকে দূরে, আরও দূরে।
রঙমহলে চলছে 'শাপমোচন।' দু'টি ম্যাটিনি শো'র
টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে আছি। দেখা নেই দীপ্তির। পাশের একটা দোকান থেকে ফোন করি। 'ভাবোই
না, আমি পাশেই আছি। আজ তুমি একাই দেখো।' ট্রেনের এই চাপাচাপি ভীড়েও কি আছে সে পাশে?
না নেই। কল্পনায় এভাবে আমরা তো একসঙ্গে থাকার কথা তো কতই ভেবেছি, কিন্তু এই পরিবেশে
সেই ভাবনা এলো না। আমি বড় হব, বিলি ভনের ট্রাম্পিটের সুরে ভেসে যাব কোন সন্ধ্যার নির্জন
ক্রুইশে। নিজকে নিঙড়ে দিয়ে গাইব, 'আমি এত যে তোমায়...' গুরুদাসে দীপ্তিকে দেখার পর
থেকে তাই তো আমি বদলে গিয়েছিলাম। অনর্সে মস্ত রেজাল্ট করে নিজেকেই অবাক করে দিতে চেয়েছিলাম।
দিন রাত পড়াশুনো করেছি, স্যারদের কাছে গিয়েছি, কলেজে, তাঁদের বাড়িতে। ক্লাশ ফাঁকি না-দিয়ে
একাগ্রতায় নোট করেছি সব। সিলেবাসের ইংরেজি সাহিত্যের সব ক'টি দিকের সব ক'টি বিচ্ছুরণের
আলোয় নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি। সেজন্যেই পরীক্ষার হলে ছিলাম এত কনফিডেন্ট।
অথচ...
মাছির মত ভন ভন করতে থাকে স্মৃতি, মাথার ভেতরে,
মস্তিষ্কের সব ক'টা স্নায়ু বেয়ে বেয়ে। মাথাটা ভার হয়ে যায়, এক আচ্ছন্ন বোধে ঝিমুনি
আসে চোখে, সারা শরীরে... 'এই রাখো আমার শেয়ার। আমার বাবা আমাকে হাত খরচ দেন। ভালই।'
'তুমি আমাকে সাহায্য করার জন্য দিচ্ছ এটা। আমার রেস্ত থাকলে তুমি দিতে চাইতে না।'
'কী যা তা বলছ? চন্ডীকে জিজ্ঞেস কোর, এ আমার স্বভাব, আমি বাকি রাখি না।' 'আমিও তো বাকি
রাখতে চাই না, দীপ্তি?' ঠিক আছে পরের দিন এই পলসকোতে আমি আনব তোমাকে, খাওয়াতে। তখন
তোমার শেয়ারটা দিও। নেব।' ও কি পরে আর কোনদিন ডেকেছিল আমায়? মনে পড়ে না। আমাকেই ডাকতে
হয়েছে বারবার। এসেছে আর পয়সা শেয়ার করেছে। একদিন আমার হতাশায় ধমক দেয়, 'তা হলে আর একসাথে
একসাথে বলে স্বপ্ন দেখো কেনো এত?'... দীপ্তির বাতিক, জানা গান বা কবিতার লাইন এখানে
ওখানে টুকে রাখা। খাতার পাতায়, মলাটে, বইয়ের পাতার মারজিনে। সবখানেই। এক টুকরো জায়গা
মিললেই হ'ল। 'অরুণের এই কলেজে আসা ঠিক হয় নি। ও নষ্ট হয়ে যাবে', বইয়ের ভেতরের এক পাতার
কোণে। 'একেই কি বলে আঠারোর ঘূর্ণী?, আর এক জায়গায়...
‘এই ওঠ ওঠ! এখানে
নেমে যা। এই গাড়ি দিল্লি যাচ্ছে। ধরা পড়লে সোজা জেল হাজত,' জুতোর ডগা দিয়ে আমাকে ঠুক
ঠুক করে জাগিয়ে দেয় মোটা বেঁটে টিকিট চেকার। আমি জামা কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াই,
'এটা কোন স্টেশন?' 'ধানবাদ। ঘন্টা তিনেক বাদে ফেরার কালকা মেল। হাওড়ায় ফিরে যাস। নইলে
কপালে মহা দুঃখ আছে তোর, বলে রাখলাম। অন্য কামরায় ওঠার চেষ্টা করিস না যেন।' বলে প্রায়
ধাক্কাতে ধাক্কাতে আমাকে বগি থেকে নামিয়ে দেয়। চারপাশে অনেক জোড়া চোখ। সহিনুভূতিতে
টলটল, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। ওদের অনেকেরই টিকিট নেই জানি। তবে চেকারকে দেবার মত
পয়সা ছিল। আমার ছিল না।
ট্রেনটা চলে যেতেই স্টেশনটা একলা হয়ে যায়। চারপাশে
সব সবকিছু একা হয়ে যায় যেন। ওপারের প্লয়াটফর্মের চায়ের দোকানটা, তার মালিক, কেটলির
গলা বেয়ে উঠে আসা বাষ্প, ল্যাম্পপোস্ট, রেল লাইন, প্লয়াটফর্ম... সবাই একলা যেন। আমিও
একলা বোধ করতে থাকি। অনন্ত চরাচরে একলা। ফুটব্রিজ বেয়ে ওপারে যাই। সার বাঁধা অফিস ঘর।
ইতিউতি কিছু মানুষ। একটা বেঞ্চে বসে পড়ি। দিল্লি যাওয়া হল না। এবার? হঠাৎ মনে পড়ে,
রেল কলোনির মিহিরের বড়দা ধানবাদের কোন কোলিয়ারিতে কাজ করেন। কী কাজ মনে পড়ে না। চিরকাল
আমাকে কোলিয়ারি খুব রোমাঞ্চিত করে। জানি, পৃথিবী জুড়েই সবচেয়ে শোষিত শ্রমিক দল হ'ল,
খনিশ্রমিক। আমি নিজেকে ঝাঁকিয়ে তুলি। কোলিয়ারিই হবে আমার নতুন ঠিকানা। আমার নতুন সংগ্রামী
জীবনের ঠিকানা। খালি বেঞ্চ, ভাবনাটা মাথায় ঢুকে আমাকে হাল্কা করে দিল। টান টান শুয়ে
পড়লাম। কিন্তু কোলিয়ারির হতভাগা শ্রমিক বা তাদের জীর্ণ শীর্ণ পরিবারগুলোর মুখ না, ধেয়ে
আসে দীপ্তির হাসি হাসি মুখ। বন্ধুর প্রশ্রয়, বোনের সতর্ক বলয়, মায়ের স্নেহ আর সর্বোপরি
ভালোবাসার অনন্ত দিগন্ত স্পর্শ... দীপ্তিকে ভুলি কী করে? দিনাজপুরে যা খুইয়ে এসেছি,
ব্রেবর্ণ রোডের সেই ধুর্ত সর্দারজী আমার জীবন থেকে মানবিকতার যা কিছু ছিঁড়ে নিয়ে গেছে,
সিটি কলেজের টিএন্সি আমার জীবনে যে বিষ ঘুলে দিয়েছেন... সব কিছুকে এক সময় নির্মল সুগন্ধে
লেপে দিয়েছে দীপ্তি। অথচ... আমি পড়াশুনায় ভালো ছেলে, নিদেন এটুকুও প্রমাণ করতে পারলাম
না। নিজের কাছেও না আর কারো কাছেই না। বার বার এই ব্যর্থতাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আমাকে।
উত্তেজনায় উঠে বসি। আমি কি সত্যি ফেল করার ছেলে? তাহলে ফেল করলাম কী করে? এক এক করে
প্রতিটা পেপারের প্রতিটা প্রশ্ন সেই সঙ্গে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরে আমার লেখা প্রতিটা
উত্তর মনে করার চেষ্টা করতে থাকি। মনে পড়তে থাকে মনে পড়তে থাকে। না, তাহলে আমি ফেল
করলাম কী করে? কে আমাকে ফেল করালো? কীভাবে ঘটল এই এই অঘটন?
টিকিট ঘরে গিয়ে একটা হাওড়ার টিকিট কিনলাম। আমি
কলকাতায় ফিরে যাব। আমি চ্যালেঞ্জ করব ইউনিভার্সিটিকে। রিএকজাম হোক আমার পেপার। আমি
কোথায় কোন কারণে ফেল করলাম, তা জানতে হবে। নিশয়্ই জানতে হবে। জানতে চাওয়া আমার অধিকার।
জিজ্ঞেস করতে চাওয়ালা জানাল, দিল্লির কালকা মেল আজ লেট। দেরি হবে। ভাবনায় ছটফট করতে করতে ফিরে আসি বেঞ্চটাতে। তবে
কি অন্য কোন গাড়ি ধরব? স্টেশন মাস্টারের কাছে যাই। তিনি বললেন, কালকা মেলই সবেচেয়ে
ভালো ট্রেন। সকালের আগে একমাত্র ওটাই ট্রেন। অনেক সময় লেট মেক আপ করে নেয়। অপেক্ষা
কর। আমি অপেক্ষা করতে পারি না। প্ল য়া ট ফর্ম বেয়ে চড়কির মত ঘুরপাক খেতে থাকি...
32. // পরীক্ষা //
আমার কলেজের দিনগুলো ছিল ১৯৬৩ থেকে ৬৭ পর্যন্ত।
অর্থাৎ বাংলার শিক্ষাঙ্গণ যখন ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত পরিবেশের ঝলমলে রোদ্দুরে স্নাত
হত। আমি আগেই বলেছি, শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয় ও সহযোগিতা ছাড়া কলকাতায়
আমি আর যা কিছুই হতে পারতাম, আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় দীক্ষিত হতে পারতাম না। যেদিন বিএ'র
ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসেছি, বোধহয় ফোর্থ পেপার, ভয়ার্ত খরগোশের চোখে দেখতে পেলাম, কেমন
করে লন্ডভন্ড হয়ে গেল আমাদের সূর্যস্নাত শিক্ষাঙ্গণ।
আমার সিট পড়েছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটির সেন্টিনারি
বিল্ডিং-এ। চারতলা কি ছয়তলায়। আমার পড়াশুনোটা ছিল আমার নিজস্ব ঘরানায়। আমার মূল টেক্সট
বই কেনার পয়সা ছিল না। আমার পড়াশুনোর হাতিয়ার ছিল, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, যা কারো
কাছ থেকে এনে ফেরত না-দিয়ে পাওয়া, আর বিবিএস (বিভূতি ভূষণ সেন) এবং পিএস'র (পরিমল সেন)
ক্লাশ। এঁরা দু'জন তাঁদের লেকচার তাদের সাবজেক্টে কখনই সীমিত রাখতেন না । জড়িয়ে নিতেন
আরো আরো বিষয়ের নির্যাস। বিভূতিবাবু পড়াতেন জুলিয়াস সীজার, কিন্তু তাঁর ক্লাশ করে আমি
সেক্সপীয়রের নাটকই শুধু নয়, সেক্সপীয়রের কবিতা,
সনেট, সমকালীন সামাজিক ও রাজ-নীতির পটভূমি, এমনকি সেই সময়ের অন্যান্য নানা ইউরোপীয়
জাতীর বিষয়ে কিছু না কিছু জানার সুযোগ পেতাম। পরিমলবাবু পড়াতেন ইংরেজি গদ্য, কিন্তু
তিনি তাঁর লেকচারে জড়িয়ে নিতেন নাটক, কবিতাকেও। আমি রুদ্ধশ্বাসে এই সব কথা নোট করে
করে নিজেকেই উপহার দিতাম ইংরেজি সাহিত্যের বিপুল বিস্তার। এর ফলে একটা ব্যাপার ঘটল,
আমি মূল টেক্সট না পড়েও যে কোন সাবজেক্টের কোশ্চেন পেপারের সব ক'টি প্রশ্নের উত্তর
দিতে পারতাম। তা সেই প্রশ্নগুলো যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই করা হোক না কেন। প্রথম কারণ,
দারুণ রেজাল্ট করার লক্ষ আমার কোনদিনই ছিল না, তার উপায়ও ছিল না অবশ্য, আর দুই, সংশ্লিষ্ট
বিষয়ের নোট খাতার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা অবধি টানা পড়তাম বলে নানা পথে বারবার
ঘোরাফেরা করতে হত, আর ঝরঝরে হয়ে যেত মূল টেক্সটের ভেতরের ব্যাপারগুলো। সে জন্যেই আমি
খুব হাল্কা মনে পরীক্ষা দিতে পারতাম। পরীক্ষার হলে আমার কোন টেনশন থাকত না। সেদিনও,
মনে আছে, আমি এক দুই তিন এই ক্রমে খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখছিলাম। খুশি মনেই। কিন্তু
বেশিক্ষণ কাটল না।
দুদ্দাড় করে একদল ছাত্র পরীক্ষার ঘরে ঢুকেই তছনছ
করতে থাকে চারদিক। এর ওর উত্তর দেবার খাতা কোশ্চেন পেপার ছিঁড়ে কুটি কুটি করে হাওয়ায়
নাচতে থাকে। আমি ছিলাম প্রথম বেঞ্চে, বুঝতে পারি না, কী ঘটছে, কেন ঘটছে। বোকার মত সামনের
ফাঁকা মেঝেতে বসে হুমড়ি খেয়ে উত্তর লিখতে থাকি। আমার পরিচিত, রাজনীতি করে, বিপ্লব হালিম,
দৌড়ে এসে আমার খাতাটা নিয়ে ফস ফস করে ছিঁড়ে ফেলে . ততক্ষণে জানালা গলে কলেজ স্ট্রিটের
মাঝরাস্তায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে ক্লাশ রুমের বেঞ্চ, টেবিল চেয়ার... সব ফ্লোরের সব পরীক্ষার
ঘর থেকেই। আমরা, পরীক্ষাত্রীরা ভয়ে ক্লাশের বাইরে, প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে
যাই। নেমে দেখি, চারপাশে গোছায় গোছায় উন্মত্ত ছাত্রদের দল। আমার অঙ্কে এখান থেকেই চোখে
পড়তে থাকে নকশাল আন্দোলন। ভাঙো ভাঙো ভাঙো! সেদিন থেকেই যেন দুমড়ে মুচড়ে গেলে শিক্ষক-ছাত্রের
সুখ সুখ সম্পর্কগুলো। এরপর থেকেই কলকাতার চারপাশে ধিকিধিকি আগুন ছড়াতে লাগল, এক থেকে
অন্য ক্যাম্পাসে, এক থেকে অন্য কলেজে, এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে। ভাঙো ভাঙো ভাঙো!
পরীক্ষা পিছিয়ে গেল মাস খানেকেরও বেশি সময়। পরীক্ষা নিয়ে এখন আর ভয় নেই। শিক্ষা এখন
ছাত্রদের হাতে, শিক্ষককদের হাত খালি।
পরীক্ষা দিতে না-পারাটা আমার কাছে এক ভয়ঙ্কর
আতঙ্কের হয়ে উঠল। ততদিনে আমি আর দীপ্তি অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি। এমনকি একদিন দীপ্তির
বাবার সামনে দাঁড়িয়ে দুই বুকে সাহসের শ্বাস টেনে বলেছিলাম, 'আপনি দীপ্তির বিয়ে অন্যত্র
দিতেই পারেন। তবু আমি বলব, আমার গ্রাজুয়েট হওয়া অবধি আমাকে যদি নিজেকে আপনার মনের মত
হবার সুযোগ দিতেন...' এর একটা পটভূমি আছে।
আমরা দু'জনে কলেজে রীতিমত দেখা করলেও, আমি প্রায়
প্রতিদিন দীপ্তিকে বাড়ির ঠিকানায় ইনল্যান্ডে, কখনো খামে, চিঠি দিতাম। তাতে একটু চালাকিও
ঠাসা থাকত। চিঠির দু'ভাগে থাকত আমাদের কথা, আর এক ভাগে বাবা মা'র প্রতি আমাদের অনমনীয়
কর্তব্য পালনের কথা। কেন আমরা তাঁদের মতের বিরুদ্ধে কোন কথা বলব না কিংবা পদক্ষেপ নেব
না, সে সব থাকত ওই এক ভাগে। আমি জানতাম, একদিন না একদিন কোন চিঠি ওর বাবা-মা বা দাদা-দিদিদের
হাতে আসবেই। হ'লও তাই। একদিন দীপ্তি এসে বলল, 'মা তোমাকে তাঁর নিটিং স্কুলে ডেকেছেন।'
দীপ্তি খর্গোশের মত কাঁপতে থাকে। আমি কচ্ছপের খোলে মুখ লুকাই। তবু একদিন সাহস করে শ্যামবাজারের
রঙমহল সিনেমার দোতলায় স্কুল, গেলাম। তিনি আমাদের সম্পর্কে তাঁর অসম্মতি জানালেন, তবে
খেয়াল করলাম, তা খুব মৃদু। বললেন, 'একই ক্লাশে পড়ো, তোমরা সমবয়সী...' আমি বুঝিয়ে বলি,
আমার ছাত্র জীবনের নষ্ট করা বছরগুলোর কথা। তাঁকে আশ্বস্ত করতে বলি, 'আমি দীপ্তির থেকে
তিন-চার বছরের বড়'। কথায় কথায় টের পাচ্ছিলাম তিনি আমার চিঠি পড়েই আমার বিষয়ে জেনেছেন
বেশি। অনেক কথার শেষ টেনে বলি, 'আপনারা ওর বিয়ের চেষ্টা করছেন, ভালোই তো! আমি শুধু
গ্রাজুয়েট অবধি আপনাদের অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানাব,.. এর মধ্যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে,
কথা দিচ্ছি, আমি কোমরে গামছা বেঁধে দীপ্তির বিয়েতে পরিবেশন করব।' এ কথা চিঠিতেও লিখতাম
দীপ্তিকে। তিনি বিশ্বাস করলেন। তাই আপত্তিতে তিনি আর জোর খুঁজে পান না। এরপরে যখন জানলাম,
অল ইন্ডিয়া রেডিওর এক অত্যন্ত নামী ব্যক্তির ভাইয়ের সঙ্গে দীপ্তির বিয়ে প্রায় পাকা,
আমি সরাসরি পৌঁছে যাই দীপ্তির বাবার কাছে। পেশায় ডাক্তার, তারওপরে পূর্ব কলকাতার 'জাস্টীস
অফ পীস'. মিনিট দশেকের আলোচনা শেষে মিষ্টি এল। তবে রাজি হলেন না আমার গ্রাজুয়েশন অব্দি
অপেক্ষা করতে। শুধু বললেন, তোমার চেয়ে ভালো পাত্র আমি দেখবই। আমি তো অপেক্ষায় থাকতে
পারি না। তবে মেয়ের অমতে আমি তাঁকে কোথাও বিয়ে দেব না, সেটাও ঠিক।' সেই গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার এই হাল। কবে হবে, হলেও
আবার তা তছনছ হবে কিনা, সেই আতঙ্কে দিন কাটতে থাকে আমার।
কয়েক মাস পরে পরীক্ষা হ'ল, ততদিনে প্রথম প্রস্তুতির
উদ্যম ও উদবেগ, দুইই স্তিমিত নয়ত সরে নড়ে গেছে। শিক্ষাঙ্গণেও এসেছে অশান্ত রাজনৈতিক
ঝড়ের ঝাপটা। এখানে সেখেনে স্লোগান হরতাল মিছিল ধর্মঘট ক্লাশ বয়কট শুরু হয়ে গেছে। পড়ার
একাগ্রতা থেকে মেধাবী থেকে মেধাবীরাও সরে সরে যাচ্ছে, নানা আলোচনায় প্রমাণ পাচ্ছে,
বুর্জোয়া শিক্ষার অসারতার কথা। গ্রামাঞ্চলের অবহেলিত ছাত্র-ছাত্রীদের সেই শিক্ষা থেকে
দূরে রাখার শহুরে ষড়যন্ত্রের কথা। সমাজের নতুন দায়বদ্ধতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ছাপা হচ্ছে,
প্রচারিত হচ্ছে নানা পত্র-পত্রিকা, লিফলেট,
লিটল ম্যাগাজিন-- সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনে তরুণদের অভিনব নিষ্ঠায় নিবেদিত করার লক্ষে।
এই ডামাডোলের বাইরে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অনাগ্রহী আড্ডাবাজ আমার পক্ষে পরীক্ষার জন্য
কতটা প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হচ্ছিল মনে পড়ছে না। আর তা মনে পড়ছে না বলেই বোধ হয়, আমি
আমার পরীক্ষার জন্য আমার পুরো উদ্যোমটাই খুইয়ে বসেছিলাম।
পরীক্ষার রেজাল্ট বের হ'ল। নোটিশ বোর্ড ছাড়িয়ে
দেয়াল জুড়ে লিস্ট। আমি ফেল। কোথাও আমার নাম নেই। দীপ্তি পাশ করেছে। আমার নামও খুঁজেছে
নিশ্চয়, পায়নি। তাই আমার আসার আগেই সরে গেছে সামনের আয়নেক্সি বিল্ডিং-এ। দেখি, সেই
বিল্ডিঙের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে এই বিলডিঙে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্বস্ত আমার দিকে।
আমার শরীরটাকে তছনছ করে মুহূর্তে বয়ে গেল প্রকান্ড তীক্ষণ এক ঘুর্ণিঝড়। আমরা আলাদা
হয়ে গেলাম। দীপ্তির সামনে দাঁড়াবার মুখ নেই আমার, ওর বাবা মা'র কথা তো ওঠেই না। আমি
এ বারান্দায় দাঁড়িয়েই দোতলা থেকে শূণ্যের শরীরে জল-অঞ্জলি দিই দেড় বছরে গড়ে তোলা আমার
সমস্ত ইচ্ছা কামনা আর স্বপ্নকে। শিয়ালদায় ফিরে আসি। ফুলবাগান থেকে হাঁটতে হাঁটতে। আসলে
কিছু সময় একান্তে ভেবে নিতে চাইছিলাম, এবার কোন পথে, কোন দিকে।
আমার সাত বাই দশ ঘরে ঢুকেই কাঁধের ঝোলায় আমার
জামা আর প্যান্টটা ভরে নিই। দেয়ালে ছিল বাবা-মা'র একটা ছবি, বাঁধানো। চেয়ারে বসা। ফ্রেম
ভেঙে ছবিটা থেকে মা-বাবার ছবির মুখটা ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমজাদীয়ার পাশে পাড়ার
মেজদার সিগ্রেট-নস্যির দোকানে হাত ঘড়িটা জমা দিয়ে আশি টাকা নিয়ে বাসে, সোজা হাওড়া স্টেশন।
এ প্লয়াটফর্ম সে প্লয়াটফর্ম করে দেখতে থাকি কোনো বগির মাথায় হলুদ সরু বোর্ড, 'বোম্বাই'
কিংবা 'মাদ্রাস' অথবা 'জম্মু'... ঘুরতে থাকি। বুঝে উঠতে পারি না। বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত। শরীর শুকিয়ে
কাঠ, চোখমুখে কান্না শুকিয়ে চরা, পায়ের পেশি অবশ। একটা বেঞ্চে বসে পড়ি। এক সময় সিমেন্টের
ট্যাঙ্কের কলে মুখ দিয়ে জল খাবার শক্তিটাও যেন হারিয়ে ফেলি। প্লয়াটফর্মে ভীড় বাড়ে,
ভীড় আলগা হয়, বুঝতে পারি না, এবার কোথায়। শুধু এটুকু জানি, কলকাতা আর নয়। কলকাতা আমার
জন্য না। হঠাৎ চোখের সামনে গুড়গুড় করে এসে দাঁড়াল একটা ট্রেন, তাতে লেখা 'দিল্লি।'
সম্ভবত খবরের কাগজ নিয়মিত পড়ি বলেই বোম্বাই কিংবা মাদ্রাস বা জম্মুর চেয়ে দিল্লিকে
চেনা মনে হল বেশি, দিল্লিকে যেন জানি বেশি। ধীরে ধীরে একটা বগিতে ভীড় গুঁতোগুঁতি ঠেলে
উঠে পড়ি। অন্য পাশের খোলা দরজার কাছে বসে পড়ি। ট্রেনটা একসময় চলতে শুরু করে...
31.
//কলেজের মাস্টারমশাইরা //
গুরুদাস কলেজে আমার বন্ধুদের চেয়ে মাস্টারমশাইরা
বেশি কাছের হয়ে উঠছিলেন। এটা কলেজের বিল্ডিং প্যাটার্নের কারণেই বেশি। সিটি কলেজ দু
র্গে র মত। গথিক স্ট্রাকচার। এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে যেতে নামতে অনেক সিঁড়ি। অনেক
ঘর অনেক ক্লাশ, সর্বোপরি একই বিল্ডিঙে, একই ব্লয়াকবোর্ডে, দেয়ালে, দরজায় করিডোরে তিনটি
কলেজ। সকালে রামমোহন, দিনে সিটি আর রাতে আনন্দমোহন কলেজ। এদিক থেকে গুরুদাস কলেজ অন্যরকম।
কলেজটাকে খুব নিজের মনে হয়। কলেজটা যেন হাত ছড়িয়ে ডাক দিয়েই চলেছে। ইউ শেপের বিল্ডিং।
ক্লাশ রুম, লাইব্রেরি, সায়েনস লেবরেটরি, টিচার্স রুম, প্রিনসিপ্যাল, ভাইস প্রিনসিপ্যালের
ঘর, কলেজ অফিস সব নানা ফ্লোরে মিলেমিশে ছড়ানো। যে কোন জায়গায় যাতায়াতের সময়ই দেখা হয়ে
যায় সবার সঙ্গে সবার। গোপন আশ্রয় বলে কারো কোথাও কিছু নেই। আমার কাছে মাস্টারমশাইরা
দূরের মানুষ ছিলেন না। চলাফেরার সময় তাঁদের সঙ্গে একটা দুটো কথা হয়েই যেত। একমাত্র
বিবিএস আর প্রিনসিপ্যাল হিমাংশুবাবু ছাড়া।
প্রিন্সিপ্যাল হিমাংশুবাবু আমাকে আশাতীত ভালোবাসতেন।
কারণটা সম্ভবত কলেজে আমার নানা কান্ড কারখানা। ফ্রেশার্স ওয়েলকামের পর আমাকে একদিন
ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি কী গান গেয়েছি তা জানতে চাইলেন। গানের পুরো কথাগুলি জানতে চাইলেন।
বুঝলাম, স্যারের কাছে কেউ চুগলি করেছে। আমি ঘাবড়াই না। ন্যাট কিং কোলের সেই বিখ্যাত
'মাই পজেশন' গানটার সব ক'টা লাইন মনে করে করে বললাম। স্যারের টেবিলের উল্টো দিকে কোণে
বসেছিলেন সুখময়বাবু, আমাদের কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার
গান? বলি ব্ল্য়াক আমেরিকান গায়কের কথা। সুখময় বাবু বললেন, 'তোমার গানটা শোনার পর আমি
এই গানটি লিখেছি, এটাতে সুর দিয়ে গাইতে পারবে, অরুণ?' হিমাংশুবাবুর চোখে প্রশ্রয়ের
ঝিলিক দেখে স্বস্তি বোধ করি। সুখময়বাবু একটা খাতার পাতা ফস করে ছিঁড়ে তাঁর লেখা গানটা
আমাকে দিলেন। আমি সামনে ঝুঁ কে স্যারদের সম্মান জানিয়ে বাইরে চলে আসি। ইংরেজির অনর্স
ক্লাশে প্রিনসিপ্যাল পড়াতেন কবিতা, সেই গোল্ডেন ট্রেজারি থেকে। আশ্চর্য, আমি তাঁর চোখে
কয়েক রত্তি বাড়তি ভালোবাসার ঝলক পেতে থাকি।
কথায় আছে, বাঁদরের সামনে থেকে লাঠি সরাতে নেই। তাহলে
বিপদ। মহাজাতি সদনে আমাদের কলেজ সোস্যাল চলছে। অনুষ্ঠান শোনার চেয়ে গল্পগাছা ইয়ার্কি
ফাজলামি হচ্ছিল বেশি। আমি তখন দোতলার গ্যালারিতে। আমাদের সময়ে হিমাংশু বিশ্বাসের ইনস্ট্রুমেন্টাল
গ্রুপ ছিল। নানা জনপ্রিয় গানের মিউজিক বাজাতো তার দল। তখনও গায়কদের সঙ্গে একজন তবলচির
বেশি কোন হ্যান্ড নেয়া চালু হয় নি। সে হেমন্তই হোন বা শ্যামল কিংবা তরুণ। তাই তখনকার
সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড গ্রুপ ওই হিমাংশু বিশ্বাসের। আমরা ব্যান্ডের তালে সুরে যখন
ঝুলছি দুলছি, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় বাজনা। অধ্যাপকরা হিন্দি গানের সুর বাজানোর বিরুদ্ধে।
কেডি স্যার স্টেজে উঠে ব্যাখ্যা করলেন, হিন্দি আমাদের বাংলার সংস্কৃতি না। তাই শুধু
বাংলা গানের বাজনা বাজবে।
আমি দোতলার গ্যালারি থেকে যত জোরে সম্ভব (আমার গলার
পীচ খুব উঁচুতে, আজও) চিৎকার করে উঠি, 'না না না! হিন্দি গানের সুর কেন বাজবে না? বাজবে।
আমরা শুনতে চাই।' সঙ্গে সঙ্গে একতলা দোতলা সবখান থেকে প্রতিবাদে কেঁপে ওঠে অডিটোরিয়াম,
'হিন্দির বাজনা চলবে, চলবেই।' মহা হট্টোগোল। হিমাংশুবাবুর দল প্যাক আপ শুরু করে দিলেন।
এই সময় প্রিন্সিপ্যাল স্টেজে উঠে প্রচন্ড হুঙ্কারে আমার নামোচ্চারণ করে বলতে থাকেন,
দোতলার দিকে তাকিয়ে, 'অরুণ। তোমাদের আপত্তি থাকলে কলেজে আলোচনা হবে। আজ যখন অধ্যাপকরা
আপত্তি করছেন, সেটা মেনে নাও। হিমাংশুবাবু, আপনি বাজান।' আমি চুপ করে যাই। অভীকের কথাটা
মনে পড়ে, 'গুরুরা সবসময় নির্ভুল।'
কিছুদিন পর আমি সরাসরি প্রিন্সিপ্যালের রুমে ঢুকে
পড়ি। 'স্যার,কলেজ সোস্যালের হিন্দি গানের ব্যাপারটা নিয়ে ডিবেট হোক, স্যার। আমরা বিতর্কে
ব্যাপারটা ফয়সালা করতে চাই,' উনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি ঘাবড়ে যাই। ভেবেছিলাম, রাজি হবেন
না, আর এতেই জয় হবে আমাদের। পরে স্যারকে জানিয়ে দিন ঠিক করে ফেলি, একটা বড় ব্লয়াক বোর্ড
বাইরে এনে লিখে দিলাম, বড় বড় করে-- বিতর্ক সভা। বিষয় 'কলেজ সোস্যালে হিন্দি গান বাজানো
সমীচিন নয়'. আয়োজকঃ ইংলিশ অনর্স ক্লাশের ছাত্রদল' সারা কলেজেই সাড়া পড়ে গেল। ক্লাশে
ক্লাশে গিয়ে সম্ভাব্য বক্তাদের লিস্ট তৈরি করা হল। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ডেকে পাঠিয়ে
বললেন, 'আমি তোমাদের সঙ্গে। মোশনের এগেইনস্টে বলব।' আমরা ছাত্ররা দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে
উঠলাম। হিমাংশুবাবু বললেন, 'অডিটোরিয়ামে না, ক্লাশ রুমেই বি ত র্কের আয়োজন কোর।' বুঝলাম,
স্যার পিছু হঠছেন। বিতর্কের দিন আমাদের জেনেরাল ক্লাশ রুম, ২৩ নম্বর ঘরে ভীড় উপছে পড়ল।
মোশনের পক্ষে নেতৃত্ব দিলেন ইতিহাসের কেডি স্যার, বিপক্ষে আমি। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করলেন, প্রেয়স-প্রেয়সীর প্রতি আবেগ
মানুষের জন্মগত, শুধু তাই নয়, এটা সমাজসিদ্ধও ছিল বটে। ১৯৬৪-৬৫ সালের কথা। উপস্থিত
ছাত্রীদের কান লাল হয়ে উঠল স্যারের উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি শুনে, ছেলেরা হাতে তালি দিতে
থাকে। কেডি বললেন, সব সংবিধানেই অলিখিত কিছু বিধান থাকে, তেমনি আমাদের কলেজের সংবিধানেও
আছে। তার একটি এই, বাংলা ছেড়ে হিন্দিকে প্রশ্রয় না দেয়া। আমি উদ্ধৃত করলাম, ওয়ার্ডসওয়ার্থের
ইয়ারো কবিতার একটি লাইন-- ‘দ্যেয়ার বেন্ডস দ্য স্কাই ওভার দ্য ইয়ারো ভেল।' বললাম, আমি
যখন এই লাইন উচ্চারণ করব, প্রিন্সিপ্যাল স্যার, আমার পিঠ চাপড়ে বললবেন, 'সাবাস অরুণ'
অথচ আমি যদি বলি মধুমতি ফিল্মে মুকেশের গানটির কথা-- ‘বহ আসমাঁ ঝুক রহী হ্যায় উঁচে
জমিন পর', স্যার তেড়ে ফুঁ ড়ে আমার মুখ বন্ধ করে দেবেন... হই হই পড়ে গেল চারপাশে। অন্যরা
যখন বলতে ব্যস্ত, স্যার আমাকে ডেকে ফিসফিসিয়ে বললেন, 'ভোটাভুটিতে যেও না। সেটা ঠিক
হবে না।' আমি ভোটাভুটিতে যাই না।
এসব ঘটনা আমাকে কলেজের স্যারদের কাছের মানুষ তৈরি
করেছিল। বলতে গেলে, কলেজের সব ডিপারট্মেন্টের স্যারদের মধ্যেই আমার প্রতি একটা বিশেষ
দাক্ষিণ্য অনুভব করতাম। আমার পড়াশুনো স্যারদের প্রশ্রয় ছাড়া কোনকালেই সম্ভব হয় নি,
গুরুদাস কলেজেও না। এই কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের স্মৃতি যেমন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে,
তেমনি আমার জীবনে উজ্জল হয়ে বিঁধে আছে স্যারদের গভীর ভালোবাসা, সান্নিধ্যের প্রেরণা
আর অফুরান প্রশ্রয়।
ফিললজির ক্লাশ নিতেন পিএস, পরিমল সেন। মেটে রঙের
পাঞ্জাবী আর ধুতি, স্যারের বেশিক্ষণরে বেশ। আমার জীবনের সেরা মাস্টারমশয়দের একজন পিএস।
ফিললজি ছাড়াও পড়াতেন ইংরেজির আরো কয়েকটি সাব্জেক্ট। সবচেয়ে অমনযোগী ছাত্রও পিএসের ক্লাস
ফাঁকি দিত না। ইংরেজি অনর্সের ক্লাশে আমরা বরাবরই মাত্র কয়েকজন। ফললজির প্রথম ক্লাশের
শেষে পিএস জিজ্ঞেস করলেন, 'বুঝেছ?' ক্লাশের প্রায় সবাই মাথা নাড়ল, দু' একজন চুপ। আমি
উঠে দাঁড়াই, 'না স্যার, আমি বুঝতে পারিনি।' এবং সেটা সত্যি। আমি কিছুতেই ফিললজি ব্যাপারটা
ধরতে পারছিলাম না। সেদিনের মত সময় পেরিয়ে গিয়েছিল, স্যার বললেন, 'ওক্কে নেক্সট ক্লাশে।'
পরের ক্লাশেও একই পড়ানো। ক্লাশ শেষে একই প্রশ্নের উত্তরে আমার একই কথা, 'না, বুঝিনি,
স্যার।' এবার তৃতীয় দিন। একই প্রশ্ন আর একই উত্তর আমার, 'না স্যার, বুঝিনি।' পিএস রাগলেন
না। চোখের মাইনাস পাওয়ারের মোটা কাঁচের ওপারের ছোট চোখদুটোকে আরো ছোট করে আমার দিকে
এগিয়ে এলেন, 'এই ছেলে, তুমি আমার পরীক্ষা নিচ্ছ না তো?' আমি লজ্জায় জিভ কাটি, 'না স্যার,
সত্যি। আমরা কেনো এই সাব্জেক্টটা পড়ব, সেটাই মাথায় ঢুকছে না। পড়া বোঝা তো পরের কথা।' ও তাই বলো! স্যার টেবিলে ফিরে গেলেন। এবং সুন্দর
করে বোঝালেন, কী ভাবে এই বিদ্যা ভাষার গড়ণ গঠন, তার ঐতিহাসিকতা, একটি ভাষার সঙ্গে আর
একটি ভাষার সখ্যতা, একটি সভ্যতা থেকে আর একটি সভ্যতায় মানুষের বিস্তারের কথা বলে সেইসব।
সেই লেকচারটি এখনো কানে বাজে। পরে এমএ পড়ার সময় আমি ফিললজি আমার একটা পেপার হিসেবে
অনায়াসে নিয়েছিলাম, এবং নিজেকে এক নয় অনেক বিদ্যার উঠানে বিস্তার করতে পেরেছিলাম। পিএস
ছিলেন সেই ঘটনার রূপকার।
গরমের লম্বা ছুটি সামনে। বিজি মানে, ব্যোমকেশ ঘোষ
স্যারের কাছে গেলাম। ছুটিতে আমি কিছু রেফারেনস বই পড়তে চাই, কিন্তু পাব কোথায়? ছুটিতে
কলেজ লাইব্রেরি বন্ধ থাকবে, তো লাইব্রেরি থেকে কিছু বই নিয়ে ছুটির পরের প্রথম দিনেই
তা ফেরত দিলে তো কারো ক্ষতই হবে না! স্যার যুক্তি মানলেন। আমি এ র্যাক সে র্যাক থেকে
সাত আটটা নানা আকারের বই বেছে এনে স্যারের সামনে রাখলাম। এসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান
সঙ্গে। স্যার আমার আবেদনে সই করতে যাবেন, লোকটা বাধা দিল। স্যারের সইয়ে এতগুলো বই তো
দেয়া যাবে না! প্রিন্সিপ্যালের সই দরকার হবে। ব্যোমকেশবাবু বললেন, 'দুটো বই বেছে নাও।
সই করে দিচ্ছি।' ভাবলাম, একবার প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে গিয়ে দেখাই যাক না। আমরা
দুজনে বইগুলো বুকে ধরে স্যারের কাছে পৌঁছে যাই। প্রিন্সিপ্যাল একটা একটা করে বইগুলো
দেখলেন। আমার অ্যাপ্লিকশনে সই করে দিলেন। আমি অভিভূত। স্যারকে পা ছুঁ য়ে প্রণাম করি।
সেই থেকে আমার পক্ষে অমনযোগী ছাত্র হওয়া আর সম্ভব হল না। দারুণ রেজেল্ট করেছি, তা অবশ্য
নয়। তবে আমি যে এক আন্তরিক ছাত্র, সে প্রমাণ নিজের কাছেই নিজে দিতে থাকি। বারবার।
---------------------